বালডার উপাখ্যান (২)

ঈয়াসীন এর ছবি
লিখেছেন ঈয়াসীন [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১০/০৬/২০১৩ - ৯:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পর্ব ২ : অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া

balder1
বালডার

ধারাবাহিকতা পেতে হলে প্রথম পর্ব পড়ে নিন দয়া করে

পিতৃদেব অডিন পূর্বেই রওনা হয়ে গিয়েছিলেন মৃত্যুপুরীর পথে। পুত্রের মৃত্যুর খবর তিনি জানতেন না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সেখানে এক মহীয়সী মহিলা অবতার ভল্বা-র সঙ্গে সাক্ষাত করা, মৃত্যুপুরী এবং মৃত্যু সম্পর্কীয় যাবতীয় তথ্যাদি যার জ্ঞাত। অডিন সেথায় পৌঁছে দেখলেন বিশাল ভোজের আয়োজন চলছে। তিনি কৌশলে মানবরূপ ধারণ করে ভল্বার সরনাপন্ন হলেন। অডিন তাঁর কাছে ভোজের হেতু জানতে চাইলে জানতে পারলেন বালডারকে মৃত্যুপুরীতে অভ্যর্থনা জানাতেই এই ব্যাপক আয়োজন; অর্থাৎ বালডারের মৃত্যু অমোঘ। পিতার বুকের ভেতর কষ্টের পাখিগুলো এক সঙ্গে ডানা ঝাপটিয়ে উঠলো। কিন্তু মুখশ্রীতে সেই কষ্টকে তিনি প্রতিফলিত হতে দিলেন না। তিনি এও জানতে পারলেন হত্যাকারী তাঁর আরেকপুত্র হোডার। এই কালকূটসম তথ্য জেনে অডিন ভীষণ কষ্টাবৃত হলেন, তিনি মূর্ছা যান প্রায়। অডিন কৌশলে জেনে নিলেন সেই মৃত্যুর প্রতিদানে হোডারের ভাগ্যে কি জুটবে। তিনি তখন আরো জানতে চাইলেন- এমন কি কেউ আছে যে বালডারের মৃত্যুতে শোকাগ্রস্থ হবে না, চোখের জল ঝরাবে না। তৎক্ষণাৎ সেই বিদুষী মহিলা অবতার বুঝলেন এই প্রশ্নকর্তা সাধারণ কেউ নন, আগামীতে ঘটতে যাওয়া অনেক পরিস্থিতিই এর জ্ঞাত। তিনি বুঝলেন এ আর কেউ নন, স্বয়ং দেবরাজ অডিন। আর কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি অন্তর্নিহিত হলেন। শেষ প্রশ্নের উত্তর না জেনেই অডিন ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে অতি দ্রুত অ্যাসগার্ডে ফিরে এলেন। তিনি ভেবেছিলেন হত্যাকাণ্ড সংঘটিও হবার পূর্বেই যে করে হোক তার অ্যাসগার্ডে পৌঁছুতেই হবে; যদি কোনো উপায়ে তা রদ করা যায়।
কিন্তু হায়, বড় দেরী হয়ে গেছে ততক্ষণে। সমস্ত অ্যাসগার্ড জুড়ে তখন শোকের মাতম। তাদের সকলের প্রিয় প্রিয়ভাষী বালডার তুচ্ছ, ক্ষুদ্র এক শরাঘাতে মৃত, তাঁর সোনার অঙ্গ থেকে ঝরে পড়ছে রুধির। দেবতারা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, তাদের কাউরো বুঝতে বাকী রইলো না যে এই হেন কর্ম কার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, তবে আপাতদৃষ্টিতে হোডারই খুনী; তাই প্রতিদানে হোডারের মৃত্যুই অনিবার্য। এমনটাই প্রথা। তবে সেসব পরের বিষয়, দেবাদিদেব অডিনের যোগ্য পুত্র বালডারের দেবকীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজনটাই এখন মুখ্য।
