ছোটখালার যাওয়া

??? এর ছবি
লিখেছেন ??? (তারিখ: শনি, ০১/১২/২০০৭ - ৪:১৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

কবিতার ঋণ কত জায়গায় থাকে? "ছোটখালার যাওয়া" লেখা হয়েছিল ১৯৯৭/৯৮ সালে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে এই কবিতার আবহটি তৈরি হয়েছিল তিনটি শিল্প-উপাদানে:
১. সালভাদর দালি-র ছবি Apparition of My Cousin Carolineta on the Beach at Rosas
2. চেঙ্গিজ আইত্মাতভের অবিস্মরণীয় গল্প জমিলা
৩. একটা ইউক্রেনীয় লোককথা (নাম ভুলে গেছি)

এই তিনের পারমুটেশন কমবিনেশনে যা দাঁড়িয়েছে, সেটা কবিতা হিসেবে ভালো কি খারাপ সেই বিচার আমার নয়, কিন্তু আমি যখন এই কবিতাটির দিকে তাকাই, তখন দালির ছবি, চেঙ্গিজ আইত্মামভের গল্প আর ইউক্রেনীয় লোককথাটিকে জড়াজড়ি অবস্থায় দেখতে পাই। এই দেখতে পাওয়াটাই আমার জন্য স্বস্তির, বুঝিবা আনন্দেরও।

.....................................................

ছোটখালার মনে নেই, ওকে আমি পালিয়ে যেতে বলেছিলাম
বলেছিলাম, এসো, লুকিয়ে থাকি শূন্য ফুলদানির
অন্তহীন রহস্যের ভেতর
কিংবা মরণশীল দুটো মাছরাঙার সাথে জীবন বদলাই আর
হাওড়ের মধ্যে ডাকাতের মত তাড়া করি ঘূর্ণায়মান প্রপেলারকে

এ-কথা শুনে ওর সূঁচ-ধরা হাত গেল থেমে। ওর চোখ
হয়ে ওঠল মেঘাচ্ছন্ন দিনের জোড়াপুকুরের চেয়েও সন্ত্রস্ত
সূচিকর্ম ওর প্রিয়। মাছরাঙাদের সমাজে সেলাইয়ের প্রচলন নেই জেনে
কী হাসি তার!
যেন আমার প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেছে
সুপারি গাছদের বিশেষ বর্ধিত সভায়

ওর ব্যস্ততা ছিল। ভিনদেশী এক রাজকুমারের ঘুমের জন্য
বালিশের ওয়াড়গুলোকে কথা বলতে শেখানোর কাজ, সারাদিন
নিজ আঙুলের সৌন্দর্যে নিজেই সে মুগ্ধ হয়ে থাকত
আমার কথা শুনত কি শুনত না -- বৃষ্টি ধরে এলে
আমি শূন্য ফুলদানির ভেতর একা ঘুমিয়ে পড়তাম
ঘুমিয়ে ভাবতাম
প্রপেলার-পাখার অন্তহীন হিমেল নৈঃসঙ্গের কথা

সেই রাজকুমারের ওপর আমার ছিল অসামান্য ক্রোধ
তাকে আমি খুঁজে বেড়াতাম সত্যিকারের টিনের তলোয়ার নিয়ে
ধ্বসিয়ে দিতাম যাবতীয় উঁইয়ের ঢিবি, তার ঘোড়াটিকে
ধাওয়া করবার জন্য
ভাব রাখতাম দ্রুতগামী বাছুরদের সাথে

একদিন আমার আয়ত্বে এল রূপকের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা
অনুনয় করে বললাম, খালা, চল বোয়ালমারির বিলে
নিশুতি রাতে তুমি জেলেডিঙি হয়ে ঘুরে বেড়াবে, আর আমি
হ্যাজাক-হারিকেন
কিংবা চলো দূরে, যেখানে তুমি এক বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, আমি এক
উলুঝুলু কাকতাড়ুয়া
নয় আরো দূরে, তুমি পোড়োবাড়ি আর আমি টিনের সেপাই!

