পোল্যান্ডের শেষ চিঠি - আউশ্‌ভিৎস

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি
লিখেছেন সুবিনয় মুস্তফী (তারিখ: রবি, ০৩/০২/২০০৮ - ১২:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

autoগত সপ্তাহে লন্ডনে ফিরে এসেছি। আবার কাজে নামলাম, কিন্তু মন পড়ে আছে অন্যত্র। ক্রাকোভ খুব ভালো লেগেছে। শেষ দিন শহরময় হাঁটছিলাম, ছবি তুলছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম, আর যদি দুই-তিনটা দিন বেশী থাকতে পারতাম। অনেক কিছুই না দেখে চলে আসতে হয়েছে। সংস্কৃতি আর ইতিহাসের এত সম্ভার যেই শহরে, তা কি আসলে এক উইকেন্ডে দেখা সম্ভব?

এখন অফিসে ফিরে এসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্ল্যান করছি এর পরে কোথায় যাওয়া যায়। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ইউরোপের মানচিত্র - মনে হয় এখনই রায়ানএয়ার থেকে টিকেট কেটে আবার বেরিয়ে পড়ি - প্রাগ বা ভিয়েনা, রটারডাম বা ব্রাসেলস, সারায়েভো বা ডুব্রোভ্‌নিক।

*

শেষবার যখন লিখছিলাম, তখন আমি ক্রাকোভ শহর থেকে দেড় ঘন্টা পথ দক্ষিণে। আউশভিৎস কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে অল্প কয়েক মিনিট দূরে। ভীষণ ঠান্ডা পড়েছিল সেদিন। আউশভিৎস ক্যাম্প এবং তার অদূরে অবস্থিত বির্কেনাউ ডেথ ক্যাম্প দেখতে দেখতে বাকি দিনটা চলে যায়। বাস যখন ক্রাকোভ-এ ফেরে, তখন বেশ রাত।

*

আউশভিৎস নিয়ে লেখার শক্তি বা সাহস পাচ্ছিলাম না। প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়েছে এই অভিজ্ঞতা। ভাষায় সেই অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারবো কি না, তা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। আউশভিৎস থেকে ফিরে এসে দুয়েকদিন বেশ চুপচাপ (না কি gloomy?) ছিলাম। তাৎক্ষনিক কিছু প্রতিক্রিয়া আমার ব্যক্তিগত ব্লগে লিখে রেখেছি। আমার কল্পনার ব্যর্থতা খুব প্রকটভাবে ফুটে উঠেছিল সেদিন আমার কাছে ।

পকেট ইতিহাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার অনেক আগে থেকেই এডোলফ হিটলার এবং তার নাৎসী পার্টির ভয়ংকর ইহুদি-বিদ্বেষ ছিল। জার্মান জাতির দুঃখ-কষ্ট তথা পৃথিবীর নানা সমস্যার পেছনে হিটলার খুঁজে পেতো আন্তর্জাতিক ইহুদি চক্রের ষড়যন্ত্র। যুদ্ধ শুরু হলে পরে জার্মান সেনাবাহিনী ভের্‌মাখ্‌ৎ (Wehrmacht) প্রায় পুরো ইউরোপই দখল করে ফেলে। পশ্চিমে ফ্রান্স, হল্যান্ড পর্যন্ত ঘায়েল, আর পূর্ব দিকে মস্কোর অদূরে চলে এসেছিল ভের্‌মাখ্‌ৎ।

autoইউরোপের ভূখন্ডে তখন প্রায় এক কোটি ইহুদি বসবাস করতো। এই এক কোটি মানুষকে জানে মেরে ফেলার জন্যে হিটলার আর তার দোসরেরা তৈরী করে the Final Solution to the Jewish Question। ইহুদী প্রশ্নের আখেরী ফয়সালা। সমগ্র ইউরোপ জুড়ে গড়ে ওঠে ডজন ডজন ডিটেনশন সেন্টার আর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। ১৯৩৯-৪০ সাল থেকে শুরু করে একেবারে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত চলে হত্যাযজ্ঞ।

