নটরডেমিয়ান ৩: গ্রুপ সেভেন, এইট ঘুরে অবশেষে থ্রীতে থিতু

অমিত আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন অমিত আহমেদ (তারিখ: বুধ, ২৭/০৬/২০০৭ - ৪:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

প্রথম দিন গ্রুপ সেভেনের ক্লাসে ঢুকেই মনটা তেতো হয়ে গেল। গ্রুপের ১৫০ জন ছাত্রের প্রত্যেকেরই নাকি পূর্ব নির্ধারিত আসন, সবাইকে সেখানেই বসতে হবে। এই আসন নাকি আবার আমাদের উপস্থিতি অনুযায়ী প্রতি হপ্তায় পরিবর্তন করা হবে। কেউ নিয়মিত আসলে তার আসন সামনে এগুবে আর অনুপস্থিত থাকলে বা দেরি করে আসলে (আমরা বলতাম লেট অ্যাটেনডেন্স, চারটে লেট অ্যাটেনডেন্স হলে সেটা আবার একটা অ্যাবসেন্টের সমতুল্য... কত কি যে দেখুম দুনিয়ায়) সেটা যাবে পেছনের দিকে। প্রতিদিন দুইবার করে উপস্থিতি চেক করা হতো, প্রথম ক্লাসে আর টিফিন টাইমের পরে প্রথম ক্লাসে। সবার বসার জায়গা নির্ধারিত বলে একবার তাকিয়েই বলে দেয়া যেত কে ক্লাসে উপস্থিত নেই, রোল কলের প্রয়োজন পড়তো না। তার মানে গ্রুপ ধরে সব বন্ধুদের একসাথে বসার সুযোগটা বন্ধ, আর স্যাররাও কে কোথায় বসেছে দেখেই বুঝতে পারবেন কারা ক্লাসে নিয়মিত আসে। তবে আমার বন্ধুরা প্রায় সবাই পড়েছে গ্রুপ ওয়ান, টুতে আর ফাইভে। সেভেনে কেবল আমি, মেজবাহ আর নিয়াজ। সেই ভেবেই নিজেকে সান্তনা দেই।

গ্রুপ সেভেনের ক্লাস তখন ছিল পুরানো বিল্ডিংয়ের দুই তলায়, করিডোরের বাম পাশে ঠিক শেষ মাথায়। বড় ক্লাস রুমটা চার কলামে টানা বেঞ্চ দিয়ে সাজানো। এক বেঞ্চে তিনজনের বসার ব্যবস্থা। অন্য পাশে সারা দেয়াল জুড়ে ব্ল্যাকবোর্ড। আমি বেশ মুগ্ধ হলাম ক্লাস দেখে। আমাদের স্কুলে আবার কোন বেঞ্চই অক্ষত ছিল না! ক্রিকেট খেলার প্রয়োজন পড়লেই আমরা একটা বেঞ্চ ভেঙে সুন্দর ব্যাট আর উইকেট বানিয়ে ফেলতাম। সে তুলনায় নটরডেমের বেঞ্চ গুলো বেশ নতুনের মত চকচক করছে। তার উপর ক্লাসে আবার স্পিকারের ব্যবস্থা। শিক্ষক প্রথমে ঢুকেই ছোট্ট মাইক্রোফোনটা জামায় আটকে নেন, তারপর লেকচার দেন। বিশাল ভাব!

আমার সিট পড়েছে শেষ সারির মাঝামাঝি, বেঞ্চের মধ্যিখানে। বাম পাশে জোব্বা পরা দাড়িওয়ালা এক টিংটিংয়ে হুজুর আর ডান পাশে চশমা পড়া পাঠ্যপুস্তক খেকো পড়ুয়া (আফসোস তাদের কারো নামই এখন আর মনে নেই)।
হুজুরকে যাই জিজ্ঞাস করিনা কেন সে উত্তর দেয়, আলহামদুলিল্লাহ!
"কি? কেমন লাগে নটরডেম?"
"আলহামদুলিল্লাহ!"
"সিট পছন্দ হইছে?"
"আলহামদুলিল্লাহ!"
"বেশী কড়াকড়ি লাগেনা?"
"আলহামদুলিল্লাহ!"
আমি বাধ্য হয়ে অন্য ছেলের দিকে তাকাই।
"কি মিয়া, গ্রুপ সেভেন কেমন লাগে?"
সে ফিস ফিস করে বলে, "আমরা যে কি ভাগ্যবান... ওই যে ছেলেটা..." আঙ্গুল তুলে সে সামনে বসা একটা শুকনা মত ছেলেকে দেখায়, "ও বোর্ডে ফাস্ট স্ট্যান্ড!"
আমি বিমর্ষ হয়ে ব্যাগ থেকে "মাসুদ রানা" বের করে পড়তে থাকি। ওদের চেয়ে রানার সঙ্গ নিঃসন্দেহে অনেক ভালো।