জননী ফ্রিগা পুত্রশোকে মুহ্যমান, যে কোনো কিছুর বিনিময়েই তিনি পুত্রকে জীবিতাবস্থায় ফিরে পেতে চান। এই ক্ষেত্রে তিনি যে কোনো অসাধ্যকে সাধ্য করতে প্রস্তুত; যদিও সে জানে তা অসম্ভব, তবু মন তো মানে না, মা তো! তিনি উপবিষ্ট সকলকে উদ্দেশ্য করে অনুরোধ করলেন কেউ একজন যাতে মৃত্যুপুরী গিয়ে যমদেবীর সঙ্গে সাক্ষাত করে এবং জেনে আসে বালডারকে ফিরে পাবার কোনো উপায় আছে কিনা, কোনো উৎকোচে যমদেবী সন্তুষ্ট হবে কিনা? এরপর প্রাঙ্গনে দীর্ঘ নীরবতা; কেননা মৃত্যুপুরীর যাত্রাপথ অতি ভয়ঙ্কর, সে যাত্রায় আগ্রহী যাত্রী পাওয়া অতিশয় দুষ্কর। প্রথানুযায়ী অডিনও পুত্রের শব ত্যাগ করে কোথাও যেতে পারছেন না। তখন ফ্রিগা ঘোষণা করলেন যে, যদি কোনো বীর এই দুর্গম পথ পারি দিয়ে কার্যোদ্ধার করতে পারে তবে সে হবে ভবিষ্যতে অ্যাসগার্ডের সকল অ্যাসিরগণের সর্বাধিক প্রিয়ভাজন। অসীম সাহসী দেববীর হেরমড তখন এই দুঃসাহসিক কর্ম সম্পাদনে সম্মত হলেন। অন্য সবার মতই হেরমডও বালডারকে অত্যন্ত ভালবাসতেন; সকল দেবতার প্রিয়ভাজন হবার প্রলোভনেই শুধু নয়, বালডারের প্রতি অনুরাগও হেরমডকে এই দুর্গম পথ পারি দিতে প্রভাবিত করলো। দেবশ্রেষ্ঠ অডিন সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর নিজস্ব অষ্টপদী ঘোড়া স্লেইপনির-কে সপে দিলেন হেরমডের হাতে। এই দক্ষ ঘোড়াটির চলার বেগ যেমনি দ্রুত তেমনি তার দুর্গম থেকে দুর্গমতর পথ পারি দেবার ক্ষমতা। স্লেইপ্নির-এ আরোহিত হয়ে দ্রুত মৃত্যুপুরী নিফলহেইমের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন মহাবীর হেরমড।
হেরমডের প্রস্থানান্তে শাস্ত্রানুযায়ী শুরু হল বালডারের অন্তিমযাত্রার আয়োজন। সে আয়োজন বিশাল, ব্যাপক; দেবতা বলে কথা। বালডারের মৃতদেহটি অতি সম্ভ্রমের সঙ্গে তুলে দেয়া হল তারই নিজস্ব নৌযান রিংহর্ন-এ। প্রতিটি ধর্মেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য থাকে, আর সেসবে বৈচিত্র্যও থাকে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো সমুদ্রবেষ্টিত, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার আঞ্চলিক পুরাণ বা নর্স পুরাণে দেবতাদের শব নৌযানে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেবার উল্লেখ দেখা যায় বহুক্ষেত্রে, সেই নৌযানই ভেসে ভেসে গিয়ে পৌঁছায় নিফলহেইমে অর্থাৎ মৃত্যুপুরীতে; আর সেই নৌযানে শবের পাশে আরো অনেক কিছুই রাখা হয়, তেমনটাই প্রথা। পার্শ্ববর্তী বন থেকে বিপুল পরিমান কাঠ কেটে এনে চাপিয়ে দেয়া হল রিংহর্নে, দহনের জন্যে। অ্যাসিরগন সকলেই তাদের যার যার প্রিয় ও মূল্যবান দ্রব্যটি সযত্নে রাখতে লাগলেন এই অন্তিমযানে। পিতৃদেব অডিন তাঁর অতি প্রিয় অলৌকিক শক্তিধারী যাদুর অঙ্গুরীয় অবলীলায় বিসর্জন দিলেন সেই স্তূপীকৃত মূল্যবান দ্রব্যাদির মাঝে। ড্রাউপ্নির নামক সেই আংটিটি যতই মূল্যবান আর প্রয়োজনীয় হোক, সুপুত্রের প্রতি স্নেহের তুলনায় তার মুল্য কিছুই নয়। আংটিটি শবের পাশে রেখে মৃতপুত্রের কানে কানে কি যেন বললেন অডিন। কেউ তা জানতে পারলো না। সে এক রহস্যই রয়ে গেল। এই মুহূর্তটিকে নর্স পুরাণের এক উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত হিসেবে গন্য করা হয়।