এক কোটির লোকের মধ্যে শেষে কতজনকে মারা হয়েছিল? ঐতিহাসিকদের হিসাবমতে আনুমানিক ৬০ লক্ষ ইহুদি নিধণ করা হয়। মানে ইউরোপের সর্বমোট ইহুদি জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশ। যুদ্ধের আগে পোল্যান্ডে আনুমানিক ৩৩ লক্ষ ইহুদি বসবাস করতো। যুদ্ধের পরে এসে দেখা যায় তা মাত্র ৩ লক্ষে নেমে এসেছে। প্রতি ১১ জনে ১ জন বেঁচেছিল। আমি যেই শহরে গেলাম, ক্রাকোভ, যুদ্ধের আগে আদমশুমারী অনুযায়ী তার ২০% অধিবাসী ছিল ইহুদি। আর আজ পুরো শহরে মাত্র ৫০ জন ইহুদি বাকি আছে। ইতিহাসে এতো সফল এথনিক ক্লিন্সিং-এর উদাহরণ বিরল।

শুধু যে ইহুদিদের টার্গেট করা হয়েছিল, তাও না। ইউরোপের জিপসিদেরও মেরে ফেলা হয় ঢালাওভাবে। ইহুদিদের হত্যাযজ্ঞকে যেমন বলা হয় Holocaust, তেমনই জিপসিদের হত্যাযজ্ঞেরও একটা নাম আছে। Porajmos (ইংরেজীতে The Devouring, বাংলা অর্থ দাঁড়ায় 'গ্রাস করা')। নিকৃষ্ট জাতি (inferior race) হিসাবে জিপসিদের বধ করা হয়েছিল।

আরো মেরে ফেলা হয় সমকামীদের, এবং বিকলাঙ্গ ও মানসিকভাবে বিকারগ্রস্তদের। হিটলারের মতে এই গোষ্ঠীগুলা আর্য জাতির জেনেটিক ও চারিত্রিক বিশুদ্ধতা নষ্ট করে দিচ্ছিল।

জেনোসাইড - কেন ও কিভাবে?

হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে এত জায়গা থাকতে আউশভিৎস কেন? দক্ষিণ পোল্যান্ডের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মাঝখানে কেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি তৈরী করা হলো? কারন খুব সহজ - ভৌগোলিক দিক থেকে হিসাব করলে দক্ষিণ পোল্যান্ড ইউরোপীয় ভূখন্ডের একেবারে মধ্যেখানে পড়ে। ট্রেনের মাধ্যমে সমগ্র মহাদেশ থেকে ইহুদি জড়ো করে এনে এক জায়গায় রাখার জন্যে আউশভিৎস ছিল সবচেয়ে উৎকৃষ্ট স্থান। ক্যাম্পের মিউজিয়ামে একটা ম্যাপে আছে - তাতে দেখা যায় যে উত্তরে নরওয়ে থেকে শুরু করে একেবারে দক্ষিণে গ্রীস থেকে ইহুদিরা এসেছিল এই ক্যাম্পে, মরেছিল এই মৃত্যুর কারখানায়।

autoএক জাতি দ্বারা আরেক জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার প্রয়াস মানুষের ইতিহাসে নতুন কিছু না। ১৯১৫-১৬ সালের দিকে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য চেষ্টা করেছিল তাদের সংখ্যালঘু আর্মেনীয় সম্প্রদায়কে শেষ করে ফেলার। এই হত্যাযজ্ঞে প্রাণ হারায় ১৫ লক্ষ নিরীহ আর্মেনীয় নারী পুরুষ ও শিশু। ঐতিহাসিকরা এখন একে অভিষিক্ত করেন আর্মেনীয় হলোকস্ট নামে, যদিও তুরস্কে এর সত্যতা নিয়ে আজ অব্দি অনেক প্রশ্ন তোলা হয়। তুর্কীরা মানুষ হিসাবে কেমন আমার সরাসরি অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু আর্মেনীয় হলোকস্টের অপরাধ স্বীকারের বেলায় তারা প্রচন্ড মাত্রায় সেনসিটিভ, এতটুকু পেপার-পত্রিকা থেকে পরিস্কার হয়।

