রোজনামচা

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: রবি, ০৩/০৮/২০০৮ - ২:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নন্দননন্দন

অনেকদিন পরে গতকাল বিকেলে নন্দন চত্তরে ঢুকে পড়ি বিনা কারণে। কাজ-কর্ম কিছু নেই এমন নয় কিন্তু করতে ইচ্ছে করছে না। ভাল লাগছে না কিছুই। নন্দনে কি একটা সিনেমা চলছে, প্রচুর ভিড় হলে ঢোকার! কি সিনেমা? আবার বাইরে গিয়া পোষ্টার দেখবো? থাক! নন্দনের সামনেটা দিয়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াই চা-কফির ছোট ষ্টলটার সামনে। এক কাপ চা খেলে হয়। এখানেও লাইন! লাইনে দাঁড়িয়ে এ'দিক ও'দিক তাকাতে গিয়ে চোখ পড়ে একজনের ওপর।মুখটা চেনা। নন্দনে গেলেই দেখা পাওয়া যায় তার। স্যুটেড বুটেডই বলা যেত নেহাত কোটখানা গায়ে নেই। ইন করে পরা শার্ট, রোদচশমাখানি কপালের উপর তোলা। রেলিংএর ধারে গাছতলার বাঁধানো বেদীর উপরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে চলমান জনতার দিকে।

নন্দন চত্তর, বছরভর যেখানে মেলা জমে থাকে। মানুষের মেলা।

বেশ অনেকদিন আগের কথা। বছরখানেক হবে। নাটক দেখতে গিয়েছিলাম সেদিন যদ্দূর মনে পড়ছে। মনে পড়েছে। সংসৃতি নামক নাট্যগোষ্ঠির কততম যেন বর্ষপুর্তি ছিল আর সেই উপলক্ষ্যে দু'দিনে পরপর চারখানা নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন তাঁরা। এক বন্ধুর আমন্ত্রণে আমি গিয়েছিলাম সেই নাটক দেখতে। বন্ধুটি তখনো এসে পৌঁছননি তাই আমি এদিক ওদিক করছিলাম। সেদিনও একটা চা নিয়ে রবীন্দসদনের লাগোয়া হাতখানেক উঁচু রেলিংএ বসে চা খাচ্ছিলাম আর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম।
রবীন্দ্র সদন
হঠাৎ মনে হল কেউ একজন বারে বারেই সামনেটা দিয়ে যাচ্ছে আর আসছে। তাকাতে গিয়ে দেখলাম সে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। চেহারা সুরত দিব্যি। জামা-কাপড়ও দিব্যি। দেখতে তো ভদ্রলোকেদের মতই! হাতের চা শেষ। কিন্তু তার যাওয়া আর আসা থামছে না আর এবার তার হাঁটার গতিও ধীর। সুযোগ দেওয়ার কোন ইচ্ছে নেই তাই বসে না থেকে উঠে পড়লাম। নন্দন চত্তর পেরিয়ে চলে যাই অ্যাকাডেমীর সামনে। বন্ধুর টিকির দেখা নেই এখনও। বিরক্ত লাগে। কি মনে হতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রোমিও এখানেও হাজির! আর এবার তার মুখে আগে থেকে ধরে রাখা একটা হাসি! আমি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আবার নন্দন চত্তরে ঢুকে পড়ি।

হাঁটতে হাঁটতে নন্দন পেরিয়ে শিশির মঞ্চ আর তারপরেই গগনেন্দ্র শিল্প প্রদর্শনশালা। কিছু একটা প্রদর্শনী যেখানে হরবখতই চলে। ঢুকে পড়ি সেখানে। নানা শিল্পির আঁকা ছবি সব ঝুলছে দেওয়ালে দেওয়ালে। মন দিয়ে ছবি দেখি। আবারও কেমন কেমন লাগল। এবার আর ঘাড় ঘোরাতেও হল না কষ্টা করে, পাশেই বিগলিত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে রোমিও, সেও ছবি দেখছে! লহমায় ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা আবার নন্দনের দিকে হাঁটা শুরু করি। এক্সকিউজ মি! কানের পাশে শব্দটি শুনে প্রথমে বুঝতে পারিনি যে আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে। তাকাই, রোমিও! এক্সকিউজ মি, আপনার সাথে কি দু মিনিট কথা বলতে পারি যদি কিছু মনে না করেন? তার সাথে কথা বলার বা তার কথা শোনার কোন ইচ্ছে নেই জানিয়ে দিয়ে সোজা আবার অ্যাকাডেমী, বন্ধুটি ফোনে জানিয়েছেন, তিনি অ্যাকাডেমীর সামনে পৌঁছেছেন!

