উপন্যাস : যদি সে ভালো না বাসে – পর্ব ১৭

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: রবি, ২০/০৪/২০০৮ - ১০:৪৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৫.১ নিশি

বাবাকে একা পাওয়া যাচ্ছে না ক'দিন ধরে। আজও সকালে অন্যমনস্ক মুখে বেরিয়ে গেলো দেখলাম। সাজিদ ভাইয়ার আসা নিয়ে মা-র সঙ্গে কী কথা হলো জানি না। মায়ের মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। এখনো জানে বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে? বলেনি এখনো? আর কবে বলবে? বাবা যে তারিখ বলেছিলো, সেই হিসেবে আর ঠিক ছয় দিন বাকি থাকার কথা। কী ব্যবস্থা হচ্ছে কে জানে!

হয়তো আমার মাথাব্যথা নয়। তবু মাথাব্যথা বটে। বাবার হয়তো সবচেয়ে বেশি। তাহলে আমার নয় কেন? মায়েরও কিছু। তাহলে আমার নয় কেন?

এক হিসেবে ধরতে গেলে সাজিদ ভাইয়া আমার কেউ নয়। সে হিসেবটা ঠিক মনে হয় না। বাবার পুত্র হিসেবে সে আমার ভাই না তো কী? আলাদা বাবা বা মায়ের হয়েও সৎ ভাইবোনরা অনেক সময় একসঙ্গে বেড়ে ওঠে। সাজিদ ভাইয়ারও এক সৎ বোন আছে শুনেছি, তাদের বাবা-মা কেউ তাদের মিলিয়ে দেয় না। রক্তের যোগাযোগ নেই, অন্য কোথাও তাদের শুরু হয়েছিলো, পরে এসে তারা এক ছাদের নিচে মানুষ।

সেদিক থেকে আমি আর সাজিদ ভাইয়া বরং অনেক কাছের। মা আলাদা হলেও বাবা আমাদের মিলিয়ে দেয় কোথাও। আমরা দু'জন পৃথিবীর দুই প্রান্তে বড়ো হয়ে উঠেছি, তবু সে আমার ভাই-ই। সাজিদ ভাইয়ার মাকে আমি কখনো চাক্ষুষ দেখিনি, পুরনো অ্যালবামে ছবি দেখেছি। মায়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে দু'জনকেই সমান সুন্দর লাগে। তার সঙ্গে কখনো দেখা হলে তাকে আমি কী সম্বোধন করবো? সাজিদ ভাইয়ার এই সমস্যা হচ্ছিলো আমার মায়ের সঙ্গে, মা তাকে বলে দিয়েছিলেন ছোটো মা ডাকতে। সাজিদ ভাইয়ার মা কী তাহলে আমার বড়ো মা?

এইসব সম্পর্ক-টম্পর্কগুলো মাঝে মাঝে জট পাকিয়ে যায়, গোলমেলে লাগে। মায়ের দিকের কোনো আত্মীয়-স্বজনকে কখনো দেখা হয়নি। তার এক বোন দেশে থাকতে মাঝেমধ্যে নাকি আসতেন, আমি ছোটো ছিলাম, মনেও পড়ে না। বাপমায়ের সঙ্গে মাকে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হয়েছিলো বাবাকে বিয়ে করার কারণে। তাদের দেখা আমি কোনোকালে পেলাম না।

বাবার দিকেও এরকম গোলমাল আছে। দাদা-দাদীর সঙ্গে আমার এবং ঋষির সম্পর্ক খুবই ভালো। আমাদের জন্যে তাঁদের ভালোবাসার কমতি নেই, সব ভালোমন্দের খোঁজখবর রাখেন। জন্মদিনে ফোন করেন, এসএমএস করেন। দেশে এলে কতোরকমের দরকারি-অদরকারি জিনিস আনেন। তবু কোথাও যেন কিছু অপূর্ণ লাগে। হয়তো সেখানেও ভালোবাসার ভাগাভাগি।