এই একরোখা অস্বীকার করা থেকে তাদের জাতিগত দম্ভের পরিচয়ও মেলে। আর্মেনীয় সাংবাদিক হ্রান্ত দিংক (Hrant Dink)-কে মেরে ফেলা হয় গত বছর, আর তুর্কী নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুক-কেও দেশত্যাগ করতে হয়েছিল একই কারনে।

তো দেখা যাচ্ছে পরিকল্পিত হলোকস্ট নতুন কিছু নয়। কিন্তু ইহুদি হলোকস্ট যেই কারনে এতখানি সাড়া তুলতে সক্ষম হয়েছিল, তার অন্তত একটা কারন হচ্ছে এই নৃশংস প্রকল্পের আধুনিক ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিগত 'উৎকর্ষ'। হলোকস্টের ৩০ বছর আগে সমাপ্ত হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেইবার ইউরোপীয় সভ্যতা প্রথমবারের মতো পরিচিত হয় পরিখা যুদ্ধের (trench warfare) সাথে, যেখানে সমন্বয় ঘটেছিল শিল্প বিপ্লব, যুদ্ধ ও মৃত্যুর। যেই যুদ্ধের ভিত্তি ছিল industrialization আর mechanized warfare, সেই যুদ্ধে মারা যায় দুই কোটি ইউরোপীয় সৈন্য। হানাহানির ইতিহাসে এক অভিনব, অভূতপূর্ব ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার কারনেই ২০ ও ৩০-এর দশকে এসে ইউরোপীয় সভ্যতা তার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, নাৎসী জার্মানীর আবির্ভাব হয়। প্রায় এক শতাব্দী আগের সেই যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী প্রভাব আজও পরোক্ষভাবে প্রতীয়মান।

১৯৪০ থেকে ১৯৪৫-এর ইহুদি হলোকস্টেও ব্যবহার করা হয় শিল্প বিপ্লবের সব অত্যাধুনিক কায়দা-কানুন, মাল-মশলা ও যন্ত্রপাতি। জার্মানরা বরাবরি খুব গোছালো, পরিকল্পিত জাতি হিসেবে পরিচিত। উন্নত প্রযুক্তি নির্মান ও তার প্রয়োগে তাদের থেকে চৌকষ জাতি মেলা ভার। যে কোন প্রজেক্টের ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়নেও তাদের থাকে প্রচন্ড নিষ্ঠা ও নিয়মানুবর্তিতা।

ইহুদিদের চরম দুর্ভাগ্য যে জার্মান জাতির এই গুণাবলী তাদের উপর গজবের মত নেমে এসেছিল। আউশভিৎসে গিয়ে এই কারনেই গা শিউরে উঠে - বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের সেরা প্রযুক্তি এনে বসানো হলো পোল্যান্ডের প্রান্তরে, জার্মানরা তাদের সমস্ত technological sophistication এবং managerial excellence প্রয়োগ করলো শুধু একটা উদ্দেশ্যে - এক কোটি মানুষকে সবচেয়ে কম সময়ে , সবচেয়ে কম খরচে কিভাবে খুন করা যায়।

বিশ্বের ইতিহাসে এমন ঘটনা এর আগে বা পরে আর ঘটেনি।

আউশভিৎস ১ এবং ২

আউশভিৎস বলতে আসলে দুটো জায়গা বোঝায়। প্রথমটি আউশভিৎস ১ - অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির কমপ্লেক্স, অনেকগুলো বিল্ডিং আটো-সাটো করে জড়ো করা। এটা ছিল মূলত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। এখানে গ্যাস চেম্বার এবং মৃতদেহ পুড়িয়ে ভস্ম করে দেওয়ার ক্রিমেটোরিয়ামও ছিল।

তবে আউশভিৎস-২ এর বিশাল ব্যাপকতার কাছে তা কিছুই না। আউশভিৎস-২ এর আরেক নাম বির্কেনাউ। এই কমপ্লেক্সটা আরো তিন কিলোমিটার দূরে - বাসে করে যেতে হয়। বিস্তীর্ণ প্রান্তর। বির্কেনাউ-এর মোট আয়তন ৪২৫ একর। কাঁটাতারের বেড়ার পেছনে শত শত কাঠের ব্যারাক। লাইনের পর লাইন, মাইলের পর মাইল।

