সেই মেয়েটা ভেলভেলেটা - ২

দময়ন্তী এর ছবি
লিখেছেন দময়ন্তী (তারিখ: রবি, ১৮/০৩/২০১২ - ২:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্ব

"ত্বকের যত্ন নিন'------

নিনির ছোটদিকে দিব্বি খাপচু দেখতে। আগে নাকি গায়ের রং একটু মাজামাজা ধরণের ছিল। মানে ওর মামাদের মত অত টুকটুকে ফরসা ছিল না। তা বড়মামী ছোটদিকে প্রত্যেকদিন কাঁচা হলুদ আর মুসুরির ডাল বাটা মাখাত। শীত গ্রীস্ম, জ্বর পেটখারাপ সবেতেই। কলেজে যাওয়ার আগে পর্যন্ত চলেছে এই রুটিন। সপ্তাহে একদিন সরষের খোলবাটা মাখাত। নিনির এটা খুব মজা লাগত লালী-বুলির খাবার জিনিষ ছোটদিকে মাখতে দেখে। তা এক রবিবারে দেখা গেল সমস্ত খোল লালী-বুলির জাবনায় দেওয়া হয়ে গেছে এদিকে দোকান থেকে বিকেলে দিয়ে যাবে। তাহলে সপ্তাহান্তিক খোলচর্চার কি হবে? নিনি তো দোকানে যেতে দুই পায়ে দৌড়। পাড়ার শিবুদার দোকানে গিয়ে বলে "আড়াইশো খোল দাও তো।" শিবুদা জানে ওদের বাড়ী দুটো গরু। আড়াইশোয় কি হবে? বাচ্চা মেয়ে, ভুল তো হতেই পারে। তাই জিগ্যেস করে "আড়াইকিলো তো?" নিনি বলে "না না আড়াইশো।" পোটেনশিয়াল খদ্দের হারাতে না চেয়ে শিবুদা বলে "তুই বরং ১ বার বাড়ী থেকে জেনে আয়।" এবারে নিনির কিন্তু খুব প্রেস্টিজে লেগেছে। ও সবিস্তারে জানায় কেন আড়াইশো গ্রামই দরকার। ব্যাস ঘরে ঘরে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। দুদিন বাদে স্কুল থেকে ফিরে নিনির কি হেনস্থা। কি না সবাই নাকি ছোটদির খোলচর্চার কথা জেনে গেছে। তা গেছে তো গেছে কি হয়েছে? কে জানে কি হয়েছে! কিন্তু নিনি জানতে থাকে "সারাদিন বই মুখে নিয়ে বসে থাকলেই কি আর বুদ্ধি গজায়!। পড়ে তো যত রাজ্যের গপ্পের বই তা এই হবে না তো কি!" জানতে থাকে শ্বশুরবাড়ীতে গেলে ওর খুব মুশকিল হবে, কারন ওর তো আর কোন কান্ডজ্ঞান নেই। আবার শোনে এইসবই হল ওর বদমাইশী, নিজেও ফাটা ফাটা গোড়ালী নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর তাই ছোটদিকে এইভাবে অপদস্থ করেছে। চেঁচামেচি করেও কাউকে বিশ্বাস করাতে পারে না যে ও কোনকিছু ভেবে দোকানদারকে বলে নি। মাকেও না। আরো শোনে নানার বৌকেও নাকি ওর জন্য খুব কষ্ট পেতে হবে।

