ডায়রির পাতা ছিঁড়ে...

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: মঙ্গল, ২৮/০৮/২০০৭ - ২:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চৈত্রের শেষ দুপুরেও রোদের তেজ একটুও কমেনি ৷ স্টেশনের সিমেন্টের বাঁধানো এক বেদীতে বসে কুলকুল ঘামি ৷ অপেক্ষায়, হাওড়াগামী ট্রেনের ৷ লেডিস কমরায় উঠব বলে এমন একটা জায়গায় এসে বসেছি যেখানে প্ল্যাটফর্মের মাথার উপর কোন আবরন নেই৷ আদ্ধেক ন্যাড়া এক গাছের ছায়া খুঁজে নিয়ে গাছের গোড়ার বাঁধানো বেদীতে বসি৷ পিঠ বেয়ে ঘামের ধারা নামে৷ রুমালের আকারের ছোট্ট তোয়ালে হাতব্যাগ থেকে বের করে মুখ গলা আর ঘাড়ের দিকটা মুছি৷ বৌদি কী হাওড়া যাবেন? প্রশ্ন শুনে মুখে তুলে তাকিয়ে দেখি হাঁটুর উপরে লুঙ্গি পরা খালি গায়ের এক লোক প্রশ্ন করেছে৷ লোকটিকে ভিখিরি ভেবে তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাই৷ লোকটি বলে ওঠে, 'আমার মেয়েছেলেটাও হাওড়া চলে গেছে! ঘুমিয়ে ছিলাম আমি, পাশ থেকে কখন উঠে চলে গেছে টেরও পাইনি৷ মাগী বদমাইশ! বারোভাতারী, একটা ব্যাটাছেলেতে মন ভরবে তার? আমি কত খুঁজেছি মাগীকে, পাইনি৷ এখন গিয়ে আমি মদ খাব৷ দশটা টাকা আছে আমার কাছে, মদ খাব আর ঘুমাব!' ট্রেনের জন্যে অপেক্ষারত এক ভদ্রমহিলা পাশ থেকে বলে ওঠেন, 'ঐ করগে, তোমার আর কী হবে! ঠিক করেছে বৌ চলে গেছে!' লোকটি আর দাঁড়ায় না কে কী বলল শোনার জন্যে৷ এগিয়ে যায় প্ল্যাটফর্ম ধরে৷ চোখে পড়ে লোকটির সারা গায়ে দগদগে ক্ষত৷ যেন খাবলা খাবলা ছাল চামড়া ছাড়িয়ে নিয়েছে কেউ৷ ঐ ক্ষতের উপর বসে থাকা মাছিরাও যায় লোকটির সাথে সাথে, আগে পিছে ওড়ে তারা৷ গা শিরশির করে আমার, চোখ ফেরানোর চেষ্টা করি অন্যদিকে, রেললাইনের দিকে, ট্রেন কি আসছে!

শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরছি আমি। অসুস্থ শ্বশুরমশাইকে দেখতে এসেছিলাম ৷ বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ তিনি, দুদিন আগে ফোন করে শাশুড়ি বলেন, তোমার বাবার শরীরটা বেশ খারাপ। শরীর প্রায়শই খারাপ থাকে তবু এভাবে তো বলেন না ওঁরা। জানতে চাই, আমি কী একবার বাড়িতে আসব মা? শাশুড়ি বলেন, আসবে? তা এসো! কবে যাব জেনে নিয়ে তিনি বলেন, এলে আর সেদিন ফিরে যাবে না, সেইমত ব্যবস্থা করে এসো ৷ সম্মতি জানাই ৷ রবিবারে নাকি ট্রেন এমনিতেই কম থাকে ৷ তায় প্রতিটি ট্রেনই দশ-পনের মিনিট করে লেট থাকে, প্ল্যাটফর্মে অস্থির পায়চারীরত সাদা চুড়িদার কামিজ পরা একটি মেয়ে নিজের মনেই বলে যায়৷ আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চায় লাষ্ট ট্রেন কখন গেছে৷ হেসে ফেলি আমি, লাষ্ট ট্রেন দেখতে পেলে তো আমি তাতেই চেপে বসতাম আর এতক্ষণে হাওড়ার কাছাকাছি চলেও যেতাম! এবারে মেয়েটিও হেসেই ফেলে৷

