আমার ডলফিনগুলো-১

যূথচারী এর ছবি
লিখেছেন যূথচারী (তারিখ: শুক্র, ২৫/০৯/২০০৯ - ৮:১২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শীতলক্ষ্যার পাড়ে জন্ম আমার। শৈশব কেটেছে ওই নদীকে কেন্দ্র করেই। বৃষ্টি হলেই কেন যেন নদীটা টানতো আমায়। সবার অলক্ষ্যে একটা পানশি অথবা কোশা (কুশা) নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম নদীতে। জাল থাকতো নৌকাতেই, না হলে নিয়ে যেতাম সঙ্গে করে। তারপর জাল ফেলে মাছ ধরা। তখন মাছ-ও পাওয়া যেত বেশ। জাল ফেললেই মাছ। পুটি আর ছোট চিংড়ি পেতাম বেশ। তবে অন্য মাছ-ও পেতাম। এমনকি রুই কাতলা বোয়ালের মতো পোষা মাছ-ও পাওয়া যেত। একবার তো বিরাট একটা কালো কুচকুচে তেলতেলে মাছ উঠলো জালে। এই মাছ খাওয়া যায় কিনা, এটা সাপ জাতীয় কিছু কিনা, এই নিয়ে আমি আর সহ-জেলে চাচাতো ভাই গুরুগম্ভীর আলোচনা শুরু করলাম। পরে আমরা সিদ্ধান্তে আসলাম, এটা আসলে শিশুর বাচ্চা। সুতরাং আমরা এটাকে নদীতেই আবার ছেড়ে দেওয়া যাক।

শিশু মাছের নামটা কেন শিশু মাছ হলো, এটা মাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। সেবার চনপাড়া থেকে ইছাখালি পর্যন্ত নৌকা করে আসছিলাম আমরা। গয়না নৌকা - ছৈ দেয়া। মা, আমরা তিন ভাইবোন আর আমার খালু। যদিও খালু, কিন্তু তিনি আবার আমার নানার ভক্তশিষ্য। আমার নানা ছিলেন বাউল ধরনের মানুষ। নিজেই গান লিখতেন, সুর করতেন এবং গাইতেন। স্বভাবতই তার কিছু শিষ্য জুটেছিল। চনপাড়া থেকে রওনা হওয়ার কিছুক্ষন পরেই নতুন চরে এসে মাঝিরা নৌকা ভিড়িয়ে দিল। অনেক দূরের পথ, সুতরাং কিছু খাওয়া দাওয়া করা দরকার। খালু, আমি এবং মাঝিদের একজন চললাম নতুন চরের অস্থায়ী বাজারে। কতো জাতের যে মাছ উঠেছে! শীতলক্ষ্যা যেখানে মেঘনার সাথে মিশেছে, সেটা বেশি দূরে না হওয়াতে সদ্য আহরিত ইলিশ-ও পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। আমরা বেছে বেছে শেষমেষ ইলিশ-ই কিনলাম। আরো কিছু বাজারসদাই করে, চরেই রান্নাবান্না করে খেয়েদেয়ে আমরা রওনা হলাম। ঠিক তখনই কয়েকটা বিশাল মাছ লাফিয়ে উঠলো নদীতে, মাকে জিজ্ঞেস করলাম- এই মাছের নাম কি? মা বলে, এদের নাম শিশু। এতো বড়ো মাছের নাম কেন শিশু, তার জবাব মা, খালু বা মাঝিরা কেউ দিতে পারলো না। আমরা তিন ভাইবোন ছৈ-এর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে শিশু মাছেদের খেলা দেখতে লাগলাম। বিশেষ করে চেইন করে করে যে লাফগুলো দিচ্ছিলো, তা ছিল অসাধারণ। মাঝিরা আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছিলো- এতো কিনারে যাইও না, পইড়া যাইবা। মাঝিরা বলে বলে পনেরোটা, বিশটা শিশু আছে নদীতে; আমার অবশ্য পরে মনে হয়েছে শত শত শিশু আছে নদীতে।

তখনো আমরা টেলিভিশনে ডলফিনের ব্যাপার স্যাপারগুলো বুঝে উঠতে পারিনি। ডলফিনের বাংলাই যে শুশুক এবং তার স্থানীয় বিকৃতি যে শিশু তা-ও আমাদের মাথায় ঢোকেনি। তবু এতো বিশাল বিশাল মাছেদের এতো শিশুসুলভ কাণ্ডকারখানা আমাদের মুগ্ধ করতো।

