উপন্যাস : যদি সে ভালো না বাসে – পর্ব ১১

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: সোম, ১৪/০৪/২০০৮ - ১০:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৪.৩ জামাল

সতীনের কথায় মায়ের চিৎকার দিয়ে কাঁদার কথা, অথবা চুপ করে যাওয়ার কথা, কিন্তু খুব শান্ত গলায় মা জিজ্ঞেস করে, হামার কথা তাঁই জানে?

হ্যাঁ। লুকাবো কেন? আমি কোনো কথা লুকাই না, মিথ্যা বলাও আমার স্বভাব নয়।

কী কলো তাঁই? হামাক তালাক দিবার কয়নি?

না, বলেনি। তবে তুমি চাইলে দিতে পারি। জামালের জন্যে চিন্তা করতে হবে না। তুমি এই সংসারে থাকো বা আলাদা হয়ে যাও, ছেলের দায়িত্ব আমার। মাসে মাসে তোমাদের খরচের জন্যে টাকা আসবে।

মা চুপ করে থাকে।

বাবা বলেন, এক্ষুণি উত্তর দিতে হবে না। ভেবেচিন্তে ঠিক করো। এ বাড়িতে থাকতে চাইলে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না, আমার স্ত্রীর মর্যাদা নিয়েই থাকবে। তবে যদি মনে হয় তুমি নতুন করে জীবন শুরু করবে, তাতেও আমার আপত্তি নেই। তুমি আমার ছেলের মা, তোমাকে কখনো অসম্মান করিনি, করবোও না। এইটুকু বিশ্বাস কোরো।

বিশ্বাস না করার কারণ ছিলো না, বাবা ভুল কিছু বলেননি। তবে বড়ো হয়ে আমার ধারণা হয়েছে, এরকমই হয়তো নিয়তি ছিলো। শহরে সংসার করতে না গিয়ে মা শুধু বাবার দ্বিতীয় বিয়ের একটা উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছিলো। বিশুদ্ধ গ্রামের মেয়ে আমার মায়ের শিক্ষা-দীক্ষা, চলন-বলন সবকিছু বাবার বিশাল ক্যারিয়ারের সঙ্গে কখনো মানানসই হতো না। অকার্যকর হওয়ার সব উপাদান তাদের বিয়েতে ছিলো একেবারে গোড়া থেকেই।

বাবা কথা রেখেছিলেন, তিনি আমাদের সম্পূর্ণ পরিত্যাগ কখনো করেননি। কিন্তু আমার বেড়ে ওঠার বয়সে বাবাকে কাছে পাওয়া হলো না, এই দুঃখও আমার কোনোদিন যাবে না। টাইফয়েডে মায়ের অকস্মাৎ মৃত্যুর পর আমি চাচা-চাচী ও ততোদিনে প্রায় চলৎশক্তিহীন দাদার কাছে থেকে যাই। তখন আমার বারো বছর, আমাকে নিতে কেউ আসেনি। বাবার পাঠানো মানি অর্ডার নিয়মমতো এসেছে, কখনো ভুল হয়নি। ছুটিতে বাবা দেশে এলে গ্রামে এসেছেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা ওঠেনি। ততোদিনে তাঁর নতুন সংসারে আরেকটি পুত্রসন্তান এসে গেছে। কিশোর বয়সী আমার নিজেকে তখন বাড়তি উচ্ছিষ্ট না ভাবা কিছুতেই সম্ভব ছিলো না। চাচা-চাচী যথাসম্ভব করেছে, দাদা তখন থেকেও না-থাকা। মনে হতো, আমার কেউ নেই। অনেকদূরে কোথাও বাবা আছেন, কিন্তু নেই। অনেকটা তাঁর নিজের ইচ্ছায়। মা আমাকে ত্যাগ করে চলে গেছে, তা কি ইচ্ছায় না অনিচ্ছায়?

