পৃরোনো আলাপ: ২০০৭ এর একুশের দিনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে তীরন্দাজের খোলা চিঠি

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৮/০১/২০০৯ - ২:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২০০৭ এর একুশের দিনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলাম। এর মাঝে সময় অনেক পথ পেরিয়েছে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও পাল্টেছে পুরোপুরি। আমাদের দেশে আবার ফিরে এসেছে গনতন্ত্র। পাশাপাশি আমরা সপ্ন দেখি ডিজিটাল বাংলাদেশের। কিন্তু তারপরও চিঠিটির কথা মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো।

শ্রদ্ধেয়া শেখ হাসিনা
আজ ইনকিলাবে আপনার অবেদনটি 'প্লীজ সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলুন' শীর্ষক লেখাটি পড়ে আপনাকে এই খোলা চিঠিটি লিখতে অনুপ্রাণিত হলাম। আমি রাজনীতিবিদ নই, অতি সাধারণ একজন মানুষ। দেশ, দেশের মানুষ ও এদেশের রাজনীতির প্রতি আমার সচেতনতা রয়েছে, এটাই আমার পরিচয়। জানিনা আমার এ লেখা আপনার চোখে পড়বে কি না, তারপরও ক্ষুদ্র আশা রয়েছে হয়তো কোনভাবে পড়বে। এর পাশাপাশি এ লেখার একটি কপি আওয়ামী লীগের হোমপেজে পাওয়া ই-মেইল ঠিকানায় পাঠালাম।

শ্রদ্ধেয়া শেখ হাসিনা, আপনি সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার আহ্বান জানিয়েছেন। অতি সুন্দর ও যুক্তিসিদ্ধ চাওয়া আপনার। তবে ও চাওয়া শুধুমাত্র আপনার একার নয়, দেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের এই একই চাওয়া। আমাদের দেশের আমলাতান্ত্রিক সমাজ, ক্ষমতা ও সম্পদকেন্দ্রিক রাজনীতির যাতাকলের পেষনে এই অতি সাধারণ চাওয়াও আমাদের জন্যে অতি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের রাজনীতিবিদরা কি সাদাকে সাদা দেখেন? গত পয়ত্রিশ বছরের রাজনীতিতে দু:খজনকভাবে আমরা তার কোন প্রমান দেখতে পাইনি।

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর উৎপত্তির ইতিহাসের দিকে নজর দেয়ার ডাক দিয়েছেন আপনি। বিষয়টি এত বেশী অনস্বীকার্য যে, এ ডাকের আদৌ কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। যে ইতিহাসকে বুকে ধারণ করে আওয়ামী লীগের উপস্থিতি বাংলাদেশে, সে ইতিহাসকে সঠিকভাবে ধরে রাখতে পারলে আজ এ দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষ মাথায় আগলে রাখতো এ দলকে ও এ দলের প্রতিটি নেতাকে। কিন্তু আপনারা তা করতে পারেন নি। অন্যান্য দলের নেতাদের মতোই ক্ষমতা, সম্পদ আর ভোগলিপ্সার কাছে বলি হয়েছেন আওয়ামী লীগেরও বেশীরভাগ প্রভাবশালী নেতাও। এটা আপনাদেরই নিদারুন ব্যার্থতা, দেশের মানুষের একচোখা দৃষ্টিভঙ্গী নয়। পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও বাংলাদেশের স্বাধীনতায় আওয়ামী লীগের অবদানের উচ্চতর শিখর থেকে আপনারাই এ দলকে টেনে নামিয়ে এমনি এক অবস্থায় দাঁড় করিয়েছেন।

শ্রদ্ধেয়া শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল দল হিসেবে জানে এ দেশের জনগন। কিন্তু তা কাগজে কলমে, চলনে বলনে হলেও বাস্তবে তার কোন প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়নি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এক সেমিনারে যোগ দিয়েছিলাম জার্মানীতে। তিনদিন ব্যাপী এ সেমিনারের সভ্পতিত্ব করেছেন আওয়ামী লীগেরই এক মহিলা নেত্রী। সে সময়ে বিএনপি বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমতায় ও আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের ভুমিকায়। ক্ষমতাশীন বিএনপি সরকারের বিরদ্ধে তুমুল আন্দোলনে আপনারা আঁতাত করেছেন জামাতে ইসলামীর সাথে। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আপনাদের এই পদস্খলনে। আমি একা নয়, আমার মতো অনেকেই এটাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারে নি। রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে জামাতের মতো একটা স্বাধীনতাবিরোধী, ধর্মান্ধ দলের সাথে কোন ইস্যুতেই আঁতাতে যাওয়া প্রতিটি সচেতন মানুষের জন্যে মহাপাপের সামিল। আপনারা নিজেরা সে পাপে পাপী হয়ে এ মানুষগুলোর কাছে আপনাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। আমি সেদিন সেই নেত্রীকে এ প্রশ্ন রাখার পর তিনি কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেন নি। সভা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম, আরো কয়েকজন যোগ দিয়েছিলেন আমার সাথে।

