ছোটগল্প: আমার মা

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: শনি, ২৬/১২/২০০৯ - ৯:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রতিবারই মনে হয়. শক্ত এক সাঁড়াশি দিয়ে কেউ চেপে ধরে আমার কণ্ঠনালী। নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মগজের রক্তপ্রবাহ থেমে বিকল করে দেয় বোধ। আমার সামনে একটিমাত্রই পথ। নিজের গলার আওয়াজকে যথাসম্ভব কমিয়ে দিতে হয়। যতই কমাতে থাকি, ধীরে ধীরে ততোই ফিরে আসে বোধ। নি:শ্বাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়তে থাকে সে সাথে। মগজের ভেতরের জড়তা সরিয়ে নিজেকে অনুভব করতে শুরু করি আবার। কিন্তু তখন আমার গলার আওয়াজ একমাত্র আমি ছাড়া শুনতে পায়না কেউ। এমনকি মাইকের আওয়াজ বাড়িয়েও কোন কাজ হয়না তখন।

অথচ যেকোন বিষয় গুছিয়ে বলায় বেশ নামডাক আসার। দর্শণের জটিল তত্ত্ব এতো সহজ ভাষায় ছাত্রদের, শ্রোতাদের সামনে বোধগম্য করে তোলায় আমার সমকক্ষ খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। এই খট্‌খটে শুকনো তাত্ত্বিক বিষয়ে আমার বক্তৃতা শোনার জন্যে যত বোদ্ধাদের ভীড় জমে, সেটি অনেকের জন্যেই যথেষ্ট ঈর্ষার কারণ। তারপরও আসে অনেকেই, এমনকি যারা ঈর্ষা করে, তাদেরও কেউ কেউ। কিন্তু লোকজনের সংখ্যা বাড়তে থাকলেই তার সাথে পাল্লা দিয়ে গলার আওয়াজ কমতে থাকে আমার। ছাত্রদের বেলায় কোন সমস্যা হয়না, ওরা আমাকে জানে। এমনকি ক্লাশেও মাইকের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু বাইরের বোদ্ধাদের সামনে খুব বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। মাঝে মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় হলে। কেউ কেউ টিটকিরি মেরে শিসও দিয়ে বসে। আমাকে কিছুক্ষণ বিরতি নিতে হয়। কিছুটা আত্মস্থ হয়ে ধীরে ধীরে মৃদু আওয়াজেই বক্তৃতা শুরু করি আবার। হয়তো বিষয়বস্তু, আর আমার বলার ধাঁচের গুনেই মনোযোগ ফিরে পায় শ্রোতারা। আমি পার পেয়ে যাই কোনভাবে।

লোকজনের ভীড় না থাকলে বেশ ভালো থাকি। একা একা কথা বলায় যতটা জোর আমার, সেটি স্বাভাবিকের চাইতে কম বলে মনে হয়না। বহু মানুষের ভিড়ে এই কষ্টটি শুরু হয়। তারপর তার রেশ আরো কয়েকদিন ধরে আমার জীবনীশক্তি কুরে কুরে ধ্বংস করে। বেশী লোকজনের সামনে কথা বলা কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি তাই। ডাক্তারের কাছে গিয়েছি, মনোবিদও দেখিয়েছি বহুবার। দেশের বাইরেও চিকিৎসা করিয়েছি। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হয়নি। এখন আমার বিশ্বাস, সমস্যাটি আমার নিজেরই গঠন, গড়ন আর মননের একটি অংশ হয়ে গিয়েছে। অনেকটা নিজের ছায়ার মতো। অনেক মানুষের ভিড়ে সে ছায়াটি বড় আর স্পষ্ট হতে হতে আমাকেই গ্রাস করে আমার কণ্ঠনালী চেপে ধরে। আমার আর মুক্তির কোন পথ থাকে না।

