চৌদোলা

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: শনি, ১৯/০৪/২০০৮ - ২:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তিনজন মানবের গল্প। তিনটি অস্তিত্বের গল্প। এমনি গল্প যুগ যুগ ধরে বলা হয়েছে। লেখা হয়েছে কাগজে, যখন মানুষ কাগজের ব্যবহার জানতো, তার আগে গাছের পাতায়, তারও আগে শিলালিপিতে। তারপরেও শেষ নেই এ গল্পের। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন প্রকৃতিক স্পর্শকাতরতায় এ গল্পের বিস্তার কালে কালে ও কালেরই ঘূর্ণিতে মিলিয়ে মিশিয়ে।

প্রথম মানবের গল্প। যখন প্রকৃতি নিথর, বাতাস শীতল, তখন শিশির জমে গাছের পাতায় পাতায়, মুক্তোর মতো ঝিলমিলিয়ে। প্রথম মানব যখন হাসে, তার একটি হাসির বন্যায় ঝরে পড়ে প্রকৃতির সমস্ত শিশিরবিন্দু একসাথে। তার চোখের তারায় তখন হাজার সমুদ্রের ঢেউ। প্রথম মানবকে কাঁদতে দেখেনি কেউ। অথচ তার বুকের ভেতরেই নিথর মেঘের মতো বরফে জমানো সে কান্না। সে বরফ জমানোই সবসময়। কান্না হয়ে চোখের কোনে সমুদ্র হয়না কখনোই। হলেও কেউ কখনো তা দেখতে পায়নি। মানব তার নিজস্ব গড়া দূর্গে নিজেই যেনো বন্দী। দূর্গের অনেক উঁচুতে গড়া ছোট ছোট জানলা দিয়েই তার ঝর্ণার মতো ছন্দিত হাসির ঝংকার শিশির ঝরায়। কিন্তু বুকের ভেতরে জমানো কান্না বুকের দুর্গেই ঘুর্নি হয়ে গুমরে বেড়ায় সারাটি সময়। কিন্তু সে কান্নার উৎস কোথায় ? কোন এক অজানা ভয়ে তাই প্রথম মানুষ মসৃণ আয়নায় মুখ দেখেনা কখনোই।

দ্বিতীয় মানবের গল্প। দ্বিতীয় মানব যেনো বিষন্ন এক মৌন পাহাড়। তার চোখের তারায় কখনো কোন সপ্নের বাগান গড়ে উঠেনা। সমুদ্রের অজস্র ঢেউ বুকের উপর ভেঙ্গে পড়লেও কোন ক্লান্তি আসেনা তার স্থবিরতায়। দ্বিতীয় মানবের হাতে রয়েছে কোন এক স্বর্গপুরি থেকে খসে পড়া সুরেলা এক বাঁশী। কিন্তু সে বাঁশী তার তার হাতে কোন স্বর্গীয় সুরের মুচ্ছর্না তোলেনা । সে বাঁশী লুকোনো রয়েছে তার বুকের অজস্র গুহার মাঝে সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন মলিন এক গুহায়। সে গুহাতে সুর্যের আলোও ঢোকার আগে থমকে দাঁড়ায় বারবার। তারপরেও দ্বিতীয় মানব তার নিজস্ব অস্তিত্বে অন্য মানবের পাশে কোন এক সাক্ষরিত মতায় উদ্ধত।

তৃতীয় মানবের গল্প। তৃতীয় মানবের বুকের মাঝে ছন্দিত আগুন। বাঁধভাঙ্গা অনুভূতির ঢেউ তার বুকের আগুনকে আরো বেশী উত্তাল করে। যন্ত্রণার তীব্র সমুদ্রে ভেসে ভেসে মলিন তার অবয়ব। কিন্তু তারপরেও চোখের তারায় অজস্র সপ্নের অস্থির উন্মাদনা ঢেকে রাখে সে মালিন্যকে। তার বুকের ভেতরের নরম ভালোবাসাকে বিলিয়ে দিতে তৃতীয় মানব হাতড়ে বেড়ায় কোন এক অস্থির পথ। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তার স্পর্শকাতর ভালোবাসা পথেরই আনাচে কানাচে। তৃতীয় মানব তাই পথ হারিয়ে পথকেই আগলে আছে বুকে।