সূঁচের কাজ শেষ হলে ছোটখালার জন্য পালকি এল
এল অঘোর শ্রাবণ, আমার চোখ পোড়োবাড়ির জানালা
আমি কাকতাড়ুয়া, আমি টিনের সেপাই, আমি হ্যাজাক-হারিকেন
বর্ষণসিক্ত বাঁধে ওঠে অনেকক্ষণ ধরে হাত নাড়লাম
ছোটখালার যাওয়া তবু ফুরাল না, চলে যাচ্ছে সে
নিসর্গের সেলাই খুলে হারিয়ে যাওয়া জেলেডিঙির মত।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ইনসেস্ট!

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

??? এর ছবি

টেক ইট ইজি! হাসি
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

হাসান মোরশেদ এর ছবি

এ বড় মোহন
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- ছবিটা দেখেন তো এখানে আছে কি না।
দালির কালেকশন গুলোর একটা সাইট দেখেছিলাম গতবছর, আজকে খুঁজে পেলাম না। আপনি একটা কাজ করতে পারেন, Adiós a mi tía Julia- এই কীওয়ার্ড ধরে আগাতে পারেন। ছবিটা চেনা থাকলে হয়তো আমি একটা ট্রাই করতে পারতাম।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

??? এর ছবি

এখানে নাই ধূসর গোধূলি। সার্চ দেয়ার কী ওয়ার্ডটা কী আবার লিখে দেবেন? ছবির থিমটা ছিল, একটা নারী নৌকায় উঠে চলে যাচ্ছে। সাগরে, আর নৌকার মধ্যে একটা সাইপ্রেস গাছ। এরকম।
ধন্যবাদ।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

??? এর ছবি

অবশেষে ছবি পাওয়া গেল। গানটা বাদ দিলাম, খুব ভালো যাচ্ছে না এই প্রতিবেশের সাথে। বরং "জমিলা" গল্পটির লিংক দিলাম, যারা পড়বেন তারা ঠকবেন না নিশ্চিত। "ইনসেস্ট" বিষয়ক যে তর্জনী উত্থিত হয়েছে, তার জন্য "জমিলা" এক মোক্ষম মহৌষধ।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

রিজনেবল ইনসেস্টে আপত্তি নাই। এমনিতেই মনে হইল তাই উল্লেখ করলাম। আসলে দৃষ্টিভঙ্গী বড় কথা। এইটারে প্লেইন ভাবে দেখা সম্ভব। অথবা আমার মত টুইস্টেড মন নিয়া দেখা সম্ভব।

আমি মনে করি লেখালেখিতে এই ধরনের বিষয়গুলা উঠে আসা দরকার। আলো না ফেললে অন্ধকার কাটবে কিভাবে?

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

??? এর ছবি

সব ধরনের "সম্ভাব্য" প্রতিক্রিয়াকে জায়গা দেয়ার জন্য আমাদের যথেষ্ট স্পেস থাকা উচিত। কিন্তু সবসময় সেটা থাকে না। যে কোনো বিষয়কে আমরা আমাদের পাদানি থেকেই ভাবি এবং এটাকেই যথেষ্ট মনে করি। অন্য জায়গা থেকে অন্য একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টাকে যে দেখা সম্ভব একথা প্রায়শই ভুলে যাই। বা ভুলিয়ে দিতে চাই।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

কর্ণজয় এর ছবি

*****

সেলিম আহমেদ এর ছবি

অসম্ভব ভাল লেগেছে সুমন আপনার কবিতা আর কি করে কবিতাটি এলো সেই বর্ননা।
মাহবুব মোর্শেদের "ইনসেস্ট" মন্তব্য সম্পর্কে শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই যে, আমার মনে হয়েছে যে, ছোটখালা এখানে আসলে নারীর আর্কিটাইপ হয়ে এসেছে সেই ছো্ট্ট বালকের কাছে। তার সেই ভূবনে মায়ের পর ছোটখালাই তো "অন্য এক নারী" যাকে "অন্য এক পুরুষ" এসে একদিন এসে নিয়ে যাবে কোথাও।
আমাদের সবার মধ্যেই ওই বয়সে হয়তো ঈডিপাল কমপ্লেক্স কোন না কোনভাবে কাজ করে।

??? এর ছবি

ধন্যবাদ সেলিম, ঠিক ধরেছেন আপনি। সুন্দর বলেছেন।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

বিবাগিনী এর ছবি

‌‌:)
jamilaর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

‌‌::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

??? এর ছবি

যাক, ছোটখালার উছিলায় আপনাকে জমিলা পৌঁছানো গেল!
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

