রং এর সম্রাট হুন্ডার্টওয়াসার, প্রকৃতিপ্রেমে এক সিক্ত মানব

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: শুক্র, ০৪/০৪/২০০৮ - ৩:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হুন্ডার্টওয়াসারক্যনভাসের শরীর ছুয়ে ছুয়ে নানা রং পাশাপাশি, একের সাথে অন্যের নিবিড় অন্তরঙ্গ ভালোবাসা। দেয়ালের গায়েও রং এর মোহন বিন্যাস, তুলির আদুরে প্রলেপে পরস্পরের সাথে কখনও মিশে, কখনও খুনশুটির আনন্দে আকাশের নীলের সাথে একই নিলয়ে। একবার তাকালেই চোখে শীতল আরাম, বুকের ভেতরে পেলব উষ্ণতা ভাললাগার সিক্ত সুখ । এরই মাঝে জীবন, মানুষ, প্রকৃতি, ভালবাসা, ক্রোধ। মিলে মিশে একাকার নগর, বন্দর, শহর আর স্থাপত্য। তুলির প্রলেপে এই কাব্যিক হোলিখেলার যনি স্রষ্টা, তিনি অস্ট্রিয়ান চিত্রকর ফ্রিডেনরাইখ হুন্ডার্টওয়াসার।

বেকার বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে হুন্ডার্টওয়াসার এর জন্ম ১৯২৮ সালের ১৫ ডিসেম্বরে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায়। জন্মের তেরো দিন পরই বাবা মারা যাওয়ায় শুধুমাত্র মায়ের ভালবাসাকে সম্বল করে বেড়ে ওঠেন তিনি। যদিও মা ইহুদী, ১৯৩৭ সালে ছেলেকে ক্যাথলিক খ্রীস্টান হিসেবে ধর্মান্তরিত করেন। তারই এক বছর পর অস্ট্রিয়া দখল করে হিটলারের নাজী বাহিনী। ১৩৪৩ সালে অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন শহরে হুন্ডার্টওয়াসার পরিবারের উনসত্তুর জন সদস্যকে নাজী বাহিনী নিশৃংসভাবে হত্যা করলেও ফ্রিডেনরাইখ ও তার মা রক্ষা পেয়ে যান।

১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৪৯ অবধি ভিয়েনার শিল্পকলা একাডেমিতে পড়াশোনা করেন। একবছর পরই সে একাডেমিতে ছেড়ে দিয়ে ইটালী চলে যান। সেখানে বড় বড় চিত্রকরদের সাথে কাজ করার সুযোগ হয় তার। পরে ফ্রান্স সহ আরো অনেক দেশের চিত্রকরদের সাথে পরিচিত হবার মাঝে নিজস্ব সৃষ্টিতেও উৎকর্ষতা আসে। রং এর খেলারং এর খেলা
আত্মভোলা মানুষ ছিলেন, মন ও মানসের স্বাধীনতার আকাঙ্খাই জীবন জুড়ে। ১৯৫৮ সালে প্রথমবারের মতো বিয়ে করেন তিনি। এ বিয়ের স্থায়িত্ব মাত্র দুই বছর। ১৯৬০ সালে জাপানে টোকিওর আন্তর্জিতিক শিল্পকলা উৎসবে “মাইনিচি” পুরস্কার আনতে জাপান যান। সেখানে ১৯৬২ এক জাপানী তরুনীকে বিয়ে করেন। এ বিয়ের স্থায়িত্বকালও মাত্র চার বছর। ১৯৬৪ সালে অস্ট্রিয়াতে এক খামার বাড়ী কিনে নাগরিক সভ্যতার আড়ালে একা বসবাস শুরু করেন। প্রকৃতিকে ভালবাসতেন ও প্রকৃতির মতোই সহজ সরল জীবনের প্রতি ছিল তার নিদারুন টান। প্রচলিত ধ্যনধারণার প্রতি বিদ্রোহ ও প্রকৃতির সাথে নিজেকে মেশানোর আকাঙ্খায় নগ্নতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। নিজের বাড়ীতেও সেভাবেই চলতেন। এমনকি ১৯৬৭ সালে মিউনিখে ও ১৯৬৮ সালে ভিয়েনায় দুই আলোচনা সভায় নগ্ন অবস্থাতেই বক্তৃতা করেন হুন্ডার্টওয়াসার।

