ক্নাইপে ইন ডি একে ৩

সুমন চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন সুমন চৌধুরী (তারিখ: রবি, ০১/০৭/২০০৭ - ১:৪২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এরপর টানা বহুদিন যাওয়া হয়নি নানা ব্যস্ততায়। আসলে মাসে অন্তত দুই রবিবার কোন না কোন প্রোগ্রাম থাকে। আর সোমবারের ক্লাস-সেমিনার-কামলার কথা ভেবে রবিবারগুলো দুপুর থেকেই একরকম পানসে হয়ে আসে।

২০০৫ এর গ্রীষ্মকালীন ছুটি। উর্ধ:শ্বাসে কামলা চলছে। উইকেন্ডগুলোকে মনে হয় অমৃত। কোন এক শুক্রবার কামলা থেকে একটু তাড়াতাড়ি ছাড়া পাওয়া গেল। পকেটের দিক থেকে দেখলে দু:সংবাদ। কিন্তু হপ্তাভরে কাজ করে প্রাণ হাঁফিয়ে উঠেছিল। আগস্ট মাসের রাত ন'টা মানে বাইরে খটখটে রোদ। বাড়ির কাছাকাছি আসতে আবারো পাপবুদ্ধির সুড়সুড়ি। আল্ট মার্ক্টে নেমে পড়লাম বাস থেকে। সোজা দক্ষিণে হাঁটতে হাঁটতে মিনিট দশেকের মধ্যে ক্নাইপে ইন ডি একে

পাবের মালিক হেয়ার ক্লুগ ছিলেন বারে। দেখেই হৈ হৈ করে উঠলেন।আরে সুমন আসছে!সুমন আসছে!মুখে এক্টা হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও মন কেমন খচ্ খচ্ কর‌ছিল। শেষতক মদের দোকানের জনপ্রিয় ক্রেতা! তাও আবার বার দুই সাক্ষাতেই!যাই হোক। ভদ্রলোক আসলে নিতান্তই ভালো মানুষ। ঐ দোকানে নাকি গত ৩৫ বছরে আমি ছাড়া কোন অজার্মান আসে নি এক গালিয়েভা মারুশভা ছাড়া। আমাকে ভদ্রলোকের পছন্দ কারণ আমার মতো শান্ত শিষ্ট ক্রেতা নাকি উনি কদাচিৎ দেখেছেন। সপ্ততিপর বুড়োরা প্রায়ই নাকি ভাংচুর করেন। কিংবা হঠাৎ টাল হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন। তখন নানান ঝামেলা করে বাড়ি পৌছে দিতে হয় তাদের। যদিও এই বারটা তিনি করেছিলেন মূলত বুড়োদের জন্য কারণ তিনি নিজেও একজন বুড়ো। পশ্চিমের নি:সঙ্গ বুড়োরা অন্তত একটু মাতালামিও যদি না করতে পারে তবে বাকি দিনগুলো অহেতুক জীবিত থাকার দরকার কি...ভদ্রলোক ইত্যাদি জ্ঞানের কথা চালিয়ে গেলেন টানা মিনিট বিশেক। তারপর বল্লেন আজকের প্রথম পেগ আমার পক্ষ থেকে খাও। দিলেন ডবল পেগ। জ্যাক ডানিয়েলস আমার বরাবরই ভালো লাগে। হাসি মুখে কয়েক কোয়া বাদাম মুখে দিয়ে বললাম, গালিয়েভা মারুশভা কে?

আহ্ গালিয়েভা...সবাই ডাকতো গালা। সম্ভবত '৯১ এর মাঝামঝি। তখন ডেডেআর থেকে হুড়মুড় করে লোক ঢুকছে। অ্যারফুর্ট থেকে হেনরিক ক্নাপ আর গালিয়েভা এসে বাসা ভাড়া চাইলো আমার কাছে। আগাম ৭০০ ডয়েশ মার্ক দিতে রাজি হওয়ায় আমি বললাম ঠিকাছে।

কি যে স্নিগ্ধ ছিল মেয়েটা বললে বিশ্বাস করবা না। শনিবার বিকালের দিকে আসতো। প্রায়ই হেনরিক কাজে থাকতো সেই সময়। এসে নিজে থেকেই বীয়ার নিয়ে লিখে রাখতো। সবার সাথে কথা বলতো হাসিমুখে। তারপর গান গাইতো। পোস্টডাম এলাকার লোকসঙ্গীত। মন ভরে যেত গান শুনে। গাইতে গাইতে চোখ ভিজে যেত।বেলারুশ থেকে এসেছিল ওর বাবা-মা। এক প্রজন্মেই জার্মান হয়ে গেছে। তবে এই মিষ্টি গলা, এই মেলোডি আমার কাছে একেবারেই জার্মান নয়। মাঝে মাঝে ফরাসী গানও গাইতো। এডিথ পিয়াফের গানগুলো বিশেষ করে ..রীতিমতো শুনলে পুরো পাড়া চুপ মেরে যেতো...