পোষ্টার

চা হাতে নিয়ে আবার সেই পথে, নন্দন পেরিয়ে শিশির মঞ্চ আর আবার সেই প্রদর্শনশালা। বিশাল বড় পোষ্টার আগের দিনই চোখে পড়েছিল, রক্তরঙা বোর্ডে সাদা কালিতে লেখা- মাওবাদী, নৈরাজ্যের আরেক পর্ব। সিপিএম'এর মুখপত্র গণশক্তি-তে এযাবত মাওবাদী সম্পর্কিত ছাপা সব ছবি-খবরের বড় বড় সব ছবি। এক জায়গায় এ পর্যন্ত মাওবাদীদের হাতে নিহত সব মানুষের নাম, বয়েস। সে লিষ্ট অনেক বড়। বেশ কিছু মানুষ একের পর এক ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে সব খবরের ছবি পড়ছেন।
ছবি, খবর
ঢোকার মুখে চেয়ারে কয়েকজন বসে আছেন, সামনে টেবিলে খোলা এক খাতা। কেউ কেউ সেখানে মতামত লিখে দিয়ে যাচ্ছেন। ছবিগুলো দেখি, খবরগুলো পড়ি। কিছু কিছু খবর তো কাগজে পড়া। কিছু ছবিও দেখা কিন্তু সে'সব ছবি খবরের কাগজে এত জীবন্ত কখনও লাগেনি। গা শিরশির করে। বমি পায়। ভারী ঠেকে বাতাস। বেরিয়ে আসি সেখান থেকে।

---

সন্ধেবেলায় মীনাক্ষী'র সাথে উইন্ডো শপিংএ যাই। প্যান্টালুনস, ওয়েষ্টাসইড, রিবক সেবেতে সেল চলছে। কোথাও ৪০% অফ তো কোথাও আপ টু ৫০%। পুজোর যদিও এখনও ঢের দেরী কিন্তু বাতাসে এখন থেকেই পুজো পুজো গন্ধ আর এই গন্ধটা খুব বেশি করে টের পাওয়া যায় এই সব সেল দেওয়া দোকানগুলোতে গেলে। কিছুই কেনার কোন প্ল্যান ছিল না তবুও ঘুরে ঘুরে মীনাক্ষী কেনে কুর্তা, টি-শার্ট, ব্যাগ। প্রায় নতুন একজোড়া স্নিকার্স থাকা সত্বেও রিবক থেকে কেনে স্নিকার্স, ব্যাগ। সবসময়েই প্রচুর কথা বলে আর প্রচুর হাসে মীনাক্ষী। রীতিমত বকবক বলা যায়। আমি হুঁ হ্যাঁ করি। বেশির ভাগ সময়েই চুপ করে থাকি। অ্যাই মেয়ে, এত কম কথা বল কেন! অনুযোগ মীনাক্ষীর। দু'জনে দুটো ঠান্ডা চা নিয়ে ক্যাফেতে বসি। আলো ঝলমল মল মানুষের আনাগোনায় সরগরম। ব্যস্ত সমস্ত মুখে ঝাপিয়ে পড়ে মানুষ কেনাকাটা করছে, যেন কালকেই ঈদ। কিংবা যেন পুজোর শুরু!

