৯/১১ এবং আমি (১)

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি
লিখেছেন সুবিনয় মুস্তফী (তারিখ: সোম, ২০/০৮/২০০৭ - ৮:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তারিখ - ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১
সময় - সকাল ৭:৫৫
স্থান - আমার ফ্ল্যাট, ডেন্টন, টেক্সাস

*

- ক্রিং! ক্রিং!... ক্রিং! ক্রিং... ক্রিং! ক্রিং

ঘুমিয়ে ছিলাম সেদিন ভোরবেলায়। বেশ আরামের ঘুম। কোনো মজার স্বপ্ন দেখছিলাম কিনা সেই সুখের ভোরে, তা আজ আর মনে নেই। কিন্তু ফোন বাজা শুরু হয়ে গেলো কি কারনে, কোনো এক কান্ডজ্ঞানহীন গবেটের কাজ নিশ্চয়ই। বিছানায় শুয়েই রয়েছি তবুও, আধো-ঘুমের মধ্যে অপেক্ষা করছি কখন ফোনটা বাজা বন্ধ হবে। হয়তো দেশ থেকে ফোন করেছে কেউ, আমার বা আমার ফ্ল্যাট্‌মেট্‌দের কারো বাসা থেকে। মরুকগে, এত দরকার থাকলে আবা- wait, wait! জামানের গলা না?! এত সকালে কি চায় শালা?

(৩০ মাইল দূরে ড্যালাসে থাকে জামান, আমার কলেজ জীবনের বন্ধু, ওর কায়েতটুলির বাসায় গিয়ে প্রচুর আড্ডা দিয়েছি এক সময়, আজ ঘুরে ফিরে দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে। দুজনই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি - ও কম্পিউটারে, আমি অর্থনীতিতে। পাশাপাশি কাজও করে যাচ্ছি, দুজনই রাতের শিফ্‌ট্‌ - আমি একটা ২৪-ঘন্টা গ্যাস স্টেশনে (বাঙ্গালি মালিক), ও একটা মোটেলে (গুজরাটি মালিক)। মোটামুটি জিগ্‌রি দোস্ত বলা চলে - ওর নীল রঙ্গের টয়োটাতে পাঙ্খা মেলে উড়াল দেই আমরা প্রায়ই, হাইওয়ে দিয়ে উদ্দাম গতিতে, জানালা নামিয়ে দেই, গাড়ির রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দেই, দুজনে মিলে গলা ছেড়ে গান গাই কোরাসে, শো-শো বাতাসে সে গান মিলিয়ে যায়...)

সেই জামান হারামজাদার গলা আবছা শুনতে পাচ্ছি, মেশিনে ভয়েস মেসেজ রাখছে সে। ওর সে-রাতের মত শিফ্‌ট্‌ শেষ, তাই নিশ্চয়ই অযথা যন্ত্রণা দিচ্ছে। আমি কম্বলের নীচে ফের ডুব দিলাম।

কিন্তু একটু পরে আবারও ফোন। মেজাজটা খিঁচড়ে গেল - যাওয়ারই কথা! টেনেটুনে উঠলাম, বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে ফোনটা তুললাম এবং অশ্রাব্য কিছু গালি বন্ধুকে শোনানোর জন্যে তৈয়ার হলাম। কিন্তু জামান চেঁচিয়ে কি যেন বলার চেষ্টা করছে। বলছে টিভি ছাড়, টিভি ছাড়, সিএনএন-এ কি যেন দুর্ঘটনার দৃশ্য সরাসরি দেখাচ্ছে, নিউ ইয়র্কে কি যেন হয়েছে। কিন্তু আমার টিভিতে তো সিএনএন আসে না, বরঞ্চ কম্পিউটার ছাড়লাম, ইন্টারনেট থেকে কিছু জানা যায় কিনা দেখি।

আমার ইন্টারনেটের স্পিড তখন বেশ বাজে, তারপরও সিএনএন-বিবিসি এক ঝলক দেখে যা বুঝলাম, তা বিশেষ সুবিধার ঠেকলো না: ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে একটা প্লেন ঢুকে গেছে। আল্লাহই জানে কিভাবে এরকম একটা স্টুপিড দুর্ঘটনা সম্ভব হয়েছে। মাত্র তিন সপ্তাহ আগেই আমি আর আরেক বন্ধু ইরশাদ মিলে নিউ ইয়র্ক ঘুরে এসেছি, এমনকি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারও দেখে এসেছি। সেখানেই দেখি অঘটনটা ঘটেছে।

৬ বছর আগের সেই অভিশপ্ত ভোরে মন দুরুদুরু করে উঠেছিলো কোন এক অজানা কারনে। আজো মনে আছে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে ক্যাম্পাসের কম্পিউটার ল্যাবে চলে গিয়েছিলাম। সকাল ৮টায় ল্যাব খোলে, বসে পড়েছিলাম হাই-স্পিড ইন্টারনেটের সামনে খবরটা ভালমতো পড়বো বলে। রিফ্রেশ চাপছি একটু পর পর - ঠিক তখনই সিএনএন-এর পাতায় অবিশ্বাস্য আপডেটটি এসেছিলো - দ্বিতীয় একটা প্লেন উড়ে গেছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ভিতরে!

