উপন্যাস : যদি সে ভালো না বাসে – পর্ব ১৫

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: শুক্র, ১৮/০৪/২০০৮ - ১০:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৪.৬ জামাল

নীলার সঙ্গে আমার তখনো পরিচয় হয়নি। যেসব নারী আমার জীবনে তখন ছিলো, তারা শুধুই আসে এবং যায়, সম্পর্কের বাঁধন বা দৃঢ়তা কিছু ছিলো না। কেউ কেউ দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতি ও সম্পর্কের আশা করে, আমার আগ্রহ হয় না। হয়তো অস্পষ্টভাবে আমার ধারণা হয়েছিলো, রিনি থাকবে রিনির মতো, আমি খুঁটিতে বাঁধা প্রাণীর মতো নাগালের মধ্যে যা পাওয়া যায় তার সব আহরণ করে যাবো। বাবার জীবন সামনেই দেখেছি। মাকে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্যে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন তাঁর হয়নি। আমার মা নিজেকে আলাদা করার কথা ভাবেনি, মেনে নিয়েছিলো। এই দেশে মেয়েরা বরাবর তা-ই করে এসেছে। রিনি আমার খুঁটি উপড়ে দিয়েছে, দড়ি কাটা শুধু বাকি।

যথাসময়ে তা-ও ঘটে। রিনির বড়ো ভাই রশিদের তৎপরতায় কোনো তিক্ততা ছাড়াই বছর দুয়েকের মাথায় বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হয়। সাজিদ তার মায়ের কাছে থাকবে। আপত্তি করার কিছু ছিলো না, করলেও তা টিকতো না। ছেলে মানুষ করার মতো, বিশেষ করে তার মাকে বাদ দিয়ে, উপযুক্ত বাবা তো আমি নই। চূড়ান্ত হওয়ার আগে রিনির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি, অন্তত ছেলের ভবিষ্যত ইত্যাদি নিয়ে, সে বলবে না। রশিদ ভাই সাজিদের সঙ্গে আমার কয়েকবার দেখা করার ব্যবস্থা করে। একদিন ছেলে জিজ্ঞেস করে, বাবা তুমি আসো না কেন? আমরা বাসায় কবে যাবো? মাকে তুমি ভালোবাসো না?

এই প্রথম বুকে বিষাদের বাতাস ঢুকে পড়ে। সামলে নিতে কিছু সময় লাগে। বলি, তোদের দু'জনকেই আমি খুব ভালোবাসি বাবা!

সত্যি বলেছিলাম, হৃদয়ের ভেতর থেকে তুলে এনে। এখন এই এতো বছর পরে জিজ্ঞেস করলেও বলবো। অনেক হোঁচট-ধাক্কা খেয়ে কেন যেন মনে হয়, রিনির সঙ্গে সঙ্গে সব সৌভাগ্যও আমার জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। কাউকে বলা চলে না, নিজের মনে কখনো কখনো ভাবি, রিনি থাকলে কীরকম জীবন হতো?

এতোকিছুর মধ্যেও কর্মক্ষেত্রে আমার মনোযোগ ছিলো অখণ্ড ও একাগ্র। সেখানে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ আমার নেই। চারজনের যৌথ পরিশ্রমে ব্যবসা মোটামুটি একটা অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়। অসামান্য কোনো সাফল্য নয়, কিন্তু তা আত্মবিশ্বাস ফোটায়।

নীলাকে বিয়ে করা রিনির সঙ্গে ছাড়াছাড়ির চার বছর পর। ততোদিনে রিনির নতুন সংসার হয়েছে, নিউ ইয়র্কে। সাজিদ তার কাছে। খুশি-অখুশি কোনোটাই হওয়ার কথা নয় আমার। তবু কোথাও যে একটু চিনচিনে অনুভব হয়নি, তা বলা কঠিন। দুই বছরের মাথায় নিশি এলো। সাজিদ আমার জীবনের ভেতরে যতোদিন সরাসরি উপস্থিত ছিলো তার দিকে তেমন মনোযোগ দেওয়া সত্যিই হয়ে ওঠেনি। নিশিকে দিই। সবার জীবনে দ্বিতীয়বার সুযোগ আসে না, আমার এসেছে বলে মনে হতে থাকে।

