অণুঘটক বনাম অণুঘটক বিষ

ঈয়াসীন এর ছবি
লিখেছেন ঈয়াসীন [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ১২/০৪/২০১৩ - ২:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যখন একটি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় তখন দুটি ভিন্ন লিঙ্গের অবিবাহিত মানুষ (অধুনা অবশ্য কোথাও কোথাও সম লিঙ্গের মাঝেও এমনটি ঘটছে) বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নুতন পরিচয়ে পরিচিত হয়, যার নাম ‘বিবাহিত’; পাশ্চাত্যে এমন রীতির চল না থাকেলও আমাদের এই অঞ্চলে উক্ত বিশেষ প্রক্রিয়াটি সংঘটিত করতে ক্ষেত্রবিশেষে একজন তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন পড়ে, যাকে আমরা ঘটক বলে জানি। এই ‘ঘটক’ ব্যক্তিটি এই প্রক্রিয়ার আগাগোড়ায় সম্পৃক্ত থাকলেও বিবাহিত হয় কেবল স্বামী এবং স্ত্রী। আবার রসায়নে দুই বা ততোধিক পদার্থের বিক্রিয়াকালীন কিছু পদার্থ সেই বিক্রিয়ায় অংশগ্রহন করে এবং নিজ বৈশিষ্ট্যের সহায়তার মাধ্যমে বিক্রিয়াকে তরান্বিত কিংবা সংঘটিত করে কিন্তু নিজে বিক্রিয়াজাত হয় না এবং নিজ বৈশিষ্ট্যও অটুট রাখে, তাদের রসায়নের ভাষায় বলা হয়- ‘অণুঘটক’; গ্রামের বাড়ীতে মা-খালাদের দেখেছি মাটির চুলায় রান্না করবার সময় আগুনের তেজ বাড়াতে মাঝে মাঝে তাল পাখা দিয়ে বাতাস করে; এ ক্ষেত্রে তাল পাখাটিও হয়তো একটি অণুঘটক কিংবা ঘটক জাতীয় উদাহরণ।