পাশে নামিয়ে রাখা ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হই এটাকে বয়ে সেই বাড়ি অব্দি নিয়ে যেতে হবে ভেবে ৷ দেখতে ছোট হলেও ব্যাগটি বেশ ভারী ৷ গাছের নারকোল, দু'রকমের আচারের শিশি, কাগজি লেবু কী নেই এতে! আর সেই বই দুটো ও তো আছে, সময় কাটানোর কথা ভেবে যে দুটো আমিই সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম অথচ একবারও খুলে দেখিনি! মন প্রসন্ন হয় ভোরবেলায় ছাদ থেকে কুড়িয়ে আনা আমের গুটিগুলো ও শাশুড়ি দিয়ে দিয়েছেন ভেবে! ক্ষুদ্র এক জিনিস, যার কোন মূল্যই নেই, আমি কুড়িয়ে না আনলে সেগুলো ছাদেই পড়ে থেকে শুকিয়ে যেত আর তারপর ঝরা পাতা ঝাট দেওয়ার সময় ওরাও চলে যেত শুকনো পাতাদের সাথে৷

ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেই ছাদে চলে গিয়েছিলাম৷ ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখি, দাঁড়িয়ে থাকি রেলিং ধরে ৷ এই প্রথম শ্বশুরবাড়িতে একা রাত্রিবাস আমার৷ ও'র কথা ভাবি, গতকাল দুপুর থেকে আজ এই ভোর অব্দি এক মুহুর্তের জন্যেও সে মন থেকে সরেনি৷ রাতে আধো ঘুম আধো জাগরনের মাঝেও সে ছিল৷ কথা বলেছে, খুনসুটি করেছে, আদর করেছে৷ সে কী তবে স্বপ্ন ছিল!

খানিক পরেই শাশুড়িও উঠে আসেন ছাদে, হাতে অ্যালুমিনিয়ামের জাগ ভর্তি জল, টবে দেবেন ৷ শুকনো মরে যাওয়া গাছ সব, কয়েকটা ফণিমনসা শুধু বেঁচে আছে জল ছাড়াই৷ জলের জাগ শাশুড়ি মায়ের হাত থেকে নিয়ে একটু একটু করে সব কটা টবেই জল দেই৷ মা বলেন, হাঁটুতে ব্যাথা, কোমরে ব্যাথা, ছাদে উঠতে পারি না এখন আর, গাছগুলো সব শুকিয়ে গেল গো! এই ক্ষরায় কী গাছ বাঁচে জল ছাড়া! আমি শুনি, এই ছাদ নাকী ও'র খুব প্রিয়৷ অনেক আগে, যখন ও বাড়িতে থাকতো, বেশির ভাগ সময়ই এই ছাদে কাটাতো৷ মাদুর পেতে বই নিয়ে ছাদে চলে আসতো, ঘন্টার পর ঘন্টা ছাদেই থাকতো সে৷ তখন নাকি অনেক গাছ ছিলো ছাদে৷ দু'বেলা গাছেরা জল পেত, ইট আর সিমেন্টের এই ছাদে ছিল এক ছোট্ট বাগান৷ তবে সাজানো নয়৷ ইতস্তত: ছড়ানো ছিল সব টব৷ এখানে ওখানে৷ ঠিকই তো! যে বাগানে সে সময় কাটায়, যে যায়গা ও'র প্রিয়, সেই বাগান সাজানো হতেই পারে না!

