উপন্যাস : যদি সে ভালো না বাসে – পর্ব ১২

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/০৪/২০০৮ - ৯:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৪.৪ জামাল

পরদিন সকালে বাবা বললেন, আজ না হয় স্কুলে যাস না, জামাল।

স্কুলে যাওয়া আমার খুব পছন্দের নয়, দ্বিতীয়বার বলার দরকার হয়নি। ছোটো মা-সহ আমাকে নিয়ে বাবা গেলেন মায়ের কবরে। সুমনকে বাড়িতে রেখে যাওয়া হলো। মা মারা যাওয়ার প্রায় দুই বছর পর বাবা প্রথম গ্রামে এলেন। বিদেশ থেকে তৎক্ষণাৎ আসা সম্ভব ছিলো না জানিয়ে আমাকে চিঠি লিখেছিলেন অবশ্য। মায়ের অনুষ্ঠানাদি আর কবর বাঁধানোর জন্যে টাকাও এসেছিলো যথাসময়ে ও যথানিয়মে। আমার মায়ের কবরে ছোটো মাকে একটুও মানাচ্ছিলো না। এখানে তাঁর কী দরকার? এই মহিলার সঙ্গে মা-র কখনো দেখা হয়নি, আগেই পালিয়েছে মা। তার আত্মসম্মান হয়তো বেঁচেছে, কিন্তু আমার? আমার কথা কেউ ভাবে?

ভাবে না বলি কী করে? এক সন্ধ্যায় আমাকে বসিয়ে বড়োরা সবাই বৈঠকে বসলেন দাদার ঘরে। বাবা, নতুন মা, চাচা-চাচী, বিছানায় শোয়া দাদা। আমাকে নিয়ে কী করা হবে, সেই বিষয়ে কথা। কথা শুরু করলেন বাবা। বছর তিনেকের মধ্যে তাঁর বিদেশের চাকরির মেয়াদ শেষ হবে, তখন ঢাকায় ফিরে আমাকে নিয়ে যাবেন নিজের কাছে। ততোদিনে আমার ইন্টারমিডিয়েট শেষ হয়ে যাবে।

আমার মনে হয়, ইন্টারমিডিয়েট পড়াটা কোথায় হবে? গাঁয়ের স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ সম্ভব, কলেজ কোথায়? কাছাকাছি কলেজ কমপক্ষে দশ মাইল। আমি কিছু বলি না, চুপ করে শুনি। প্রশ্নটা কেউ করে না। চাচা কিছু বলবেন না, জানা কথা। বড়ো ভাই যা বলবেন, তাতে সায় দেওয়ার বেশি কিছু করারও নেই তাঁর। আপত্তি করলে, প্রশ্ন তুললে বড়ো ভাই ভাবতে পারেন, বোঝা নামানোর জন্যে বলা। শুধু দাদা একবার বললেন, অক বিদেশোত লিয়া যাওয়া যায় না?

ছোটো মা বললেন, তা কিন্তু হতে পারে। ও দেশে তো চেনাজানা মানুষ বিশেষ কেউ নেই। সুমনের একটা বড়ো ভাইও থাকলো।

বাবা সংক্ষেপে জানালেন, অসুবিধা আছে।

কী অসুবিধা তা ব্যাখ্যা করলেন না। কেউ আর কোনো প্রশ্নও করে না।

আমার আর্তি কেউ শুনতে পায় না। একা আমিই জানি। সবটাই সাজানো নাটকের মতো লাগে। বাবা আর ছোটো মা-র কথাগুলো আগে থেকেই সাজিয়ে আনা মনে হয়। অভিনয় নিখুঁত হয়েছে। প্রকাশ্যে নয়, মনে মনে হাততালি দিই।

চারদিন পরে অতিথিরা বিদায় নিলেন। নতুন দু'জন অতিথিই, বাবাও এবারে তার চেয়ে বেশি কিছু না। হয়তো আমি অন্য চোখে দেখছিলাম বলে এরকম লাগে।