আমরা যারা প্রগতিশীল চিন্তা করি, যারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে মানি, আমরা যারা ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই, আমাদের অনেকেরই অনেক প্রত্যাশা ছিল এই সংগঠনকে ঘিরে। সেটা পূরণ হয়নি, আপনারা পূরণ করতে পারেন নি। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানে জেলে, তখন জামাতের গোলাম আজম পাকিস্তানী দখলদার শাসকদের সাথে পাকিস্তানে তার বিলাসবহুল বৈঠকখানায় বসে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে কি ভাবে ধুলিস্যাত করা যায়, তার নীল নকশা প্রণয়নে ব্যাস্ত। সেই গোলাম আজমকে দেশে ফিরিয়ে এনে অপরাধ করেছে বিএনপি, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর সেই বঙ্গবন্ধুর কন্যা হয়ে আপনি যখন গোলাম আজমের সাথেই আঁতাতে যান, তখন কোন তুঙ্গে আমাদের হতাশা ঠেকতে পারে, তা একবার ভেবে দেখেছেন কি? তারপর করলেন এবছর এক জঙ্গীবাদী ওলেমা সংগঠনের সাথে আঁতাত। সেখানে চেষ্টা করেছেন ফতোয়াকে আইনসিদ্ধ করার। তাতে হরিয়েছেন আপনাদের বাকী বিশ্বাসযোগ্যতা। যদিও সে চুক্তি পরে বাতিল করা হয়েছে, তারপরও বিশ্বাযোগ্যতার এ নিদারুন পরাজয় দুর হবে কি না, এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। জানা কথা, রাজনৈতিক রণকৌশল অনেক সময়েই সাধারণ নীতিবোধকে পাশাপাশি আঁকড়ে ধরে চলতে পারে না। একসময় দূরত্ব আসে এদের বিভিন্নতার কারণেই। কিন্তু এই দুরত্ব এতদুর যেতে পরে না, যাতে একটি অপরিচিতির কবজ্বান্দী হতে পারে এই দুই বোধ। আপনারা সেই দুরত্বই তৈরী করেছেন আপনাদের সুবিধাবাদী চিন্তার কাছে নিজেদের পরাজয় ঘোষনা করে। প্রগতিশীল চিন্তার বাহকদের কাছে অপরিচিত করে তুলেছেন নিজেদের।

শ্রদ্ধেয়া শেখ হাসিনা, আপনি এ চিঠিতে ঢালাওভাবে রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননে প্রতিবাদী হয়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যাদেরকে ধরা হয়েছে তাদের প্রায় সবাই দুর্নীতির অপরাধে অপরাধী। দেশের বেশীরভাগ মানুষই বর্তমান তত্বাবধায়ক সরকারের এই পদক্ষেপে আনন্দিত ও স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলছেন। এতে ঢালাও ধরণের চিন্তার সামান্য ছোঁয়াচ থাকলেও এ চিন্তার পেছনে রয়েছে আপনাদেরই অবদান। জাহাঙ্গীরনগরে খোলা পিস্তল হাতে আপনার ভাই শেখ কামালকে যখন মুজিববাদী ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করতে দেখেছি, তখনই এই নোংরা রাজনীতির প্রতি অনীহা তৈরী হয়েছিল। এ আমার কারো কাছ থেকে শোনা বা পত্রিকা পড়া কথা নয়, স্বচক্ষে দেখা। ভার্সিটি চত্বরে ও হলের ঘরে ঘরে জাতির জনকের সন্তানের হাতে খোলা পিস্তল দেখে যে আঘাত পেয়েছিলাম, তার আঘাত এখনও অতিক্রম করে উঠতে পারি নি। তার কয়েক মাস পরেই ঘটে সেই পৈশাচিক হত্যাকান্ড। দেশের জনগন, যারা এই বঙ্গবন্ধুকে চোখের মনি করে রেখেছিল, তাদেরই বিরাট এক অংশ আনন্দে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। আর আমরা সে লজ্জায়, সে গ্লানিতে ঘরের কোনে অশ্রুপ্লাবিত।

কিন্তু কেন এমনটি হলো? কেন এমনি এক পৈশাচিক হত্যাজজ্ঞের পর কিছু লোক হলেও রাস্তায় বেরিয়ে আসবে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে ক্ষমতাশীন হবার পর আপনাদের কর্মপ্রবাহের, সাধারণ জনগনের সাথে আপনাদের যে দুরত্ব তৈরী হয়েছিল, তার মাঝেই। আপনি লিখেছেন, বাকশাল করা হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট সময়কে অতিক্রম করার মানসেই। আমরা সাধারণ মানুষ কিন্তু তা একেবারেই বুঝতে পারিনি। এই না বোঝার দ্বায়িত্ব আপনাদের তৈরী করা দুরত্বের উপরই বর্তায়।