আউশভিৎস-১ এর মিউজিয়ামে দেখেছিলাম একটা ঘরে স্তুপ করা মৃত মেয়েমানুষের মাথার চুল। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত সেই স্তুপ - মোট সত্তুর টন চুল। আরেকটা ঘরে দেখেছিলাম জুতার পাহাড়, আরেকটা ঘরে ব্রাশের স্তুপ, আরেকটা ঘরে ঘটি-বাটির মর্গ। এসব দেখে আত্মা কেঁপে ওঠে। আর বির্কেনাউ-এর বরফাচ্ছাদিত খোলা প্রান্তরে সেই মাইলের পর মাইল কাঠের ব্যারাক দেখে মনের ভেতরে এক প্রকারের বিমর্ষ শূন্যতা চলে এসেছিল।

আমার কপালও এমন যে বির্কেনাউ-এ যেতে যেতেই তুষারঝড় শুরু হয়ে যায়। তিন কিমি. পথ শেষে বাস থেকে নেমে দেখি বাতাস আর তুষারের ঝাপটা বিকটাকার ধারণ করেছে। আমার পোল্যান্ডে শীতকালে যাবার পেছনে একটা কারন ছিল যে বসন্ত বা গ্রীষ্মের শোভামন্ডিত আউশভিৎস আমি দেখতে চাইনি। পাখির কলকাকলি, প্রজাপতির পাখা আর মৌমাছির ভোঁ-ভোঁ, সবুজ ঘাসে মোড়া মাঠ আর পাতা-ফল-ফুলে ঢাকা গাছও আমি দেখতে চাইনি।

আমি চেয়েছিলাম হিম শীতের আউশভিৎস দেখতে। সেদিনের অকস্মাৎ তুষারঝড়ের সাথে বধ্যভূমির চরিত্র মিলে মিশে গিয়েছিল।

কাকতালীয় ভাবে - কিছুটা দৈবই বলতে হয় - সেইদিনটি ছিল সোভিয়েতদের হাতে ক্যাম্পের মুক্তিপ্রাপ্তির ৬৩তম বার্ষিকী। প্রান্তরের শেষ মাথায় অনুষ্ঠিত হচ্ছিল স্মৃতিসভা / শোকসভা। তুষারঝড় উপেক্ষা করে ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়েছিল স্কুলের বাচ্চারা, এলাকার গণ্যমান্যরা, এমনকি আউশভিৎস থেকে বেঁচে এসেছেন এমন কিছু বৃদ্ধ ইহুদি। ক্যাম্প মুক্তির সময় সাত হাজার ইহুদি ছিলেন এই ক্যাম্পে - তারা প্রাণে বেঁচে যান।

হলোকস্ট সাহিত্য

হলোকস্ট নিয়ে আজ পর্যন্ত হাজার হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে। লাইব্রেরীর পর লাইব্রেরী ভরে ফেলা যায় এই সমস্ত বই দিয়ে। আর্মেনীয় হলোকস্ট আজ পৃথিবীর সবাই ভুলতে বসেছে। কিন্তু ইহুদি হলোকস্ট যেন একইভাবে মানুষ বিস্মৃত না হয়, এই জন্যে ইহুদিরা ছাড়াও আরো অনেকেই প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন।

তবে শুরুতে যেটা বলেছিলাম, সেই failure of imagination অতিক্রম করা সহজ নয়। এই ঘটনার ব্যাপ্তি বোঝা সহজ নয়। ক্যাম্পের মধ্যে দাঁড়িয়েও আমি কল্পনায় আনতে পারছিলাম না, গ্যাস চেম্বারের ভেতরে দাঁড়িয়েও সেই অভিজ্ঞতার অন্তঃস্থলে প্রবেশ করতে কষ্ট হচ্ছিল।