রিনির সঙ্গে যৌথজীবনে অন্য ধরনের আনন্দ-তৃপ্তি ছিলো। তখন আমার জীবনে বাবার ছায়া অনেক দীর্ঘ। আলাদা বাড়িতে উঠেও এক বউ ছাড়া নিজের বলতে কিছু ছিলো না। এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছি, বাবার সহায়তা থাকলেও পরিশ্রমের ফল পেয়ে তাকে নিজের দাবি করা চলে। কাজের সময়ের বাইরে নীলা আর নিশি। ছুটির দিনে একেক দিন একেকজনের বাড়িতে বন্ধুরা সবাই একত্রিত হওয়া, ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাওয়া – এইসব হতো। নীলার খুব ছোটোবেলা থেকে শখ ছিলো পূজার মৌসুমে একবার কলকাতায় যাওয়ার। তা-ও হলো, দলেবলে সবাই মিলে।

ঋষির জন্মের কিছুদিন পরে এক অঘটন। তখন অতো বড়ো মনে হয়নি, ভাবা গিয়েছিলো নিতান্তই ভুল। কিন্তু সেই ঘটনা আসতে আসতে বিশাল হয়ে ওঠে, তার ছায়া ক্রমশ বড়ো হতে হতে আমার সমস্ত জীবন উল্টে-পাল্টে দিয়ে যায়। এই ছায়ার বাইরে বেরিয়ে আসা আমার আজও হয়নি।

ঢাকায় আন্তর্জাতিক একটা উৎসব সংক্রান্ত যাবতীয় ছাপা ও প্রকাশনার কাজ আমরা পেয়েছিলাম। কাজটা বড়ো এবং সরকারি। নানান গোলযোগে সময়মতো কাজ তুলে দেওয়া গেলো না, তার মধ্যে একটা কারণ ছিলো সরকারি দফতর থেকে সময়মতো সব মালমশলার সরবরাহ না পাওয়া। আন্তর্জাতিক উৎসব বলে দেশের এবং সরকারের মান জড়িত। কোনো অজুহাত শুনতে রাজি নয় তারা। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাজের প্রাপ্য টাকা আটকে দিয়ে পরবর্তী দুই বছরের জন্যে সরকারি কোনো কাজ আমরা পাবো না বলে জানানো হয়। কোম্পানির বোর্ড মিটিঙে বন্ধুরা মুখ কালো করে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে, যেহেতু কাজটার যাবতীয় দায়িত্ব আমার ছিলো। সরকারি অফিসের মতো এখানেও কেউ কোনো ব্যাখ্যা শুনতে রাজি নয়। অজুহাতে ক্ষতিপূরণ হয় না।

সুতরাং বন্ধুরা অবিলম্বে বিশুদ্ধ ব্যবসার পার্টনারের মুখ বানিয়ে ফেলে। দোস্ত্ দোস্ত্ না রাহা...

কষ্ট হলেও একসময় মানতে হয়, বৈরি অবস্থার মধ্যে আর যাই হোক কাজ করা যায় না। কী করবো ঠিক না করেই তখন বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অন্যকিছু করা অসম্ভব ছিলো না, চেষ্টাচরিত্র করলে নিজে অথবা আর দুই-একজন পার্টনার নিয়ে প্রেসের ব্যবসায়ই থাকা যেতো। হলো না। আমার পুঁজিসহ প্রাপ্য টাকাপয়সা পাওয়া যায় দফায় দফায় দশ-বিশ-পঞ্চাশ হাজার করে। কোর্টকাচারি করার কথা মনে হয়নি কখনো তা নয়। যাদের এককালে বন্ধু জেনেছি তারা আমাকে বন্ধু আর না-ও ভাবতে পারে, কিন্তু তাদের আদালতে তোলার রুচি আমার হয়নি। আর তখন টাকাপয়সার যা অবস্থা, তাতে মামলা করলে যে টাকা অনিয়মিতভাবে হলেও তখন আসছিলো, তা একেবারেই বন্ধ হয়ে যেতো। ওই টাকায় তখন আমার পরিবার চলে।