800px-Odin's_last_words_to_Baldr

এদিকে ঘটে গেল আরেকটি নির্মম দুর্ঘটনা। বিপদ যখন আসে তা বুঝি দশ দিক থেকেই নাগিনীর মত ফণা তুলে আসে। শবযজ্ঞের এই দীর্ঘ ও বিপুল আয়োজনের ধকল সামলাতে না পেরে বালডারের সুন্দরী জায়া নান্না মৃত্যুবরণ করলেন। এমনিতে স্বামী হারানোর বেদনায় সে ছিল অত্যন্ত শোকাক্রান্ত। তার উপর অনাহারে, অতিক্রন্দনে দুর্বল; এতটা সইবার ছিল না তার পক্ষে। অ্যাসগার্ডে শোকের মাত্রা দ্বিগুণ হল, শবযাত্রায় শবের সংখ্যাও হল দ্বিগুণ।

এক্ষেত্রে অতি প্রাসঙ্গিক একটি তথ্য উপস্থাপন একান্তই যাচিত। ভাইকিং পুরাণে বহুক্ষেত্রে মৃত স্বামীদের সঙ্গে স্ত্রীদের সহমরণের উল্লেখ আছে। পুরাণশাস্ত্র মান্যকারী ভাইকিং জাতি তা অনেক কালাবধি পালন করে এসেছে। প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদেরা ভাইকিংদের বহু জোড়া কবর আবিস্কার করেছে। দশম শতাব্দীর সেইসব আবিষ্কৃত জোড়া কবরের কিছু কিছু নারী কঙ্কালের মাথার খুলির পিছন দিকে কুড়াল কিংবা অমন কিছুর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়; অর্থাৎ সহমরণে রাজী না হলে স্ত্রীদের হত্যা বা আহত করে সহমরণে বাধ্য করা হতো। এই নির্মমতার সংস্কৃতি কেবল ভাইকিংদের একক সম্পত্তি নয়, একাধিক ধর্মে একাধিক পুরানালম্বীদের মাঝেই এমন দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। স্পষ্ট করে উল্লেখ না থাকলেও ধারণা করা হয়, স্বামী হারানোর ব্যাথা আর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অতি আয়োজনের চাপে নান্নার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়ার ছন্দপতন ঘটে আর সেহেতুই তার মৃত্যু ঘটে।

যথাসময়ে যখন রিংহর্ন নৌযানটিকে ছেড়ে দিতে হবে তখন ঘটলো আরেক বিড়ম্বনা। অতিরিক্ত কাষ্ঠ আর উৎসর্গীকৃত দ্রব্যাদির ভারে রিংহর্ন এতটাই ভারী হয়ে গেছে যে তাকে আর নাড়ানোই যাচ্ছে না। ডাঙ্গা থেকে জলে নামানোই মুশকিল হয়ে দাঁড়ালো; তখন পর্বতদানবেরা এগিয়ে এলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। তাদের মাঝে এক মহাশক্তিশালীনি দানবী ছিল, যার নাম হাইরোকিন। দানবী হাইরোকিনের কাঁধের ধাক্কায় যদিও বা রিংহর্ন নড়ে উঠলো কিন্তু তলার চাকার ঘর্ষণে জ্বলে উঠলো আগুন, নয়টি পৃথিবী প্রকম্পিত হল একসঙ্গে। বজ্রদেবতা থর এতক্ষণ আড়ালে ছিলেন, উক্ত ঘটনায় তিনি এতটাই ক্রোধান্বিত হলেন যে, দানবীকে শায়েস্তা করবার জন্যে তিনি হাতুড়ি হাতে উদ্ধত হলেন। উপস্থিত সকল দেবতা অর্থাৎ অ্যাসিরগনের মধ্যস্ততায় থর নিবৃত্ত হলেন আর পরিস্থিতি অবলোকনে তার রাগ প্রশমিত হল। অবশেষে হাইরোকিনের ঐকান্তিক সহযোগিতায় অ্যাসগার্ডের সকলকে অশ্রু জলে ভাসিয়ে রিংহর্ন রওনা হল মৃত্যুপুরীর উদ্দেশ্যে।