তাই মাঝে মাঝে শিল্প বা সাহিত্যের আশ্রয় নিতে হয়। ঐতিহাসিকদের হাড়-ভাঙ্গা প্রচেষ্টার পাশাপাশি বিংশ শতাব্দীর কিছু সাহিত্যিক বরেণ্য হয়ে আছেন হলোকস্ট নিয়ে তাদের লেখালেখির জন্যে। হলোকস্টের পাশবিকতার আন্দাজ পেতে গেলে এই লেখক এবং এই বইগুলো অপরিহার্য। এই সূত্রে আমি সবচেয়ে বিখ্যাত কয়েকজন লেখকের নামই কেবল উল্লেখ করবো।

- ইতালীয় রসায়নবিদ প্রিমো লেভি আউশভিৎস-এর সার্ভাইভার ছিলেন। যুদ্ধ শেষ হবার পরে তিনি তার স্মৃতিকথা লিখতে বসেন। আউশভিৎসের জীবন নিয়ে লেভির দুটো বই If This is a Man এবং The Truce হলোকস্ট সাহিত্যের প্রধানতম স্তম্ভ। সমগ্র বিশ্বে এই বই দুটোর লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। লেভি প্রচন্ড অপরাধবোধ দ্বারা তাড়িত ছিলেন। কেন তিনি বেঁচে রইলেন, যেখানে ৬০ লক্ষ মানুষ মারা গেলো? এই অপরাধবোধ সহ্য করতে না পেরে তিনি ১৯৮৭ সালে আত্মহত্যা করেন। যুদ্ধের সুদীর্ঘ চার দশক পরে। তিনি তার বাড়ির সিঁড়ি থেকে ঝাপ দিয়েছিলেন।

autoহলোকস্ট সাহিত্যের আরেক স্তম্ভ নোবেল বিজয়ী লেখক এলি ভিজেল (Elie Wiesel)। তার স্বল্প দৈর্ঘ্যের রচনা Night বা 'রাত্রি' লেভির সাহিত্যের মতই বহুল বিক্রিত, বহুল পঠিত। বুখেনভাল্ড কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প মুক্ত হবার পরে ক্যাম্পের মৃতপ্রায় অধিবাসীদের একটি বিখ্যাত ফটো তোলা হয়। এলি ভিজেল আছেন সেই ফটোতে - ১৬ বছর বয়সের সেই নর-কংকাল কিশোর ছেলেটিই পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে এসে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলো।

- হলোকস্ট নিয়ে সাহিত্য রচনা করে ২০০২ সালে নোবেল জিতেছেন আরেকজন লেখক, হাঙ্গেরীয় ইহুদি সাহিত্যিক ইমরে কের্তেশ (Imre Kertesz)। তার হাতে-গোনা কিছু বই ইংরেজীতে অনুবাদ হয়েছে।

- পোলিশ বংশোদ্ভূত লেখক তাদেউশ বরোভ্‌স্কি (Tadeusz Borowski) আমাদের জন্যে রেখে গেছেন তার অবিস্মরণীয় ছোটগল্প সংকলন - This Way for the Gas, Ladies and Gentlemen। প্রিমো লেভির মতো তিনিও আত্মহত্যা করেন - ১৯৫১ সালে, মাত্র ২৮ বছর বয়সে।

- এ ছাড়াও আহারন আপেলফেল্ড, আর্নোস্ট লুস্টিগ, এদের হলোকস্ট রচনা উল্লেখযোগ্য। এই লিস্টে আরো অনেক সাহিত্যকর্ম ও সাহিত্যিকের নাম লিপিবদ্ধ আছে (pdf file)।