নিনি আর চেঁচায় না। চুপ করে যায়, গম্ভীর হতে শেখে। খুব একটা দৌড় ঝাঁপ করে খেলতে পারত না, তবে খেলতে যেত রোজ বিকেলে মাঠে। সবার সাথে হইচই করতে খেলতে বেশ লাগত। তা দিদা হঠাৎ বলে দিল আর কারো বাড়ী গিয়ে খেলতে হবে না। ওরা তখন শুভ্রাদের উঠোনে খেলত। নিনিদের বাড়ী কেউ আসতে চায় না, নিনির মানা হয়ে গেল অন্যদের বাড়ী যাওয়া। ব্যাস খেলাধুলো শেষ। সত্যি তো ছোটদি বেশী লোকের সাথে মিশতে পারে না, কথাও বলতে পারে না, আর নিনি সারাক্ষণ হ্যা হ্যা করে যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে, আর সব কাকীমা জ্যাঠিমারা কেবলই বলে যান এসে এসে "আহা মুন্নি আর নিনি দেখো একেবারে দুইরকম, মুন্নি খুব শান্ত, তবে নিনি আমাদের ভারী মিশুক। নিনিকে কিছু বল, সবসময় হাসিমুখ।" আরো কত কি। তা দিদা হয়ে তাঁর একটা কর্তব্য নেই মুন্নির বদনামের প্রতিকার করার! তাই তিনি করেন। নিনির তো বাবাও নেই, কিছু একটা বদনাম হলে? তাই দেবুদের বাড়ী ঝগড়া হলে "নিনি পড়তে বোসো...."। নিনি গান গাইতে গাইতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে "আমার দিন কাটে না, আমার রাত----" দিদার ক্রুদ্ধ মন্তব্য "বাঃ এখন থেকেই এইসব গান?" গানের আবার এইসব, কিসব কি? ওমা তা বললে কি হয়? এইটুকু মেয়ে এত পাকা পাকা গান কি বাপু! মুন্নিকে নাকি পাড়ার ছেলেরা কিসব বলে। পেছনে পেছনে স্কুলে যায়। তাই মুন্নির সাথে ছবির মা যায় মুন্নিকে স্কুলে পৌঁছে দিতে , নিয়ে আসতে। ছোটদি বড় হয়ে কলকাতার কলেজে চলে যায়। নিনি ফোর থেকে ফাইভ, ফাইভ থেকে সিক্স,সেভেন, এইট,নাইন উঠতে থাকে। স্কুলে শাড়ী, বাড়ীতে ফ্রক। বাইরে কখনও শাড়ী, কখনও ফ্রক। সালোয়ার কামিজ? কক্ষণো না। ওসব অসভ্য পোষাক। কিন্তু মজা হল শাড়ী পরলেই কানে আসে কিছু না কিছু গানের কলি। সবসময় যে খারাপ লাগে তাও নয়।

এদিকে বুদ্ধির ঢেঁকি হলে কি হবে, নিনির আবার ছোটবেলা থেকেই বেশ 'বাড়ন্ত গড়ন'৷ ক্লাস থ্রীতে নিনিরা কলকাতা ছেড়ে চলে এসেছিল, দাদুর বাড়ির একদিকের ভাড়াটে তুলে দিয়ে ওদের থাকা শুরু হল৷ নিনি ভর্তি হল কাছের স্কুল 'বালিকা শিক্ষা সদন' এ৷ মেথরপট্টির পাশের স্কুল, এমনিতে নিনিদের পাড়ার আর বিশেষ কেউ সেখানে পড়তে যেত না৷ বছরের মাঝখানে আর কোনও স্কুলে তো ভর্তি নেবে না, এদিকে কলকাতার সেই লাল টুকটুকে ড্রেসওলা স্কুলের মাইনে বড্ড বেশী৷ মা কোত্থেকে দেবে অত টাকা! তাই কোন্নগরে চলে আসা, এখানে মা'য়ের একটা চাকরি হয়ে যাবে, দাদু বলেছে৷ সেই স্কুলে নিনি প্রথমবারেই ক্লাসে প্রথম হল৷ কলকাতার স্কুলে তো নম্বর দিত না আর নিনি তেমন কিছু ভাল করতও না, মিসরা খুব একটা মনোযোগ দিত না ওর দিকে৷ এখানে প্রথম হওয়ায় নিনি, নিনির মা, পিপি সব্বাই খুব খুশী ----- দিদা অবশ্য বলল 'হ, ফেলের মইধ্যে ফার্স্ট , তার আবার কথা'৷ এইটা হল গিয়ে ক্লাস থ্রী'র বার্ষিক পরীক্ষার কথা৷ ক্লাস ফোরের বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিনই নিনি বড়্ হয়ে গেল৷ সে কি ভয় নিনির আর সাথে অসহ্য যন্ত্রণা তলপেটে৷ 'আমি তো আজকেই মরে যাব' ---- এই ভাবতে ভাবতে নিনি কেবলই পালিয়ে বেড়াচ্ছিল মামাবাড়ির এই কোণ সেই কোণে, বাগানের কোণাকাঞ্চিতে ---- কিন্তু আর তো পারা যায় না ------ নড়াচড়া করাই দু:সাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে! শেষে মায়ের কাছে এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে দাঁড়ায় নিনি ------ তারপর তো এক লম্বা-আ-আ গল্প৷ মায়ের বিস্ময়, এত তাড়াতাড়ি মেয়ে বড় হয়ে যাওয়ার আক্ষেপ, নানার অসীম কৌতুহল ------ মায়ের কড়া ধমক --- 'লজ্জা শরম' সম্পর্কিত শিক্ষাদান ----- পরপর দুবার ক্লাসে প্রথম হওয়ার সব আনন্দ উধাও৷