২০০০ সালের ১৯শে ফোব্রুয়ারী নিউজিল্যান্ডে “কুইন এলিজাবেথ” জাহাজের ডেকে হৃদপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। তার শেষ ইচ্ছানুযায়ীই নিউজিল্যান্ডেই কবর দেয়া হয় তাকে। কফিনের বদলে তার নিজর তৈরী এক পতাকায় মুড়ে দেয়া হয় তার মরদেহ। এটাও প্রচলিত ধ্যনধারণার প্রতি বিদ্রোহেরই প্রকাশ, যা মৃত্যুর পরও প্রকাশ করে গেছেন।
মাগডেবুর্গে হুন্ডার্টওয়াসার হাউজমাগডেবুর্গে হুন্ডার্টওয়াসার হাউজ

চিত্র ও খোদাই শিল্পে প্রভাবে প্রভাবিত হুন্ডার্টওয়াসার স্থাপত্যশিল্পেও তার অবদান রাখেন। ইউরোপের বিভিন্ন শহরে তার নিজস্ব ঢং অনেক বসত ও ব্যবসায়িক ভবনের নকশা করেন তিনি। চিত্রকর গুস্তাভ ক্লিমট ও এগন শিলের প্রভাবে প্রভাবিত হুন্ডার্টওয়াসার রং ও বিন্যাসের বৈচিত্রে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করেন।

সরলরেখাকে তিনি ঈশ্বরবিহীন বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। বলতেন, প্রকৃতিতে কোথাও সরলরেখার অস্তিত্ব নেই। শিল্পেও তাই সরল রেখাকে বর্জন করার দাবী তোলেন। সমালোচকরা বলেন, হুন্ডার্টওয়াসারএর গোলকাধাঁধাময় শিল্পকর্ম, রং, স্থাপত্য তার ১৯৩৮ থেকে ১৯৮৫ অবধি অস্থির জীবনেরই সাক্ষী বহন করে।
মাগডেবুর্গে হুন্ডার্টওয়াসার হাউজমাগডেবুর্গে হুন্ডার্টওয়াসার হাউজ

অন্যান্য বিভিন্ন শহরের পাশাপাশি জার্মানীর পুব এলাকার মাগদেবুর্গ শহরেও হুন্ডার্টওয়াসার তার নিজস্ব ঢং এ ভবনের নকশা করেন। রংএর বিন্যাস ও বক্রতায় বৈচিত্রময় তার এই শিল্পকর্ম। এই বিচিত্র বিন্যাসে যে সতেজ জীবনের ছোয়া, তা অনুভব করতে অন্যান্য শহরের মাগদেবুর্গেও ভীড় জমান অনেক শিল্পপিপাসী অনুরাগী। আমার নিজেরও মাগদেবুর্গে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল গত গ্রীস্মে। প্রখর কিন্তু পেলব রোদের আলো, ভালোবাসায় সে রংচিত্র বুকের ভেতরে ধারণ করে ফিরেছিলাম ঘরে।


মন্তব্য

শাহীন হাসান এর ছবি

তীরন্দাজ এর জগতে নতুন মাত্রা যোগ হলো ...
ছবির কাজকে তিনি অক্ষরে বুনন করেছেন তার বর্ণনায়
ভালো। খুব ভালো!
....................................
বনের বেঞ্চিতে ওম শান্তি!

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

হাসান মোরশেদ এর ছবি

xxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxx
...অথবা সময় ছিলো;আমারই অস্তিত্ব ছিলোনা

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।