নির্বাণ

সুমন চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন সুমন চৌধুরী (তারিখ: রবি, ২০/০৪/২০০৮ - ৫:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চার নম্বর ট্রাম ধরে যখন কোয়নিগস্ প্লাৎসে পৌঁছলাম তখন রাত সোয়া বারোটা। আমার ডেরা আর মাত্র দুটো স্টপেজ পরে। ট্রাম দাঁড়িয়ে থাকবে এখানে আরো পাক্কা দশমিনিট। খাওয়া হয়েছে ফাটাফাটি। রুইমাছ ভুনা, গরু ভুনা, উৎকৃষ্ট ডাল, পাঁচমিশালী সব্জি....রীতিমতো আকণ্ঠ খাওয়া যাকে বলে। শরির ছেড়েই দিয়েছিল। শেষ ট্রাম মিস করার ভয়ে ধুপধাপ নেমে আসতে হয়েছে। ট্রামে জায়গা পেয়েছি মুখোমুখি চারজনের সীটে। ভুড়িটাকে সীটের সাথে পয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণে রেখে বসে আছি প্রায় কুড়ি মিনিট। এখানে ট্রাম বদলাতে নামতেই হবে। ধীরে সুস্থে উঠে বাইরে এলাম। এক নম্বর ট্রাম সামনেই দাঁড়িয়ে। উঠবো? বাতাসটা ভালো লাগছে। তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ১৪‍° সেন্টিগ্রেড। হাঁটি। হেঁটে বাড়ি ফিরতে গদাইলস্করী চালে পনের মিনিট, হন্ হন্ করে আট মিনিট।

ওবারমাইয়ার নামে একটা বেশিদামী জামাকাপড়ের দোকান ছিল এখানে। কিছুদিন আগে তারা পাততাড়ি গোটানোয় ওখানে এখন অনুর্ধ ১০ ইউরো মূল্যমানের দোকান। তারপর একটা চুলকাটার দোকান। দিনের বেলা সেখানে বাইরে থেকে উত্তেজিত বালিকাদের কাঁচি হাতে তৎপর দেখা যায়। তারপর ফার্স্ট ফুডের দোকান পেরিয়ে ডান দিকে একটা চিপা গলি। সেখানে একটা ইতালিয়ান রেস্তোরা আছে। ভাবসাব দেখে বোঝা যায় অন্তর্বাস বন্ধক রেখে আসতে হবে ওখানে পালং শাক চচ্চরি খেতে গেলে। গলির মুখ পেরিয়ে ইজিক্রেডিট নামে কোনএক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠাণ, তারপর চিবো'র ছোটখাটো ক্যাফে, তারপর এক সর্দারজীর দোকান। সেখানে শুধুই রমনীয় আভরণ, বিশেষত: অন্তর্বাস বিক্রি করা সর্দারজী বেশ হাসিখুশী লোক। সর্দারজীর দোকান পেরিয়ে আরো একটা গলি আর তারপর একটা বেয়াটেঊযে(Beate Uhse) নামের বিশ্বখ্যাত দুষ্টুবিপণী। রাত যতই বাড়ুক এর বাইরে সর্বদা কিছু নিরব তামশগীরকে ইত:স্তত ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। বাইরের ডিসপ্লেতে এবারের রেপ্লিকাটা জমেনি। গতবারের আগেরবার ক্রিসমাসেরটা ভালো ছিল। স্টেয়ার্ণের মোড়ে এসে সিগনালে হাত দিলাম। লাল বাতি জ্বলে আছে। গাড়ি রাস্তায় নেই বললেই চলে। তারপরো দাঁড়িয়ে থাকি। তাড়া নেই। বাড়ি গিয়েই বালিশে মাথা দেবো।