আমার এই অবস্থার জন্যে একজনকে দায়ী করি আমি। সে’জন আমার মা। তারপরও কর্তব্য পালন, নিয়মিত টাকা পাঠানোয় আমার কোন গাফিলতি নেই। সেসব করেও মায়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছি অনেকদিন। মা আমার সাথে যা করেছে, তার প্রতি আমার ব্যবহার সেটিরই এক ধরনের পুনরাবৃত্তি বলা যেতে পেরে। মা আমাকে কম ভালবাসতো, এটি কখনোই বলতে পারবো না। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা ভালো মন্দের দিকে কম নজর রাখতো, একথাও ঠিক নয়। একেবারে শিশুবয়েসে বাবার মৃত্যুর পর যেভাবে আগলে রেখে আমাকে বড়ো করেছে মা, সেভাবে কম মা-ই করে থাকে। বাবার মৃত্যুর পর অল্পবয়সী বিধবা, দেখতেও যথেষ্ট সুন্দরী, সচ্ছল ঘরের মেয়ে, বিয়ে দিতে কোন সমস্যা হবার কথা নয়। তারপরও বিয়েতে মায়ের মত আদায় করতে পারেনি কেউ। বাবার মৃত্যুর পর একমাত্র আমাকে ঘিরেই মায়ের দৈনন্দিন জীবন, এর বাইরে আর কিছুই নয়। তারপরও আমাকে ভয়ঙ্কর এক চাপের মাঝে রাখতো মা। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে দিত না মা। আওয়াজ সামান্য বাড়লেই ছুটে আসতো। এত জোরে কথা বলবি না! বলে ধমক দিতো বারবার। রক্তশুন্য চেহারা, উদভ্রান্ত ঘোলাটে দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। আমি সে দৃষ্টির সামনে কেঁপে উঠতাম ভয়ে। এক আত্মীয়ার কাছে শুনেছি, ছোটবেলায় নাকি কান্নার সময় একবার গলাই টিপে ধরেছিল। পরে সুস্থির হয়ে নিজেই কেঁদেছে! এসব দেখেশুনে একসময় ছেলেবেলার বন্ধুবান্ধবরাও পেয়ে বসলো আমাকে। কোন খেলাধুলোর সময় জোরে চিৎকার করে উঠলে তারাও থামিয়ে দিত আমাকে। অনেক সময় এসে নালিশ করতো মায়ের কাছে। আমাকে মায়ের সেই অস্বাভাবিক দৃষ্টির সামনে গুটিয়ে যেতে হতো আবার।

কিছুটা বয়েস হবার পর মাঝে মাঝে মায়ের কাছে তার এই ব্যবহারের কারণ জানতে চাইতাম। অন্যরা জোরে কথা বললেও কোন সমস্যা নেই, শুধুমাত্র আমার বেলাতেই মায়ের এই ব্যবহার কোন? প্রতিবারই কোন উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যেতো মা। বলতো, সময় হলে সব জানাবে আমাকে। কিন্তু সে সময় হবার আগে আমি নিজেই ধীরে ধীরে মায়ের এই নিষেধের দাসে পরিণত হয়ে গেলাম। উঁচু গলায় কথা বলা তো দূরের কথা, বেশী মানুষের সামনাসামনি হলে আমার গলায় স্বরই বেরুতে চাইত না। এই অবস্থার পর প্রতিবারই একটু একটু করে মায়ের উপর রাগ বেড়ে যেতো আমার। সে রাগ ধীরে ধীরে ধীরে এক শীতল দূরত্বের বোঝা নিয়ে জেঁকে বসলো আমাদের মাঝে।