তারপর? আমি মৃদু করে জিজ্ঞাসা করলাম। ততক্ষণে তৃতীয় পেগ চলছে।

শালার হেনরিক। ব্যাটা শুরু থেকেই যাই যাই করছিল। প্রায়ই আনার সাথে ইটিস পিটিস করতো বিলিয়ার্ড খেলার ফাঁকে।

- আনা কে?
- আনা? একসময় আমার বউ ছিল ...এখন হেনরিকের সাথে থাকে পাডেরবর্ন এর কাছাকাছি কোথাও।

- আর গালিয়েভা?
- ওদের টানাটানি দেখে বলতাম আমার দোকানে মাঝে মধ্যে যে গান করো তার বাবদ কিছু নিও...বললো সেটাতো মনের আনন্দে করি..টাকা নিলে ঐটুকুও হারাবো। একটু খানি আর্থিক নিশ্চয়তার আশায় জন্মভুমি ছেড়েছি। আর কতো ছাড়বো?কথাটা মনে দাগ কেটে গেল। আনার সাথে
হেনরিকের সম্পর্কের কথা ওর কাছেই প্রথম শুনি। খুব কাঁদছিল সেদিন। বললাম জীবন এরকমই বিচিত্র ইত্যাদি..তার কান্না থামেনা..এই হেনরিকের জন্য সে পোস্টডাম ছেড়েছে..এরপর কোথায় যাবে?

দরজা হঠাৎ খুলে গেল। একাট জার্মান শেফার্ড হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো। এসেই ক্লুগের কোলে। পিছনে ফুটফুটে মধ্যবয়সী স্লাভ সুন্দরী।

কোঁৎ করে পঞ্চম পেগ গিলতে গিলতে বললাম, কারো না কারো সাথে কোথাও না কোথাও ভালো থাকাটাই জরুরি..


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

গুট গেফ্রোরেন।

শেষের কথাটা সত্যি। ভালো থাকাটাই জরুরি।


হাঁটুপানির জলদস্যু

সুমন চৌধুরী এর ছবি


.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

ঝরাপাতা এর ছবি

ভালো থাকাটাই জরুরী এবং খুব কষ্টকরও বটে। কতই না দীর্ঘশ্বাস মানুষ এক জীবনে বয়ে চলে।
_______________________________________
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- গালা'র লাইগ্যা মনডা খারাপ হইলো। মন খারাপ
_________________________________
<স্বাক্ষর দিমুনা, পরে জমিজমা সব লেইখা লইলে!>

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ভালো থাকার চেয়ে নিজের মতো থাকাটা আরো জরুরী আরো দুর্লভ ।
ভালো কথা মিঃচৌধুরী, একটা সিরিজের আবদার কিন্তু রাখা হয়েছিলো আপনার কাছে । ভরসা রাখি ভুলে যাননি ।

-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

মনে আছে জনাব। একটু চিপাত্তীর্ণ হইয়া লই...
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

গল্পটা কি সত্য সত্যই এরকম।
নাকি আমাদেরকে চাঙ্গা করতে আপনি শেষে আইসা রস দিলেন?

লেখকদের দুনম্বরি আর প্রতিভায় বড় মুগ্ধ হয়া পড়ি।
-----------------------------------------------
গাধারে সাবান দিয়া গোসল দেয়ানোটা গাধাপ্রীতির উজ্জ্বল নমুনা হতে পারে; তবে ফলাফল পূর্বেই অনুমান করা সম্ভব, গাধার চামড়ার ক্ষতি আর সাবানের অপচয়।

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

সুমন চৌধুরী এর ছবি

বেশীরভাগ গালিয়েভার জীবনে আরো অনেক গভীর ট্রাজেডি থাকে। এই গালিয়েভা বাইচা গেছে বলা যায়...
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

Ausgezeichnet! Ihn bitte oben halten!

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- হেহ হেহ হেহ, শিমুল কি কইবার চায় বদ্দাচল?
_________________________________
<স্বাক্ষর দিমুনা, পরে জমিজমা সব লেইখা লইলে!>

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ক্যানো? জার্মন ভাষা হয় নাই?

সুমন চৌধুরী এর ছবি

হৈছে।
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

Vielen Dank, Bruder!

দ্রোহী এর ছবি

হায়রে, খালি মালের আলাপ!
__________
কি মাঝি? ডরাইলা?

সুমন চৌধুরী এর ছবি


.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।