ক্লাস ফাইভে নিনি অ্যাডমিশান টেস্ট দেয় 'হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়' আর 'হীরালাল পাল বালিকা বিদ্যালয'এ৷ দুই জায়গাতেই পেয়েও যায়৷নিনির ইচ্ছে হীরালাল পালে যাবার, ওখানেই শুভ্রা, রিঙ্কু, শর্বরীরা পড়ে৷ মা তখনও চাকরি পায় নি৷ বালিকা শিক্ষা সদনের সেক্রেটারি গোপালবাবু দাদুর বন্ধু, নিনির মা'য়ের চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন৷ ওঁদের জুনিয়ার হাই স্কুলে একটা নতুন শিক্ষিকা পদ সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন জায়গায় তদ্বির তদারক করছেন৷ মা নিনির ট্র্যান্সফারের চিঠি নিতে গেলে খুব আপত্তি করেন ---- নিনি প্রথম হয়, এখন অন্য স্কুলে নিয়ে গেলে ওঁরা মাধ্যমিকে একটা মোটামুটি ফল থেকে বঞ্চিত হবেন যে৷ ওঁদের স্কুলে গত ১১ বছর একটিও ছাত্রী প্রথম বিভাগে পাশ করে নি৷ আরও বলেন শুধু দরকারে বালিকা শিক্ষা সদনকে ব্যবহার করা ঠিক নয়৷ মা ফিরে আসে ---- তিন বছর হয়ে গেল নিনির বাবা মারা যাওয়ার ---- চাকরিটা বড় দরকার ----- নিনির বাবার অফিস, ওদের গাড়ি বিক্রির টাকা ---- আরও এদিক ওদিক করে যা পাওয়া গেছে তাতে মাসের প্রথমে স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে ২০০ টাকা আর ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক থেকে ২০০ টাকা --- এই চারশো টাকা দিয়ে মাস চালাতে হয়৷ কলসীর জল ঢেলে ঢেলে খেতে থাকলে আর কদিনই বা চলবে ---- এখনও নানার পড়াশোনা আছে৷

নিনির আর ভাল স্কুলে পড়া হয় না৷ ঐ স্কুল থেকেই মাধ্যমিক দেয়৷ মায়ের চাকরি অবশ্য হয়েছিল, নিনি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে৷নতুন একটা শিক্ষিকা পদ তখন সৃষ্টি করা যায় নি ---- সদ্য আগত বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিনিধিরা নামকরা কংগ্রেসী গোপালবাবুর এই উদ্যোগ ভাল চোখে দেখেন নি -- স্বজনপোষণের অভিযোগে খারিজ করে দেন৷ নিনির মা স্কুলে যোগ দেন 'কেরাণী দিদিমনি' হিসেবে৷ ভোর চারটেয় উঠে নিনি নানার জন্য রান্না করে, টিফিন গুছিয়ে স্কুলে যেতেন --- দুটো ক্লাসের ইংরিজি আর সংস্কৃত পড়িয়ে, কেরাণীর কাজ সামলে স্কুল ছুটির পর যেতেন হাওড়া গার্লস কলেজে বি এড পড়তে৷ বি এড ডিগ্রি পেলে গোপালবাবু বলেছেন আরেকবার চেষ্টা করবেন৷