বৃষ্টি হলেই তাই নদীতে ছুটতাম। মাছ ধরা তো আছেই, শিশুগুলোর কাণ্ডকীর্তি দেখাও একটা উপলক্ষ ছিল। একবার তো মাছ ধরে যেই না নদীর এক বাঁকে এসেছি, দেখি কি আমার পচাঁত্তরোর্ধ্ব নানা বৃষ্টির মধ্যে নদীর পাড়ে বসে একমনে শিশুর খেলা দেখছে। আমি “ও-ও-ও-ও নানা, একলা একলা বইসা কি করোগো নানাআআ?” বলে যেই না হাঁক দিয়েছি, অমনি তিনি “তফাৎ যা, তফাৎ যা” বলে চেচিয়ে উঠলেন। নানা আমাকে খুব ভালোবাসতেন, সুতরাং তার এই অকস্মাৎ রূঢ় ব্যবহারে দুঃখ পাওয়ার কথা থাকলেও, মোটেই দুঃখ পেলাম না। বরং এই ঘটনার কথা চিন্তা করে সেদিন-ও মজা পেয়েছি, এখনো হাসি পায়। বুড়া একটা লোক ঝুম বৃষ্টির মধ্যে একা একা বসে শিশুর খেলা দেখে! নৌকা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে আমি দ্রুত তার চোখের আড়ালে চলে গেলাম। সেদিন-ও একগাদা মাছ ধরেছিলাম। ঢাকায় এনে স্কুলে ভর্তি করিয়ে না দিলে আমি হয়তো জেলেই হতাম একটা। নানা জাত বেজাতের মাছ ধরে সেগুলোকে নতুন চরের বাজারে বিক্রি করে লবন, তেল কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। মাকে বলতাম- নে মা তোর মাছ, তেল, লবন; শিং মাছ আর উচ্ছের ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত খাব আজ।

জেলে হওয়া আর হলো না, তবে সুযোগ পেলেই শিশুগুলোকে দেখতে যেতাম। কয়েকদিন আগেই তো রাজকুমার* সমভিব্যহারে বাড়ি গেলাম। যদিও এখন অনেক রাস্তাঘাট হয়েছে, এখন আর নৌকা করে কেউ যায় না, তবু শিশু দেখার লোভে আমি আর রাজকুমার নৌকা ভাড়া করলাম। পৃথিবীর সব নোংরা আর দুর্গন্ধ সহ্য করতে সক্ষম বলে জানতাম যে রাজকুমারকে, সে-ও পুরো নৌযাত্রাটিতেই রুমাল দিয়ে নাক চেপে রাখলো। আমি কিন্তু নাকে রুমাল দেইনি। কারণ আমি জানি, এই রাস্তা এই ব্রীজ এই কলকারখানা এই সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার বাবা, মামা, খালুরা কতোবার যে মন্ত্রী এমপি-দের কাছে গেছে, রাস্তা করেন, ব্রীজ করেন, ঢাকার এতো কাছে অথচ শিল্পায়ন হলো না, একটু শিল্পায়নের উদ্যোগ নেন, কতো দেন দরবার নিয়ে। অবশেষে রাস্তা হলো, ব্রীজ হলো, শিল্পায়ন হলো, নদীর নতুন চরে এডিবল তেলের কারখানা হলো। আর আমার শিশুরা পচে গলে মিশে গেল শীতলক্ষ্যার পানির সাথে। আমার নিজের অপরাধে আমার শৈশবের সঙ্গীদের মৃত্যু হলো, আর আমি তার পঁচা গলা শরীর মেশানো পানির গন্ধে নাকে রুমাল দেই কিভাবে?

*রাজকুমার সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

নগরায়ন, শিল্পায়ন ঠিকাছে । টিকা থাকতে হৈলে এগিলি লাগবো । তয় আমাগো সমস্যা হৈলো এইটা করতে গিয়া আমরা প্রকৃতিরে হঠায় দিতেছি ।
একটা নিউজ শেয়ার করলাম । আমার মনে হয় এখনও সবকিছু শেষ হয়ে যায় নাই ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

বছর কয়েক আগে একবার সুন্দরবনে গিয়া কুয়াশায় লঞ্চ আটকা পড়ছিলো। আমাদের সেই লঞ্চ ঘিরে খেলা করতে এলো একদল ডলফিন। ঘিরিয়া ঘিরিয়া নৃত্য যেন। সেই দৃশ্য কখনো ভুলবো না।
এবার সুন্দরবন গিয়ে সেই দৃশ্যটাকে খুব মিস করছি।

আমরা এরকমই আসলে...

রাজকুমার সম্পর্কে আমার ব্যাপক কৌতুহল ছিলো আপনাদের নানাবিধ মন্তব্য পড়ে পড়ে। সেদিন তাই বাঘাদারে চেপে ধরে জেনে নিলাম অনেক কিছু। এখন তাকে আরো বেশি জানার ইচ্ছাপ্রবল নিয়া ঘুরে বেড়াই...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রেনেসাঁ [অতিথি] এর ছবি

অবশেষে রাস্তা হলো, ব্রীজ হলো, শিল্পায়ন হলো, নদীর নতুন চরে এডিবল তেলের কারখানা হলো। আর আমার শিশুরা পচে গলে মিশে গেল শীতলক্ষ্যার পানির সাথে।
সমবেদনা ।
আমার ছেলেবেলাও ঠিক আপনার মতই। পদ্মা নদীর সাথে মিশে আছে শৈশব আর কৈশরের অনেকটা সময়। ফারাক্কার কল্যানে সেই পদ্মায় হাঁটুপানি।

নগরায়ন, শিল্পায়নের দরকার আছে এগুলো হতে হবে পরিকল্পিতভাবে।

রণদীপম বসু এর ছবি

ওইখানে ক্লিক করলে কি রাজকুমার সম্পর্কে কিছু জানা যায়...?

