বৃত্ত

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি
লিখেছেন জোহরা ফেরদৌসী (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩০/০৫/২০১৩ - ৭:৫২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

।।এক।।

ছুটির দিনের শেষ বিকেল। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। আনোয়ারা বেগম বসে আছেন আট তলার ফ্ল্যাট বাড়ির ড্রয়িং রুমের সামনের এক চিলতে বারান্দায়। সদ্য বৃষ্টির পরের রোদটা তেমন জোরালো না। ফ্লাট বাড়িটার সামনেই রাস্তা। রাস্তার ওপারের মুখোমুখি বাড়িটা দোতলা। অনেক গাছ গাছালীতে ভরা। তারপর সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় সারি সারি উঁচু উঁচু বিল্ডিং। আকাশে এখনো দল বেঁধে চলেছে মেঘের সারি। মেঘের দলের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে সামনের বাড়িটার জানালার ছাদে, কার্নিশে। ফুরুৎ করে একটা ছোট্ট শালিক উড়ে এসে বসল কার্নিশের ওপর। সরু চঞ্চু দিয়ে জমে থাকা বৃষ্টির পানি শুষে নিচ্ছে শালিকটা। ওর দেখাদেখি আরও একটা শালিক উড়ে এলো। এক টানে অনেক খানি পানি খেয়ে নিলো দ্বিতীয় শালিকটাও, যেন অনেক দিন খায় নি এমন স্বাদু বৃষ্টির পানি।

বৃষ্টির পরের মাটির সোঁদা গন্ধ এই ফ্লাট বাসায় পাওয়া যায় না। তবে, বাতাসের ভেজা ভাবটা পাওয়া যায়। আনোয়ারা বেগমের মনটাও কি আজ একটু ভেজা? থেকে থেকে কেন মনে পড়ছে পেছনের কথা! ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মত পুরানো সব কথারা উড়ছে কেন মনের আকাশে? সেই কবেকার শৈশব...বেগম বাজারের বাড়ি...বড় উঠোনের চারিদিকে টিনের ঘর...কলতলায় ঝাঁকড়া লেবুর গাছ...সাদা সাদা ফুল ভর্তি হাসনাহেনার গাছ... ফুলের গন্ধে চলে আসা গাছের গোঁড়ায় কুণ্ডলী পেঁচানো সাপ...রাতের বেলায় বাথরুমে যেতে সেই সাপ দেখে চমকে যাওয়া...দুই বেণী ঝুলিয়ে স্কুল, কলেজ...উঠোনেই শামিয়ানা টানিয়ে বিয়ে। তারপর কত বার বাড়ি বদল হতে হতে এই আট তলার ফ্লাটে থিতু হওয়া। কখন এক এক করে এলো জাহিদ, মিতু, নিতু...চোখের পলকে কেমন সব বড়ও হয়ে গেল। মিতু, নিতু এখন ইউনিভার্সিটিতে। জাহিদ বুয়েট থেকে পাস করে চাকরীতে ঢুকেছে তিন বছর। মাস ছয়েক আগে জাহিদের বিয়েও হয়ে গেল।

স্বাতী। জাহিদের বৌ। কেমন যেন অদ্ভুত লাগে মেয়েটাকে আনোয়ারা বেগমের। ঠিক মিতু, নিতুর মত না। মিতু, নিতুর অনেক বন্ধু বান্ধব, হরদম আসছে যাচ্ছে। এই মেয়েটা কেমন যেন চুপচাপ। জাহিদ তার চিরকালের জেদি ছেলে, যখন যেটা বলে সেটাই করে ছাড়ে। আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কত মেয়ে দেখলো। আনোয়ারা বেগমও দেখেছেন অনেক মেয়ে। ছেলে পছন্দ করলো না। হঠাৎ একদিন বাড়ি এসে যখন স্বাতীর কথা বলল, তখন আনোয়ারা বেগম আর না করতে পারেন নি। জাহিদের বাবা অবশ্য একদমই রাজী ছিলেন না। স্বাতীর বাবা রিটায়ার্ড। শ্যামলীর আদাবরে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে। অনেকগুলো ভাই বোন। স্বাতী সবার ছোট। বুঝাই যাচ্ছে, ভাই বোনরাই বড় করেছে স্বাতীকে। বিয়েতে আর কি দেয়া থোয়া করবে? হ'লোও তাই।