যাইহোক, যে কথা পাড়তে এত কথার লেজ ধরে টানাটানি করছি; সেই কথায় এখন সরাসরি আসা যাক। বাংলাদেশে গত কয়েক মাসের অস্থিতিশীল অবস্থায় পক্ষে-বিপক্ষে, বিশ্বাসীতে-অবিশ্বাসীতে, সৎ-অসৎ এ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতে আর মওদুদীবাদীতে, প্রতিরোধে-তাণ্ডবে যে এক বৈপরীত্য বা দন্দের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তাতে অন্যতম অণুঘটক ছিল যে ব্যাক্তিটি তার নাম মাহমুদুর রহমান; নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে সংবাদ শিরোনামে আসা যার বিকৃত শৌখিনতা, সত্যনিষ্ঠতার মাপকাঠিতে বিচার করলে যার সম্পাদিত পত্রিকাকে টয়লেট পেপারের সঙ্গে তুলনা করা যায়। একটি বিশেষ মহলের আবদার রক্ষার্থে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীকে ভিন্ন খাতে নিতে তার পত্রিকায় কি কি না ছাপা হয়েছে! স্কাইপি কথোপকথন, কাবা শরীফের গিলাব হাতে সাঈদির মুক্তি কামনা, ছাত্রলীগ কর্মী দ্বারা মহিলা পুলিশ ধর্ষিতা আর সব শেষে শাহবাগের উত্তাল তরুণ প্রজন্ম যখন ৪২ বছরের প্রাণের দাবী নিয়ে লাফিয়ে ওঠা সিংহের মত গর্জন করে উঠলো তখন রাজাকারদের বাঁচাতে এই মাহমুদুর রহমান ও তার মিথ্যানিষ্ঠ পত্রিকা ‘আমার দেশ’ ঐ তরুণ প্রজন্মের যৌক্তিক দাবীকে স্তিমিত করতে বাঙ্গালীদের আবেগের সবচেয়ে নাজুক দিকটি বেছে নিল; তারা প্রমান করতে চাইলো শাহবাগের আন্দোলনকারীরা সবাই নাস্তিক, মদ্যপ আর গঞ্জিকাসেবী। ‘মদ্যপ’ ও ‘গঞ্জিকাসেবী’ বিশেষণ দুটি না গিললেও ‘নাস্তিক’ এর টোপটি অবুঝ, স্বার্থান্বেষী আর ধর্মান্ধরা ঠিকই লুফে নিল। শুরু হলো আন্দোলনের নামে পরিকল্পিত তাণ্ডব আর অতি দুঃখজনকভাবে এই তাণ্ডবে সামনের সারিতে রাখা হল নিরিহ অবুঝ সাধারণ ধর্মভীরু গ্রামবাসীদের এবং মস্তিস্ক প্রক্ষালিত অল্প বয়েসী মাদ্রাসার ছাত্রদের। ফলাফলে যা হল তা বীভৎস; গত মাস দুয়েকের অস্থিতিশীলতায় প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ প্রান হারালো; তার মাঝে জামাত-শিবির কর্মী আছে, লীগের কর্মীও আছে, সাধারণ পথচারী আর যাত্রীও আছে, কর্তব্যরত পুলিশ আছে আর আছে নিরীহ গ্রামবাসী যারা মসজিদের মাইক থেকে প্রচারিত ঈমাম কিংবা খতিবের আদেশকে অমোঘ জ্ঞান করে হামলা করেছিল থানায় কিংবা বিদ্যুৎপ্রকল্পে। যে যেখানেই মারা গিয়েছে, মনে রাখতে হবে মানুষই মরেছে; তাদের প্রতিটি জীবনের মুল্য ঠিক ততটুকুই যতটা আমার কিংবা পাঠক, আপনার। এই প্রতিটি নিহত মানুষের শরীর থেকে যে রক্তের স্রোত বয়েছে সেই রক্তের আংশিক রঙ লেগে আছে একটি মানুষের ঠোঁটে; ধর্মাশ্রয়ীদের উস্কানিদাতা, সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হোতা সেই শকুনি মামার জিহ্বায় লেগে আছে নর মাংসের স্বাদ।

এই লোকটি অবশেষে তার কৃতকর্মের জন্যে গ্রেফতার হয়েছে। তার উপযুক্ত বিচার হোক তা কায়মনোবাক্যে সকলেরই প্রার্থনীয়। তবে স্বার্থে আঘাত লাগার কারণে আর হীনতা প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় জামাত, বিএনপি তথা ১৮ দল মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের নিন্দা জানাবে, সেটা প্রত্যাশিত এবং স্বাভাবিক; তা লোকটি যতই মিথ্যুক, ধর্মীয় উস্কানিদাতা হোক না কেন, কাবা ঘরের গিলাব নিয়ে যতই বিভ্রান্তি ছড়াক না কেন!

যেহেতু কোনো স্বার্থের ধার ধারি না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছাড়া আর কোনো মদদে পুষ্ট হতে পারি না, যেহেতু অপকর্ম করলে আওয়ামী-বিএনপি কাউকে ছেড়ে কথা কই না, যেহেতু রাজাকার মুক্ত মৌলবাদ মুক্ত স্বদেশের স্বপ্নে আমরা বিভোর, যেহেতু কাউরো জলের মত পরিস্কার আর স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ অপরাধকে আমরা পাশ কাটিয়ে চলতে জানিনা, সেহেতু বিবেক বর্জিত না হয়ে অহিংসতার অন্যতম পরিকল্পনাকারী এই নাটের গুরুর গ্রেফতারে আমরা পুলকিত হবই, পুলকিত হয়েছি; ফেসবুক স্ট্যাটাসে, নোটে, ব্লগে আমরা হাজার তরুণ-যুবক এই গ্রেফতারকে সাধুবাদ জানিয়েছি। তাতে চক্ষুশূল হচ্ছি অনেক কাছের মানুষের; তাদের মতে এই যুগের শ্রেষ্ঠ সৎ ও নির্ভীক সাংবাদিক হচ্ছে মাহমুদুর রহমান। পাঠক, বিশ্বাস করুন এই কাছের মানুষগুলো সবাই বিএনপি কিংবা জামাতের সমর্থক নন, কেউ অশিক্ষিতও নন; তবু একজন চিহ্নিত অপরাধীর অপরাধ কেন তাদের চোখে পড়েনা? তারা কি এতটাই অন্ধ! নিরপেক্ষ হয়ে মাঝে মাঝে চিন্তা করি, নাকি ভুলটা আমাদেরই? আমরা জল কে জল, অগ্নি কে অগ্নি জ্ঞান করি; এটাই যদি আমাদের ভুল হয়ে থাকে তবে জীবনটা, পৃথিবীটা না হয় ভুলেই পরিপূর্ণ হোক।