নতুন মা ও আমার অচেনা ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিন স্পষ্ট মনে আছে। আমি তখন ক্লাস টেনে। দুই মাইল দূরে স্কুল, হেঁটে যাওয়া-আসা করি। পড়ায় মন নেই, যেতে হয় তাই যাই। ঘরে ফিরে আসি, তা-ও আসতে হয় বলে। কোনো কোনোদিন স্কুলে যাওয়ার নাম করে নদীর ধারে শ্মশানঘাটে গিয়ে একা একা বসে থাকি। ছোটো অপ্রশস্ত নদীতে ক্রমাগত ঢিল ছুঁড়ি, সেগুলি নদীর ওপারে পাঠিয়ে দিতে চাই। পারি না, মাঝনদী পর্যন্ত যায় বড়োজোর। আমার দৌড় ওই পর্যন্তই। বাসনা আছে, তা পূরণের সামর্থ্য নেই। নদীর ওপার আমার নাগালের বাইরে থেকে যায়।

শ্মশানে লোকজনের ভিড় থাকে মাঝেমধ্যে। তখন দক্ষিণে আরো কিছুদূর হেঁটে যাই। বড়ো গাছপালা ঘেরা জঙ্গলমতো একটা জায়গা আছে, সেখানে যাই, আপনমনে হাঁটি। গাছতলায় শুয়েবসে থাকি। বেলা পড়ে এলে বাড়ির পথ ধরি।

সেদিন স্কুলে গিয়েছি, আগের দিন শোনা গিয়েছিলো কে একজন আসবে জাদু দেখাতে। জাদুকর তার হ্যাট উল্টেপাল্টে আমাদের দেখায়, ভেতরে কিচ্ছু নেই। শূন্য হ্যাট টেবিলের ওপরে উপুড় করে রাখে। তারপর ভাতের হাঁড়ির ঢাকনা তোলার কায়দায় হ্যাট তুলতেই ভেতর থেকে এক জোড়া সাদা কবুতর বের হয়। আরো নানা ভেলকিতে আমাদের বিস্ময় জাগায়। স্কুলে এতো ছেলে থাকতে একসময় কে জানে কেন জাদুকর আমাকে মঞ্চে ডেকে নেয়। কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, ইতিহাস বইয়ে তোমার সবচেয়ে প্রিয় কে?

বললাম, সম্রাট শাজাহান।

লোকটা আমাকে চেয়ারে বসিয়ে মুখের সামনে তার হাতের পাঞ্জা ঘোরায়, কীসব যেন বলে। তারপর আর কিছু মনে নেই। পরে সবার কাছে শুনলাম, লোকটা আমাকে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলো। যখন জেগেছি, আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, তুমি কে বলো তো? আমি উত্তরে বলেছি, সম্রাট শাজাহান!

শুনে বিশ্বাস হতে চায় না। তাই হয় নাকি? কিন্তু ওরা বানিয়ে বলবে কেন? বাড়ি ফেরার পথে মনে হতে থাকে, জাদু হয়তো একেবারে স্থায়ীভাবে কিছু পাল্টে দিতে পারে না। সম্রাট শাজাহান থেকে আবার জামাল হয়ে যেতে হয়, নিস্তার নেই। জাদুকরের ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতা অস্থায়ী, না হলে ভালো হতো না মন্দ হতো কে জানে! কারণ একজনের ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিপরীত ইচ্ছা আরেকজনের হতে পারে। আমি বাবার কাছে যেতে চাই, কিন্তু বাবা যদি না চায়? জাদুকর তাহলে কার বাসনা পূরণ করবে?