মীনাক্ষীর কথা একটু বলি। অন্ধ্র প্রদেশের মেয়ে। মা বাঙালী। ব্যাঙ্গালোরে থাকে বাড়ির অন্যেরা, চাকরীসূত্রে মীনাক্ষী কলকাতায়। আমার সাথে আলাপ ব্যায়ামাগারে। ব্যায়াম করার ব্যাপারে ও কোনকিছুর সাথেই কোনরকম আপস করতে রাজী নয়। ছিমছাম চেহারার মীনাক্ষীকে দেখতে রীতিমত সুন্দরী। ঝরঝরিয়ে বাংলা বলে যদিও লিখতে পারে না। একসময় ফুটবল খেলত, একবার হাঁটু ভাঙার পর থেকে খেলা বন্ধ, এখন শুধু এক্সারসাইজেই খুশি। ট্রেডমিলে পাগলের মত দৌঁড়ায়, হেভি ওয়েট ট্রেনিং করে, এক ছটাক মেদও শরীরের কোথাও রাখতে রাজী নয় সে। মীনাক্ষী ভালবাসে এক তামিল ছেলেকে যে থাকে দিল্লিতে। ছেলেবেলার বন্ধু, একসাথে বড় হয়েছে। এটা ঠিক সরল সোজা প্রেমকাহিনী নয়। ওরা দু'জনে ভাল বন্ধু। এক সময় ছেলেটি অন্য এক মেয়ের প্রেমে পড়ে, বিয়ে করে আর বছরখানেকের মধ্যে তাদের ডিভোর্সও হয়ে যায়। ছেলেটি বিয়ে করে ফেললেও মীনাক্ষী বিয়ে করেনি। করবে না এমন কিছু ভাবেনি। ব্যাস। বিয়েটা করেনি। ছেলেটির সাথে যোগাযোগ ছিল, সেই যোগাযোগ এখন গাঢ় হয়েছে। কয়েক মাস পরপরই ছুটি নিয়ে উড়ে দিল্লি চলে যায় দু-তিন দিনের জন্যে। এই সেদিনও গিয়েছিল। ফিরে এসে বলে, ইশশ, প্রতি মাসেই যদি ছুটি নেওয়া যেত! মাঝে মাঝেই বলে, তুমি আমার জন্যে একটু দোয়া কর না বাবা, আমার যেন বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। বুড়ি হয়ে গেলাম যে! কেন কে জানে ওর বিয়েটা হয়ে ওঠছে না আর কবে হবে সে বিষয়ে ওর নিজেরও কোন ধারণা নেই।

মল ছেড়ে বেরিয়ে আসি বাইরে। ভ্যাপসা একটা গরম। যদিও সারাদিনই যখন তখন বৃষ্টি নেমে পড়ছে কিন্তু তারপরও এই পচা গরম। মীনাক্ষী থাকে দক্ষিণে আর আমি তো নদী'র অন্য পারে। দুজন একেবারে দুই প্রান্তে। কাল আসছ তো যোগা করতে? শেষবারের মত জিজ্ঞেস করে এগিয়ে যায় নিজের পথে। আমিও এগোই ফেরার রাস্তায়। পেছনে পড়ে থাকে ঝলমলে মেগাসিটি - কলকাতা।

বাড়ি গিয়ে আজ বিন্নির ভাত রাঁধব সাথে ভুনা ডিম। আহ ...

(নন্দন ও রবীন্দ্র সদনের ছবিগুলো গুগল থেকে নেওয়া। বাকিগুলো মোবাইল সৌজন্যে।)


মন্তব্য

স্বপ্নাহত এর ছবি

ইশ ....সবাই কত ঘোরাঘুরির মধ্যে আছে।

আর আমারে কীনা পরীক্ষার চিপায় টেবিলে বসে কুলিং লোড টেম্পারেচার ডিফারেন্স এর সূত্র মুখস্ত করতে হইতেসে। মন খারাপ

---------------------------

থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

শ্যাজা এর ছবি

ঘুরাঘুরি-ই তবে খুব বেশি না।

মন দিয়া পড়া মুখস্ত করেন, আগে গিয়া কামে দিব।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

কীর্তিনাশা এর ছবি

হ মনে হইতাসে শ্যাজাদি মজায় আছে বেশ।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সৌরভ এর ছবি

বাড়ি গিয়ে আজ বিন্নির ভাত রাঁধব সাথে ভুনা ডিম। আহ ..

