চুপকথা ১৬

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: রবি, ১৬/১২/২০০৭ - ১:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৬

The war is over, if you want it...

১৯৭২-এর জানুয়ারি। শান্তাহার থেকে ট্রেনে উঠবো, নিজের শহরে ফিরছি। দেখি ট্রেনের গায়ে পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে মুছে আলকাতরা দিয়ে হাতে লেখা হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সেই প্রথম প্রকাশ্যে বাংলাদেশ নামটি উৎকীর্ণ দেখি। অপটু হাতে লেখা, তবু কী রোমাঞ্চ, কী স্পর্ধিত গৌরব! বিহারী-অধ্যুষিত এলাকা শান্তাহার, পাকিস্তানীদের সহযোগী হওয়ার অপরাধে তাদের অনেকে নিহত - কেউ কেউ অন্যায়ভাবেও - অবশিষ্টরা পলাতক। বাড়ি বাড়ি উড্ডীন সোনালি রঙে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত নতুন পতাকা। আগের বছর তেইশে মার্চে সারাদেশে উড়েছিলো এই পতাকা, অবশ্য তা আবার নামিয়ে ফেলতে হয়েছিলো পঁচিশে মার্চের পর। এখন আর এই পতাকা কোনোদিন নামাতে হবে না। যে জাতি এতো সহ্য করতে পারে, এতো শৌর্য ধারণ করে - তাদের আর ভয় কী?

পরদিন সকালে বেরোতেই বুধা চাচার মুখোমুখি। শশ্রুমণ্ডিত মলিন মুখ, ধীর পায়ে হাঁটেন। পাড়ার গলির শেষ মাথায় তাঁর দোকান, বোধহয় সেখানেই যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ান। এক মুহূর্তমাত্র। তারপরই ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠেন, বাদশা, আলতাফ আলীক অরা মারিছে, বা’ রে...

বাদশা-আলতাফ আলী সম্পর্কে চাচাতো ভাই, ছোটোবেলা থেকে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি আমরা, এক মাঠে খেলেছি। তাদেরসহ মোট চোদ্দোজনকে তুলে নিয়ে গুলি করে মারা হয়েছিলো, আগেই শুনেছি। এই দলে আমার স্কুলের সহপাঠী সাইফুলও ছিলো। তখন রোজার সময়। মানুষজন সেহরি খেয়ে সবেমাত্র চোখ মুদেছে, এই সময় পাড়া ঘেরাও করে যুবাবয়সী ছেলেদের ছেঁকে তুলে আনা হয়, ফজরের আজান হওয়ার আগেই গাদাগাদি করে মিলিটারি ভ্যান তাদের নিয়ে যায়। তাদের লাশ পরে পাওয়া যায় শহরের কয়েক মাইল দূরের এক গ্রামের পুকুরপাড়ে, সেখানেই তারা এখনো শায়িত।

বুধা চাচাকে বলার মতো কোনো কথা মুখে আসে না। কী বলা সম্ভব পুত্রশোকগ্রস্ত পিতাকে? পুত্র যদি হতো রোগগ্রস্ত, মৃত্যু হওয়ার মতো উপযুক্ত বয়স্ক হতো, তাহলে হয়তো কিছু সান্ত্বনা পাওয়ার অজুহাত পাওয়া সম্ভব। পাকিস্তানীদের অপছন্দের কাজে লিপ্ত হলেও, যেমন হয়েছিলো সাইফুল, কতকটা বোঝা যেতো। কিন্তু নিরস্ত্র-নির্বিরোধ পুত্র এবং ভ্রাতুষ্পুত্রের নির্মম হত্যাকাণ্ড, তরুণ বয়সী হওয়াই যাদের একমাত্র অপরাধ, কীভাবে অর্থবোধক হয়? কী সান্ত্বনা আছে তার? সাইফুল ঘরে বসে মলোটোভ ককটেল তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করতো, এই অপরাধে যুদ্ধের শুরুর দিকেই ধরা পড়ে। তাকে নাটোর জেলে রাখা হয়েছিলো মাস দুয়েক, তারপর হয়তো কিছু অলৌকিক উপায়ে ছাড়া পেয়ে ঘরে ফিরে আসে এবং নির্দোষ দিনযাপন করতে থাকে। সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে তাকে ফিরে পেয়ে তার বাবা-মা কৃতজ্ঞ বোধ করেন, গরু জবাই করে কাঙালিভোজন করান। অতি সামান্য সময়ের ব্যবধানে সেই সাইফুলকেই আবার ধরে নিয়ে যাওয়া হলে সেই তার শেষ যাওয়া হয়। সাইফুলের বড়ো বোন হাসনা আপা থাকেন আমাদের একটি বাড়ি পরেই। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে কী বলবো?

