আমরা কি আরও ৩৫ বছর অপেক্ষা করব?

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৫/০৬/২০০৭ - ২:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পূর্ণ হলো বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের অমরদেহ দেশে ফেরার ১ বছর। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পাকিস্তান থেকে তাঁর অমরদেহ ফেরত এনে সমাহিত করা হয় এখানে। এই মহা জটিল কাজটা করতে আমাদের মাত্র ৩৫ বছর লেগেছে!
কেন? এর পেছনে অবশ্যই আছে নানা কাহিনী। এখানে সমাহিত করার পেছনেও আছে মজারসব কাহিনী।

বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ বীরবিক্রম হামিদুল হোসেন তারেক- এর সঙ্গে একবার আমার কথা হচ্ছিল। তাঁর কাছ থেকেই জানলাম, মতিউর রহমানকে খানিকটা বাইরে সমাহিত না করা হলে একজনের সমাধিস্থলের গুরুত্ব নাকি কমে যাবে। ফেরত আনার বিলম্বের জটিলতার এটাও একটা কারণ! বেশ, যা হোক।

তো, ১ বছরেও আমরা মতিউর রহমানের মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের প্রস্তাবিত এপিটাফ স্থাপন করতে পারিনি,এখনও। এটাও ভাল, হয়তো আরও ৩৫ বছর লাগবে আমাদের এই মহা মহা জটিল কাজটা করতে।

আমারমতে, যে জাতি তার বীর সন্তানদের সম্মান দেখাতে কুন্ঠিত হয়- সে জাতির চেয়ে অভাগা আর কেউ নাই।

মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমান দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছেন একটি সিদ্ধান্তের জন্য। কবে তাঁর মতিকে ফেরত আনা হবে।
একটি দৈনিকে মর্মস্পর্শী ভাষায় লিখেছিলেনঃ
মতিউরের জন্য একটু জায়গা...
প্রতিটি মানুষেরই একটি ঠিকানা থাকে, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানেরও ছিল।
’৭০-’৭১ সালে সেই ঠিকানা ছিলঃ ১৯/২ অফিসার্স ফ্যামিলি কোয়ার্টার, মসরুর বেস, করাচি, পশ্চিম পাকিস্তান।
এখনো মতিউর রহমানের একটা ঠিকানা আছেঃ চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থান, মসরুর বেস, করাচি, পাকিস্তান। শুধু ঘর বদলেছে আর বদলেছে নম্বর। তবে আগে ঘরটি ছিল মাটির ওপর, এখন মাটির নিচে। নতুন ঘরের নম্বর আমার জানা নেই, আর কেউ জানে কি না তাও জানি না।

ভালবাসার মানুষটির জীবনের বিনিময়ে আমার কিন্তু একটা নতুন ঠিকানা হয়েছে। আমি এখন বাংলাদেশী। ‘৭১-এর ২৯ সেপ্টেম্বর ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে বোনের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে ভালোবাসার মানুষটিকে ভিনদেশে ফেলে বাংলাদেশে চলে আসি।

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। মতিউরের ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরুপ তাকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হলো। কিন্তু কেউ তার ঠিকানা বদলাতে সচেষ্ট হলো না। আমরা সবাই বাংলার মাটিতে নতুন করে ঘর বাঁধলাম, কিন্ত আমার মতির জন্য এতটুকু জায়গা পাওয়া গেল না।
আমি কিন্তু এখনো ভোর বেলা হাঁটতে গিয়ে বকুলতলা থেকে দুহাত ভরে ফুল কুড়িয়ে আনতে পারি, শোবার ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পারি শিউলিতলায় ছড়িয়ে থাকা ফুল, শুনতে পারি বাড়ির ছাদে পোষা পায়রার বাকবাকুম।