তিন বছর নয়, বাবার ফিরতে লেগে গেলো প্রায় ছয় বছর। যুদ্ধ একটা কারণ, ফিরলেন বাংলাদেশ হওয়ার কিছু পরে। যুদ্ধের সময়টা আমার কাটে দিনমান তাস খেলে। স্নানাহার ও রাতে ঘুমের জন্যে বিছানার প্রয়োজন না হলে বাড়িতে আর আসে কে! আমাদের পাহুনন্দা গ্রাম সীমান্তের কাছে, মিলিটারি হামলার আশংকা হলে সাইকেলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অন্যদেশের সীমানায় ঢুকে পড়া যায়।

যুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় আমাদের বাড়ি লোকজনে ভরা থাকতো। দলে দলে মানুষ শহর থেকে, অন্যসব গ্রাম থেকে পালিয়ে আসছে। ওপারে যাবে। তার মধ্যে একদিন-দু'দিন থাকার মতো অচেনা অপরিচিত মানুষ যেমন আছে, আত্মীয়-স্বজনও কম নয়। তাদের অনেককে আগে কোনোদিন দেখিনি। আত্মীয়দের অনেকে ওপারে শরণার্থী শিবিরের বদলে আমাদের সঙ্গেই থেকে যায় স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে। পরিস্থিতি বুঝে নিজেদের ঘরে ফেরে, পাহুনন্দায়ও আর নিরাপদ মনে না হলে ওপারে রওনা হয়ে যায়। একেক বেলায় তখন চল্লিশ-পঞ্চাশজনের রান্না হয় বাড়িতে।

এক ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে বাড়ি ফিরছি। রাত একটু বেশিই হয়েছে। পা টিপে সাবধানে আমার ঘরের দাওয়ায় উঠেছি। আমার ছোটো ঘরটিতে আমি একা থাকি, ঘরে যাতায়াতের জন্যে মাঝখানে সামান্য জায়গা ছেড়ে দাওয়ার দুই পাশে অনেক মানুষ পাটি পেতে চাটাই পেতে ঘুমায়। এই অন্ধকারেও কারো গায়ে পা না দিয়ে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার কায়দা ততোদিনে শিখে গিয়েছি। কপাটের শিকল নামিয়ে ঘরে ঢুকেছি, মনে হলো কেউ একজন যেন আমার পেছনে এসে ঢুকলো।

বুঝে ওঠার সময় পাওয়া যায় না, তার আগেই দরজায় খিল পড়ে গেছে। দরজা বন্ধ করার কাজটা আমার নয়, তা নিশ্চিত জানি। অন্ধকারে কেউ একজন আমাকে জাপটে ধরে। বুঝতে সময় লাগে না, শরীরের মালিক পুরুষ নয়। কোন কোন বৈশিষ্ট্য দিয়ে নারীশরীর চেনা যায় তা জানা আছে। কিছু বলার আগেই জীবনের প্রথম চুম্বনে মুখ আটকে যায়। নীরব সম্মতিতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন জাগ্রত দুই শরীর। পরিধেয় অপসারণ, উন্মোচন ও উদঘাটন পর্বের পর শরীরে শরীর মিলিয়ে দেওয়া। আনাড়িপনা বা অতিরিক্ত অস্থিরতায় আমি সমাপ্ত হই অবিলম্বে। তৎক্ষণাৎ সশব্দ একটি চড় আমার গালে নেমে আসে, সজোর ধাক্কায় আমি বিছানায় কাৎ হয়ে পড়ি। অন্ধকারে শুধু টের পাই, অপর শরীর দরজা খুলে দ্রুত অপসৃত হয়েছে।

পরদিন সকালে অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি সময় বাড়িতে থাকি। বাড়িভরা মানুষজনের মুখ দেখি। কাল রাতে আমার ঘরে কে এসেছিলো বোঝার চেষ্টা করি। কোনো নারীমুখে কোনো ছায়া দেখি না। তার পরিচয় চিরদিন রহস্যে থেকে যায়, আমার কোনোদিন জানা হয়নি।