অন্য বন্ধুবান্ধবের কাছে ধারকর্জ করে অল্প পুঁজিতে ছোটোখাটো কিছু করার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। লাভের মধ্যে লাভ ধারের বোঝা, যা আমার জীবনে আগে কখনো নিতে হয়নি। সময়মতো ধারের টাকা শোধ না করতে পেরে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছিলো। একবার পা পিছলে গেলে যা হয়, তাল সামলাতে গিয়ে হাতের কাছে যে কোনোকিছু ধরে ফেলার চেষ্টায় আরো ভাঙাচোরা করা এবং পরিশেষে নিজে চিৎপটাং হওয়া। পতনটা আমার এইভাবেই আসে।

একটা জিনিস বন্ধুদের কাছে তখন আমার শেখা হলো, অর্থনীতি পুরুষের আসল পরিচয়। অর্থনীতির সু অথবা কুস্বাস্থ্য সমাজে তোমার স্থান ও প্রতিপত্তি নির্ধারণ করবে, এটা পুরনো কথা। কিন্তু বন্ধুত্ব সম্পর্কে অবশ্য অন্য ধারণা নিয়ে আমি বড়ো হয়েছি। মনে পড়ে বাবা বলতেন, একদিনের বন্ধু তার ভালোমন্দ সব নিয়েই চিরদিনের বন্ধু। দিন পালটেছে, সে কথাও এখন বাসি। জীবন হয়তো কখনোই সম্পূর্ণ হয় না। যখন অর্থ ছিলো, জীবন খুব অর্থময় হয়নি। যখন ভুল শোধরাতে চাইলাম, তখন এলো অর্থসংকট। সবারই এরকম হয়?

আমার বড়ো অনুশোচনা, নীলা অভিমান করে তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস গান ছেড়ে দিলো। কর্মক্ষেত্রে দংশন খাওয়া পুরুষ মানুষের আত্মবিশ্বাস খুব ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। তখন খুব সহজে ভয়ংকর, হিংস্র ও সন্দেহপরায়ণ হয়ে ওঠে তারা। যেখানে কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়, সেখানেও প্রশ্ন উৎপন্ন করার উপায় খুঁজে পায়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। যা ঘটেছে, তা আর ফেরানোর উপায় নেই। অনুশোচনা নিয়ে যখন ভুল স্বীকার করতে গেলাম, তখন অনেক বিলম্ব ঘটে গেছে। নীলা সে বিষয়ে কোনো কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। একটু একটু করে দূরত্ব বাড়ে। ছোটোখাটো জিনিসে কথা কাটাকাটি হয়। ক্রমাগত কথার লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে আমরা মৌনতায় আশ্রয় নিয়েছি। প্রয়োজন ছাড়া কথা বাহুল্য হয়ে গেছে।

এক বিছানায় এখনো ঘুমাই, হয়তো বাধ্য হয়েই। আরেকটা বাড়তি ঘর আমাদের থাকলে কী হতো বলা যায় না। বিছানায় দু'জনের মাঝখানে ঘুমায় বড়ো একটা কোলবালিশ, সীমানা ভাগাভাগি করে। ঘুমের ভেতরে সীমান্ত অতিক্রম ও লঙ্ঘন কোনো কোনো রাতে ঘটে, তখন কোলবালিশ সরিয়ে নো-ম্যান'স ল্যান্ডে মিলিত হওয়া। তা শুধুই শরীরঘটিত, প্রাণের টান নেই। দুই দেশের সীমান্ত-রক্ষীদের মধ্যে ফ্ল্যাগ মিটিঙে মিলিত হওয়ার মতো। সম্পন্ন হলে একটিও কথা খরচ না করে যে যার এলাকায় ফিরে যাই, সীমান্তরেখা তখন আবার বাস্তব।

(ক্রমশ)


মন্তব্য

অপালা এর ছবি

যদি সব গুলু পর্ব লিখা থাকে, তা হলে একবারে দিয়ে দেন।অপেক্ষা করা টা কস্টের।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আজ ১৬ নম্বর পর্বটা দিয়েছি। বাকি আর মাত্র দুটি পর্ব। কষ্ট করে এটুকু ধৈর্য রাখতে পারবেন আশা করি। হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আবার সেই সীমানা ভাগাভাগির কাঁটাতার। 'পৌরুষ' মনে পড়ছে।
লেখক বড্ড নির্মম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।