পড়াশোনায় ভালো আমি। বিদ্যালয়ের সিড়িগুলো তরতর করে পেরিয়ে যেতে কোন সমস্যা হলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি পাবার পর একদিন মায়ের সাথে কথা হলো। সন্ধ্যার একটু আগে বারান্দায় বসে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল মা। আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। মা আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো।
- কাল আমি ঢাকা চলে যাচ্ছি মা। ইউনিভার্সিটির চাকুরি পেয়েছি।
- ভালো।
সামান্য একটু সময় নিয়ে উত্তর দিলো মা। সে উত্তর আমাদের মাঝের শীতলতাকে আরো বেশী ঘনীভূত করলো।
- এখান থেকে যাওয়াআসা করতে খুব সময় লাগে বলে ওখানেই একটি বাসা নিয়েছি। কাল থেকে ওখানেই থাকবো।
এবার কিছুটা থমকে আমার মুখের দিকে তাকালো মা। মায়ের এই থমকে যাওয়ার কারণ একেবারেই সহজ।। এতদিন তো সেই ভার্সিটিতেই পড়াশোনা করেছি। এখান থেকেই প্রতিদিন আসা যাওয়া করেছি। মায়ের থমকানো এটুকুতেই সীমাবদ্ধ রইলো। সরাসরি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
- ভালো।

আমাদের ভেতরে যে অভিমান আর ক্ষোভ জমা হয়েছে এতদিন, সেসব না ভেঙ্গে শীতের মেঘের মতো আরো বেশী ঘনীভূত হলো। আমরা মা আর ছেলে ধীরে ধীরে পরস্পরের জন্যে আরো বেশী অচেনা হয়ে গেলাম। কালেভদ্রে ছুটিতে বাড়িতে এলেও আমাদের দূরত্ব কমলো না। মায়ের জীবনের বাইরে আমার যে জীবন, সেখানেই নিজের সমস্যার সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকায় প্রয়াসী হলাম।

অনেকদিন বিরতির পর একবার মায়ের অসুস্থতার খবর এলো হঠাৎ। মা নিজেই খবর পাঠিয়েছে। নিজের ভেতরেই কী এক অনুভূতি কাজ করলো জানিনা, তবে এবার এক সপ্তাহ ছুটি নিয়েই গেলাম বাড়িতে। মায়ের এই অসুস্থতার মাঝেও প্রতিবারের মতো অন্ধকার নিস্পৃহতার গ্রাসে পরিণত হলো না আমাদের এবারকার সাক্ষাৎ। তার শোবার ঘরের বিছানায় যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহারা নিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে মা। আমি ঘরে ঢুকতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার চেহারা। আমি বিছানায় বসে তার হাতটি ধরে বললাম,
- কেমন আছ মা?
- আজ একটু ভালো। তুই কেমন?
- ভালো।
- ঠিক আছে। এবার মুখহাত ধুয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে নে। তারপর বিশ্রাম নিয়ে আয় আমার কাছে। তোকে কিছু কথা বলার আছে।
মনে হলো, যে সত্য জানার জন্যে এতদিনের অপেক্ষা আমার, আজ তার মুখোমুখি হবার সময় হয়েছে। আমার বুকের ভেতর দুরুদুরু আওয়াজ শুরু হয়ে গেলো। কোনভাবে খাওয়াদাওয়া সেরেই আবার এসে বসলাম মায়ের বিছানার পাশে।
- এতো তাড়াতাড়িই হয়ে গেলো খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম?
- হ্যাঁ মা।
- তুই আমার উপর খুব অভিমান করে আছিস, তাই না?

আমি কোন উত্তর না দিয়ে বসে রইলাম। জীবনের গতিপ্রবাহকে পাথরচাপা করে থামিয়ে দেয় বারবার যে মা, তার উপর শুধুই অভিমান? কিছুই বলতে পারলাম না। মা ও কথা বলতে অনেকটা সময় নিল। মনে হলো অসুস্থতার কষ্ট আর আত্মার ভেতরের কোন এক তীব্র যন্ত্রণা তাকে অবশ করে দিয়েছে। আমাকে পানিভর্তি একটি গ্লাস এগিয়ে দিতে ইশারা করলো। আমি এগিয়ে গিয়ে গ্লাসটি মায়ের মুখের সামনে তুলে ধরলাম। এক ঢোক পানি খেয়ে বিছানায় মাথা এলিয়ে চোখ খুলে আমার দিকে তাকালো মা।
- আমার কোন উপায় ছিল না বাবা! যেভাবে হঠাৎ ভেঙ্গে চুরমার হলো আমাদের সাজানো জীবন, তাতে পাগলই হয়ে যাবার কথা! কিছুটা হয়েছিও, আর সেজন্যে আমি নিজেকেই দায়ী ভাবি বাবা।
- কি হয়েছিল মা?
- বলছি, বলার জন্যেই তোকে ডাকলাম আজ। জানিনা, এতদিন যা বলিনি, আজ সেটি বলে ভুলের বোঝা আরো বাড়াবো কি না। কিন্তু গোপন রেখেও তো তোকে তিলে তিলে শেষই হতে দেখলাম আজ অবধি।
- সে যাই হোক, বলো মা। এ কথাটি শোনার জন্যে এতদিন অপেক্ষা আমার!