বিয়ে হয়েছে মাত্র ক’মাস। কিন্তু জাহিদকে দেখে কেন যেন মনে হয় ভেতরে ভেতরে পস্তাচ্ছে। অফিসে স্বাতীর সঙ্গে পরিচয় অল্পদিনের। ঘোরের মাথায় হঠাৎ বিয়েটা করা বোধহয় ঠিক হয়নি। কি দেখে ভালো লাগলো ছেলের কে জানে! ঢাকায় নিজেদের মাথা গোঁজার একটা ঠাই নেই। দেখতেও তো স্বাতী এমন আহামরি কিছু নয়। শ্যামলা মুখটা শুধু লাবণ্যে ভরা। আর পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরী করছে। এইতো। আজকাল অবশ্য স্বাতীর মুখটা প্রায়শই কেমন বিষণ্ণ থাকে। আনোয়ারা বেগমের পাশের ঘরটাই ছেলে আর বৌয়ের বেডরুম। দু’এক বার মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে ছেলের রাগী গলা শুনতে পেয়েছেন। ছেলের বৌ যেহেতু কিছু বলেনি, তিনিও আগ বাড়িয়ে কিছু জানতে চাননি। তবে, দু’দিন আগে ভোর বেলায় অজু করতে উঠে স্বাতীকে ড্রয়িং রুমের সোফার ওপর বসে থাকতে দেখেছিলেন। সেদিন আর পারেননি, অজানা আশংকায় কেঁপে উঠেছিল তার মন। কাছে এসে দেখেন স্বাতীর দু’চোখে অনিদ্রা আর কান্নার ছাপ। আনোয়ারা বেগম জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী হয়েছে, স্বাতী?” জবাবে স্বাতী “কিছু না” বলে উঠে গিয়েছিল।

মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন আনোয়ারা বেগম। ওদেরও একই মত, ভাইয়ের বিয়েটা ঠিক হয়নি। মিতুতো বলেই বসল, “এর চেয়ে ভাইয়া ফারিয়াকে বিয়ে করলে অনেক ভালো হ’ত। ফারিয়া স্বাতীর চেয়ে কত স্মার্ট। ফারিয়াদের কত বড় কনস্ট্রাকশন ফার্ম!” জাহিদের বাবার সঙ্গে তো কিছু বলাই যাবে না। তিনি প্রথম থেকেই স্বাতীকে পছন্দ করেননি, শুধু একমাত্র ছেলের ইচ্ছেটাকে সহ্য করে নিয়েছেন। এখন কিছু বলতে গেলে উল্টো আনোয়ারা বেগমের দোষ ধরবেন।

।। দুই।।

জাহিদ নিজের বেডরুম থেকে বের হয়ে হন হন করে ড্রয়িং রুমের দরজার দিকে যাচ্ছে, “এই অবেলায় কোথায় যাচ্ছ, জাহিদ ?”

“নাঈমের বাসায় যাচ্ছি, আম্মু। দরজাটা লাগিয়ে দাও।”

ড্রয়িং রুমের দরজা বন্ধ করে আবার এসে বারান্দার চেয়ারটাতে বসেন আনোয়ারা বেগম। শুনশান বাড়িতে শুধু তিনি আর স্বাতী এখন। যাবেন না কি একবার ছেলের বেডরুমে? স্বাতীকে জিজ্ঞেস করবেন কিছু হয়েছে কি না? ভাবতে ভাবতেই দেখেন স্বাতী ওর ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বের হয়ে এলো। বারান্দার গ্রিলের ওপর চিবুক ঠেকিয়ে স্বাতী তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। আনোয়ারা বেগম দেখতে পাচ্ছেন স্বাতীর চোখের ধূসর দৃষ্টি।

“আমি অপার হয়ে বসে আছি”...স্বাতীর ঘর থেকে ফরিদা পারভীনের গলা ভেসে আসছে। কী অদ্ভুত! এই বয়সী একটা মেয়ে এই সব গান শোনে কেন? কই মিতু, নিতুতো কখনো এই সব গান শোনে না! ভাবতে ভাবতে আনোয়ারা বেগমের হাত চলে যায় তার বুকের ওপর। ব্লাউজের নিচে বুকের ডানদিকে। সেখানে এক মুঠো শুন্যতা। বুকের এই জায়গাটায় হাত রাখলেই শিউরে উঠেন আনোয়ারা বেগম। ন’বছর আগের এক দিনের কথা মনে পড়ে যায়। প্রথম যেদিন টের পেয়েছিলেন। ডান স্তনের নিচের দিকে এক দলা জমাট মাংসপিণ্ড। তারপর...প্রথম বারে অপারেশন, রেডিয়েশন আর কেমোথেরাপি। দ্বিতীয়বারে যখন আবার ফিরে এলো বিচ্ছিরি অসুখটা...আবার অপারেশন। সেবারে অবশ্য ফেলে দেয়া হ’ল পুরোটা স্তন...আরেক দফা রেডিয়েশন...আরেক দফা কেমোথেরাপি।