(ডায়রিতে লিখে রাখা অনেকদিন আগের কিছু কথা )


মন্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

বড় জীবন্ত ছবিগুলো। দরকারী খুঁটিনাটিগুলোও উঠে এসেছে যায়গামতো। ডায়েরীর পাতা আরও ছেঁড়া হোক। হাসি

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

আরিফ জেবতিক এর ছবি

পাচেঁ পাচঁ।
ডায়রীর আরো কিছু পাতা কি উঠে আসতে পারে না আগামীতে?

----------------------------------
ঢাকার ভূমে ফিরেছে একাত্তর/প্রস্তুতি নে,সময় হলো তোর..

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

আমিই তো একটা দিছি। ৫ তাইলে ১ টা দেখায় কেন? কর্তৃপক্ষ বিচার চাই!!!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

শ্যাজা এর ছবি

এ'রকম প্রশ্রয় পেলে উঠে আসতেই পারে হো হো হো


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

আরিফ জেবতিক এর ছবি

প্রচুর পরিমান প্রশ্রয় নিয়মিত সাপ্লাই দেয়া হবে।
ডরো মাত॥

-----------------------------------
ঢাকার ভূমে ফিরেছে একাত্তর/প্রস্তুতি নে,সময় হলো তোর..

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

ব্লগার রুষ্ট হবেন না আশা করে মন্তব্যের পরিধি বাড়িয়ে দিচ্ছি। আগের লেখা ডাইরি, তার মানে ব্লগারের লেখার হাত এখন আরো একটু পোক্ত হয়েছে।
যদিও এখনও হাত না দিয়ে থাকেন তবে এখন উপন্যাস লেখার মত যাবতীয় দক্ষতা তার কলমে চলে এসেছে।
ডিটেইলসটা শুধু দেখার বিচ্ছিন্ন দৃশ্য নয়, ব্লগারের দক্ষতায় সেসব দৃশ্য হয়ে উঠেছে লেখার অন্যতম অংশ, গাঁথুনির জরুরি পলেস্তারা।

বউ চলে যাওয়া লোকটার চরিত্র কয়েকটা বাক্যেই সুন্দর হয়ে উঠে এসেছে। একেবারে উপন্যাসের আদলে। মনে হচ্ছে পরের পরিচ্ছেদে সেই লোকটা যেখানে মদ খেতে যায় সেখানে আমরা যাবো। সেই মদের দোকানে তার মাতলামো বা দু:খ বর্ণনার একটা গল্পও হয়তো উঠে আসবে।

শ্বাশুড়ির চরিত্রও বড় জীবন্ত হয়ে এসেছে। কয়েক লাইনে চূড়িদার পড়া মেয়েটির চরিত্রও। সব বোনা হয়ে গেছে। এখন গল্পটা শুধু বলতে হবে। কিসের গল্প হবে? শ্বশুরবাড়িতে একা রাত্রি। প্রিয়'র শৈশবের স্মৃতি নিয়ে একা কিছু সময়। নাকি ফিরে আসা তোমার কাছে।

শুধু একটা সমালোচনা ধরিয়ে দিতে চাই ব্লগারকে। পড়তে গিয়ে ভাবলাম একজন বড় লেখকের তুলনায় এই লেখার ঘাটতি কোথায়। সাথে সাথেই একটা জরুরি উত্তর খূঁজে পেলাম যে, ভাষা-ভঙ্গিটা। ভঙ্গিটা যে কারো মনে হচ্ছে। আরো অনেকে এভাবেই লেখেন বলে মনে হচ্ছে। অথবা এই লেখকের নাম খূব খ্যাতি অর্জন করেনি বলে এই ভঙ্গিটাকে আমরা তার নিজস্ব ভঙ্গি বলে জানি না - এও হতে পারে।