আবারও কিছুক্ষণ বিরতি নিল মা। মনে হলো শক্তি সঞ্চয় করছে। আমি তার মুখের দিতে তাকিয়ে অপেক্ষায় রইলাম। তার শারীরিক কষ্ট আমাকে একেবারেই স্পর্শ করলো না।

- তোর বয়েস যখন তিন মাস, তখন তোর বাবা মারা যান। সেটি জানিস নিশ্চয়ই।
- জানি মা। বলেছো, পাকিস্তানী সৈন্যরা মেরেছে বাবাকে।
- হ্যাঁ, সেকথা বলেছি তোকে। কিন্তু এর পেছনের কাহিনী আজ অবধি বলিনি তোকে।
- না বলনি, যদিও আমি অনেকবারই শুনতে চেয়েছি।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো না। মনে হলো, প্রচণ্ড শক্তিতে বাঁধভাঙ্গা কান্নাকে চাপিয়ে রাখতে চাইছে।

- ১৯৭১ এর মার্চে আমাদের ঢাকার বাসায় জন্ম হয় তোর। ইয়াহিয়ার বাহিনী যখন তাদের সমস্ত বর্বরতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঙ্গালীদের উপর, তখন আমরা ঢাকা ছেড়ে তোর বাবা গ্রামের বাড়িতে পালাতে বাধ্য হই। কয়েক মাস থাকার পর মুক্তিবাহিনীর একটি দল আসে সে গ্রামে। আমরা যে পাড়ায় থাকতাম, সেখানে এক রাতের আশ্রয় চায়। কচি কচি ছেলে, দেশের জন্যে, স্বাধীনতার জন্যে জীবনপণ ওদের। তোর বাবা ও গ্রামেরই আরো কয়েকজন মিলে ওদের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করে, রাতে থাকার জন্যে বিছানা পেতে দেয়। ওরা একরাত থেকে পরদিনই আবার পথে নামে।

এটুকু বলে আবার থামলো মা। পানির গ্লাসটির দিকে ইশারা করার আগেই, সেটি এগিয়ে দিলাম তার দিকে। মা পানি খেয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল। মনে হলো, নিজের চিন্তাশক্তিকে কেন্দ্রীভূত করার শক্তি খুঁজছে কোন এক অজানা অন্ধকারে।