ক্লাস শুরু হলো জহরলাল স্যারকে দিয়ে, গনিতের ডাঁকাবুকো প্রফেসর, শুকনো মাঝারি লম্বার বয়স্ক মানুষ, মুখে ছাঁটা গোঁফের আবেশ, সারাক্ষনই পান চাবান। উনাকে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট ছাড়া অন্য কোন জামায় দেখিনি কখনও। রসায়নের এ.সি.দাস স্যারের সাথে আবার তাঁর খুব খাতির, দু'জনকে এক সিগারেট ভাগাভাগি করে খেতে দেখেছি। যাই হোক, প্রথম ক্লাস বলে কথা, আমি মনোযোগ দিয়েই নোট করতে থাকি। জহরলাল স্যার ক্লাসে একটা গোপন কথা ফাঁস করে দিলেন। ইন্টারভিউ থেকে নাকি স্যার-ম্যাডামরা প্রতিটা ছেলেকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে ফেলেন। অনেকটা সাইকোলজী অ্যানালাইসিসের মত, পরে সেই তালিকা ধরে সবাইকে সমানুপাতে প্রতিটা গ্রুপে ভাগ করে দেয়া হয়। কথাটার সত্যতা পরে টের পেয়েছি, এমনকি প্রতিটা সেকশনে ধার্মিক, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, উপজাতি আর মফস্সলের ছাত্রদের সংখ্যাটাও ছিল একদম হিসাব মত ভাগ করা!

গ্রুপ সেভেন ছিল স্ট্যাটিসটিকস স্টুডেন্টদের গ্রুপ, আমি সহ আমাদের আরও কয়েকজন ঠিক করে ফেললাম বায়োলজী নেব। অন্যদের কি কারন ছিল জানি না, আমার কারন ছিল গ্রুপ পছন্দ না হওয়া। গ্রুপ সেভেন ভর্তি কেবল সেইন্ট জোসেফ আর সেইন্ট গ্রেগরীর ছাত্র। গ্রেগরীয়ানরা ঠিক আছে, কিন্তু জোসেফাইটদের আমার একদম সহ্য হতো না।
প্রথমে ঠিক হলো আমাদের ক'জনের ছোট্ট গ্রুপটকে বায়োলজী ক্লাস করতে হবে গ্রুপ এইটের সাথে। গ্রুপ এইট ইংলিশ মিডিয়াম বলে আমরা এমনিতেই ওদেরকে পাত্তা দিতাম না, তার উপর প্রতিদিন ক্লাস পরিবর্তন, মনটাই খারাপ হয়ে গেল। সেই মন খারাপ থাকলোনা ওখানে কিংবদন্তী আজমল স্যারের দেখা পেয়ে। তিনি ইংলিশ মিডিয়ামে দিব্যি বাংলায় লেকচার দিয়ে দিতেন। এই হয়তো দু'একটা লাইন ইংরাজীতে, এরপর আবার "জয় বাংলা"! জটিল লোক... শিক্ষকদেরকে নিয়ে আমার এই সিরিজে পরে একটা পোস্ট আসবে, তাঁর কথা বিস্তারিত বলবো সেখানে।

