কল্পগল্পঃ সাতমাথা দৈত্য

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৩/১০/২০০৮ - ৫:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নাম মহাবীর, কজেও তাই। একে নিয়ে নানা কাহিনী শহরের লোকের মুখে মুখে। একবার নাকি দু'হাতেই ঠেলে আস্ত এক ট্রেন থামিয়েছিল এক শিশুকে বাঁচাতে। আরেকবার জলোচ্ছাসের সময় একটি বাঁধের ভাঙ্গন তার শক্তিতেই নাকি ঠেকানো গিয়েছিল। এসব নানা ধরণের কাহিনী প্রচলিত আছে শহরে। কিছুটা রঙও মেশানো হয়েছে হয়তো। কেউ কেউ পুরোটাই বিশ্বাস করে, কেউ কিছুটা কম। আবার কেউ কেউ বুজরুকি বলে উড়িয়ে দিলেও, বিপদে পড়লে মহাবীরের কথাই মনে করে। এ নাম শোনেনি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না শহরে।

শহরের মানুষের বিপদে আপদে ত্রাণকর্তা যদি এই মহাবীরই না হয়, তাহলে আর কে হবে? খবর পেলো, সাতমাথা দৈত্যের অত্যাচারে শহরের বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই কোন এক গ্রীস্মের সকালে সেই দৈত্যের গূহার সামনে এসে দাঁড়ালো মহাবীর। হাতের খোলা তলোয়ার রোদের আলোতে ঝকমকিয়ে উঠলো। গূহার সামনে দৈত্যদের ঘুমের সুযোগে সে সব পশুপাখি তাদের উচ্ছিষ্ট খেতে জমা হয়েছিল, তারা ভয়ে পালিয়ে গেলো অনেক দুরে। শহরে লোকজন পর্যন্ত মহাবীরের হুংকার শুনতে পেল।

- এই হারামজাদা দৈত্য! সাহস থাকলে বেরিয়ে আয় গূহার বাইরে! তোর সব মুন্ডুই আজ আমি কেটে কেটে টুকরো করে ফেলবো!

কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। আবার আরেকটা হুংকার দিয়ে সামান্য অপেক্ষা করলো মহাবীর। কিন্তু ঘটলো না কিছুই। দৈত্য বেরিয়ে আসবে তো দুরের কথা, নড়াচড়ার কোন শব্দও পাওয়া গেলো না।
- তুই শালা দেখছি কাপুরুষের হদ্দ! চোটপাট করিস খালি দুর্বলদের উপরই। এবার আমিই ঢুকছি তোর এই নোংরা গুহার ভেতর। দেখি কে তোকে এবার বাঁচায়!

ভেতরে ঢুকে দেখলো, দৈত্য তার বিশাল শরীর নিয়ে এলিয়ে আছে আরামে। তার সাতটি মাথার কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ সকালের নাস্তা সার‌ছে, কেউ কেউ নিজেদের মাঝে গালগপ্পে ব্যাস্ত। মহাবীরের দিকে নজরই করতে চাইল না কেউ। মহাবীর এগিয়ে গেল প্রথম মাথার দিকে। প্রথম মাথা ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকালো।

- সাতমাথা দৈত্যের গুহায় ঢুকেছিস! কি করে এতো সাহস হলো তোর! কি চাই বল!
- তোদেরকে খতম করতে এসেছি। তাড়াতাড়ি তৈরী হ!

ভুরুটা আরো বেশী বাঁকা হয়ে গেলো প্রথম মাথার। সেই সাথে মুখের কোনে বিরক্তি আর টিটকিরি মাখা হাসি। মনে হলো এমন অদ্ভুত কথা শোনেনি কোনদিন সে।

- পারমিশান নিয়েছিস?
- কিসের পারমিশান?
- আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে হলে পারমিশন লাগে, সেটাও জানিস না হতভাগা?
- কে দেবে পারমিশান?
- তিন নম্বরের কাছে যা!

উত্তর দিল পাশের দ্বিতীয় মাথা দাড়ির ভেতর থেকে। ধর্ম নিয়ে ব্যাবসা করতে হলে দাড়ির প্রয়োজন খু্ব। একটি ক্ষুর ধার করার কাজে খুব ব্যাস্ত। গতকাল দলবল নিয়ে আর্টস কলেজের ছাত্রদের ধাওয়া করেছিল। কয়েকটার গলাও কেটেছে। কাল শহীদ মিনারে দিকে হামলার মতলব আছে। এ ছাড়া এয়াপোর্টের সামনে নাকি মুর্তি বসানো হচ্ছে। ধর্মবিরোধী কর্মকান্ড চলতে দিলে তো নিজের আখেরাতও ঝরঝরে! ব্যাটদের শায়েস্তা করা দরকার, তাই ধার কর‌ছে ক্ষুরটি।

কিছুটা থতোমতো খেয়ে গেল মহাবীর। কিন্তু হাল ছাড়লো না, ভয়ও পেলো না। তলোয়ারটি বাগিয়ে এগিয়ে গেল তৃতীয় মাথার দিকে। দেখলো গভীর ঘুমে অচেতন তৃতীয় মাথা। ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করলো। চেঁচিয়ে ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করলো।

- ওর ঘুম ভাঙ্গবে না। গতকাল মেয়রের ইলেকশন করতে গিয়ে খাটাখাটুনি করেছে খুব। ফিরে এসে গাঁজা টেনেছে ঠেসে। সেইসাথে তাড়িও গিলেছে বোতল বোতল। ভাগ ব্যাটা!