বাবা-মায়ের জানার কথা নয় যে সাজিদ ভাই আসছে, আমাদের সঙ্গে থাকবে জেনে আমার একটা গোপন খুশি আছে। কবে থেকে মনে নেই, কেন তা-ও জানি না, তবু সবসময় মনে হয়, আমার যদি বড়ো ভাই থাকতো! বড়ো একজন ভাই থাকলে কী হয়, কী কাজে লাগে আমার সে অভিজ্ঞতা নেই। চাওয়াটা সত্যি, এখন তা পূর্ণ হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

এক ধরনের সংশয় যে নেই, তা-ও বলি কী করে? কতোটুকু চিনি আমার এই দূরে থাকা ভাইকে? আগে যখন দেখা হয়েছে, সবই অল্প সময়ের জন্যে। স্বল্পকালের অতিথির মতো এসেছে, দেখা-সাক্ষাত, সামান্য কথাবার্তা এই পর্যন্ত। ফিরে গেছে তার নানার বাসায়, তারপর সময় হলে দূরদেশে নিজের ঠিকানায়। অল্প পরিচয়ের ভাইটি ঠিক ঠিক ভাই হয়ে উঠবে তো? তাকে তেমন করে চিনি না, তার পছন্দ-অপছন্দ জানি না। যদি তাকে আমার ভালো না লাগে? বা আমাকে তার?

বাবা-মায়ের কাছ থেকে কোনো সংকেত পাওয়া যাচ্ছে না বলে উদ্বেগ হয়। তাহলে কী সাজিদ ভাইয়া আসছে না? মায়ের অনুমোদন পাওয়া যায়নি? মা সম্মত না হলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। দুই কামরার এই বাসায় আমাদের কোনোমতে থাকা, বাবা-মায়ের মধ্যে সহজ একটা বোঝাপড়া থাকলেও না হয় কথা ছিলো। তা যে নেই, চোখকান জায়গামতো থাকলে বুঝতে কারো সময় লাগার কথা নয়। সুতরাং হঠাৎ একজন কেউ এসে উপস্থিত হলে অপ্রস্তুত লাগবে, তা-ই স্বাভাবিক। দুয়েকদিনের মামলা হলে তবু কোনোমতে ঢেকেঢুকে রেখে পার করে দেওয়া যায়। বাবার হাতে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আছে বলেও মনে হয় না। কোত্থেকে থাকবে? আগের দিন আর আমাদের নেই, থাকলে সমস্যা ছিলো না। ভয় হয়, এই নিয়ে আবার মা-বাবার মধ্যে নতুন কোনো জট না লেগে যায়।

আজ দুপুরে শ্যামলীতে মেহরীনদের বাসায় যাবো। সব বন্ধুরা আসবে সেখানে। ইরফান লন্ডনে চলে যাচ্ছে পড়তে। উপায় থাকলে ওর মতো মেধাবী ছেলেরা এ দেশে থাকে না। একদিন সে যাবে, আমরা সবাই জানতাম। দিনতারিখ জানা ছিলো না, এখন তা-ও ঠিক হয়ে গেছে। সামনের রোববার। আজ তার বিদায় উপলক্ষে সবাই একত্রিত হওয়া। কিছু হাসিঠাট্টা, রঙ্গ-রসিকতা এইসব হবে আর কি। বিপদ একটাই, রান্না করবেন মেহরীনের মা নিজে। আমাদের এই খালাম্মা অল্পস্বল্প রান্না করতে জানেন না, কম করে হলেও দশটা পদ থাকবে। খাওয়ার সময় নিজে তদারক করবেন, সবগুলো পদ নিজে পাতে পাতে তুলে দেবেন। সেটা যে একরকম নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে তা বোঝানোর উপায় নেই।

(ক্রমশ)


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হায়!

পরের পর্বে শেষ???

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আর মাত্র একটা।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।