স্টেয়ার্ণ পার হতেই চাপটা টের পেলাম। রাস্তার ওপারে শ্লেকারের সামনে এসে একবার বুকভরে শ্বাস নিলাম। অনেক সময় কাজে দেয়। কিসের কি? মনে হলো একটা বড়ো মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি.....বহুদূর থেকে ঢাকের বাদ্য শুনতে পাচ্ছি। বাড়ি পৌঁছতে কমপক্ষে আরো পাঁচ মিনিট। পা চালাই। বিপত্তি বাড়তে থাকে। থামা চলবে না। টুপির দোকানের সামনে একটু থামতে গিয়ে কেঁপে উঠলাম। এবার ঢাকের সাথে করতাল যোগ হল। ...মিঠুনের প্লেব্যাকে কিশোরকুমারের গান....ও দাদুরে ...দেখলে কেমন তুমি খেল...চট করে আবার তাল বদলে....ঢোল বাজে ঢোল বাজে ঢোল বাজে ঢোল!...ঢাম ঢাম বাজে ঢোল....কোনছবির গান?...হ্যা...মনে পড়ছে.....হাম ঢিল দেচুকেসানাম। এইজায়গায় রাস্তাটা ঢালু। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। জুতার ভেতরে পা...তার গায়ের মোজা ভিজে চুপচুপ করছে টের পাচ্ছি। গোড়ালি থেকে খানিক উপরে হাঁটুর নিচে মাসল্ কামড়াচ্ছে। কাঁধ কামড়াচ্ছে। শ্বাস নিতে ভয় পাচ্ছি। হন্ হন্ হেঁটে পার হতে চেয়েছিলাম। হপলা'য় এসে আবারো সিগন্যাল। দাঁড়ানো খুব বিপজ্জনক। লাল বাতি জ্বলেই আছে বোকার মতো। সোজা হাঁটা দিলাম। যা হয় হবে। ঠিক পেছন দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল। জানালা দিয়ে এক ছোকরা মধ্যমা দেখালো। আমি সোজা হাঁটি। মাথা চক্কর দিচ্ছে। চোখে অন্ধকার দেখছি। মুক্তমঞ্চের সামনে এসে পকেট হাঁতড়াই। চাবি কৈ? না আছে । চাবি হাতে নিয়ে এগোতে থাকি। সামনে প্রতিবন্ধক। মেরামত চলছে। আকাশে ফাটল ধরতে শুরু করছে। বেশী লম্বা কদম বাড়াতে পারছি না। ঘুরপথে আসছি। ডিপার্টমেন্টের সামনে হাউজ মাইস্টারের শেফার্ডটা বসে আছে। আমাকে তেমন ভালোবাসে না। গড়গড় করছিলো হয়তো। হয়তো না। জানিনা। আরো প্রায় তিরিশ কদম। চোখের পাতা ঘেমে যাচ্ছে। একফোঁটা ঘাম গড়িয়ে গাড়িয়ে দাড়ির অরণ্য পেরিয়ে গলার ভাঁজে এসে থামলো মনে হয়। দরজায় ধাক্কা খেলাম। চাবি ঢুকছিল না। কানের দুপাশে দুটো ঢাক বাজছে। করতালে বাড়ি পড়ছে দু চোখের মাঝামাঝি খুলির ভেতরের দিকে কোথাও। সিড়ির সুইচ টিপতে দেখি বাতি ফিউজ। ধাপগুলি একেকটা শতাব্দীর মতো...........

মিনিট তিরিশেক পরে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙি। ফ্লাশের অনুপ্রাসে ক্রমশ হারিয়ে যায় চৈত্র সংক্রান্তির পালা।


মন্তব্য

সবুজ বাঘ এর ছবি

খুব জমছে। পাউ চালাউ।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

মনে হচ্ছে কী যেন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয় নাই।
;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;
মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

এ হওয়ার শেষ হবে না জীবদ্দশায়।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

রানা মেহের এর ছবি

আপনার বর্ণনা চমতকার সুমন চৌধুরী

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

ক্যামেলিয়া আলম এর ছবি

বর্ণিল--------
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

পরিবর্তনশীল এর ছবি

কিছু একটার অপেক্ষায় ছিলাম।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

অভিজ্ঞতালব্ধ সূত্র: ‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍এই রকম অবস্থায় টয়লেটের দূরত্ব ও চাপ বিপরীত আনুপাতিক অর্থাত্ দূরত্ব যতো কমতে থাকে, ততো বাড়তে থাকে চাপ।

দিনের বেলা সেখানে বাইরে থেকে উত্তেজিত বালিকাদের কাঁচি হাতে তৎপর দেখা যায়।

বালিকারা উত্তেজিত কেন, বোঝা গেল না হাসি

ভাবসাব দেখে বোঝা যায় অন্তর্বাস বন্ধক রেখে আসতে হবে ওখানে পালং শাক চচ্চরি খেতে গেলে

অ্যাতো দামি অন্তর্বাস পরেন আপনি? অ্যাঁ

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আমি একগামী পুরুষ। একমাত্র নারীদের ভালোবাসি চোখ টিপি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আপনার এম্পিরি ১০০% সঠিক।

বালিকা উত্তেজিত, উত্তেজিত চুলালাদের ভালোবেসে দেঁতো হাসি

হুম এইটা ভুল হইছে। অন্তর্বাস সহ সবকিছু প্রকৃতমূল্যে রাখলেও কিছু টাকা বাকি থাকতে পারে...মন খারাপ



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

যাত্রাবিবরণী ভালো লাগছে।
ইংরেজিতে না লিখলে দুষ্টুদোকানটারফজিলত বুঝতাম না। (গুগল ছিল, ভাগ্যিস!)

সুমন চৌধুরী এর ছবি

তোমাগো ঐখানে নাই?



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

চোখে পড়ে নাই।
এইখানে আদম-হাওয়ার কাজকারবার বেশি। রক্তমাংসের জীবনধারা। হাঁড়িপাতিলপুতুলপিস্তলখেলনার ডিমান্ড নাই।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

এটা কি শুধুই "গল্প" গল্প নাকি জীবনের "বাস্তব" গল্প? হাসি

সুমন চৌধুরী এর ছবি

দুইটাই। দেঁতো হাসি



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

তীরন্দাজ এর ছবি

এখন ভাল আছেন তো?

**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সুমন চৌধুরী এর ছবি

হ্যা দেঁতো হাসি



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আপনার বর্ণণাশৈলী মুগ্ধ করার মতো !
খুবই ভালো লাগলো।
সিচুয়েশন সত্যিই জটিল ছিল !

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।