...আমি এক অক্ষম স্ত্রী। ৩৩ বছরেও আমার মতির ঠিকানাটা আমি বদলাতে পারিনি।

...২০০৩ সালের ৩১ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ভিত্তি স্থাপন করা হয় শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্মৃতিসৌধ। ভিত্তি স্থাপন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী রেদওয়ান আহমেদ চৌধুরী। সেদিন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের কবর স্থানান্তরিত করার কথা উঠলে এমন কথাও বলা হয় যে, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরও তো চট্টগ্রাম থেকে উঠিয়ে ঢাকায় এনে দাফন করা হয়েছিল।
কদিন আগে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতকে ইসরায়েলের প্রবল বাধার কারণে তার প্রিয় শহর জেরুজালেমের পরিবর্তে রামাল্লায় দাফন করা হয়। ফিলিস্তিনিরা স্বপ্ন দেখছে তাদের প্রিয় নেতার কবর একদিন জেরুজালেমে স্থানান্তরিত করার। সে জন্য তাকে পাথরের কফিনে সমাহিত করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, কবর স্থানান্তরিত করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বাঁধা নেই। সার্ক দেশভূক্ত পাকিস্তানেরও কোনো আপত্তি থাকার কথা না...।

--------------------------------
সাপ্তাহিক ২০০০-র সঙ্গে মিলি রহমান:
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের কবরটা...
...সিতারায়ে হরর’ খেতাবে ভূষিত, ডেভিল ডেয়ারখ্যাত অতিশয় দক্ষ পাইলট মতিউতর রহমান পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর সব কর্মকর্তাকে ফাঁকি দিয়ে মাসরুর বিমানঘাঁটি থেকে অবাঙালী ছাত্র বৈমানিক রশিদ মিনহাজসহ একটি T-৩৩ বিমান হাইজ্যাক করে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন ২০ আগষ্ট ১৯৭১ সালের শুক্রবার।

এ ভয়াবহ কাজে তাকে সহায়তা করেছিলেন তাঁর স্ত্রী মিলি রহমান। সমস্ত ঝুঁকি মাথায় নিয়ে দুই শিশুসন্তানসহ থেকে গিয়েছিলেন মৌরিপুর বিমানবাহিনীর অফিসার্স মেসে। ভারতীয় সীমান্ত থেকে ৩ মিনিটের দূরত্বে থাকতেই মরুভূমিতে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। অবাঙালী ছাত্র-বৈমানিক রশিদ মিনহাজসহ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান নিহত হন।

রশিদ মিনহাজকে সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব ‘নিশানে হায়দার’-এ ভূষিত করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে গাদ্দার বা ট্রেইটর চিহিßত করে মতিউর রহমানকে সমাহিত করা হয় অনাদরে-অবহেলায় তীব্রতম ঘৃণার সঙ্গে ঐ বিমানঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত কবরস্থানে।
বিমানঘাঁটির মূল প্রবেশদ্বারে টাঙিয়ে রাখা হয় রশিদ মিনহাজের ছবি সমরবীর হিসেবে। জানানো হয় অভিবাদন। অন্যদিকে মতিউর রহমানের ছবি টাঙিয়ে গাদ্দার হিসেবে থুথু ছিটানোর ব্যবস্থা করা হয়।

...এরপর আসে ২০ আগষ্ট, ১৯৭১ শুক্রবার। সে দিনের কথা স্মরণ করে মিলি রহমান বলেন, রাতে দেখলাম মতি ঠিক ঘুমুচ্ছে না। বারবার আমাকে আর বাচ্চাদের দেখছে। কিন্তু আমি তাকালেই আবার শুয়ে পড়ছে। সকালে উঠে স্বাভাবিক কায়দায় অফিসের পথে রওয়ানা হন তিনি। সে দিন যাবার সময় কোনো কথা হয়নি তার সঙ্গে। এমনকি প্রতিদিনকার মতো ‘খোদা হাফেজ’ বলা হয়নি মিলি রহমানের।

...২৯, সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন মিলি রহমান বোনের সঙ্গে। আসার আগে দেখতে চেয়েছিলেন প্রিয় মতির কবর। অনেক চেষ্টার পর অনুমতি মিলেছিল। Traitor of the Nation ক্যাপশন লেখা মতিউরের ছবি গাঁথা মূল ফটক পেরিয়ে কবরখানায় পৌঁচেছিলাম অবশ্য। নামতে দেয়া হয়নি। গাড়িতে বসেই দূর থেকে একনজর দেখা। প্রিয়তম মানুষের কবর দেখা!