- এদের পাশে মার্কিন কমিক বই লেখক আর্ট স্পিগেলম্যান-এর নামও উল্লেখ করতে চাই। স্পিগেলম্যান নিউ ইয়র্ক শহরের ইহুদি অধ্যুষিত Rego Park এলাকায় বড় হন। তার বাবা মা দুজনই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ছিলেন, যুদ্ধের পরে তারা আমেরিকায় অভিবাসী হন। প্রিমো লেভি আর তাদেউশ বরোভস্কির মতই স্পিগেলম্যানের মা'ও ১৯৬৮ সালে আত্মহত্যা করেন।

auto১৯৮৬ সালে স্পিগেলম্যান মাউস (Maus) নামে একটি কমিক বই প্রকাশ করেন। তার বাবার কাছে হলোকস্ট সম্পর্কে যেই বাস্তব গল্প স্পিগেলম্যান শুনেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতাই তিনি কমিক বই আকারে ধারন করে রাখেন। মাউস বইটি বহুল আলোচিত হয়। লেখক বিভিন্ন জাতিকে রিপ্রেজেন্ট করেন পশুর আকৃতি দিয়ে - ইহুদিদের আঁকা হয় ইঁদুর হিসেবে, জার্মানদের দেখানো হয় বিড়াল রূপে, পোলিশরা হয় শুকর ইত্যাদি।

পাঁচ বছর পরে স্পিগেলম্যান ছাপান মাউস-২ (Maus II)। মাউস ১ এবং ২ এর মাধ্যমে স্পিগেলম্যান ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৯২ সালে তিনি আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য পুরস্কার পুলিৎসার জয় করেন। কমিক বইয়ের জন্যে এত বড়ো পুরস্কার এই ছিল প্রথম।

বই-পুস্তক ছাড়াও হলোকস্ট নিয়ে কিছু অসাধারণ চলচ্চিত্র তৈরী হয়েছে। সাম্প্রতিক কালের সেরা তিনটি চলচ্চিত্র -
- স্টিভেন স্পিলবার্গের Schindler's List - টমাস কেনীলির বুকার-জয়ী উপন্যাসের ফিল্মি সংস্করণ
- রোমান পোলানস্কির The Pianist - পিয়ানো-বাদক ভ্লাদিস্লাভ স্পিলম্যানের আত্মজীবনী অবলম্বনে
- ইতালীয় অভিনেতা-পরিচালক রবের্তো বেনিন্‌য়ির অসাধারণ চলচ্চিত্র La vita e bella (ইংরেজী শিরোনাম - Life is Beautiful) ইতালীয় ইহুদিদের পরিণতি নিয়ে।

অনেকেই এই ছবিগুলো দেখেছেন, নতুন দর্শকদেরও এই ফিল্মগুলো ভালো লাগবে।

ক্রাকোভ - আবার আসিবো ফিরে...

ক্রাকোভ ছেড়ে চলে এলাম যখন, তখন একটা হালকা অপূর্ণতা নিয়েই ফিরেছি। পোল্যান্ডের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত এই সুন্দর শহরে একজন না, দুইজন না, বরং তিন-তিনজন নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক বসবাস করেছেন। পোল্যান্ডের সেরা চলচ্চিত্রকারেরা এই শহরে কাজ করেছেন, এবং পরে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছেন - যেমন পোলানস্কি ও আন্দ্রে ভাইদা। এমন কি Schindler's List খ্যাত অস্কার শিন্ডলার, বাস্তবের সেই মানুষ, তার ফ্যাক্টরি ফাব্রিকা শিন্ডলার এবং তার ইহুদি-রক্ষার কাহিনীও ক্রাকোভের ইহুদি-পাড়াতেই (Krakow Ghetto) ঘটেছিল। সময়ের অভাবে হায় এগুলো দেখে আসতে পারলাম না। দুঃখ রয়ে গেল।

কিছু ছবি তুলেছিলাম। সেগুলো ফেসবুকে কয়েকজন দেখেছেন। এই লিংক ধরে বাকি ছবিগুলো দেখতে পারেন - ,

*

প্রথম ছয়টি ছবি আউশভিস ১-এর। একদম প্রথম ছবিটি ক্যাম্পের সদর দরজার। নাৎসিদের নির্মম কৌতুক, জার্মান ভাষায় স্লোগান - Arbeit Macht Frei। অর্থ - Work makes you free। বাকি ছবিগুলো আউশভিৎস ২-এর।

auto

auto

auto

auto

auto

auto

auto

auto

auto

auto

auto

auto

auto

auto

auto

auto


মন্তব্য

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

আউশ্‌ভিত্স সম্পর্কে আগেই বেশ খানিকটা জানা থাকলেও এতো বিশদ তথ্যবহুল (তবে বোরিং তো নয়ই, বরং অতীব আকর্ষণীয়) লেখা আগে পড়িনি।

