উপন্যাস : যদি সে ভালো না বাসে – পর্ব ০৭

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: বিষ্যুদ, ১০/০৪/২০০৮ - ১০:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৩.২ নীলা

হঠাৎ মুসার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে। এই মাতাল ইচ্ছেটা মাঝে মাঝে হয়। কিন্তু আমি জানি, নম্বর জানা থাকলেও তাকে আমি ফোন করবো না। সে যাতে আমার সন্ধান না পায় তার জন্যে মোবাইল নম্বরও বদলে নিয়েছি। এই ঢাকা শহরে চাইলে সে আমাকে ঠিকই খুঁজে পাবে, তাতে সন্দেহ নেই। আজকাল তার হাতে সময় বেশি থাকার কথা নয়, রেডিও-টিভি আর সিনেমার গান, সিডি-ক্যাসেট এইসব নিয়ে সে আজকাল ভালোই ব্যস্ত থাকে জানি। আমার গান ছেড়ে দেওয়ার পেছনে মুসার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো না, অজান্তে শুধু উপলক্ষ হয়ে উঠেছিলো। সে আজও জানে না, হয়তো অনুমানে কিছু বুঝেছিলো। ঠিক জানা নেই। আমি নিজে কোনোদিন বলিনি, দরকার মনে হয়নি।

নিশি তখন চার বছরের, আমাদের বেশ ফুরফুরে একটা জীবন কাটছে। জামাল তার ব্যবসাপত্র নিয়ে আছে, আমার আছে গান আর নিশি নামের একটা জ্যান্ত খেলনা। জামাল ঘরে থাকলে ভাগ বসায়, মেয়ে তখন দু'জনের খেলনা। জামাল আগে একবার বিয়ে করেছিলো, একটা ছেলেও আছে – এইসব নতুন কোনো কথা নয়, জেনেশুনেই তার বউ হয়েছিলাম। ছোটোখাটো কিছু অশান্তি ও না বোঝাবুঝির চোরকাঁটা, তা কোন সংসারে না থাকে! তারপরেও বেশ দিন ছিলো তখন।

মফস্বল শহর থেকে সদ্য-আসা ছেলে মুসা হারুন। নজরুল জন্মজয়ন্তীতে টিভির এক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে আমাকে ডুয়েট গাইতে বলা হয়। তার গান শুধু নয়, নামও আগে কখনো শুনেছি বলে মনে করতে পারি না। রিহার্সালের সময় পরিচয়। লাজুক মুখচোরা ধরনের সরল-সোজা ছেলে, ঢাকা এসেছে অল্প কিছুদিন হয়। কথায় যশোর অঞ্চলের স্পষ্ট টান অটুট। গলা ভালো – সুরেলা, গভীর ও পুরুয়ালি। বয়সে আমার বছর দুই-তিনেকের ছোটোই হবে অনুমান হয়।

প্রথম রিহার্সালের দিন এক ফাঁকে মুসা বলে, আপা আপনার গান আমার খুব ভালো লাগে।

প্রশংসাটা সত্যি হতে পারে, মিথ্যা হওয়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু সত্যি বলে ভাবতে ইচ্ছে করে। স্তুতি কার না ভালো লাগে!

রিহার্সালের সময় জানা যায়, আমাদের গানটি আউটডোরে শুটিং করা হবে। গান আগে রেকর্ড করা হবে, বাইরের দৃশ্যায়নের সময় আমরা শুধু ঠোঁট মেলাবো। মিউজিক ভিডিওর ধারণা তখন মাত্র প্রচলন হচ্ছে। 'মোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলেম' গানটির জন্যে উপযুক্ত জায়গা খুঁজে রাখা হয়েছিলো, শেষ বৈশাখের তীব্র গরমে সারাদিন ধরে শুটিং হলো বলধা গার্ডেন ও রমনা পার্কে। দৃশ্যায়ন হোক বা গায়কী হোক অথবা দুইয়ে মিলেই হোক, গানটা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এমনকি ফিলার হিসেবেও ঘন ঘন প্রচার করা হতে থাকে।