বলে খেঁকিয়ে উঠলো চতুর্থ মাথা। মুখ বেয়ে কস গড়িয়ে পড়লো বাইরে। নোংরা দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুতু ছিটকালো এদিক সেদিক। গুহার ভেতরটা দুর্গন্ধে আরো বেশী ভারী হয়ে গেল। বাঁ হাতে নাক বন্ধ করে তার দিকে এগিয়ে গেল মহাবীর।

- তাহলে পারমিশানটা দেবে কে?
- সেটা আমি কি করে বলবো? কাল আসিস, নইলে পরশু। হয়তো জাগবে। আমি কি জানি? যদি রাজনীতি করতে চাস, মানুষ খুন করতে চাস। আমাকে বল। টাকা ঢালবি, সব করে দেব।

পাঁচ নম্বর মাথাটি আরামে শুয়ে শুয়ে ইতস্ততঃ সপ্নে বিভোর। গতকাল সারারাত বেশ্যাপাড়ায় কাটিয়েছে। বেশ কয়েকজন বড় বড় মন্ত্রীও সাথে ছিল। তাদের সাথে মিলে মিশে ফুর্তিও করেছে ইচ্ছেমতো। মাগীগুলোকে গতরে খাটিয়ে যে টাকাপয়সা কামিয়েছে, তাতে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বেড়ে বেড়ে আকাচুম্বী। তাই মেজাজও ভালো। কিছুটা হাসিমুখ নিয়েই মহাবীরের দিকে তাকিয়ে বললো,
- কি রে! কি চাই তোর?
- তোদেরকে পরপারে পাঠাতে চাই!
- তাহলে পাঠা!

বলেই পাশ ফিরে শুলো সে। মহাবীরকে যে এতটুকু পাত্তা দিল, সেটাই তার কাছে বেশী মনে হলো। পাশ ফিরে শুতেই ছয় নম্বরের সাথে চোখাচোখি হলো তার। ছয় নম্বর সকালের নাস্তা নিয়ে ব্যাস্ত। ঘিয়ে ভাজা পরোটার সাথে খাসীর মাংসের ভুণা। আস্ত এক হাড্ডি চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলো পাঁচ নম্বর মাথাকে,
- কি চায় এই ব্যাটা?
- কি জানি, খুনোখুনির কথা বললো। ব্যাটার মাথাটা একেবারেই খারাপ।

শুনে ছয় নম্বর তার হাড্ডির দিকে মনোযোগ দিল আবার। সপ্তম মাথাটি গতকাল কয়েকটি বস্তিতে আগুন লাগিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। সেখানে এখন বড়বড় দালান উঠবে। এক হাউজ বিল্ডিংএর মালিকের সাথে খুব খাতির তার। সেই সুবাদে অনেক সরকারী আমলার সাথেও। কিছুটা ক্লান্ত হয়ে আছে। সকালের এই ছিটকে উপদ্রবে তিরিক্ষি হয়ে উঠলো মেজাজ। কিছু বলতে না চাইলেও মহাবীরের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটি নিঃশ্বাস ফেললো সে। তাতেই যে আগুন বেরিয়ে এলো, পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল মহাবীর। শুধু তলোয়ারের বাটটি পড়ে রইলে গূহার এক কোনে। সেদিকে হতাশ দৃষ্টিতে প্রথমে তাকিয়ে থাকলো সপ্তম মাথা। তারপর মাথাটি নেড়ে বললো,

- শালার মানুষগুলোর এই একটা খারাপ স্বভাব। অদ্ভুত জীব ওরা! কি চায়, কখন চায়, কিভাবে চায়, একেবারেই স্পষ্ট করে জানাতে পারে না।

তৃতীয় মাথাটি তখনো অকাতরে ঘুমিয়ে চলেছে। তার নাক ডাকার শব্দে গূহার দেয়াল কেঁপে উঠলো বারবার। আজ অবধি সে ঘুম ভেঙ্গেছে কি না, কে জানে?


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

আধুনিক রূপকথা ভালো হইছে।
ভয় ধরানো ভালো।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

তীরন্দাজ এর ছবি

সময়টাই যে ভয়ের! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

**********************
সে দৈত্যের কাছে আমাদের সব হিরু হেরে যায় তীরুদা! তার রাহুগ্রাস থেকে মুক্তির উপায়?

কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

মুক্তির উপায় আমাদের সবার জানা, কিন্তু মুক্তি আমরা আদৌ কি চাই ?

লেখা অসাধারণ, আমি কল্পনায় ও এমন লেখা লেখতে পারলে বর্তে যাই
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ দেবোত্তম দাশ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

তীরন্দাজ এর ছবি

দু:খজনকভাবে আমাদের তেমন কোন হিরো নেই। যারাই সাত মাথা দৈত্যের গূহায় গিয়েছে, তার হয় মরেছে, নয় সে দৈত্যরই আট নম্বর মাথা হয়েছে।

মুক্তির উপায় জানা নেই বলেই তো এই গল্পের অবতারণা পুতুল!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

Shadhoo [অতিথি] এর ছবি

এত সুন্দর লেখা কিকরে আপনার মাথায় এল ॥
THANKS for the most deserved idea!

তীরন্দাজ এর ছবি

কি জানি? আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশী হলাম।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

শেখ জলিল এর ছবি

আধুনিক দৈত্যকাহিনী বেশ শিক্ষণীয়।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন্যবাদ জলিল ভাই! ভালো আছেন?
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।