দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষই পৌঁছে দেবে মানুষকে

ঈয়াসীন এর ছবি
লিখেছেন ঈয়াসীন [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৬/০১/২০১৪ - ১১:৪৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঘন কুয়াশার চাদরে গোটা কুমিল্লা শহর ঢেকে গেছে, কনকনে ঠাণ্ডা। রাত সাড়ে দশটা কি এগারোটা নাগাদ সরোয়ার চেনা রিক্সাওয়ালাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো; সঙ্গে বন্ধু নাজিম আর ৪০টি কম্বল। ঘন ঘন প্যাডেল চালাবার কারণে সারথির গায়ে ততটা ঠাণ্ডা লাগছে না, কিন্তু ঝিম মেরে বসে থাকা রথারুঢ় বন্ধুদ্বয়ের পাঁজরের হাড়ে ঠকঠকানি তাল উঠে গেল; বুকের ভেতর জাকির হোসেন, বুকের ভেতর আল্লারাখা! সরোয়ারের বড় ভাইয়ের এক বন্ধু থাকেন বিদেশে। কদিন আগে সেই প্রবাসী বড়ভাইটি তাকে ফোন করে জানালো, সে নাকি কোনো এক পত্রিকায় দেখেছে বাংলাদেশের কোনো এক গ্রামে প্রচণ্ড শীতের রাতে এক বাবা সারারাত খড়কুটো এটা ওটা হাতের সামনে যা কিছু পেয়েছে তাই দিয়ে তার ছ’বছরের ছেলেটিকে ঢেকে রেখেছিল। ভোর হবার পর বাবা দেখতে পান তার ছেলেটি বেঁচে নেই, বাবার শত প্রচেষ্টাও হার মেনেছে শীতের দাঁতাল দৈত্যের কাছে। সেই রাত ঐ প্রবাসী ভাইটি একটুও ঘুমোতে পারেনি। স্বয়ংক্রিয় তাপদায়ক যন্ত্র, পাখির পালকে তৈরি বিশেষ প্রজাতির কম্বল- কোনো কিছুই বিন্দু মাত্র উত্তাপ এনে দিতে পারেনি তার শরীরে। বারবার চোখে ভেসেছে একটি দৃশ্য- বাবা মাথায় হাত দিয়ে চেয়ে আছে ঠাণ্ডায় নীল হয়ে আসা তার ছ’বছরের ছেলেটির প্রাণহীন মুখটির দিকে। কি অসহায় এক বাবা!

সেই বড়ভাইটির পাঠানো সামান্য টাকায় সরোয়ার আজ সকালে ১৪৭টি কম্বল কিনেছে। সস্তায় আরো কেনা যেত, কিন্তু একটু টেকসই যাতে অন্তত চার পাঁচ বছর ব্যবহার করা যায় তেমন কম্বলই কিনেছে সে। কম্বল কেনা যতনা সহজ তার চাইতে সহজতর কম্বলের জন্যে টাকা পাঠানো আর সবচেয়ে কঠিন কাজটি হচ্ছে যোগ্য পাত্রে তা বিতরণ করা। কান্দিরপার মোড়ে দাড়িয়ে পড়লেই মুহূর্তে সবগুলো কম্বল বিলি হয়ে যেত। সেই সাথে বেঁচে যেত সময়, সেই সাথে লাঘব হত সরোয়ারের কষ্ট। তবে অনেক ভেবে চিন্তে সে কঠিন পথটিই বেছে নিয়েছে। সরোয়ার কিছুটা খ্যপাটে ধাঁচের, অদ্ভুত প্রকৃতির ছেলে। সে নিজেই গভীর রাতে শহরের অলি গলি ঘুরে ঘুরে দেখবে কোন গৃহহীন মানুষটি শীতে কষ্ট পাচ্ছে; একটি কম্বলও সে বিনাপাত্রে যেতে দেবেনা। এইতো গেল সপ্তাহেই সে দেখেছে রিলিফের কম্বল অর্ধমুল্যে বিকিকিনি হচ্ছে খোলাবাজারে।