বাবা দেশে ফেরার দুই বছর আগে ইন্টারমিডিয়েট শেষ হয়েছে। ম্যাট্রিকের পরে নওগাঁয় বাবার এক দূর সম্পর্কের ভাইয়ের বাসায় থেকে বি টি কলেজে আমার পড়ার ব্যবস্থা হয়। চক এনায়েত পাড়ার খুব কাছে কলেজ, পাশে মুক্তি সিনেমা হল। আরেকটু হেঁটে শহরের মাঝখান দিয়ে যাওয়া নদীর ওপরের ব্রিজ পার হলে তাজ সিনেমা। আর কী চাই? বাবার হোটেলে না থাকি, বাবার পয়সায় বন্ধুদের খাওয়াতে, সিনেমা হলে দেদার খরচ করতে কোনো অসুবিধা নেই।

দেশে ফিরে বাবা এলেন আমাকে নিতে। ঢাকায় আসা হলো। নতুন দেশের নতুন রাজধানীতে আমি নতুন আগত একজন। বাড়িতে আরেকজন নতুন আমার আগেই উপস্থিত হয়েছিলো। সুমনের দুই বছর বয়সী বোন। সুখী।

মগবাজার আর ধানমণ্ডিতে অবাঙালিদের ফেলে যাওয়া দুটি বাড়ি বাবা শস্তায় কেনেন। মগবাজারের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ধানমণ্ডিতে থাকা। বড়ো দোতলা বাড়ি, ওপরে দুই বাথরুমসহ চারটা বেডরুম, সামনে পেছনে দুই ব্যালকনি। নিচে তিন বেডরুম, দুই বাথরুম, কিচেন, ড্রইং, ডাইনিং। সামনে প্রশস্ত লন, পেছনে কাজের লোকজনদের থাকার ব্যবস্থা। একপাশে দুই গাড়ি-সমান গ্যারাজ, ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠলে তার ওপরে ড্রাইভারের থাকার ঘর।

সদ্য গ্রাম থেকে এসে এইসব দেখেশুনে কিছু ভ্যাবাচ্যাকা লাগে। এরকম বাড়ি জীবনে চোখেও দেখিনি। শহর দেখার মধ্যে দেখেছি নওগাঁ, আর সেখানে থাকার সময় এক বন্ধুর সঙ্গে ট্রেনে বগুড়া। ঢাকার তুলনায় সেগুলি খেলনা শহর। এতো মানুষজনও জীবনে দেখিনি। নতুন অনেককিছু শিখতে বুঝতে হচ্ছিলো। বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে আমার দূরত্ব বুঝতে সময় লাগে না।

(ক্রমশ)


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি
মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এই রহস্যটা থেকে যাওয়া দরকারি, অন্তত এই কাহিনীর জন্যে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

"এই রহস্যটা থেকে যাওয়া দরকারি, অন্তত এই কাহিনীর জন্যে। "
বলেন কি??? জমজমাট রহস্য!
এখন থেকে তো আপনাকে দিনে তিনবেলা তিনটে করে পর্ব ছাড়তে হবে চোখ টিপি

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

দুঃখিত বিভ্রান্তি তৈরি করার জন্যে। ভুল আমার। আসলে কাহিনী নয়, /জামাল চরিত্রটির গঠেনর জন্যে এই ঘটনা একটি উপাদান।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

একটু আগে সচলের ১ম পাতায় দেখলাম উপন্যাসের শেষ পর্ব (১৮ তম) দেয়া হলো।
অথচ, এখন এই ১২ পর্বে এসে আমার মনে হচ্ছে - মাত্র তো জাঁকিয়ে বসছে কাহিনী। আরো অনেক দূর যাবে।

দেখি, শেষ পর্যন্ত কী হয়!

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

রহস্য সামনের পর্বে যেতে উৎসাহ যোগাচ্ছে !

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।