নীল গানে সাদা সুর, কাদা কাদা গন্ধ

দময়ন্তী এর ছবি
লিখেছেন দময়ন্তী (তারিখ: শনি, ২৪/১১/২০১২ - ৫:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শহরটা হঠাৎ নীলে নীলে নীল হয়ে উঠতে শুরু করেছে, হাল্কা নীল আর সাদা। আর শহরের পুবদিকের এই উপনগরী যেন পারলে অল্ট ট্যাব মেরে একদিনেই নীল-সাদা হয়ে যায় আর কি! প্রথমে নবদিগন্ত শিল্পতালুকের একটা দুটো বাড়ী তাদের পুরানো রং বদলে সাদা আর নীল হল, তারপর রাস্তার পথবিভাজিকার ধারগুলো নীল সাদা ডোরাকাটা হতে শুরু করল, এদিকে পথবিভাজিকায় বাগান বানানোর কাজ জোরকদমে চলেছে, সেই বাগানকে রক্ষা করতে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়েছে, বেড়ার রং হলদে-সবুজ| কিছু জায়গায় দেখা গেল সবুজ রং করা কঞ্চি সরিয়ে ফেলে সাদা কঞ্চি বসানো চলেছে| তারপর কিছুদিন তারা হলদে-সাদা হয়ে রইল| বোঝা গেল হলদে-সবুজ নাকি নীল-সাদা এই দ্বন্দ্বের সমাধান না হওয়ায় এই হলদে-সাদা| এদিকে ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের অফিসবাড়ীখানি প্রায় নতুনই বলা চলে, মাত্রই গতবছর তাতে লাল বর্ডার দিয়ে হলদে রঙে রাঙানো হয়েছে --- তার চারধারের পাঁচিলের রং বদলে যায় হালকা নীলে, তাতে গাঢ় নীল র্ব্ডার| শোনা গেল বাড়ীটা পুনরায় রং করার টাকা পাওয়া যাচ্ছে না, গতবছর রং হওয়ায় এই বছরে বরাদ্দ নাই, তাই বাড়ী রইল তেমনই হলদে-লাল হয়ে| কিন্তু তা হলে কি আর সৌন্দর্য খোলে! তাই মাস কয়েক পরে সে বাড়ীও নীলে-নীল হয়ে গেল| টাকার সংস্থান কোথা থেকে হল, তা অবশ্য জানা গেল না| ইতিমধ্যে রাস্তার যেখানে যত বড়সড় সরকারী বিজ্ঞাপনের বোর্ড আছে, সবকটা নীল-সাদা হয়ে গেছে| কিছু কিছু ব্লকের হলদে রঙের জলের ট্যাঙ্ক পরিবর্তিত হয়ে হলদে-সবুজ হয়েছিল মাস কয় আগে, তারা আবার পরিবর্তিত হয়ে সাদা-নীল হয়ে গেল, বাকী ট্যাঙ্কদের মত| নতুন শেষ হওয়া বাড়ীগুলোর একটা বড় অংশই চেষ্টা করছে বাড়ীতে কোথাও না কোথাও একটু নীল সাদা অংশ রাখতে, এলাকায় জোর গুজব নীল-সাদা বাড়ীর বার্ষিক ট্যাক্স কিছু কম হবে| সরকার ভগবানকে ভয় করে কিনা সে সম্পর্কে কোনও তথ্য না থাকলেও কোনও কোনও ভগবান যে সরকারকে বিলক্ষণ ভয় করেন তা দেখা গেল রাজারহাট কালুর মোড় অঞ্চলে| একটা ঝকঝকে গোলাপী রঙের মন্দির দুম করে নীল-সাদা হয়ে গেল, দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের গোপুরমের স্টাইলে নির্মিত মন্দিরের চুড়াটা নীল-সাদা ডোরাকাটা হওয়াতে অবশ্য সত্যিই বেশ অন্যরকম লাগছে দেখতে| কিন্তু দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর আলোকসজ্জাতেও শুধুই নীল-সাদা টুনির সমারোহ, বড়জোর নীল-সাদা-সবুজ --- মোটেই ভাল লাগল না, ব্ড্ডই মৃদু আলো| লাল-হলদে টুনিবাল্বের খোঁজে দোকানে হানা দিয়ে জানা গেল চাহিদা কম বলে যোগানও কম, তবে পাওয়া গেল, কারণ যেগুলো এনেছিলেন দোকানী তাও বেশ কমই বিক্রী হয়েছে|