অন্যদিকে বহু চরাই উৎরাই পেরিয়ে অষ্টপদ বিশিষ্ট অশ্ব দাপিয়ে অবশেষে হেরমড এসে পৌঁছুল নিফলহেইম রাজ্যে। এ রাজ্যেই যমপুরী। তবে তার দ্বারে পৌঁছুতে হলে তাকে পারি দিতে হবে গিয়োল নামক এক ভয়ঙ্কর দজ্জালস্রোতা নদী। যদিও এর উপরে একটি সেতু আছে, কিন্তু তা পেরুনো অত্যন্ত দুরূহ। সঙ্গে স্লেইপনির ছিল বলে রক্ষে; স্লেইপনিরের দক্ষতায় কষ্টসাধ্য হলেও হেরমড সেই নড়বড়ে সেতুও পেরিয়ে গেল এবং উপস্থিত হল যমপুরীর প্রধান ফটকে, চির অনাকাঙ্ক্ষিত শঙ্কাপুরীতে। দ্বাররক্ষিণী মোদগুড-এর কাছে আগমন হেতু জানাতেই হেরমড জ্ঞাত হলেন সপত্নীক বালডার এরই মধ্যে পৌঁছে গেছেন। মোদগুড তাকে অন্তপুরে প্রবেশের পথ দেখিয়ে দিল। সে পথটুকু আরও সাঙ্ঘাতিক, তবে স্লেইপনির তো আছেই সঙ্গে। মৃত্যুপুরীর যে দরবার, তার নাম এলজুদনির; সেথায় সে দেখা পেল বালডার ও নান্নার। বালডারের দেহ বিচ্ছুরিত জ্যোতিতে আলোকময় হয়ে আছে সেই সভা। হেরমডের চোখে আনন্দ ও বিষাদের সম্মিলিত জল উগরে উঠলো।

balder-hermod

বালডার তাকে জানালো যে দুর্ভাগ্যবশত তাঁর আর ফিরবার উপায় নেই; র‍্যাগনারক অর্থাৎ অন্তিমদিন (কেয়ামত) অবধি তাঁকে এখানেই থাকতে হবে, এটাই তাঁর নিয়তি; তবে নান্নাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার কোনো উপায় থাকলেও থাকতে পারে। যমদেবী সে প্রস্তাবে বাধ সাজলেন, তাঁর মতে নান্নার স্বামীর সঙ্গে থাকাটাই সমীচীন। ভক্তিপরায়ন হেরমড তখন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে যমদেবী সমীপে আর্তি জানালেন যে, বালডার বিয়োগে শুধু অ্যাসগার্ড নয়, নয়টি পৃথিবীরই তাবৎ জীবজড়াদি শোকে বিহ্বল; সার্বিক কল্যান সাধনার্থে তাঁর জীবিতাবস্থায় স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত আবশ্যক এবং সকলেরই একান্ত কাম্য। এ কথা শ্রবণে যমদেবীর হৃদয় কিছুটা কোমল হল। তিনি হেরমডকে শর্তসাপেক্ষে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে- ব্রহ্মাণ্ডের সকল দেব দেবী, নর নারী, পশু পাখি, পর্বত নদী, এমনকি তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রতিটি দৃশ্য এবং অদৃশ্যমান বস্তু যদি বালডার হারানোর শোক প্রকাশার্থে অশ্রু ঝরায়, তবে বালডার সপত্নীক জীবিতাবস্থায় অ্যাসগার্ডে ফিরে যেতে পারবেন। তবে হ্যা, যদি একটি বস্তু বা একটি ব্যাক্তিও ক্রন্দনে অস্বীকৃতি জানায়, তবে বালডারের প্রত্যাবর্তন আর সম্ভব নয়; আর অবশ্যই ক্রন্দনে কাউকে জোরপূর্বক বাধ্য করা যাবে না। এমত প্রস্তাবে হেরমড অত্যন্ত সুখ বোধ করলেন, কেননা তিনি জানেন বালডারের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী; হৃষ্টচিত্তে অ্যাসগার্ডে ফিরে এসে তিনি সকলকে যমদেবীর শর্ত জানালেন।