অসাধারণ এই সিরিজটির জন্য আপনাকে শুধু ধন্যবাদ বললে কম বলা হয়।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

তানভীর এর ছবি

দারুণ উপভোগ্য বর্ণনা। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষাই নাকি ইতিহাস থেকে আমরা কখনো শিক্ষা নেই না। ভাবতেই অবাক লাগে, যে ইহুদীরা কিছুদিন আগেও এত নির্যাতিত হয়েছে, তারাই আজ প্যালেস্টাইনে নির্যাতনকারীর ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে! নির্যাতিতের হাহাকার ওদেরই তো বেশী বোঝার কথা ছিল।

উদ্ধৃতি

তুর্কীরা মানুষ হিসাবে কেমন আমার সরাসরি অভিজ্ঞতা নেই।

আমার আগের ইউনিভার্সিটিতে টার্কিশ বিশাল পপুলেশন ছিল। সামারে বিকালে ওদের সাথে মাঝে মাঝে ফুটবল খেলতাম। জাতি হিসেবে টার্কিশদের আমার খুব ফ্রেন্ডলি এবং অতিথিপরায়ন মনে হয়েছে (মেলা টার্কিশ বারবিকিউ আর বাকলাওয়া খেয়েছি। বাকলাওয়া জিনিষটা আমার কাছে মনে হয় মুজতবা আলীর রসগোল্লার মত-'না খেলে জীবনই বৃথা!')। যাই হোক, টার্কিশ এই প্রজন্মকে আমার দুইভাগে বিভক্ত মনে হয়েছে। এক অংশ খুব ধার্মিক; এরা হালাল খাবার খায়, অটোমান সাম্রাজ্য নিয়ে খুব গর্বিত এবং কামাল আতাতুর্ক নিয়ে বিব্রত। আতাতুর্ক নিয়ে আমি যখনই কোন প্রশ্ন করেছি, এরা সেটা এড়িয়ে গেছে (আর্মেনীয় হত্যাকান্ডের ব্যাপারটা জানতাম না তখন)। এরা টার্কিশদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অপর সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশকে মসজিদে কখনো দেখা যায় না, সর্বভুক এবং খাঁটি ইউরোপীয়। তবে আদর্শের ভিন্নতা থাকলেও এরা খুবই ঐক্যবদ্ধ এবং দেশপ্রেমিক। আমাদের মধ্যে যেমন হাজারো দলাদলি, এদের মধ্যে কখনো দেখি নি। যে কোন টার্কিশ অনুষ্ঠানে সবাইকে একসাথে কাজ করতে ও উপস্থিত থাকতে দেখেছি।

=============
"কথা বল আমার ভাষায়, আমার রক্তে।"

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

অসাধারণ একটি সিরিজ সমাপ্ত করার জন্যে অভিনন্দন। সত্যি বাঁধিয়ে রাখার মতো রচনা। অনুভবের স্বতস্ফূর্ততা লেখায় আনা খুব সহজ নয়। আপনার লেখায় সেটা পাওয়া গেলো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

থ্যাংক্স জুবায়ের ভাই। সন্ন্যাসী আর তানভীরকেও ধন্যবাদ। আসলে ইউরোপ ঘুরার অন্য রকম একটা আনন্দ আছে, কারন প্রতিটা রাস্তারই কোন না কোন ইতিহাস থাকে। তবে সামনের মাসেই ড্যালাস... খুব এক্সাইটেড আছি!
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমি অপেক্ষায় থাকছি।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

s-s এর ছবি

চমতকার সুবিনয়,অভিনন্দন !