"ইয়োবন যো শুরু হো যাতা হ্যায়
থোড়ি মস্তি হোতি হ্যায়
থোড়া গর্বি লাগতা হ্যায়।'
-------------

নাইন, টেন, ইলেভেন, টুয়েলভ------ আকনা স্কুল---সমরদার কোচিঙ---- ট্রেনে বাসে রোজ যাওয়া---- শ্রীদূর্গা মিল থেকে মাস্টারপাড়ার গন্ডীটা হঠাৎ বাড়তে থাকে। কত নতুন বন্ধু। দীপান্বিতা পড়াল "বিশ্বাসঘাতক"। এখন আর মা বলে না ঐ বইটা পড়বে না--ওটা বড়দের বই। মা স্কুলে নীরাদিদিমনির কাছ থেকে নিয়ে এল "ন হন্যতে" আর "মংপুতে রবীন্দ্রনাথ"। ন হন্যতে পড়ে তো দীপান্বিতা, নিনি, জয়তি, মিমি, নন্দিনী এক্কেবারে বিহ্বল। ছন্দা পড়াল "বলাকার মন"। ভাল, তবে ন হন্যতের মত নয়। মা বলে "এবারে তুই পুরো শরৎ রচনাবলী ই পড়তে পারিস"। নিনি লক্ষ্মী মেয়ের মত ঘাড় নাড়ে। হুঁ: ওর যেন কিছু পড়তে বাকী আছে। সেই যে সব্বাই শুভ্রাদের বাড়ী খেলতে যেত আর ওকে দিদা যেতে দিত না তখন বিকেল গুলো তো ও লুকিয়ে লুকিয়ে ঐসবই পড়ত। এদিকে আজকাল টিভিতেও দেখে অনেক সিনেমা। পাড়ার কাছের চলচ্চিত্রমে এলো "শোলে" দীপান্বিতা নাকি আগে বার দুয়েক দেখেছে ওর দাদার সাথে। আরো একবার দেখার খুব ইচ্ছা। নিনি তো দেখেই নি। চলল দুজনে। ট্রেনে লেডিজ কম্পার্টমেন্টেই যায় ওরা। সিনেমাও লেডিজ সিটেই দেখবে বলে এসেছে। কিন্তু সব সিট ভর্তি। অতএব ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট। নিনির চিরকালই ধারের সিটের প্রতি অসম্ভব দুর্ব্বলতা। ও বসল প্যাসেজের ধারে। দীপার পাশে পরপর ৩ টে ছেলে। ওদের থেকে বোধহয় একটু বড়ই হবে। শোলে দেখে নিনি তো একেবারে ফিদা। এদিকে দীপা কিন্তু হল থেকে বেরিয়ে অবধি বেশ চুপচাপ। কেন রে দীপা কি হয়েছে? দীপা বলে কিচ্ছু না। দীপার মাথায় ভীষণ চুল। কোমর ছাড়ানো ইয়া মোটা বিনুনিটাও আজ তেমন করে দুলছে না দীপার হাঁটার সাথে সাথে। চলে গেল দীপা বাড়ী, ওদের বাড়ী তো ওপারে নবগ্রাম কাটাপুকুরের কাছে। নিনিও বাড়ী ফেরে একটু বিমনা হয়েই।