আমি যুদ্ধে ছিলাম এবং তারপরেও জীবিত, এই বোধ কিয়ৎক্ষণের জন্যে বুধা চাচার সামনে আমাকে অপরাধী করে। বাদশা-আলতাফরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকেও বাঁচতে পারেনি।

দু’জনে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে নিঃশব্দে কথা বলি, পরে বাসায় দেখা করতে আসবো বলে আর্দ্র চোখে বিদায় নিই।

আমার ছোটো শহরটির পথে পথে একা হাঁটি। চেনা অনেক বাড়িঘর বদলে গেছে আগুনের পোড়া চিহ্ন নিয়ে। কোনো বাড়ির দেওয়ালে গুলির চিহ্ন, গোলার আঘাতে ভেঙে পড়া দালান, বসতবাড়ি। এইসব বাড়িঘরের অনেক বাসিন্দা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, ফিরবে না কোনোদিন। কারো কারো কথা আমি এরই মধ্যে জানি, আরো অনেক বেশি জানি না বলে আশংকা হয়।

মালতীনগরে জাফরদের বাড়ির সামনে দাঁড়াই। স্কুলজীবন থেকে তার সঙ্গে একত্রে ঘোরাফেরা, এই বাসার পাশে করতোয়ার পাড়ে খসরু-শ্যামলেন্দু-নিরু-মতিন-হেলালসহ বিকেলের আড্ডা। একতলা বাড়িটিকে এমন অক্ষত দেখবো ভাবিনি, জাফরের বড়ো ভাই আমানউল্লাহ খান আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের একজন। পঁচিশে মার্চের পর জাফরের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।

বরাবরের মতো ঘোরানো বারান্দার একপাশে বসার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকি, জাফর!

কোনো সাড়া নেই। বারান্দার দিকের জানালাগুলো সব ভেতর থেকে বন্ধ। এবার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ি। কেউ খোলে না, ভেতরে কেউ আছে কিনা তা-ও বোঝার উপায় নেই। সামান্য ধাক্কা দিতে দরজা খুলে যায়। জাফরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ভেতরে ঢুকি। কোথাও কোনো জনপ্রাণীর সাড়া নেই। উঠানে বড়ো বড়ো ঘাস, ঝোপজঙ্গলে আকীর্ণ। বারান্দায় ধূলা জমে আছে, এক কোণে একটি ভাঙা চেয়ার ওল্টানো। ভেতরের সবগুলো ঘরের দরজা-জানালা খোলা, একটু লক্ষ্য করে দেখা যায় সেগুলো নেই, খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাড়িময় গা ছমছম করা নিস্তব্ধতা। ঘরের ভেতরে উঁকি দিই, কোথাও কোনো আসবাব নেই, কিছুই নেই। এ বাড়িতে মানুষের বসতি কোনোকালে ছিলো, মনেও হয় না। এই শূন্যতার ভেতরেও কী আশায় কে জানে, জাফরের নাম ধরে ডাকি। কে আর উত্তর দেবে!

শ্যামলেন্দুদের বাড়িতে একটি পুরনো গ্রামোফোন ছিলো। একাত্তরের মার্চ মাসে কয়েকটি রেকর্ডসহ গ্রামোফোনটি আমাদের বাড়িতে কয়েকদিনের জন্যে ধার করে আনা হয়। একই সময়ে খসরু আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়েছিলো গীতবিতান

শ্যামলেন্দুর কাছ থেকে আনা একটি রেকর্ড তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের, তোলপাড় তোলপাড় মনের কথা গানটির খুঁজে পাই না তারে কলিটির জায়গায় রেকর্ড কাটা - ক্রমাগত শুনতাম খুঁজে পাই, খুঁজে পাই, খুঁজে পাই...

গ্রামোফোনটি সময়মতো ফিরিয়ে দেওয়া হয়ে ওঠেনি, যুদ্ধের পুরোটা সময় তা আমাদের বাড়িতেই থেকে যায়। যুদ্ধশেষে শ্যামলেন্দুর খোঁজে যাই। শোনা যায়, তারা সপরিবারে ভারতে চলে গেছে যুদ্ধের শুরুতে, আর ফিরবে না। আমার ভেতরে কাটা রেকর্ডে তখন ক্রমাগত বেজে যায়, খুঁজে পাই না তারে, খুঁজে পাই না তারে, খুঁজে পাই না তারে...

খসরু গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলো। যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক মাস পরে শহরে ফিরে এলে তাকে দেখে আমরা চমকে উঠি। আমরা কেউ জানতে পারিনি সে নিশ্চিত মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসেছে। মিলিটারিরা একদিন তাদের গ্রাম ঘেরাও করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায় - খসরুকে তার মা ও আরো কিছু আত্মীয়-পরিজনসহ সেই সারিতে দাঁড়াতে হয়। পাখি মারার কায়দায় তাদের লক্ষ্য করে পাকিস্তানী সেনারা গুলি চালায় । অন্যদের মতো খসরুও মাটিতে পড়ে যায়, কী অলৌকিক উপায়ে কে জানে, তার শরীরে একটিও গুলি লাগেনি! তখনো জানে না সে অক্ষত। মিলিটারি ও রাজাকাররা সমবেত উল্লাসে লুটপাট সম্পন্ন করে বাড়িঘরগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে চলে যায়। চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেলে সারিবদ্ধ মৃতদেহের মধ্যে খসরু উঠে বসে। মায়ের একটি হাত তখনো তার হাতে ধরা। চারদিকে স্বজনদের সারিবদ্ধ মৃতদেহের মাঝখানে খসরু স্তব্ধ হয়ে পাথরের মতো একা বসে থাকে।

গীতবিতান ফিরিয়ে দিয়ে খসরু জানায়, মিলিটারিরা তার ঘরে ঢুকে দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখে ছবিটি কোনো আউলিয়া-দরবেশের হবে ভেবে সালাম দেয়। অন্য বইপত্রের সঙ্গে গীতবিতানটি ঘরের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। বাড়িঘর আগুনে পুড়ে গেলেও গীতবিতান রক্ষা পায়, ক্ষয়ক্ষতি বলতে ধুলোমাটি লেগে থাকা বইটির বাঁধাই কিছু আলগা হয়ে গিয়েছিলো।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।