- গ্রামের রাজাকাররা এত তাড়াতাড়ি খবর পাবে, আর সে খবর একদিনের মাঝেই পাশের গ্রামের পাকিস্তানী ক্যাম্পে পৌঁছে যাবে, তা ভাবেনি কেউ। ওরা চলে যাবার পরের দুপুরে দুটো স্পীডবোট এসে থামলো আমাদের বাজারের ঘাঁটে। বাজারের লোকজনদের কাছে আমাদের খবরাখবর জানতে চাইলো। আমরা ওদের আসার কথা জেনে পালাতে বাধ্য হলাম। কয়েক জন নৌকোয়, আর কয়েকজন সাঁতরে লুকিয়ে রইলাম আমাদের নদীর পাড়ের কবরস্থানে। কী এক ভয়াবহ সময় ছিল সেটি, তা তোকে বলে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। ভেজা পোষাক আর শীতের কষ্টে তুই কেঁদে উঠছিলি বারবার। আমি তোকে থামানোর চেষ্টা করেও পারিনি। এরই মাঝে আমাদের খোঁজে কবরস্থানের পাশেই সৈন্যদের দুটো নৌকো এসে ঘোরাফেরা শুরু করলো। হয়তো সাপের ভয়ে নৌকো ভিড়িয়ে নামার সাহস পায়নি। আমি তোর কান্না আটকানোর জন্যে শক্ত করে মুখ চেপে ধরেছিলাম। কতক্ষণ, তা বলতে পারবো না। একসময় দেখলাম নীল হয়ে আসছে তোর চেহারা। চোখদুটো যেন গর্ত থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তাকিয়ে দেখলাম, কিছুটা দূরে চলে গিয়েছে এদের নৌকো। তোকে বাঁচানোর জন্যেই মুখ থেকে হাত সরাতে বাধ্য হলাম। ছাড়া পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলি তুই। শুনতে পেয়ে ফিরে এলো ওরা। নৌকো থেকেই বৃষ্টির মতো গুলি চালালো। তোর বাবা সহ সবারই গুলিতে ঝাঁঝরা হলো শরীর। তুই আর আমি যে কীভাবে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে রইলাম, জানিনা। আমাদের চারপাশে যখন রক্তাক্ত দেহের ছড়াছড়ি, তখন তুইও চুপ, আমিও চুপ। সৈন্যরাও তাদের কাজ সেরে ফিরতি পথে।

এটুকু বলে চুপ হয়ে রইলো মা। জলের গ্লাসে সামান্য চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই তার সেই ভয়াল স্মৃতিতে ফিরে গেলো আবার।
- ছোটবেলায় তুই চিৎকার করে কাঁদলেই সেই ভয়াবহ স্মৃতি ফিরে আসতো বারবার। মনে হতো, আমি সেই কবরখানায়, চারপাশে খানসেনার দল। তখন তোকে না থামলে আমি হয়তো পাগলই হয়ে যেতাম। আরেকটু বড় হবার পর তুই জোরে কথা বললেও আমি সেই স্মৃতিতেই ফিরে যেতাম। আমার কোন উপায় ছিল না বাবা। আমাকে ক্ষমা করে দে!

আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না। মায়ের প্রতি যে রাগ আর ক্রোধ জমে ছিল এতদিন, তা মিলিয়ে গেলো হঠাৎ। বরং নিজেকেই অপরাধী মনে হলো। মায়ের হাত ধরে পাশে আরো কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম নিজের ঘরে। তিনদিন পরই বস যন্ত্রণা আর কষ্টের অবসান ঘটিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় মা।


মন্তব্য

রাহিন হায়দার এর ছবি

ভালো লাগলো। তবে শেষের দিকের বর্ণনাটা আরো ভালো হতে পারত বলে মনে হচ্ছে আমার।

________________________________
তবু ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া মানা

তীরন্দাজ এর ছবি

আপনার কথা ঠিক। শেষে এসে তাড়াহুড়ো করি প্রতিবারই!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

কষ্ট বর্ণনা, এটা গল্প নয় তীরুদা।
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

তীরন্দাজ এর ছবি

হয়তো তাই। ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

ধুসর গোধূলি এর ছবি

একসময় দেখলাম নীল হয়ে আসছে তোর চেহারা। চোখদুটো যেন গর্ত থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
গল্পটা অসাধারণ লেগেছে কিন্তু কবরস্থানের অন্ধকারে এই দুইটা লাইন কেমন জানি লাগলো তীরুদা।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

তীরন্দাজ এর ছবি

কবরস্থানে অন্ধকার ছিল বা রাত ছিল, এই কথা কখন লিখলাম? দিনের বেলা ঘটনাটি ঘটতে পারে না?