তবে নিজস্ব একটা ভাষা-ভঙি হয়তো লিখতে লিখতে তৈরি হয়ে যাবে। কিন্তু এখন যা করা দরকার তা হলো একটা উপন্যাস লিখে ফেলা- এবং তা এরকম ডাইরিতে টুকে রাখা গল্প বলার ভঙ্গিতেই হতে পারে, কারণ এটা লেখকের জন্য সহজাত হবে।
খূব সম্ভাবনাময় একজন লেখকের জেগে ওঠা দেখতে পাচ্ছি।
শুভেচ্ছা।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

বটু মিয়া এর ছবি

ডায়রির ভাষা ভঙ্গি নিয়ে কি আদৌ চিন্তিত হওয়া উচিত?
বিগ সি'র আরেকটু ব্যখ্যা আশা করছি।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

ডায়রির ভাষাভঙ্গি নিয়ে বলিনি।
বলেছি উপন্যাস লিখতে গেলে এই ভাষা-ভঙ্গি কতটা স্বকীয় মনে হবে সেকথা।
এই ভাষা-ভঙ্গিতে লিখলেও লেখক খূব ভালো লেখক হিসেবেই চিহ্নিত হবেন।
তবে নিজস্ব ভাষা-ভঙ্গি তৈরি করতে পারলে এই লেখক খ্যাতি নিয়ে বেঁচে থাকবেন।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

শ্যাজা এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ শোমচৌ।
আপনার পরামর্শ মনে রাখব। ‌


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

ভাস্কর এর ছবি

পইড়া আরাম পাইছি...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

বিপ্লব রহমান এর ছবি

অসাধারণ!

সামহোয়ারিনে আপনার তিতাস পর্বগুলো আগেই পড়া। তখন থেকেই আপনার লেখা নিয়ে এক ধরণের বিস্ময় আর মুগ্ধতা তৈরি হয়েছে।

এই লেখাটি পড়েও একই অনুভূতি হলো; কিছুতেই যেনো ঘোর কাটে না।

ক্যারি অন!

(ছোট্ট একটি অনুরোধ। আমার মতো ক্ষীণ দৃষ্টির অনলাইন পাঠকের জন্য ছোট ছোট প্যারায় লিখলে চোখের আরাম হতো।)


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

সৌরভ (অফলাইনে) এর ছবি

ভাল লাগলো দিদি!
আমার ডায়রিতে যদি এরকম পাতা থাকতো।

কারুবাসনা এর ছবি

কেলো করেছে!
আরে পাতাটাতা কি ছেড়ার জিনিস?


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

নিঘাত তিথি এর ছবি

খুব ভালো লাগা অনুভূতি জন্ম নিলো আপু।

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

পোস্টানোর সময় চোখ বুলিয়ে যাওয়ার বেশি কিছু করার সময় ছিল না। ঠিক করেছিলাম সময় নিয়ে পড়বো পরে। খুব ভাল লাগলো। উপন্যাস লিখলে খুব ভাল করবেন, এটা আমারও মত। পথঘাটে এরকম ছেঁড়া পাতা বিলিয়ে দিলে মূল ডায়েরির খোঁজেই বাঙ্গালি পাঠক জাতি হয়ে উঠবে।

মধুশ্রী এর ছবি

খুব সুন্দর লিখেছেন, শ্যাজুদি। এই অল্প পরিসরের মধ্যেও, বিভিন্ন চরিত্রের খুঁটিনাটি বর্ণনা, পারিপার্শ্বিকের সুস্পষ্ট চিত্রায়ন, বিশেষতঃ সময়ের ব্যবহার (বর্তমান থেকে ধীরলয়ে অতীতমুখী)...এই সব কিছু চোখে পড়েছে। ভাষাও সহজ সাবলীল। খুব ভালো লেগেছে।

মধুশ্রী

শ্যাজা এর ছবি

মধু,
এবার তুই লিখতে শুরু কর।

বিপ্লব,
আরো ছোট প্যারাগ্রাফ?

ধন্যবাদ সৌরভ।

ইশতিয়াক,
আপনাকেও ধন্যবাদ।

ভাস্কর,
আছেন ক্যামন?

তিথি,
হাসি


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।