নিনিরা শ্রীরামপুর বটতলা থেকে স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে আসত ফেরার সময়ে। ক'দিন পরেই দেখা গেল নিনিদের স্কুল থেকে ফেরার সময়ে দীপা একটু পিছিয়ে যায়। আর একটি ছেলে সাইকেল নিয়ে আসে ওদের পাশে পাশে। দীপাকে নাকি বলেছিল ওকে ঠিক বাসন্তির মত লাগছে। দীপাকে ছোটবেলা থেকে সবাই বলত "কালো"। তাই ও প্রথমে ভেবেছিল ব্যঙ্গ। কিন্তু ওকে নাকি একটা চিঠি দিয়েছে ভীষণ সুন্দর। তাই দীপাও বুঝেছে ওটা ব্যঙ্গ নয়। কোনোদিন দীপা দিব্বি খুশী খুশী থাকে, কোনোদিন আবার ওদের ঝগড়া হয়, বেজায় মনখারাপ করে বসে থাকে। ইলেভেনের অ্যানুয়ালে দীপা রীতিমত খারাপ করল আর তারপরেই কেলো। দীপার প্রেমিক নাকি খুব খুশী হয়েছে। ওমা সে কী রে? খুশী মানে? দীপা কেমন বিভ্রান্ত হয়ে জানায় ও-ও বুঝতে পারছে না। ছন্দা আর সীমা খুব রেগে যায় --- পরেরদিন ই ধরে ওরা জেরা শুরু করল। জানা গেল ইনি নাকি হায়ার সেকেন্ডারী প্রচুর চেষ্টা করেও পাশ করতে পারেন নি। যাক কলা!! তো তাতে দীপার খারাপ রেজাল্ট হওয়ায় খুশী কেন? এইবারে হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে ছেলেটি। "তোমরা নিজেদের কি ভাব শুনি? সব সায়েন্স দেখাচ্ছ? অ্যাঁ? করবে তো সেই খুন্তি নাড়ার চাকরী তার আবার অত রেজাল্ট ফেজাল্ট কি? " সীমা, ছন্দা, নন্দিনী তো তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। নিনি আর জয়তী দেখে দীপা আস্তে আস্তে পিছিয়ে গিয়ে হাঁটা দিয়েছে। নিনি তাড়াতাড়ি দীপার সঙ্গ ধরে। দীপার মুখটা কি যে অদ্ভুত হয়ে আছে। ঠিক কাঁদো কাঁদো নয় অথচ আবার কিছু যেন একটা। দীপা কিন্তু স্টেশনের দিকে যাচ্ছে না, বরঞ্চ কলেজ মোড়ের দিকে হাঁটা দিল যে! নিনি সাথে আসছে এটা এবারে দীপার খেয়াল হয়। নিনিকে বলে তুই ফিরে যা, আমি একটু একলা একলা ঘুরব। নিনি ঘাবড়ে যায়, বোঝাতে চায় চল বাড়ী চল। একলা ছাড়তে চায় না। দীপা বুঝতে পারে, বলে তুই কি ভাবছিস আমি আত্মহত্যা করব, নারে তা নয়, তবে একটু একা একা ঘুরি। তারপরে সন্ধ্যে হবার আগেই ফিরে যাব। অগত্যা নিনি ফেরত আসে। পরে শুনেছিল দীপা নাকি ঘন্টা দুই ঘুরে তারপর বাড়ী যায়। এই ঘটনার ১০-১২ বছর বাদে নিনি শুনেছিল সেই দুটি পংক্তি

"প্রথম প্রেম ঘুচে যাবার যন্ত্রণাকে নিয়ে
কান্না চেপে ঘুরেছিলাম তোমারই পথ দিয়ে'
দীপার সাথে তখন আর যোগাযোগ নেই।