কালবিলম্ব না করে অডিন ও ফ্রিগা সর্বত্র দূত পাঠিয়ে দিলেন। দূতের সন্দেশ প্রাপ্তিমাত্র যে যার মত কেঁদে উঠলো; নয় পৃথিবীর দিকে দিকে মাতম উঠে গেল। সকলেরই কপোল অশ্রুসিক্ত; এমনকি হিংস্র, নির্মম পশুগুলোও ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। অতিনীচ পিশাচেরাও দূতগণকে বিমুখ করলো না।

পৌরাণিক কাহিনীতে একটি ঘটনা শুরু হলে বহু ঘোরানো প্যাঁচানো সিঁড়ি বাইবার পরও যেন তার পরিসমাপ্তি ঘটে না। এ কাহিনীতেও উত্থিত ঘটনায় পুনরায় ঘটলো পতন। লোকির মত কুটিল ও হীনমনা চরিত্র জীবিত থাকতে বালডারের প্রত্যাবর্তন সহজ ও সরল হওয়াটাইতো অস্বাভাবিক। দূতগণ দশদিক জুড়ে সর্বত্র বিচরণ করতে করতে ‘থোক’ নাম্নী এক দানবী-র দেখা পেলেন। থোক দূতগণের দাবী বা আর্জি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলো। এই দানবীর মতে, অশ্রুবর্ষণতো দূরের কথা উপরন্তু যমদেবীর অনুশোচনা বোধ করা উচিৎ এমনধারা হাস্যকর শর্ত জুড়ে দেবার জন্যে। তার মতে বালডারের জীবনে প্রত্যাবর্তন অমূলক এবং অযৌক্তিক। দূতগণ অনেক অনুনয় বিনয় করলেন, পুরুস্কারের প্রলোভনও দেখালেন। থোক কিছুই কানে তুললো না আর বললো- যাওতো বাপু, তোমরা তোমাদের পথ দেখো। আমাকে শান্তিতে একটু আনন্দে থাকতে দাও; কাঁদতে আমার বয়েই গেছে! দূতগণ পরাজিত সৈনিকের মত নতমস্তকে অ্যাসগার্ডে ফিরে এলো। সব শুনে দেবতারা বুঝলেন, থোক আর কেউ নয়, দানবী রুপধারী দুষ্টুমতি লোকি; যখন যেমন ইচ্ছে রুপধারনের অলৌকিক ক্ষমতা আছে তার। বালডারের মৃত্যুর পর থেকেই লোকি পলাতক। দেবতারা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন- লোকির বিষয়টি পরে বিবেচ্য হবে, তবে তার আগে বালডারের মৃত্যুর প্রতিদানে প্রথানুযায়ী হোডারকে মরতেই হবে। কিন্তু কে নেবে সেই নির্মম কর্মের ভার?

বিশ্বে যত ধর্ম, যত ঈশ্বরবাদ, যত পুরাণবিশ্বাস তার সবগুলোতেই একটি ধ্রুব শব্দ আছে- ‘ভবিতব্য’, যা ঈশ্বর কর্তৃক পূর্বলিখিত। অডিন পূর্বেই বিদুষী মহিলা অবতার ভল্বার কাছ থেকে জেনে এসেছিলেন কার দ্বারা বালডার হত্যার প্রতিশোধ নেয়া হবে; সেই পূর্বলিখিত অদৃষ্টের ফল ফলাতে অডিন মিলিত হতে গেলেন হিমায়িত বসুন্ধরার দেবী রিন্ড-এর সঙ্গে। রিন্ডের আত্মসম্মানজ্ঞান প্রখর। হোক অডিন দেবোত্তম, তিনি নিজেওতো দেবী, পতিতাতো নন। শুধুমাত্র হোডারের হত্যাকারী হিসেবে একটি পুত্র জন্মানোর জন্যে অডিন তাঁর দেহটিকে ব্যবহার করতে যাচ্ছেন, এই অপমানটুকু তাঁর কাছে কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। হৃদয়ের ব্যকুলতা না থাকলে নিছক যান্ত্রিক শারীরিক মিলনে কীইবা সুখ! আবার দেবপতি অডিন ভীষণ সুপুরুষ; এমন পুরুষের সহবাসপ্রাপ্তিইবা কি করে প্রত্যাখ্যান করা যায়! ভবিতব্যের ছকানুযায়ীই তাঁদের মিলন ঘটলো আর দৈবশক্তিবলে তৎক্ষণাৎই জন্ম নিল তাঁদের পুত্র ভালি। দেবতাদের ব্যাপার স্যাপারই ভিন্ন, জন্মাবামাত্রই ভালি দ্রুত বিকশিত হতে থাকলো; জন্মাবার প্রথম রাতেই সে পূর্ণশক্তিমান প্রাপ্তবয়স্ক বীর-এ পরিনত হল আর সে রাতেই ভালি অ্যাসগার্ডে পোঁছে শরবিদ্ধ করলো বৈমাত্রেয় ভ্রাতা হোডারকে। হায় অদৃষ্ট, হায় ভবিতব্য! বেচারা হোডার, যার নিজস্ব কোনো অপরাধই ছিল না, তবু প্রথা পালনার্থে তাঁকেই বলি হতে হল। অডিন-ফ্রিগা দম্পতি দুটি পুত্রকেই হারালো।