গানটি মুসা এবং আমাকে এক ধরনের পরিচিতি দেয়। এখানে-ওখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের জুড়ি বেঁধে আমন্ত্রণ আসতে থাকে, যদিও ছোটো নিশিকে রেখে ঢাকার বাইরে যাওয়া হয়নি। যাবো, কখনো ভাবিওনি। ঢাকার বাইরের আমন্ত্রণগুলো এক কথায় নাকচ হয়ে যেতো। মঞ্চে উঠলে হংসমিথুন গাওয়ার দাবি, মুসার সঙ্গে। দাবি পূরণে প্রচুর করতালি, তারও মাদকতা আছে।

তবে সাফল্যে ও পরিচিতিতে সত্যি আমার মাথা ঘুরে যায়নি। গিয়েছিলো জামালের। কে কী বোঝালো নাকি নিজেই বুঝলো জানি না, মুসার সঙ্গে আমার গোপন সম্পর্ক আবিষ্কার করে বসলো সে। আমাকে জিজ্ঞেস করা নয়, ব্যাখ্যা চাওয়া নয়। একদিন সরাসরি সিদ্ধান্ত জানায় সে, ওই ছেলের সঙ্গে তোমার এতো মাখামাখি কীসের? ওর সঙ্গে তোমাকে যেন আর গাইতে না দেখি।

মাখামাখি কোথায় কীভাবে দেখেছে সে, বোঝা গেলো না। দু'চারদিন মুসা আমদের বাসায় এসেছে, একসঙ্গে বসে নতুন গান তুলেছি। সবই জামালের উপস্থিতিতে। তার সঙ্গে সে শালা-দুলাভাই সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছিলো, দু'জনের হাসিঠাট্টাও কম হতো না। মুসা মামা এলে নিশি তৎক্ষণাৎ তার কোলে। আমরা হারমোনিয়াম নিয়ে বসলে সে-ও বসে যেতো গলা মেলাতে। তবু বিনা মেঘেও কখনো কখনো বাজ পড়ে, জানা হলো। বজ্রপাত সচরাচর মাথার ওপরে হয় এবং তা পোড়ানোর ক্ষমতাও ধরে।

দিনের পর দিন জামালের কাছে একই অভিযোগ শুনে শুনে ক্লান্ত হয়ে যাই। ভালো লাগে না, সরল-সোজা জীবন হঠাৎই খুব জটিল লাগতে থাকে। জামালের জন্যে ভালোবাসা তখন কতোটুকু অবশিষ্ট ছিলো আমার, বলা শক্ত। সন্দেহ-বাতিক যে মানুষকে কতো উন্মত্ত করতে পারে, কোনোদিন জানতামই না। কথা কাটাকাটির সময় একদিন জামালের হাত উঠলো আমার গায়ে। ফুলে ওঠা বাঁ চোখের ওপরে কালসিটে দাগ দেখে বুঝে যাই, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসে গেছে।

জামাল আমাকে গাইতে নিষেধ করেনি, শুধুমাত্র মুসার সঙ্গে গাওয়া চলবে না বলছে। কিন্তু টের পাই, আজ কথা উঠেছে, কাল আর কাউকে নিয়ে হবে। আমাকে গান ছাড়তে হবে, না হয় এই সংসার। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি, না-ই হলো আমার গান গাওয়ার সাধ পূরণ। সবার সব ইচ্ছে পূর্ণ হবে, তার কোনো মানে নেই। আমারও হবে না। কী এসে যাবে তাতে? পৃথিবীর কারো কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু পাঁচ বছরের নিশির জীবনে বাবা-মা দু'জনকেই দরকার, একজনকেও বাদ দেওয়া চলে না। তখন আমার শরীরের ভেতরে ঋষিও উঁকি দিচ্ছে।

মনস্থির করা সহজ হয়ে যায়। রেডিও-টিভির অনুষ্ঠান ফিরিয়ে দিই, মঞ্চের অনুষ্ঠানও। উৎকণ্ঠা নিয়ে মুসা আসে। জিজ্ঞেস করে, কী হলো তোর, নীলা আপা?