দ্য পিয়ানিস্ট এবং লা ভিটা এ বেলা যে কোনো বিচারেই জীবনকে আমূল পাল্টে দেবার মতো ছবি। আমার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে পড়বার আগ্রহ তৈরির পেছনে এই দুই ছবির ভূমিকাই অপরিসীম।

ধারণা করি,আপনার জীবনবোধকে অনেকখানি পাল্টে দিলো এই ভ্রমণ ,এবং এই উপলব্ধিগুলোও যা এই ধারাবাহিকে প্রকাশ করলেন।

হলোকস্টের মৃতদের আত্মার প্রতি নতমস্তক হলাম, আবারও এ লেখাটি পড়ে।
========================
জীবন জীবন্ত হোক,তুচ্ছ অমরতা

হিমু এর ছবি

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের শুরুর দিকের বলি কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা। হিটলার ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে পত্তন হয় প্রথম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। প্রতিহিংসা দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত দৃঢ় করার জন্যে প্রয়োজন শত্রুর, হিটলার প্রথমেই পাকড়াও করা শুরু করে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকজনদের। ইহুদিদের কপালে দুর্ভোগ এসেছে আরও পরে।

আউশ্বিৎস শুধু কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পই না, অ্যানাইহিলেশন ক্যাম্পও। জার্মানরা শুরুতে কনৎসেন্ট্রাৎসিওনসলাগার [কাৎসেট] নাম দিয়ে শুরু করে এই নির্যাতন পন্থা, পরবর্তীতে নির্মাণ শুরু হয় ফেরনিখটুংস-কাৎসেট। আউশ্বিৎস আর ত্রেবলেনকা এদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত। তবে বুদ্ধিটা এসেছে বৃটিশদের কাছ থেকেই, বোয়ের যুদ্ধে তারাই প্রথম তৈরি করে এই ঘনাবাস।

ডাখাউ (প্রথম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প) দেখার পর ঠিক করেছি, আর কোন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে স্বেচ্ছায় কখনো যাবো না। এ এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা।

সুবিনয় মুস্তফীর এই সিরিজটি চমৎকার লাগলো। অন্যান্য সচলদের কাছেও ভ্রমণের এমন সুখপাঠ্য বিবরণ আশা করতে থাকবো।


হাঁটুপানির জলদস্যু

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ডাখাউতে ছবি তুলছিলাম কিছু। স্ক্যান করা নাই। মন খারাপ



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

বিপ্লব রহমান এর ছবি

আমি চেয়েছিলাম হিম শীতের আউশভিৎস দেখতে। সেদিনের অকস্মাৎ তুষারঝড়ের সাথে বধ্যভূমির চরিত্র মিলে মিশে গিয়েছিল।

আপনার অসাধারণ এই ধারাবাহিকটি পড়তে পড়তে বার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো দি পিয়নিস্ট আর দি শিন্ডলার্স লিস্ট ছবির নানান টুকরো দৃশ্য। এই রকম লেখা পাঠের সুযোগ করে দেওয়ায় আপনাকে অনেক কৃতজ্ঞতা। ধন্যবাদ।।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

অয়ন এর ছবি

বিজ্ঞান দর্শনে সবচেয়ে বেশী অবদান যে জাতির, মানব ইতিহাসের বিভৎসতম হত্যাযজ্ঞটাও সেই জাতির হাতে। অদ্ভূত ব্যাপার।

দিগন্ত এর ছবি

চমতকার ভ্রমণকাহিনী পড়লাম। তবে কনসেন্ট্রেশণ ক্যাম্প আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বললে মারিও ক্যাপেচ্ছির কথা মাথায় আসে - ২০০৭ এর মেডিসিনে নোবেল বিজেতা। বিশ্বযুদ্ধ শেষে একে মৃতপ্রায় অবস্থায় হাসপাতালে ফিরে পেয়েছিলেন এর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী মা।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

হুমায়রা এর ছবি

Dear সুবিনয়
শুভেচ্ছা রইল। আমি একটি ই-ম্যাগাজিন প্রকাশ করছি ফ্লরিডা থেকে। আমার ই-ম্যাগাজিনে আমি কি আপনার 'পোল্যান্ডের চিঠি' লেখাটি প্রকাশ করতে পারি? অনুমতি দিলে খুশী হব। আমার ম্যাগাজিন লিংক http://www.nauba-aloke-bangla.com/

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।