শ্রদ্ধেয়া শেখ হাসিনা। আপনার চিঠিতে একটি বক্তব্যের অনুপস্থিতি পীড়াদায়ক লেগেছে। বর্তমান তত্বাবধায়ক সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ যে আমাদের দেশের ও বিশ্বের গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কারণেই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না, তা কারোরই অজানা নয়। এই ইতিবাচক পদক্ষেপ ও তার প্রতি জনগনের সমর্থন যে দিকে অঙ্গুলি নিক্ষেপ করছে, তা হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের ভেতরের শুদ্ধিকরণ একটি অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হয়ে দাঁড়িয়েছ। এ পদক্ষেপ আরেকটি কারণে প্রয়োজন, যাতে রাজনৈতিক রণকৌশল ও সাধারণ নীতিবোধ পাশাপাশি এক কদমে চলার যোগ্যতা অর্জন করে। সেদিকে আপনার কোন বক্তব্য না দেখতে পেয়ে হতাশ হলাম। আশা করছি তার প্রয়োজনীয়তা আপনি দেখতে পাবেন একদিন। জানা কথা একদিন আপনাদের বা আপনাদের বিরোধী পক্ষের হাতেই এ দেশের শাসনক্ষমতা বর্তাবে। তখন আপনাদের এই সময়ের শুদ্ধিকে সম্বল করে ও শাসনক্ষমতাকে ক্ষমতা হিসেবে না দেখে শাসনভার হিসেবে দেখে যদি নিজেদের প্রকাশ করতে পারেন, তাহলে আওয়ামী লীগের নিজস্ব ইতিহাস ও কর্মের কারণেই আমারই মতো আরো অনেক প্রগতিশীল মননকে আপনাদের পাশাপাশি পাবেন। সে দিকে নজর রেখে ও আপনাকে অমর একুশের শুভেচ্ছা জানিয়ে ইতি টানছি।

তীরন্দাজ।
জার্মানী, ২১.০২.২০০৭


মন্তব্য

অনিশ্চিত এর ছবি

আমার বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই আওয়ামী বিরোধী (যদিও তারা এবার মহাজোটকেই ভোট দিয়েছে), কারণ একমাত্র আওয়ামী লীগের কাছেই তাদের অনেক প্রত্যাশা ছিলো। অন্য দলগুলোর কাছে তাদের কোনো প্রত্যাশাই নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ বারবার তাদের হতাশ করে এমন অবস্থায় নিয়ে গেছে যে, তারা আওয়ামী লীগের কাছে কিছু আশা করতেও দ্বিধায় ভোগে। আওয়ামী লীগ যদি এটা বুঝতে পারে যে, যার কাছে প্রত্যাশা বেশি থাকে, তার ছোটখাটো ভুলও বুকে বাজে- তাহলে দলটি হয়তো অতীত ভুলগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবে।
‌‌-------------------------------------
হাত বাঁধা, কিন্তু দড়ি মুক্ত - হায় পৃথিবী!

‌‌-------------------------------------
হাত বাঁধা, কিন্তু দড়ি মুক্ত - হায় পৃথিবী!

জিজ্ঞাসু এর ছবি

কড়া, সময়োপযোগী চিঠি। চলুক

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

রণদীপম বসু এর ছবি

চলুক

অফটপিক: তীরন্দাজ ভাই, কানাডা থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা 'সুবর্ণ স্বদেশ'-এ আপনার 'জাহাজী জীবনের গল্প' ধারাবাহিক ছাপছে দেখে ভালো লাগলো। অভিনন্দন। ওখানে ধারাবাহিকটি আপনার পিতৃপ্রদত্ত নামেই বোধ করি ছাপা হচ্ছে....

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

তীরন্দাজ এর ছবি

খবরটির জন্যে অনেক ধন্যবাদ রণদীপম। আমি খুশী খবরটি শুনে। কিন্তু ওরা আমাকে এ বিষয়ে কিছুই জানায় নি।একটু জানালে ভালো হতো না?

আপনি কি ওদের লিংক টি জানেন বা ঠিকানা? ওদেরকে অন্তপক্ষে কপি পাঠাতে অনুরোধ করতে পারতাম।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

তুলিরেখা [অতিথি] এর ছবি

কী অবস্থা!!!!!!! বলেন কি? লেখকই জানেন না?
আমার এক বন্ধুর একবার এরকম হয়েছিলো। মিশর-ভ্রমণ নিয়ে লিখে এক ফোরামে দেন, ওনাকে কিছু না জানিয়েই এক পত্রিকায় বেরোয়!!!!!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।