দেবতারা কুচক্রী লোকিকে নিষ্কৃতি দিলেন, এমনটা নয়। পলাতক লোকিকে খুঁজে বের করে কঠিনতম শাস্তি প্রদানে তাঁরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ; নইলে বালডারের প্রত্যাবর্তন ঘটবে কি করে?

(চলবে)


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আহ, চমৎকার গল্প পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

[খালি খাঁটি বাংলা টাইটেলডার দিকে তাকাইলে কেমুন কেমুন জানি লাগে ইয়ে, মানে... ]

ঈয়াসীন এর ছবি

চোখ টিপি

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

নজমুল আলবাব এর ছবি

শেষের অপেক্ষায়।

ঈয়াসীন এর ছবি

শীঘ্রই; আশা করছি।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বালাই ষাট... শেষ হবে কেন? ইয়ে, মানে... চলুক না, বেশ লাগছে

ঈয়াসীন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

স্যাম এর ছবি

পড়ছি, ভাল লাগছে, চলুক।

ঈয়াসীন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

তারেক অণু এর ছবি

ঝরঝরে হয়েছে গল্প বলা, সেই সাথে ঐতিহাসিক তথ্য গুজে দেওয়াটা খুবই প্রাসঙ্গিক। চলুক

ঈয়াসীন এর ছবি

লইজ্জা লাগে

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

ইমরান ওয়াহিদ এর ছবি

অন্যান্য পুরাণগুলোর তুলনায় এই নর্স পুরাণ বড়ই কাঠখোট্টা। আমার কাছে সবসময়ই একটু চিনি কম মনে হয়। যোদ্ধা জাতির পুরাণ তো, বীর রস আর করুণ রসে ভরা। বাকি রসগুলো একটু কম কমই আসে। ওডিন রিন্ড-এর কাছে গেলো ভবিতব্য অনুযায়ী পুত্র প্রার্থনা করতে। হতো জিউস, ছলে-বলে-কলে-কৌশলে পুত্র আদায় করে নিত এবং তা আবার আদিরসে ভরপুর থাকতো।

তবে পারিবারিক সম্পর্ক আবার এই পুরাণে প্রায় ঠাসবুনটে বাঁধা।

নর্সদের পরকালও তো অন্যদের চাইতে ব্যতিক্রম। যদি অস্ত্র হাতে বীরের মৃত্যু হয়, তবে ভ্যালহালায় গিয়ে অসীম পর্যন্ত বন্ধু/শত্রু নির্বিশেষে সারাদিন যুদ্ধ, দিনশেষে উত্তাল পানাহার। আর যদি অস্ত্র হাতে মৃত্যু না হয় তবে ভ্যালহালায় গিয়ে ঐ পুর্বোক্ত বীরদের দাস।

ঈয়াসীন এর ছবি

যথার্থ বলেছেন। ভারতীয় পুরাণ হলেও বেশ রস থাকতো। চিনি আর চিনি, বড্ড মিষ্টি।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

ভালোই লাগছে। পরের পর্বের অপেক্ষায় ---

ঈয়াসীন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- , সপ্তা খানেকের ভেতরই আশা করছি। চোখ রাখবেন নীড়পাতায়

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়তে ভাল লাগছে। পরের পর্বের অপেক্ষায় আছি।

ঈয়াসীন এর ছবি

গুছাচ্ছি, সপ্তা খানেক লাগবে। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

তুলিরেখা এর ছবি

খুব ভালো লাগছে। অপেক্ষায় আছি পরের অংশের।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ঈয়াসীন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।