ঢাকা শহরের বনানী কবরস্থান যথেষ্ট আলোকিত জায়গা। বিশাল দালানের ভীড়ে অন্ধকারে ডুবে নয়। আমাদের গ্রামের ঢোলভাঙ্গা নদীর পাড়ের কবরস্থানটিও যথেষ্ট আলোকিত থাকে দিনের বেলা।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আলোকিত থাকলে তো আরও সমস্যা তীরুদা। চিন্তিত

ঘটনাটা দিনের বেলা আর আলোকিত হলে কবরস্থানে যারা লুকালো, তারা নিজেদের ঠিকমতো লুকিয়ে রাখতে পারার তো কথা না। অনেক বড়বড় ঘাস থাকতে হবে নল খাগড়া কিংবা শনের মতো। আর কবরস্থানের পাশে নৌকায় টহল দেয়ার সময় পাকি সৈন্যদের সেই নল খাগড়ার ঝোপ ভেঙে কেউ ভেতরে ঢুকলে সেটাও চোখে পড়তো! তারা যে রকম মাথামোটা, ঐ দেখেই গোলাগুলি শুরু করে দিতো।

আরেকটা অপশন হতে পারে সবাই হয়তো পুরনো কোনো কবরে নিজেদেরকে লুকিয়ে ফেলেছে। এটা যদি হয় তাহলে হানাদারদের গুলির পরে কেবল একজন মা ও তাঁর শিশুই বেঁচে গেলেন, বাকিরা কবরের ভেতরে থেকেও কী করে গুলিবিদ্ধ হলেন, সেটাও একটা প্রশ্ন।

এতো পকর পকর করছি তীরুদা, কারণ গল্পটা আমার ভালো লেগেছে, কিন্তু খটকা লাগছে কবরস্থানে এসে। আমি দৃশ্যটা কল্পনা করতে পারছি না। সেই জন্যই আপনার কাছ থেকে পরিষ্কার হয়ে নিতে চাইছি। মন খারাপ
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

তীরন্দাজ এর ছবি

গল্পটি তোমার ভালো লেগেছে বলে খুশী হয়েছি।

হয়তো আমার বর্ননায় গোলমাল থাকতে পারে। আমি নিজেই নিজেকে তাড়াহুড়ো আর অসাকধানতার দোষে দোষী করি। তারপরও বলছি, ঘটনাটি দিনের বেলাতেই ঘটেছে। ওরা কবরের ভোতরে লুকোয়নি, দিনের বেলাতেই গাছের আড়ালে ছিল। সেখানেও উপর থেকে হলেও সামান্য হলেও আলো আসে। আর আমার তো মনে হয়, মায়েরা রাতের অন্ধকারেও শিশুদের কষ্ট দেখতে পারে, টের পায়। হয়তো সেভাবেই দেখেছে এই গল্পের মা। হতে পারে না? পাকিরা দিনের বেলাতেও সে কবরে নৌকো ভিড়াতে সাহস পায়নি।

আমাদের দেশের গ্রামে একটি নদী আছে। নাম ঢোলভাঙ্গা। তার পাশেই কবরস্থান। আমি সেটাকে ভেবেই লিখেছি। সেখানে দিনের বেলাতেও পালানো যায়। বাইরে থেকে কেউ দেখবে না। আর আমাকে যদি দিনের বেলাতেই কোথাও পালাতে হয়, তাহলে সেটি নিতেও পারি। নৌকো করে করস্থানে এসে পালানোর চিহ্ন? হয়তো ছিল। বোকা পাকিদের চোখে পড়ে নি হয়তো!

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

অতিথি লেখক এর ছবি

সব শেষ যে গোছানো হবে এমন নয়। স্রষ্টাও মাঝে মাঝে কিছু শেষের বেলায় হিজিবিজি আকেঁন। শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরেই নয়, মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে এমন অনেক ঘটনাই আছে যা অনেককেই স্মৃতির পুরনো গলিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ভাল লাগলো।

অমাবস্যা

তানবীরা এর ছবি

গল্পটি ছুঁয়ে গেছে তীরুদা।

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

বইখাতা এর ছবি

ভালো লেগেছে গল্পটা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।