অনেক আগেই ওর সঙ্গে সম্পর্ক তুই-তোকারিতে এসে গিয়েছিলো। বললাম, ভালো লাগে না রে।

বাজে কথা বলছিস তুই।

বাজে হলে বাজে, এসব নিয়ে আমাকে আর বিরক্ত করতে আসিস না।

স্তম্ভিত মুখে মুসা আমার দিকে তাকায়। কী বোঝে কে জানে, অর্ধেক খাওয়া চা রেখে সে উঠে চলে যায়। আর সে কখনো আসেনি, আমিও আসতে বলিনি। ঋষি হওয়ার বছর দুয়েক পরে নিজেই একদিন ফোন করি। বাসায় একা থাকলে মাঝেমধ্যে ফোনে কথা বলতাম। ওই পর্যন্তই। তা-ও একসময় বন্ধ করে দিই, কিছু না জানিয়ে মোবাইল নম্বর পাল্টে ফেলি।

গানের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক আমার আর নেই। শোনাও ছেড়েছি। অন্য কেউ শুনছে, তখন কানে এলে কিছু করার নেই। নিজের আগ্রহে শুনি না। গাওয়ার প্রশ্ন নেই, একটু গুনগুন করা, তা-ও করি না। একা বাসায় থাকলে কখনো একেবারে ভেতর থেকে কোনো কোনো সুর লতিয়ে ওঠে, গলায় উঠে আসতে চায়। তখন অন্য কিছুতে মন দিই। নিজের কাছে পালিয়ে থাকা। খাটের নিচে রাখা হারমোনিয়াম আমার পুরনো পরিচয়ের স্মারক হয়ে আছে। আজকাল আর তাকিয়েও দেখি না। শুধু জানি, জিনিসটা ওখানেই আছে। থাক। দীর্ঘশ্বাস প্রকাশ্য করতে নেই।

জামালের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখন এক ছাদের নিচে বাস করার চেয়ে বেশি কিছু নয়। দরকারি কথা ছাড়া এখন কথাও তেমন হয় না, তাতে ছেলেমেয়েদের সামনে কথা কাটাকাটির সম্ভাবনা কমে। ব্যবস্থাটা দু'জনেই মেনে নিয়েছি। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের না-বলা চুক্তি।

(ক্রমশ)


মন্তব্য

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

ছয়টা পর্ব একটানে পড়লাম (আজকে অফিসে কাজের চাপ নাই চোখ টিপি)
প্রসংশা তো নতুন করে করার দরকার নাই ,,,, হিউম্যান-রিলেশনের একটা জটিল থিসিস হবে আশা করি ,,,
একেক পর্বে একে চরিত্রের স্বগোতোক্তিতে কথা বলার ব্যাপারটা ভালো লেগেছে ,,, একই লেখক কতজনের হয়ে বলতে পারে!! ,,, এই স্টাইলটা কখনও চোখে পড়েনি ,,, আপনার আবিস্কার?

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

বলেন কি? আবিষ্কারক? আমি? না রে ভাই, অতো প্রতিভা নিয়ে জন্মাইনি। উত্তম পুরুষে একাধিক চরিত্রকে দিয়ে গল্প বলানোর এই ধরণটা নতুন কিছু নয়। অনেক গল্প-উপন্যাস এই কায়দায় লেখা হয়েছে। আমার তো ধারণা, এটা একটা মস্ত ফাঁকিবাজি। কারণ, উত্তম পুরুষে লেখা অনেক সোজা।

এই লেখাটা সম্পর্কের জটিল বিশ্লেষণও খুব একটা নয়। সরল-সোজা করে একটা গল্প বলার চেষ্টা। গভীর তত্ত্ব কিছু নেই। পড়তে কারো ভালো লাগলেই আমি খুশি।

ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা আপনার পাঠ ও মন্তব্যের জন্যে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- পর্বটা একটানে পড়লাম। শুধু জানালাম গল্পদাদুকে। হাসি
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

শুধু জানানো? ভালো না হোক, মন্দ কিছুও কি বলার নেই? চিন্তিত

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

'মাতাল ইচ্ছে'টা আগামিতে কি করে, জানার অপেক্ষায় - - -

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আগেভাগেই বলে দেবো? নাঃ, থাক। চোখ টিপি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

সন্দেহ-বাতিক যে মানুষকে কতো উন্মত্ত করতে পারে- ভীষন সত্যি কথা।
মাঝখানে বেশ কয়েকটা পর্ব বাদ পড়ায় আর পড়িইনি। শেষের অপেক্ষায় ছিলাম। আবার শুরু করলাম।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।