কনফুসিয়াস এর ছবি

খালাদের ভেতরে সবচেয়ে ছোট যিনি, তাদের সাথেই কবিদের সখ্যতা গাঢ় হয়, সবসময়?
সুনীল অথবা মহাদেবের ঠিক একই সুবাসের একটা কবিতা পড়েছিলাম, পড়ে চমকে উঠেছিলাম, ছোট মাসী-কে নিয়ে লেখা। কবিতা মনে নেই, তবে এরকম একটা লাইন ছিলো সেখানে, "ছোট মাসী, তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে গিয়ে আমি প্রথম..." বা, এরকম কিছু।
অনেকদিন পরে আপনার কবিতাটায় সেই ছায়া খুঁজে পেলাম, এই মুহুর্তে আবার সেটা পড়তে ইচ্ছে করছে।
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

মুজিব মেহদী এর ছবি

'ছোটখালার যাওয়া' কবিতাটি মনে খুব দাগ কেটে গেল।
সবচে' উত্তাপ বোধ করলাম কবিতাটির জন্মরহস্যে। সংশ্লিষ্ট শিল্পকর্মের সংস্পর্শে যথাসময়ে আসতে পারলে এ ধাঁচের একটি কবিতা হয়ত আমিও লিখতে পারতাম।
...................................................................
অসংখ্য 'নেই'-এর ভিড় ঠেলে
জ্বলজ্যান্ত 'আছে' খুঁজে পাওয়া হলো আসল ফকিরি

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

??? এর ছবি

হা হা হা.... ভালো বলেছেন মুজিব। তবে যথাসময়টা যে কখন সেটা কি আমরা জানি? আমার নিজের লেখা থেকে দৃষ্টান্ত দিই: "ঝিঁঝিট" নামে ১৯৯৪ সালে একটা কবিতার বই বের হয়েছিল আমার, সেখানে "জননী" নামে একটা সনেট ছিল, যেটা মূলত সন্তানকে ফেলে রেখে যায় এমন একটা ভাসমান পতিতাকে নিয়ে লেখা। খুবই অপরোক্ষ ধরনের। কবিতাটি লিখেছিলাম ১৯৮৯ সালে। একই বিষয়ের ওপর ২০০৫ সালে, মানে ১৬ বছর পর, লিখি গল্প "ডুমরি"। বিষয়টাকে যখন পাশাপাশি ভাবি, নিজের এই ধরনের পৌনপূনিকতাকে বেশ উপভোগ্য লাগে। "জননী" যখন লিখেছিলাম, তখনি বুঝেছিলাম ঐ বিষয়টাকে ঠিকমত ধরতে পারি নাই আমি। ডুমরি লেখার পর মনে হৈল, ধরার প্রাণপণ চেষ্টা অন্তত করেছি।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

??? এর ছবি

ঐ কবিতাটা সুনীলের, কনফুসিয়াস। তিনি লিখেছিলেন, ছোটখালার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে গিয়ে তিনি প্রথম যৌন আনন্দ পেয়েছিলেন। ফ্রয়েড-পড়া পঞ্চাশের দশকের জন্য যথার্থ র‌্যাডিক্যাল উচ্চারণ সেইটা। আমার ক্ষেত্রে এতটা র‌্যাডিক্যাল নয় বিষয়টা। ছোটখালার প্রতি আমার যে টান, তাতে শরীরী যৌনতার ভাষার চেয়ে ঘন উপমা অনেক বেশি স্বস্তিকর আর স্বাভাবিক, আমার জন্য। শরীরী যৌনতা একটা ঘটনামাত্র, এর বাইরে একটা প্রায়-সার্বজনীন অনুভূতি কাজ করে সকল অনুভূতিশীল ভাইগ্নার হৃদয়ে। ছোটখালার ব্যাপারে।
আমাদের পরিবারপ্রথায় ছোটখালা আসলে কাছাকাছি বয়সের হয়ে থাকেন বলেই হয়ত। আমি সে বিষয়টাকে ধরতে চেয়েছি, শরীরী যৌনতার ঘটনাকে নয়।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

??? এর ছবি

অই যে আকাশ নীল আমার পড়া নাই। কার লেখা?
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।