কোন এক বাসন্তিক দিনে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মানব কোন এক চৌদোলায় চড়লো - কি কারণে, তা জানা নেই কারো। হয়তো আকাশ থেকে কোন একটি উল্কা খসে পড়ায় চমকে উঠেছিলো ওরা, হয়তো অনেক অনেক দুরে কোন এক নবাগত শিশুর কান্নায় থমকে গিয়েছিলো ওদের পথ, হয়তো বা ওদের বন্দর থেকে যে জাহাজ ছেড়ে গেলো, তার গন্ত্যব্যস্থল জানার জন্যেই, -- যে কারনেই হোক না কেনো, ওরা চড়লো সে চৌদোলায়। আকাশ তৃপ্ত হলো তার সমস্ত রোদটুকু ওদের গায়ে ঢেলে দিয়ে। বাতাস তার সে আনন্দের ভার বইতে না পেরে, ঝলকে ঝলকে ছিটিয়ে দিলো তার সে আনন্দ বাকী প্রকৃতিতে।

প্রথম দোলার গল্প। অনেক উঁচুতে দুলছে দোলা। অনেকটা আকাশের কাছাকাছি। আকাশে যদি মেঘ থাকতো, তাহলে মেঘও ওদের দোলার সাথী হতে পারতো। দুরন্ত গতিতে দুলছে দোলা। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মানবও দুলছে একই গতিতে। আকাশে কাছাকাছি কোন এক হঠাৎ মেঘে থামলো দোলা ক্ষনিকের জন্যে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মানব কিছুক্ষনের জন্যে সে মেঘের বসতে একটু থেমে আবার চড়লো ওদের দোলায়। ছুটলো দোলা তার অফুরন্ত গতিতে। পৃকৃতি, পাহাড়, মেঘ ছুটলো ওদের সাথে। কিন্তু দোলার দুরন্ত গতির সাথে পাল্লায় পেরে উঠলো না ওরা। দোলা গিয়ে থামলো অনেকটা নীচুতে, সাগর থেকে কিছুটা দুরে অন্য মানবের বসতে। সেখানে অজস্র সাজানো আলোর মাঝে হঠাৎই দিগন্তে বিদায় নিলো দিন।

- প্রথম মানবের বুকের মাঝে তখনো সে সাজানো আলোর ঝলকানি।
- দ্বিতীয় মানবের হাতে তখন কাগুজে ফুলের মালা।
- তৃতীয় মানবের বুকের খাঁচায় বিদায়ী আলোর তীব্র ব্যথা।

দ্বিতীয় দোলার গল্প। দ্বিতীয় দোলা থামলো একেবারে সমুদ্রের কাছে কোন এক জলছোঁয়া আর্শ্চয্য নগরীর মাঝে। জল আর প্রায় ভেঙ্গে পড়া প্রাসাদের মাঝে অজস্র রংএর হোলিখেলা নগরীর প্রতিটি কোনায় কোনায়। তারপরেও প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মানবের হাতে কেমন করে যেনো টুকরো হয়ে গেলো নগরীর নিস্তব্ধ বাতাসে তাদের সময়গুলো। নগরীর নৈস্বর্গিক ভালোবাসা, নোনাজলের দূরন্ত ঢেউ, কোনকিছুই ওদের ভেঙ্গে যাওয়া সময়কে জোড়া লাগাতে পারলো না।

- দ্বিতীয় মানবের হাতে তখন কাগুজে ফুলের মালা।
- প্রথম মানবের চোখের তারায় সাজানো রংএর বাগানবাড়ী।
- তৃতীয় মানব ভাঙ্গা সময়কে বুকে করে র্তীর ব্যথায় বিবর্ন।

তৃতীয় দোলার গল্প। দোলা ছুটলো আবার বিস্তির্ন বনভুমি, জলাশয়কে ডানে, বায়ে ও পেছনে রেখে। থমকে দাঁড়ালো এসে এক উঁচু প্রাসাদের পাশে। শ্বেত মর্মরের কঠিন বাঁধনে সাজানো সে প্রাসাদ। তার চুড়োগুলো আকাশকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভালোবেসে চুমো খায় মেঘের ভাজে ভাজে। তিনজন মানবের কোনো একজনের বুকেও স্পর্শ করলো সে ভালোবাসা। কিন্তু কোনো এক বিপরীত ঘুর্নির কর্কশ ছোয়ায় বুকের ভেতরে বিক্ষোভের দমকে বিক্ষিপ্ত হলো সে ভালোবাসা।

- তৃতীয় মানব নিজেই তখন কোন এক আগ্নেয়গিরির জলন্ত গহন।
- প্রথম মানব কোন এক অজানা অক্ষমতায় বিবস, ক্লান্ত।
- দ্বিতীয় মানবের হাতে তখনও কাগুজে ফুলের মালা।