আগে মানে বছর দেড়েক আগে অবধি শহরের বড় বড় রাস্তাগুলোয় বাতিস্তম্ভে জ্বলত হ্যালোজেন আলো| গতবছর থেকে ছোটবড় সব রাস্তার দুপাশে 'ত্রিফলা আলো' লাগানো শুরু হয়, একটি বাতিস্তম্ভে তিনটি বাতি লাগানোর ব্যবস্থা| সাদা বাতি, অনেকটা পুরানো কলকাতার গ্যাসের আলোর মত দেখতে| আলো তেমন জোরালো নয়, বেশ মায়াবী চাঁদের আলোর মত, আলোর চেয়ে আলোছায়া ভাব বেশী| রাজারহাট এক্সপ্রেসওয়ে, কুড়ি ফুট চওড়া রাস্তার দুইপাশে তিনটে তিনটে করে আলো, মাঝে পথবিভাজিকায় দুটো হ্যালোজেন আলো| অর্থাৎ রাস্তার যেকোন অংশে দুপাশে ছয়টা এবং মাঝে দুটো, মোট আটটা করে আলো --- যাকে বলে একেবারে 'আলোয় ভুবন ভরা'| এ তো তাও বেশ চওড়া এক্সপ্রেসওয়ে, বিভিন্ন আবাসিক এলাকার ৪ ফুট চওড়া রাস্তায় একদিকে ত্রিফলা আর একদিকে হ্যালোজেন, একুনে চারটে করে আলো| এদিকে দুটি ত্রিফলা স্তম্ভের মধ্যে ব্যবধান বড়জোর দেড় ফুট কি দুই ফুট| বোঝাই যাচ্ছে সরকার এবার অন্ধকার দূর করেই ছাড়বেন| ওদিকে এই ত্রিফলা আলোর জন্য নাকি মাসে ছয়কোটি টাকা করে অতিরিক্ত বিদ্যুতের বিল আসছে পৌরসভার| আর আলো বসানোর অনিয়মের কথা তো এক জমজমাট থ্রিলার প্রায়|

ওদিকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গুঁতোয় সাধারণ সঙ্গীতপ্রেমী জনতার গানশোনা প্রায় ঘুচে যাওয়ার যোগাড়| হীরকরাণীর আদেশ শহরের সব কটি সিগন্যালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাতে হবে| তা আদেশ জারি হতেই মন্ত্রীসান্ত্রী পাত্রমিত্র হইহই করে সিগন্যালের মাথায় মাথায় লাগিয়ে দিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের পেনড্রাইভ| তাদের আবার লাল আলো জ্বলার সাথে সাথেই চালু হওয়ার ব্যবস্থাও করা হল| জৈষ্ঠের দুপুরে চারমাথার মোড়ে গাড়ী দাঁড়াতেই ভেসে এল 'উতল ধারা বাদল ঝরে----' তা মন্দ কি! যাদুবাস্তব তো একেই বলে| এদিকে সবুজ হয়ে অন্যদিকটা লাল হতেই গাড়ীগুলো ছুটল, ওদিকের এক প্রাইভেট বাসের চালাক চালক শেষ মুহূর্তে 'টেনে বেরিয়ে' যেতে গিয়ে এদিকের এক মারুতির ছানার বনেটের ছাল একটু তুলে নিয়ে গেল| ওদিকের লাল হয়ে যাওয়া সিগন্যাল থেকে তখন ভেসে আসছে করুণ আর্তি 'তুমি কিছু দিয়ে যা-আ-ও'| এ তো নাহয় গেল সিগন্যালে সিগন্যালে তোমার কবিরে দাও ডাক-এর গল্প| এদিকে পাড়ায় পাড়ায় রক্তদান শিবিরগুলিতে আগে প্রথমে কিছুক্ষণ বাজত বিভিন্ন গণসঙ্গীত, পরে আস্তে আস্তে কিশোরকুমার ইত্যাদিরা আসর জমাতেন| খুব জনপ্রিয় ছিল 'এ আমার গুরুদক্ষিণা-আ-আ' আর 'তোমার বাড়ীর সামনে দিয়ে আমার মরণযাত্রা যেদিন যাবে'| কিন্তু এখন আর ওসব বাজার জো-টি নেই| যদি কোনও এক ছুটির দিন সকালে উঠে শোনা যায় 'দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে' কিম্বা 'নীল দিগন্তে ফুলের আগুন লাগল' তাহলে বুঝতে হবে আশেপাশে কোথায়ও হয় রক্তদান শিবির নয়ত বিনামূল্যে চক্ষুপরীক্ষা ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে| এছাড়াও যতেক ছোটবড় বিশ্বকর্মা, কালী, শনি, জগদ্ধাত্রী, সরস্বতী ইত্যাদি বারোয়ারি পুজোতেও সারাদিন সারারাত বেজে চলে তিনটি কি পাঁচটি রবীন্দ্রসঙ্গীত| রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোনও সঙ্গীতকার যখন নোবেল পুরস্কার পান নি, তখন তাঁদের গান কোথায়ও বাজানোই উচিৎ নয় এমনটাই সম্ভবত মনে করেন হীরকরাণী ও তাঁর পারিষদগণ|