রেললাইনের কাছাকাছি আসতেই সরোয়ারের চোখে পড়লো সাত আটজন মেয়ে রাস্তার ধারে গুটিসুটি মেরে বসে কাঁপছে। ওড়না দিয়ে কান গলা প্যাঁচানো। কাছে এসে থামতেই মেয়েগুলো তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো। ওড়না সরিয়ে বুকটাকে যতটা সম্ভব উদ্ধত করে দুষ্টু হাসি হাসবার চেষ্টা করলো। সারামুখে উৎকট মেকআপ আর ঠোঁটে ডবল প্রলেপে লিপিষ্টিক মাখানো। গায়ে কোনো বাড়তি কাপড় নেই। কেবল সালোয়ার কামিজ। নিজেদের আকর্ষণীয় করে দাঁড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। সরোয়ার বললো- বোন, আপনারা যে যার বাড়ি চলে যান, এই শীতে কুয়াসা ভেঙ্গে কে আসবে? একটি মেয়ে বললো- আমাদেরতো বাড়ি নেই; যে রাতে যার বাড়ি যাই সেটাই আমাদের বাড়ি। বাবার বাড়ি আছে গ্রামের দিকে, তবে সেদিকে আর ফেরবার পথ নেই। সরোয়ার বললো- ঠিক আছে, আপনারা আপনাদের মত বসে থাকুন, কিন্তু গায়ে একটু গরম জামা পড়লে বুঝি আপনাদের দিকে কেউ তাকায় না? মেয়েটি জানালো- না ভাই, তা না; আমরা সস্তা বেশ্যা, যে টাকা পাই তা দিয়ে দুবেলা ঠিক মত ভাত জোটে না, গরম কাপড় কিনবো কোথা থেকে? সরোয়ার প্যাঁটরা খুলে ওদের সবাইকে একটি করে কম্বল দিয়ে বললো- আপনারা ভাল থেকেন বোন। (কথোপকথন হচ্ছিল কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষাতেই; কুমিল্লার কোনো পাঠক এই অংশটুকু রুপান্তর করে দিলে আনন্দচিত্তে এই অংশটি সংশোধন করে দেবো) কেমন যেন একটা ভীষণ ভাল লাগায় ভরে উঠলো সরোয়ারের মনটি। এর আগে সে কখনও কোনো গণিকার সঙ্গে কথা বলেনি। একজন গণিকাকে ‘বোন’ সম্বোধন করবার অভিজ্ঞতা এতটা মধুর! একটি মাত্র সম্বোধনে বিভাজনের খেলো নিয়ম ভেঙ্গে, মেরুকরণের রীতি পায়ে দলিয়ে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসা এতটাই স্বর্গীয়।

রাতে নিজে বের হয়ে কম্বল বিতরণের উদ্দেশ্যটি তার ভালভাবেই সফল হল; রাস্তার পাশে, অলিতে গলিতে অনেককেই পাওয়া গেল যারা ছিন্নবস্ত্রে অসহায়ের মতন শীতের সঙ্গে অসম যুদ্ধ করছিল। অনেক রাত হয়েছে, রিক্সাওয়ালা বেচারাও বড্ড ক্লান্ত। কাল রাতে আবার বেরুবে ভেবে বাড়ীর দিকে ফিরছিল তারা। ফিরবার পথে কান্দিরপারের টাউন হল সংলগ্ন মাঠটির পাশ ঘেসে এগুচ্ছিল তারা। সঙ্গে আনা দুটো কম্বল তখনও রয়ে গেছে। সামনে কাউকে পেলেই দিয়ে দেবে মনস্থির করলো সরোয়ার। দেখলো- ষোল সতেরো বছর বয়েসী একটি ছেলে ল্যাম্পপোস্টের নীচে ঘুমনোর আয়োজন করছে। পাশেই কুমিল্লার বিখ্যাত কুমিল্লা ক্লাব, শহরের সব ধনীদের আয়েশ করবার ভবন। সরোয়ার আরেকটু কাছে এসে ছেলেটির পাশে দাঁড়ালো। মাথার নীচে দশ ইঞ্চি মাপের একটি ইটকে বালিশ বানিয়ে ছেলেটি শুতে যাচ্ছিল। শরীরে ময়লায় বাদামি রঙ হয়ে আসা একটি সেন্ডো গেঞ্জি, তার উপর সিমেন্টের খালি বস্তা পেঁচিয়ে অনবরত কাঁপছে ছেলেটি; চটের বস্তাও নয়, ফাইবার সুতোয় তৈরি পাতলা পলিথিন ধরণের যে বস্তা হয়, সেটি। সরোয়ার একটানে সরিয়ে ফেললো সেই বস্তা, সরাতেই তার চোখের জল বাঁধ ভাঙল, ছেলেটির কোনো পা নেই। সেখানে আর দাঁড়াতে পারছিল না সরোয়ার, একটি কম্বল নিজ হাতে সযত্নে তার গায়ে দিয়ে সে চলে এল সেখান থেকে। বাকি কম্বলটি সে রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে দিল। রিক্সা অনেক দূর চলে এসেছিল, কি মনে করে রিক্সাওয়ালা রিক্সা ঘুরিয়ে আবার সেখানে ফিরে এলো। নিজের কম্বলটিও পঙ্গু ছেলেটির গায়ে জড়িয়ে দিল রিক্সাওয়ালা। কে বলেছে সুদিন আসবে না? সুদিন আসবেই, দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষই পৌঁছে দেবে মানুষকে।