আমার মনে যত দ্বিধা-সংশয় ছিল ততক্ষন পর্যন্ত, ঠিক সেই মুহুর্তে সব উড়ে গেলো। কোন দুর্ঘটনা নয় এটা, বরং পরিকল্পিত আক্রমন। মাথার মধ্যে বনবন করে ঘুরছে অন্য চিন্তা - এর আগের টানা একটা বছর ধরে প্যালেস্টাইনে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার আগুন জ্বলছে, মানুষ মরছে প্রতিদিন, বোমা ফাটছে, ইস্রাইলের এরিয়েল শ্যারন আগুনে ঘি ঢেলে যাচ্ছে, কিন্তু বুশ বলেছে সে কোন প্রকার মধ্যস্থতা করে সময় নষ্ট করবে না। এটা কি তবে ফিলিস্তিনিদেরই প্রতিশোধ নেওয়া হলো নাকি? এতো মারাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো দেখি।

এক দিক দিয়ে মনটা বেশ খুশিই হয়েছিলো, আমেরিকা একটা চপেটাঘাত খেয়েছে বলে। কিন্তু পাশাপাশি ভয়ও চলে এসেছিলো মনের কোনে। ল্যাবে সেই সাতসকালে তখন বড়জোর আধা-ডজন লোক, কারো কারো স্ক্রীন দেখে বুঝেছিলাম তাদের নজরে তখনও খবরটি আসেনি। মনে মনে ভাবছিলাম - বাবারা, দুনিয়াটা হঠাৎ করেই খারাপের দিকে মোড় নিলো, তোমরা সেটা এখনো জানো না হয়তো, কিন্তু জেনে যাবে আর অল্প একটু পরেই।

আমি নিঃশব্দে ধীর পায়ে ল্যাব থেকে বেরিয়ে বাড়ি হেঁটে চলে যাই। দুই ফ্ল্যাট্‌মেট্‌ সৈয়দ আর আলিকে জেগে তুলি, খবরটা তাদের জানাই।

*

তার মাত্র এক ঘন্টা পরেই দুটো বিল্ডিংই ধ্বসে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ক্লাস বাতিল হয়ে গিয়েছিলো সেদিনকার মতো। পুরো দেশ থেমে গিয়েছিলো, স্কুল-কলেজ অফিস-আদালত সব কিছুর কাজ প্রায় বন্ধ। সবাই টিভির সামনে সম্মোহিতের মতো বসে আছে, নয়তো বন্ধু-আত্মীয়-প্রিয়জনের খোঁজ নিচ্ছে।

৯/১১-র সাথে সাথে শেষ হয়ে গিয়েছিলো আমাদের পুরনো জীবন, পুরনো সব নিশ্চয়তা। পালটা আমরা পেয়েছিলাম এক নতুন জীবন যার রীতি-নীতি, নিয়ম-কানুন ছিল আলাদা, নির্মমভাবেই আলাদা। সেই সময় ঐ দেশে অবস্থানরত বাঙালি যারা ছিলাম (অথবা ভিনদেশী অথবা মুসলিম), বোধ করি তাদের সবাইকে একটা করে কলম ধরিয়ে দিলে একেকজন একেকটা চমকপ্রদ উপন্যাস লিখে ফেলতে পারবেন। আজ টেক্সাস থেকে ৫,০০০ মাইল দূরে বসে উপন্যাস নয়, বরং কিছু স্মৃতিই মনে পড়ে যাচ্ছে। অনেক অনেক স্মৃতি। একদিনে বলে তা শেষ হওয়ার নয়...


মন্তব্য

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

শোনার আগ্রহে ,,, চলুক স্মৃতির চাকা
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

কে জানতো আপনি ডেন্টনে ছিলেন? আমি বাস করি ডালাসে দীর্ঘকাল।

টুইন টাওয়ারের প্রথমটিতে আঘাতের খবর সেদিন শুনেছিলাম রেডিওতে অফিস যাওয়ার পথে। পরেরটা শুনলাম অফিসে পৌঁছানোর কিছু পরে।

ভালো লাগছে আপনার লেখা। পরের পর্ব আসুক।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

ভালোই তো! ড্যালাস কোথায় আছেন? আমার অনেক বন্ধু আছে এখনো, মাঝে মাঝে বেড়াতে যাই। সবাই আগে থাকতো Richardson-এ, এখন সব Allen, McKinney, এসবে চলে গেছে।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

রিচার্ডসন অঞ্চলে একসময় থাকতাম। এখন থাকি অ্যালেন-এ। এরপরে কবে আসবেন? খবর দিতে ভুলবেন না।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমিও অপেক্ষায় থাকলাম। আমি ৯/১১ এর অনেক পরে এসেও এর কুপ্রভাবটা বুঝতে পারি। বিশেষ করে নন-মেট্রোপলিস যেকোন জায়গায় গেলেই বোঝা যায়। অবাক লাগে আগের গল্প শুনলে। কী গল্প শুনে আমেরিকা আসলাম, আর কী আমেরিকা পেলাম!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আজকে গ্রাউন্ড জিরোতে কন্সট্রাকশনের জায়গায় আগুন লেগে দুজন ফায়ার ফাইটার (অগ্নি যোদ্ধা?) মারা গেছে। এই নিয়ে নিউইর্য়কবাসীর আবার মনে পড়ে গেছে পুরোনো ঘটনা। খবরে বড় করে দেখালো।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অতিথি এর ছবি

????

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।