পরিশেষে বলতে চাই, রসায়নে অণুঘটকের পাশাপাশি আরো কিছু পদার্থের উল্লেখ আছে, তাদেরকে ‘অনুঘটক বিষ’ বলে; যে সব পদার্থ অনুঘটকের অনুঘটন ক্ষমতা হ্রাস এমনকি বন্ধ করে দেয়। আজকের তারুণ্য মাহমুদুর রহমানের মত অনুঘটকদের বিরুদ্ধে, তাদের অপপ্রচার বিনাশে তেমনি এক শক্তিশালী অণুঘটক বিষ।


মন্তব্য

সুমাদ্রী এর ছবি

এই বরাহ-শাবকটাকে শুরুর দিকেই যদি আটক করা যেতো, তবে বাংলাদেশে এতদিনে হয়ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিজয় ঘটে যেত।

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

ঈয়াসীন এর ছবি

সঠিক বলেছেন

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

তারেক অণু এর ছবি

আপনে নাস্তিক হইয়া গেছেন খাইছে ,আমি না বললেও মাহমুদুর গং বলবে গড়াগড়ি দিয়া হাসি

ঈয়াসীন এর ছবি

টাইম নাই

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

পৃথ্বী এর ছবি

মাহমুদুরের গ্রেপ্তারে কোন কোন স্বাধীনতার পক্ষের সুস্থ স্বাভাবিক মানুষও দেখলাম কিছুটা বিভ্রান্তিতে ভুগছেন। ভুয়া তথ্যকে সঠিক হিসেবে উপস্থাপন করে যদি কারও স্বার্থে আঘাত হানা হয়, তবে তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া কোন প্রকার স্বাধীনতারই লঙ্ঘন হয় না। পত্রিকার সম্পাদকরে কিছু কইলেই অনেকে রেড এলার্ট মুডে চলে যান, কিন্তু এটা মনে রাখা জরুরী পত্রিকা প্রসব করলে সাত খুন মাফ হয় না।

এই একই বিভ্রান্ত ব্যক্তিরা এর সাথে ব্লগারদের গ্রেপ্তার তুলনা করছেন। এমনিতেই ব্লগারদের বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়নি, তার উপর ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ আনলেও ধর্মানুভূতির সংজ্ঞা একটা তর্কযোগ্য প্রশ্ন। এর সাথে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুয়া তথ্য প্রচারের তুলনা হয় না।


Big Brother is watching you.

Goodreads shelf

কৌস্তুভ এর ছবি

ওইটাই বলতে যাচ্ছিলাম, যে আপনিও নাস্তিক!

ঈয়াসীন এর ছবি

চোখ টিপি

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

অতিথি লেখক এর ছবি

এই খলনায়কের গ্রেফতারে খুশি প্রকাশ করায় চাকুরীচ্যুত হব জেনেও খুশি চেপে রাখিনি। আমরা জেগে আছি, যাতে পার না পেয়ে যায়। চলুক লড়াই-- শ্রদ্ধা
মম রাজ্যের রাজা

ঈয়াসীন এর ছবি

সাধু সাধু

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।