(ঘটনাটি সত্য, সরোয়ার নামটিও সত্য, শুধুমাত্র পতিতাদের সঙ্গে কথোপকথনের দৃশ্যে কিছুটা প্রাসঙ্গিক কাল্পনিক বক্তব্য সংযোজিত হয়েছে; তবে আগাগোড়া মূল ঘটনা অবিকৃত রাখবার চেষ্টা করা হয়েছে। দেশে প্রচণ্ড শীত, আমাদের সামান্য সহযোগিতা অনেকগুলো অসহায় মানুষের শুকনো ঠোঁটে হাসি ফোটাতে পারে। আসুন যে যার অবস্থান থেকে এই দায়িত্ব পালন করি। আর হ্যা, এই দায়িত্বে সরাসরি অংশগ্রহন করতে না পারলে এমন কাউকে নিযুক্ত করুন যারা সরোয়ারদের মত অদ্ভুত সৎ প্রকৃতির, একটু পাগলাটে ধরণের।)


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

এরকম পাগলাটে সরোয়ার সুলভ একজনকে ঠিক এই কাজ করতে দেখেছি হল জীবনে... এদের দেখলে মাঝে মাঝে সাহস পাই, মনুষ্যত্ব বোধহয় টিকেই যাবে হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

পরিবর্তন আসবেই, হয়তো একটু সময় নেবে কিন্তু আসবেই আমি বিশ্বাস করি।
(আজকে সন্ধ্যায় কুমিল্লায় ছিনতাইকারীর হাতে নিজের মোবাইলখানি দিয়ে আপন মনে বাড়ি আসলাম মন খারাপ )

মাসুদ সজীব

ঈয়াসীন এর ছবি

চোখ টিপি , আন্তর্জাতিক, স্বচ্ছ ছিনতাই

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

অতিথি লেখক এর ছবি

ইহা বাকশালী সরকারের জন্যে হয়েছে, আজ যদি দেশে গনতন্ত্র থাকতো তাহলে এমন কুনু ঘটনার জন্মই হতো না ওঁয়া ওঁয়া

মাসুদ সজীব

তারেক অণু এর ছবি
এক লহমা এর ছবি

চলুক
ঠিক সরোয়ার-এর মত মানুষরাই দুঃসময় থেকে সুসময়ে পৌঁছে দেয় মানুষকে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

চলুক

সুদিন আসবেই, দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষই পৌঁছে দেবে মানুষকে

সেই দিনের অপেক্ষায় রয়েছি।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

আয়নামতি এর ছবি

আমার তো মনে হয় পৃথিবীতে ভালো মানুষের সংখ্যাটাই বেশি। খারাপের সংখ্যা কম।
নইলে কবেই খারাপের চাপে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত! সময় মাঝে মাঝে খারাপের কোর্টে বল ঠেলে দিয়ে মজা দেখে।

এক লহমা এর ছবি

আমারও তাই মনে হয়। চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

আয়নাদিদির সাথে একমত।

ইয়ে, কয়েকটা টাইপো আছে মনে হলো : কুয়াসার চাঁদরে > কুয়াশার চাদরে। হাঁড় > হাড়

____________________________

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।