ডানদিকের বুকের ওপর হাত রাখলে চামড়ার নীচে পাজরের হাড় হাতে লাগে। শক্ত হাড়ের ওপর আনমনে হাত বুলাতে থাকেন আনোয়ারা বেগম। যেন নিজের না, অন্য কারুর বেদনার ক্ষতে হাত বুলাচ্ছেন এমন করে আলতো আঙ্গুলে হাত বুলাতে বুলাতে গতকাল রাতে জাহিদের বাবার মুখে শোনা কথাগুলো ভাবতে থাকেন। আজকাল আর ছেলে মেয়েদের সামনে শুনতে হয় না। ছেলে মেয়েরা ভীষণ মা অন্তঃ-প্রাণ। বিশেষতঃ জাহিদকে একটু সমঝেই চলেন ওর বাবা। তাই আহমেদ সাহেব আজকাল একান্তেই বলেন অসহিষ্ণু গলার কথাগুলো, “মানুষ কত রকম আনন্দ করে। আল্লাহ আমাকেই কেন বেছে নিলো? আমাকেই কেন ক্যান্সারের বোঝা বইতে হবে সারা জীবন? কী দোষ করেছি আমি?”

গত ন’বছর ধরে শুনতে শুনতে এখন এক রকম গা সওয়া হয়ে গিয়েছে আনোয়ারা বেগমের। শুধু জাহিদের বিয়ের পর থেকে আজকাল তার আতঙ্ক একটাই। ছেলের বৌ না শুনে ফেলে শ্বশুড়ের কথা! চাপাস্বরে বারবার মিনতি করেন আনোয়ারা বেগম, “আস্তে কথা বলো। পাশের ঘরে ছেলের বৌ, শুনতে পাবে...”

আনোয়ারা বেগম জানেন না, আজ থেকে ঠিক দশ বছর পরে স্বাতীর বামদিকের স্তনে একটি মাংসপিণ্ড ধরা পড়বে। বিদেশ, বিভূঁইয়ে অপারেশন, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি এই সব করতে করতে জাহিদ ক্লান্ত হয়ে যাবে। তারপর একদিন বেদনার্ত স্বাতীকে সে বলবে, “মানুষ কত রকম আনন্দ করে। আল্লাহ আমাকেই কেন বেছে নিলো? আমাকেই কেন ক্যান্সারের বোঝা বইতে হবে সারা জীবন? কী দোষ করেছি আমি?”

তখন পাশের ঘরে ওদের ছয় বছরের ঘুমন্ত ছেলেটা দুঃস্বপ্ন দেখে কেঁদে উঠবে, “মা...


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

শুধু ভাল লাগা লেখা নিয়েই কিছু বলা/লেখা বোধ হয় একটু অবিচার করা হয়ে যায়। তাই, জোহরা বোন, তোমার এই লেখা নিয়েও একটু বলি। অনেক সম্ভাবনা ছিল - কিন্তু ব্যবহার করা হয়নি। ফলে একটা অত্যন্তই লেখার মত বিষয় নিয়ে লেখা গল্পটা জমে ওঠার জায়গায় পৌঁছানোর আশা জাগিয়ে কি রকম দম ফুরিয়ে শেষ হয়ে গেল। যা যা আমি এই গল্পতে পেলে ভাল লাগত তার দু-একটি এই রকম -
(১) স্বাতীকে মিতু, নিতু জাহির-দের থেকে বেশী জায়গা দিয়ে তাকে বিশেষ চরিত্র হিসেবে যে ভাবে দাঁড় করান হল এর পরে তাকে ঘিরে গল্পটার আরো কিছু বিস্তার, টানাপোড়েন।
(২) আনোয়ারার যে মনে হওয়া যে জাহিদের সাথে স্বাতীর বনবনা হচ্ছে না সেটার বদলে যদি তার বিপরীতটাই মনে হোত, সেক্ষেত্রে দশ বছর পরের যে ভবিষ্যতটার ছবি আঁকা হয়েছে, তার অভিঘাতটা ঠিকঠাক তীব্রতায় লাগত।
তবে তুমি যে তোমার অপূর্ব আত্মকথা-র গন্ডীতে আটকে না থেকে সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছ তার জন্য অনেক খুশী জানালাম।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