নিনি, জয়তী, দীপান্বিতা, রুমা আর ঝুমা প্রতি রবিবারে ফিজিক্স পড়তে যায় সমরদার বাড়ী। উনি প্রতিদিন কতকিছু খাওয়ান। ওঁর দুই ছোট ভাই, নিনিরা নাম দিয়েছে ব-না আর ছো-না। অর্থাৎ কিনা বড় নার্ভাস আর ছোট নার্ভাস। নিনিরা গিয়ে বেল বাজালে এদের দুজনের একজনই আসে তালা খুলতে। আর ওদের কাউকে দেখলেই ভীষণ নার্ভাস হয়ে যায়, হাত কাঁপতে থাকে, কোথায় তালা আর কোথায় চাবি। ওরাও তখনই নিজেদের মধ্যে কথা বন্ধ করে একদম চুপ হয়ে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাতে আরো বেড়ে যায় নার্ভাসনেস। কিন্তু ধাঞ্চুদি বা নিরুপমাদি দরজা খুলতে এলে আর এই মজাটা হয় না। সমরদার বাড়ী কালীপুজা হয়। পরেরদিন ওদের সব্বার নেমন্তন্ন থাকে। তখন তো আর ছেলেদের ব্যাচ, মেয়েদের ব্যাচ আলাদা করে কিছু মানা হয় না। নিনিরা খেতে বসে বিশ্বদীপ, কমল, অর্ঘ্যদের সাথেই। সমরদার বাড়ীর পাশে রেললাইন টপকে ওপারে যাবার একটা সরু ফালি পায়েচলা রাস্তা আছে। ওটা টপকে ৩-৪ মিনিট হাঁটলেই নিনিদের বাড়ী। সমরদা রোজ পড়ানো শেষ হবার পর নিনি আর জয়তীকে লাইন পার করিয়ে দিয়ে যান। ঐসময় প্রায় কোনোদিনই কোন গাড়ী থাকে না, কিন্তু উনি ঠিক দুদিক সাবধানে দেখে তবে পার করাবেন। আসার সময় নিনির মায়ের কড়া নির্দেশ আছে একা একা যেন লাইন না পেরোয়। স্টেশান ঘুরে, শাড়ীমহলের সামনে দিয়ে যাবে। নিনিও লক্ষ্মী মেয়ের মত শোনে। অতটা ঘুরতে সময় লাগবে বলে মা প্রতিদিন সতর্ক করেন ১৫-২০ মিনিট আগে বেরোবার জন্য। নিনি তাই বেরোয় আর তারপর মিমিদের বাড়ীতে মিনিট দশেক গপ্প করে তবে যায়। নাহলে তো বড্ড আগে পৌঁছে যাবে আর তখন আবার সমরদার জেরা। সমরদা রামকৃষ্ণ মিশনের একটি স্কুলে পড়ান। প্রতি শনিবার বাড়ী আসেন। আজও কি খুশী হন নিনিদের কাউকে দেখলে। এমন শিক্ষক আর একজনকেও দেখে নি নিনি। এরপরে যখন কলেজ গেল তখনও না।

চলবে (বোধহয়)


মন্তব্য

লাবণ্যপ্রভা এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম
চলুক

দময়ন্তী এর ছবি

হাসি
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

ইশ! এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল ! মন খারাপ
পরের পর্ব কবে আসবে ?

দময়ন্তী এর ছবি

আসবে আসবে শীগগিরই আসবে৷ হাসি

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

মর্ম এর ছবি

মনে রাখার মত একটা শিরোনাম আর সাথে টেনে ধরে রাখার মত একটা লেখা।

ভাল লাগছে নিনির গল্প। চলুক।

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

দময়ন্তী এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মর্ম৷ হাসি

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

পথিক পরাণ এর ছবি

আমাদের বেড়ে উঠার গল্পগুলো কি অদ্ভুত!

ভালো লাগছে সিরিজটা--

------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---

দময়ন্তী এর ছবি

হ্যাঁ আমাদের বেড়ে ওঠার গল্পগুলো কত আলাদা অথচ কত মিল তাতে৷

ধন্যবাদ৷ হাসি

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

বেশ ভালো লাগল।

দময়ন্তী এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ৷ হাসি

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

তাপস শর্মা এর ছবি

অনেক ভাল্লাগ্লো দিদি। হাসি

দময়ন্তী এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ৷ হাসি

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।