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

যূথচারী এর ছবি

যদিও রাজকুমার নামক একজন ব্যক্তি আছেন, কিন্তু আমরা যারা রাজকুমারের ভক্তকুল, আমাদের কাছে রাজকুমার আসলে একজন ব্যক্তির চেয়ে অনেক বাইরের; রাজকুমার একটি ধারণা। আর ধারণা সম্পর্কে জানতে হলে ওই ধারণা সম্পর্কে ভক্ত-অভক্তের মন্তব্য ও বিশ্লেষণ জানাটা জরুরি। ওই লিংকে আপনি এই মন্তব্য এবং বিশ্লেষণগুলো পাবেন। সেখান থেকেই আপনাকে রাজকুমার রহস্যের কিছুটা ধোয়াঁশা আমেজ নিতে হবে। আপনি যদি তার জন্ম, শিক্ষা ইত্যাদি বৃত্তান্ত জানতে চান, তবে গোপনে গোপনে নিয়ে ফেলুন; রাজকুমার যেন কোনোভাবেই না জানে। জানলে আপনাকে রাজকুমার-প্রণীত বাংলায় কিছু শুনতে হতে পারে। সেই দায়দায়িত্ব আমি নিতে রাজি না।
চোখ টিপি


চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...


চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...

গৌতম এর ছবি

আমার মামাবাড়ি যেতে হতো দুটা নদী আর একটা হাওর পেরিয়ে। মোহনগঞ্জের কংশ নদী পেরুলেই ডিঙ্গাপোতা হাওর আর হাওয়ের ওই পারে ধনু নদ। ছোটবেলায় ট্রলারে, নৌকায় যেতে যেতে অগণিত শিশু মাছ (আমরা শিশু মাছ-ই বলতাম) দেখেছি। কখনও মিনিটের পর মিনিট তাকিয়ে আছি একদিকে, শিশু মাছ লাফ দিলো অন্যদিকে- তাই নিয়ে সে কী আফসোস! তারপরও একবারের যাত্রায় অন্তত ৫০-৬০টা শিশু মাছ দেখা যেতো।

একটু বড় হওয়ার পর অর্থাৎ এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে শেষবারের মতো যখন মামাবাড়ি গেলাম, তখন যাওয়ার পথে মাত্র একটা শিশু মাছ দেখেছিলাম। এটা প্রায় ১৫ বছর আগের কথা। এখন সেখানে শিশু মাছ আছে কি না কে জানে!

না থাকারই তো কথা!
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

জুয়েল বিন জহির [অতিথি] এর ছবি

আপনেগো এলাকায় শিশু কইত? ছোটবেলা আমরা কইতাম হুং মাছ। রঙিন পালতোলা দাঁড়টানা নৌকায় দাদার বাড়ি যাওনের সময় ওদের খেলা দেখতাম পাটাতনে বসে। অনেক দিন পর আবার মনে পড়ছে...

আমার যতদূর মনে পড়ে রাজকুমার আপনার ঐখানে গেছিল প্রায় ৪-৫ বছর আগে @ জাফর ভাই

না, ঐ খানে ক্লিক করে রাজকুমার সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না; রাজকুমার ভক্তদের আকুলতা-ব্যাকুলতা ইত্যাদি ইত্যাদি জানা যায়@ রণদীপম বসু

যুধিষ্ঠির এর ছবি

শুশুক বা শিশু মাছ কি আসলেই ডলফিন? আমার ধারণা ছিলো ওগুলো ডলফিন জাতের সামুদ্রিক প্রানী, কিন্তু ঠিক ডলফিন না। খুব সম্ভবত: বাংলাদেশে যেগুলো দেখা যেত ওগুলো পরপয়েজ

আমি নিশ্চিত না, কেউ কি সঠিক জানেন?

এনকিদু এর ছবি

আমি দুই একবার নদীতে শুশুক দেখেছিলাম, কয়েক পলকের জন্য । আমার কাছে মনে হয়েছে পরপয়েজের চাইতে ডলফিনের সাথেই মিল বেশি । এখানে দেখুন, আমাজনের নদীতে এক ধরনের ডলফিন বাস করে । আমাদের দেশের নদীতে যাদের দেখা যায়, তারা এরকম কিছু হয়ত । আর আমার স্মৃতির সাথে এই পাতার মিঠা পানির ডলফিনের ছবিটা সবচেয়ে বেশি মিলে ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

যূথচারী এর ছবি

সম্প্রতি যে ডলফিন উৎসব হলো, সেখানে আয়োজকরা তো বললো, শুশুক-ই ডলফিন। গণ্যমান্য প্রফেসররাও তো সেখানে ছিলেন, আমি অবশ্য মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যই গেছিলাম; সুতরাং আমিও কনফিউজড। তবে, সম্ভবত ডলফিন-ই, আমার কাছে ওদের যে লিফলেট-টিফলেটগুলা আছে, ওখানে ওরা ডলফিন শব্দটাই লিখছে।


চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...


চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।