অমিত’দা, দৌড়ের উপ্রে আছি। তবুও তোমার মন্তব্য দেখে জবাব না দিয়ে যেতে পারছি না। খুব ভালো করেছো কষে একটা সমালোচনা করে।

অনেক সম্ভাবনা ছিল - কিন্তু ব্যবহার করা হয়নি। ফলে একটা অত্যন্তই লেখার মত বিষয় নিয়ে লেখা গল্পটা জমে ওঠার জায়গায় পৌঁছানোর আশা জাগিয়ে কি রকম দম ফুরিয়ে শেষ হয়ে গেল।

একদম ঠিক বলেছো। বেশী লম্বা করতে চাইনি। তাতে যে দরকারী ডিটেইলসগুলো বাদ পড়ে গেল, সেটা আর বুঝে উঠিনি ইয়ে, মানে...

যা যা আমি এই গল্পতে পেলে ভাল লাগত তার দু-একটি এই রকম -
(১) স্বাতীকে মিতু, নিতু জাহির-দের থেকে বেশী জায়গা দিয়ে তাকে বিশেষ চরিত্র হিসেবে যে ভাবে দাঁড় করান হল এর পরে তাকে ঘিরে গল্পটার আরো কিছু বিস্তার, টানাপোড়েন।

ঠিক কথা।

(২) আনোয়ারার যে মনে হওয়া যে জাহিদের সাথে স্বাতীর বনবনা হচ্ছে না সেটার বদলে যদি তার বিপরীতটাই মনে হোত, সেক্ষেত্রে দশ বছর পরের যে ভবিষ্যতটার ছবি আঁকা হয়েছে, তার অভিঘাতটা ঠিকঠাক তীব্রতায় লাগত।

এখানে আমার একটু দ্বিমত আছে। গল্পটাতে একাধিক সমান্তরাল বৃত্ত আছে। জাহিদ যে পরিবারে বেড়ে উঠেছে সে পরিবারে স্বাতীর পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতাই যোগ্যতার মাপকাঠি। যে কারণে জাহিদের বাবা স্বাতীকে শুধু “সহ্য” করে নেয়। জাহিদের মা নিজেও আহ্লাদিত না। জাহিদের বোনরা রীতিমত উপেক্ষা করে। জাহিদের বাড়িতে স্বাতী শুরু করে অনাকাঙ্খিত এক দাম্পত্য জীবন। জাহিদ যদিও সাময়িক ভালো লাগার বশে সেই বৃত্তকে অতিক্রম করতে চেয়েছিল। কিন্তু সচেতনভাবে পারে না। তাই সে বিয়ের অল্পকিছু দিনের মধ্যেই পস্তাতে শুরু করে। এই জায়গাটা আমি পরিষ্কার করতে পারিনি, সে আমার ব্যর্থতা।

তবে তুমি যে তোমার অপূর্ব আত্মকথা-র গন্ডীতে আটকে না থেকে সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছ তার জন্য অনেক খুশী জানালাম।

মকশ করতে হবে, প্রচুর মকশ। বুঝলে না আমি হচ্ছি চিরকালের আলসে কুম্ভকর্ণ, আমাকে দিয়ে কি কিছু হবে? কিচ্ছু হবে না।

যাকগে, অনেক ধন্যবাদ, অমিত’দা। ভালো থেকো।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

তারেক অণু এর ছবি

পড়ে ফেললাম এক টানেই, কিন্তু মাঝেই একাধিক জায়গায় ছন্দপতন , অথবা তাড়াহুড়োর প্রবাহ আছে মনে হচ্ছে। লেখা চলুক

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

এক্কেবারে ঠিক কথা বলেছেন, অণু। গল্পটা আবার লিখতে হবে। দেখি আবার একটা চেষ্টা নেব একটু সময় নিয়ে। যাকগে, পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগ্ল কিন্তু আর ভাল হতে পারত, লেখা চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।