চতুর্থ দোলার গল্প। দোলা নামছে এবার শেষ শক্তিকে ধরে ধরে বাতাসের গায়ে ভর করে। এবারের যাত্রা ফিরতি পথের। তারপরেও দোলা কোন এক ভালোবাসার নগরী ছুঁয়ে গেলো একবার। অসংখ্য ভালোবাসার সারে চিত্রিত সে নগরী। কোন কোন মানব সে ভালোবাসায় বিলীন হয়ে নিজেরই বুক হাতড়ে সুখের ছবি আঁকলো।

- দ্বিতীয় মানবের হাতে তখনও কাগুজে ফুলের মালা।
- তৃতীয় মানব তখন আসুরিক অসাড়তায় বিমুঢ়।
- প্রথম মানবের শীৎকারে পাখীরাও বেদনায় ডানা ঝাপটায়।

এমনি করেই শেষ হলো তিন মানবের চৌদোলার যাত্রাপথ। দ্বিতীয় মানব কাগুজে ফুলের মালাটি হাতে নিয়ে নিপুন যত্নে রাখলো বিবর্ণ বাঁশীটির পাশে। তৃতীয় মানব কোন এক কষ্টকে আকড়ে ধরে কোন এক অজানা অভিমানে মিলিয়ে গেলো কোথায় কে জানে। আর প্রথম মানব কোন এক কুহেলিকার নিগুঢ় বন্দীত্বে প্রতিদিন মুখ দেখে তার অমসৃন আয়নায়।


মন্তব্য

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আপনার বর্ণনার ভঙ্গি অসাধারণ।
ভীষন ভালো লাগলো।
তিন মানবের মধ্যে কোন জনকে বেশি কাছের করে এঁকেছেন?

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন্যবাদ!

দ্বিতীয় জনকে....।
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পরিবর্তনশীল এর ছবি

আরেকটা সুন্দর গল্প!

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

শাহীন হাসান এর ছবি

গল্পটি সুলিখিত।
অসাধারণ কাব্যিক ঢং-এ বিবৃত হয়ছে এই চৌদোলা'য়--
তিন জন মানব-মানবীর জীবন এবং সময় ....।
তীরন্দাজ-- আপনাকে শুভেচ্ছা।
....................................
বনের বেঞ্চিতে ওম শান্তি!

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

অতিথি লেখক এর ছবি

কবি, চারু-কামলা ও বিপ্লবীকে দোলাতে গিয়ে মানুষের তিন মহান রূপ কে এঁকে ফেলেছেন কবি, চারু-কামলা আর বিপ্লবীর অপূর্ব দক্ষতায় ! অসাধারন ।

---------------
মাঝ রাতের বর্ষণ
ই-মেইলঃ

ক্যামেলিয়া আলম এর ছবি

আমি সাধারণত গল্প না কবিতা তা শিরোনাম না জেনেই পড়া শুরু করি---আপনার লেখা পড়তে গিয়ে আমি আবার মাউস উপরে তুলে দেখে কনফার্ম হয়ে এসেছি---কারণ এখন কোন ছোটগল্প মনে করে আতলামী করতে গিয়ে দেখি ওটা ছিল কবিতা।
আমি যখন কোন সত্য মানুষের সত্য বিষয় নিয়ে লিখি-----কিন্তু তা বুঝতে দিতে চাই না তখন এ ধরণের কাব্যিক বিষয়ের ব্যবহার করি--------আপনারও কি তাই?
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

তীরন্দাজ এর ছবি

আপনি ঠিক ধরেছেন। অনেক ধন্যবাদ!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍কাব্য প্রায় বুঝি না। আর মনে হয়, সেই কারণেই গল্পটা আমার দুর্বল অ্যান্টেনা রিসিভ করতে পারলো না মন খারাপ

ভাই, আমার সরাসরি কথায় মাইন্ড কইরেনা না। লেখারে তো খারাপ কই নাই। খালি কইলাম, দাঁত বসাইতে পারলাম না। দোষ আপনার নয়।

গত বেশ কিছুদিন ধরে আপনার প্রত্যেকটা গল্পেই আমি কিন্তু খুব মুগ্ধ হয়েছি।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিজেকে জয় করার অর্থ বিজয় না পরাজয়? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

তীরন্দাজ এর ছবি

মাইন্ড করার প্রশ্নই আসে না। সত্য কথনই ভালোবাসি...।
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍আশ্বস্ত হলাম।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিজেকে জয় করার অর্থ বিজয় না পরাজয়? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

রানা মেহের এর ছবি

কিছু কিছু লেখা আছে।
খুব অর্থ বের করা যায়না।
শুধু বিষাদ দুলিয়ে যায়।
চৌদলা দুলিয়ে গেল

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।