কেমন য্যানো শ্যাষ হইলো না।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

তোমার বাসায় আসছি তবে, ডিম ভুনা খেতে চাই। খাওয়াবে তো ??

আর, ঐ লোকটা কিসের জন্য যে তোমার পিছু নিয়েছিল বুঝতে পারছিনা। মনেহয় শুধুই টাঙ্কি মারার শখ ছিল তোমার সাথে। হাঃ হাঃ। এমন সুন্দর একটা মুখ দেখে বেচারার অবস্থা ত্যানা ত্যানা হয়ে গেছিল!
ভাল লাগল শ্যাজাদি তোমার লেখা (সবসময়ই লাগে)। অনেকদিন পর মোটামুটি নিয়মিত তোমার লেখা পাচ্ছি তাতেই খুশি লাগছে অনেক।

--------------------------------------------------------

শ্যাজা এর ছবি

হাসি


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

কিছু কিছু জায়গায় মনে হলো, আরেকটু বর্ণনা থাকলে ভালো হতো আরো। বিন্নির ভাত, ভুনা ডিম ... শুনেই খেতে ইচ্ছে করছে হাসি

শ্যাজা এর ছবি

ধন্যবাদ প্রহরী মশাই।

আপনার মন্তব্য পড়ে কয়েকটা ছবি তুলে দিলাম। ফাঁক-ফোকর যেটুকু ঢাকা যায় আর কি। আবারও ধন্যবাদ।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

এইবার হইছে হাসি

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো লাগলো আপনার রোজনামচা।
মীনাক্ষীকে বলেন, বিয়ের জন্য অস্থির হওয়ার কিছু নেই। ওই দিল্লীকা লাড্ডু খেলেও পস্তাতে হয়!

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

শ্যাজা এর ছবি

শিমুল,
ব্যাপার হইল, না খাইয়া পস্তানোর থেকে খাইয়া পস্তানো ভাল বলে একটা কথা আছে না? সে আবার এই বাক্যে বিশ্বাস করে যে!

আপনাকে ধন্যবাদ।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

ধুসর গোধূলি (ওঙ্গায়) এর ছবি

মীনাক্ষী কে? কী করে? কী পরে? চিন্তিত

মনজুরাউল এর ছবি

রক্তরঙা বোর্ডে সাদা কালিতে লেখা- মাওবাদী, নৈরাজ্যের আরেক পর্ব। সিপিএম'এর মুখপত্র গণশক্তি-তে এযাবত মাওবাদী সম্পর্কিত ছাপা সব ছবি-খবরের বড় বড় সব ছবি। এক জায়গায় এ পর্যন্ত মাওবাদীদের হাতে নিহত সব মানুষের নাম, বয়েস। সে লিষ্ট অনেক বড়। বেশ কিছু মানুষ একের পর এক ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে সব খবরের ছবি পড়ছেন।

আমার বোঝার ভুলও হতে পারে। তবে যদ্দুর বুঝেছি তাতে মনে হয়েছে,-রোমিও,নন্দন,শিশিরমঞ্চ,রেবক সেল এগুলি অনুপান মাত্র। মূল উপস্থাপনা- আমার চার লাইনের উপরে-নিচে। তাই কী?বামফ্রন্টের চোখে মাওবাদীরা এইরকম,জানি। আপনার কাছেও কী?!

সে'সব ছবি খবরের কাগজে এত জীবন্ত কখনও লাগেনি। গা শিরশির করে। বমি পায়। ভারী ঠেকে বাতাস। বেরিয়ে আসি সেখান থেকে।

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

শ্যাজাদি তোমার ডিম ভুনার ছবি খুঁজছিলাম তো !! পেলাম না। ছবিগুলো বেশ তুলেছ।

--------------------------------------------------------

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।