তা বলে এইসব পরিবর্তন, আমূল পরিবর্তনের জন্য সাধারণ মানুষের কি কোনও দায় দায়িত্বই নেই? সবটাই শুধু সরকার ও তার কার্ত্রীর ইচ্ছায়? তা মোটেই নয়, হতে পারেও না| সাধারণ মানুষ, যাকে সাধারণত একটা 'মাটির মানুষ'এর ইমেজও দেওয়া হয়, সেই মানুষ কিন্তু স্বেচ্ছায়, নিজের বুদ্ধিতেই নিজের সুবিধে হবে ভেবেই অনেক কিছু করে থাকে, অনেক অন্যায় আচরণকে মান্যতা দিয়ে থাকে| জলের ট্যাঙ্ক, রাস্তার কার্ব, উড়ালপুলের রেলিং নাহয় সরকার রঙ করেছে, বসতবাড়ী কিম্বা মন্দির তো আর তা নয়| 'করছাড়'এর লোভনীয় গল্প ছড়ানো ও সেই লোভে লোভে বসতবাড়ীকে নীল-সাদা করে নেওয়া এই আমার আপনার মত 'মাটির মানুষ'ই করে| লাল-হলদে কিম্বা লাল-হলদে-সবুজ-নীল-সাদা সবরকম টুনি দিয়ে যাঁরা নিজ বাড়ী কিম্বা বারোয়ারি প্যান্ডেল সাজিয়েছেন তাঁদের কেউ বাধা দিয়েছেন বলে শুনিনি| হয়ত দু একটা টিপ্পনী, কিম্বা হাল্কা বিস্ময় --- তা সে তো অনেক ব্যপারেই অনেকে করে --- কিন্তু তা নয়, ঐ আসলে নীল-সাদা আলো লাগালে হয়ত সারকারের প্রতিনিধির সুনজরে থাকা যাবে --- ছোটখাট ও বড়সড় সুবিধে পাওয়া যেতে পারে --- এই সম্ভাবনাতেই আমরা, 'মাটির মানুষ'রা নীল-সাদা টুনি লাগাই, সত্যনারায়ণ পুজো উপলক্ষ্যে সারাদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাই-- হোক না মাত্র একটা সিডিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, মুখের ধান্দাবাজ হাসিটার ওপরে পরে নিই নীল-সাদা মুখোশ, সারল্যের, নির্বুদ্ধিতার, হয়ে যাই কাদার মানুষ|


মন্তব্য

তাপস শর্মা এর ছবি

ছেড়ে দাও সব আমার উপর বৃথাই চিন্তা, কান্নাকাটি
রবীন্দ্রনাথ নাচে ফুটপাতে, সময় থাকতেই আসবে লন্ডনী ঘটি

০২

মাও ফাও। হাউ ? যাও, বাদ দাও, সব কাহিনী
আমিই মা, আমিই মাটি, আমিই হীরকরাণী

০৩

দিদির চিন্তার অন্ত নাই
দিদিকে বোঝা বৃথা তাই

দময়ন্তী এর ছবি

১) মন খারাপ
২) ইয়ে, মানে...
৩) চিন্তিত

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আপনি এট্টা মাওবাদী

দময়ন্তী এর ছবি


কোনদিন না ধরে নিয়ে ্যায়

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

ব্যাপার কি দমু’দি ? কে ক’টা হাঁচি দেবে তাও কর্তা ব্যাক্তিরা ঠিক করে দিচ্ছেন ?

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

দময়ন্তী এর ছবি

শুধু হাঁচি? সব স-অ-ব আহা আমাদের অভিভাবক কিনা

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ওদিকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গুঁতোয় সাধারণ সঙ্গীতপ্রেমী জনতার গানশোনা প্রায় ঘুচে যাওয়ার যোগাড়| হীরকরাণীর আদেশ শহরের সব কটি সিগন্যালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাতে হবে|

ঘটনা সত্যি নাকি? অবাক কাণ্ড দেখি। গানে গানে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ। এর চেয়ে সুশীলতম পন্থা তো আর হতেই পারে না। হীরকরানী তো দেখা যায় আইডিয়া কুইন।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

দময়ন্তী এর ছবি

কাল না পরশু ক্ষুদ্রশিল্প ও হস্তশিল্প মেলায় গিয়ে ক্ষুদ্র ও হস্তশিল্পের সাথে পারফমিzর্ন আর্টকেও মিলিয়ে মিশিয়ে ঘন্ট পাকিয়ে দিয়েছেন| কি আর বলব --- কিস্যু বলার নাই

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

বাহ্, বাহারি সব ধারনা !

দময়ন্তী এর ছবি

হুঁ সে আর বলতে!

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

কৌস্তুভ এর ছবি

মেট্রো স্টেশনের নামগুলো জায়গার থেকে বদলে সেলিব্রিটিদের নামে করাটা বিশুদ্ধ ছাগলামো ছিল। কত লোকে যে হ্যাপায় পড়েছে! দুনিয়ার আর কোথাও মেট্রো স্টেশন নিয়ে এমনটা করেনা।

দময়ন্তী এর ছবি

আরে উনি নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী| দেখবেন একদিন উনি নিজের বিরুদ্ধে অনশনে বসবেন|

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

নিলয় নন্দী এর ছবি

হীরকরাণী

এই টার্মটা বেশ লেগেচে !

দময়ন্তী এর ছবি

হাসি
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

কনফুসিয়াস এর ছবি

মহিলা তো সাংঘাতিক রোমান্টিক দেখা যাচ্ছে!

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।