যাইহোক, কিছুদিন পরেই ঘরছাড়া আমাদেরকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দেয়া হলো। আমার আশা ছিল গ্রুপ ওয়ানে সব দোস্তদের সাথে পড়বো, সেই আশায় গুড়েবালি, আমি পড়লাম গ্রুপ থ্রীতে। গ্রুপ থ্রী দেখতে বাইরে থেকে গ্রুপ সেভেনের মতই, তবুও প্রথম দেখাতেই আমার বেশ পছন্দ হয়ে গেল। একটা কারন হলো, সব গ্রুপে ক্লাস ক্যাপ্টেন সিলেক্ট করা হয়ে গেছে, কেবল গ্রুপ থ্রী তে হয়নি (জ্বী, এই শিশুতোষ জিনিসটা আছে নটরডেমে)। আরেকটা কারন হলো, ক্লাস হয় নতুন বিল্ডিংয়ে লাইব্রেরীর ঠিক পাশের রুমে, তার মানে সেখান থেকে গল্পেই বই নিয়ে ক্লাসে পাঠ্যপুস্তকের ফাঁকে পড়ার সমুহ সুযোগ।

আমার আসন পড়লো এবার প্রথম সারীতে শেষের দিকে, এবারও মাঝে। এক পাশে মারফতী চুলের এক ছেলে, অন্য পাশে দানব-সদৃশ একজন। পরিচয় পর্ব শেষ হলো, মারফতি চুলের ছেলেটার নাম চৌধুরী, ওকে জিজ্ঞাস করলাম,
"কি মিয়া, কেমন লাগতাছে নটরডেম?"
ও বলল, "বালের নটরডেম! কি করতে যে মায়ে ঢুকাইলো এইখানে। বাল! বালরে! বালটা আমার!"
দানবাকৃতির ছেলেটার নাম ইজু, ওকে জিজ্ঞাস করলাম,
"ক্লাসে কি পড়াইছে? নোট-টোট নিছো কিছু?"
সে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জলদ কন্ঠে বলে,
"কি কও এইসব? নোট নেওনের টাইম আছে?"
মনটা আমার প্রশান্তিতে ভরে যায়, গ্রুপটাকে ভালবেসে ফেলি... এই না হলে গ্রুপমেট!

[প্রথম প্রকাশ সামহোয়্যার ইন ব্লগে | ২০০৭-০৬-০২ ১৭:৪৮:২৮]

© অমিত আহমেদ

(চলবে)


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

এমনিতে কোন অসুবিধা নাই, তবে এইগুলা একপোস্টে সেকশন করে দিতে পারতেন। ফরম্যাটিং গাইডবুকে সাইজ অপশনটা দেখেন।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অমিত আহমেদ এর ছবি

সঠিক, ভুল হয়ে গেছে... গন্দমটা ওইভাবে দিতে হবে!

************************
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

অরূপ এর ছবি

আমিও ৯৭৭.. চোখ টিপি
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নিবোর্ধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!

অমিত আহমেদ এর ছবি

আরে জটিল হাসি

************************
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

আরিফ জেবতিক এর ছবি

পুরানা মাল না,নতুন মাল চাই।
শিমুলরে আনতে পারলে বেশ হতো,তাই না অমিত?
কুমিল্লা মেডিকেলে সে কেমনে সেম সাইড গোল করেছিল,এমন একটা লেখা পড়ে হাসতে হাসতে আমি ৩ দিন নড়তে পারিনি।

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

অমিত আহমেদ এর ছবি

শিমুলরে আসলেই মিস করতাছি। ওর লাস্ট লেখা কবে পড়ছি তাই মনে নাই।

একটা থ্রেট দেন পোলাটারে... সোজা ভাবে আইবো বইলা মনে লয় না!

************************
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

আরিফ জেবতিক এর ছবি

যে কম্পুটার ব্যবহার করে না,তারে আর থ্রেট দিয়া কাম কি?
তবু পারলে ফোন নাম্বারটা দিও তো মেইল করে,অনেকদিন যোগাযোগ নেই।

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

আশফাক আহমেদ এর ছবি

আরেকটা কারন হলো, ক্লাস হয় নতুন বিল্ডিংয়ে লাইব্রেরীর ঠিক পাশের রুমে, তার মানে সেখান থেকে গল্পেই বই নিয়ে ক্লাসে পাঠ্যপুস্তকের ফাঁকে পড়ার সমুহ সুযোগ।

আমার বই পড়ার আলকাপাতলা বদঅভ্যাসের পেছনের গ্রুপ থ্রি আর পাশের লাইব্রেরি অনেকাংশে দায়ী

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।