...'এতো তিক্ততা যেন আর কারো জীবনে না আসে। আমি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী। সবখানে যাবার সুযোগ ছিল। সামাজিক এই মর্যাদা, সম্মান, পরিচিতির পরও আমাকে যে তিক্ততার স্বাদ নিতে হয়েছে, তাতে আমার সব সময় মনে হয়েছে সাধারণ মেয়েদের অবস্থা তাহলে কত শোচনীয়, কত দুর্দশাগ্রস্ত!
এটা যে কী সাংঘাতিক জিনিস বলা মুশকিল। যেই বুঝল আমার স্বামী নেই ওমনি আমি যেন বেওয়ারিশ জিনিস।কোনো খুঁটি নেই, যা ইচ্ছে তাকে নিয়ে যেন করা যায়।
অশ্রুসজল হয়ে উঠেন তিনি। বলেন, ‘বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, ছয়টা হরমোন ইনজেকশন নিতে হয়েছে আমাকে শুধু মোটা হবার জন্য। যাতে আমাকে বয়সী দেখায়। ভারিক্কি দেখায়। বয়স বাড়ানোর জন্য আমার মতো মানুষকে বাধ্য হতে হয়েছে এই ইনজেকশন নিতে। তাহলে বোঝেন অন্য মেয়েদের, নারীদের অবস্থা...'।

...৩৪ বছর ধরে তো কেউ ইতিহাস লিখল না। সেই ইতিহাসের কথা তো আমাকেই লিখতে হলো।

...এমনকি আমার নিজের পরিবারেও লিখবার মতো যোগ্য লোক ছিলেন। আমার দু’বোনজামাই আলাউদ্দিন আল আজাদ ও মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামানের মতো লোক ছিল। তারাও তো লিখতে পারতেন। কেউ তো লিখল না। বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে এখানে ওখানে নানাভাবে লেখা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ে আছে। জাহানারা ইমাম লিখেছেন। কিন্তু আমার জানামতে, বিস্তৃত করে পুরো জীবন জানবার মতো করে তাদের নিয়ে লেখা হয়নি।
আমি অন্তত বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরকে (বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর স্মারকগ্রন্থ)নিয়ে সে চেষ্টাটা করলাম।


মন্তব্য

অরূপ এর ছবি

আগুন
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নিবোর্ধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!

নজমুল আলবাব এর ছবি

আগুনের চাইতেও বেশি কিছু।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

হায় পোড়াদেশ!

--------------------------
আমি সত্য না হইলে গুরু সত্য কোনকালে?

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

মতিউর রহমানকে নিয়ে একটা ছবি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে শুনেছি। ওয়েবে কোথাও কি দেখা যায় সেটা শুভ?
বুঝতে পারি না, এপিটাফ লাগানোতে কি এমন জটিলতা? কেন এত দেরি?

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বাংলাদেশ এখন অনেক ব্যস্ত মিঃ চৌধুরী ।ব্যারিষ্টার হোসেইন নারীগমনের সময় ও বের করতে পারছেননা, রাষ্ট্রচিন্তায় ।
--------------------------
আমি সত্য না হইলে গুরু সত্য কোনকালে?

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অমি রহমান পিয়াল এর ছবি

আইরনি বলতে পারেন, তারপরো মতিউর অনেক হাইলাইটেড বাকিদের চেয়ে। অনেকের সম্পর্কে কিছুই জানা নাই। শুভ লিখবেন একটা সিরিজ?

তুমি হাসো, আমি কাঁদি, বাঁশি বাজুক, কদম তলেরে...


তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

শুভ, ছবি তৈরি হয়েছে, সেই ছবি বসুন্ধার স্টার সিনেপ্লেক্সে দেখানো হয়েছে, মিলি রহমান তাতে এসেছিলেন, পরিচালক নিজে মতিউরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছবি বানানোর টাকা দিয়েছেন, এটুকু খবর পড়েছিলাম মনে আছে। যেকোনো দৈনিকের সিনেমা বিটের সাংবাদিক বলতে পারবেন।

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।