এক জায়গায় দেখি দুই গ্রামের মধ্যে হা ডু ডু খেলা হচ্ছে। অনেক লোকের ভিড়, তার মধ্যে আমারও কোনোমতে জায়গা হয়ে যায়। সন্ধ্যার কিছু পরে ফিরে আসি, তখন চারদিকে অন্ধকার নেমেছে। অথচ আমাদের সারা বাড়ি আলোয় আলো। এই সময়ে আমাদের একটা-দুটো ঘরে আলো থাকে, আজ সব ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে। বাড়ির বাইরে বৈঠকখানায় এই সময় কারো থাকার কথা নয়, সেখানেও আলো দেখে উঁকি দিই। একটা চেয়ারে বাবা, পাশে দাঁড়ানো একজন মহিলা আর এক বালক। ইজিচেয়ারে দাদা। কয়েক বছর আগে বাবার এনে দেওয়া ইজিচেয়ারটায় দাদা সবসময় বসে থাকতেন, আজকাল আর বসেন না, বিছানায়ই থাকতে হয়। আজ হয়তো ধরে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মহিলা এবং বালকের পরিচয় আমার জানা। আগে চোখে দেখা হয়নি, এই যা। আমি এক পলক দেখে দরজা থেকে সরে যাচ্ছিলাম। বাবার চোখে পড়ে গেলে ভেতরে ডাক পড়ে।

হাতে বইপত্র দেখে বললেন, কী রে, এতোক্ষণে স্কুল থেকে ফিরলি?

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে বাবা নতুন মুখগুলির দিকে তাকিয়ে বলেন, এই হলো জামাল। আর জামাল, এই হলো তোর ছোটো মা আর ভাই। এর নাম সুমন।

নতুন মায়ের দিকে তাকাই। ফরসা, সামান্য লম্বাটে মুখ। হাসি হাসি মুখ দেখেও ঠিক বোঝা যায় না আমাকে পছন্দ করছেন কি না। পরনের শাড়ি দেখলে বোঝা যায় দামি। এই ধরনের কোনো শাড়ি আমার মায়ের ছিলো না। আমাকে হাত ধরে কাছে টেনে নিলে শরীরে এক ধরনের সুবাস পাই, তা-ও আমার কাছে নতুন। সুমনের মুখ দেখে তাকে খুব ক্লান্ত লাগে, এক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়বে এরকম মনে হয়।

পরিচয়পর্ব খুব দীর্ঘ হয় না বলে স্বস্তি পাই। নিজের ঘরে ফিরে হ্যারিকেনটা দরজার বাইরে রাখি। অন্ধকার ঘরে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকি। বাবা এসেছেন, আমার খুশি হওয়ার কথা। তাঁর কাছাকাছি থাকতে ভালো লাগে, থাকতে চাই। বরাবর তাই হয়ে এসেছে। এবারে অন্যরকম, দূরে সরে থাকতে ভালো লাগছে। আগে বাবা গ্রামের বাড়িতে এলে আমি পুরো মনোযোগ পেতাম। এখন আর তা হওয়ার নয়। আমার চোখ ভেজে।

(ক্রমশ)


মন্তব্য

তারেক এর ছবি

জুবায়ের ভাইয়ের নতুন উপন্যাস!! ই বুক চাইইইই!! শেষ করেন, পুরোটা একসাথে পড়ব। হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ঠিক আছে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ধুসর গোধূলি এর ছবি
মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এই পর্ব কী দোষে দোষী হলো? চিন্তিত

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

মুশফিকা মুমু এর ছবি

ইস জামালের জন্য মায়া লাগছে মন খারাপ

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

বড়োই কোমল হৃদয় আপনার। দেখা যাক, শেষমেশ কী হয়! ততোক্ষণ থাকবেন তো?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

উদাস এর ছবি

নিয়মিত পড়ে যাচ্ছি। ভালো লাগছে।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আওয়াজ না দিলে ধন্যবাদ জানানোর সুযোগটা পেতাম না। হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

"বাড়ি ফেরার পথে মনে হতে থাকে, জাদু হয়তো একেবারে স্থায়ীভাবে কিছু পাল্টে দিতে পারে না। সম্রাট শাজাহান থেকে আবার জামাল হয়ে যেতে হয়, নিস্তার নেই।" -- আহারে, আসল যাদু যদি জানতাম!!
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

জ্বিনের বাদশা তো আপনি নিজে। চোখ টিপি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আমার চোখ ভেজে।

পাঠকের মন ভেজে।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

জামালের জন্য খারাপ লাগছে।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।