২ মার্চ, ২০০৬
সময়: সন্ধ্যা ৭:০০-৭:৪০
অফিস - তিস্তা গ্রুপ, মহাখালী, ঢাকা
ভাইয়ার রুমে ঢুকে বসবে নাকি বসবে না সেটা নিয়ে একটা দ্বিধায় পড়ে যায় রাজীব। ভাইয়া ফোনে কথা বলছে। কথা বলতে বলতেই চোখের ইশারায় ওকে বসতে বললেন তিস্তা গ্রুপের এএমডি সজীব রহমান। একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো ও। এখন বাজে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা, সাধারণত সাড়ে ছটার মধ্যেই ও অফিস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, ভাইয়াও সেটা জানেন, তাহলে এখন হঠাৎ রুমে জরুরী তলব কেন? আজ দুপুরে মিরপুরের স্যুয়েটার ফ্যাক্টরীতে স্যাম্পল পাঠাতে দেরি হওয়ায় একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু সে সমস্যার সমাধানটাতো ও নিজেই করেছে! সেই কাহিনী তুলে এখন আবার বকা দেবার পায়তাড়া চলছে নাকি?
রাজীবের বড় ভাই সজীব ওর চেয়ে মাত্র তিন বছরের বড়। দু'জনের সম্পর্কটা প্রায় বন্ধুর মত। একটা সময়ে ছিল যখন ওদের বিনোদন মানেই ছিল মারামারি করা। বাবা-মার চিন্তার শেষ ছিল না তখন ওদের নিয়ে। কিন্তু এক্ষুনি হয়তো দু'জনে মারামারি-ফাটাফাটি হয়ে গেল, একটু পরেই আবার দেখা যাবে দু'জনে বসে গভীর মনোযোগে দাবা খেলছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সম্পর্কটা কেবল গাড়ই হয়েছে। এক সাথে আড্ডা, সিনেমা দেখা কিংবা ভিডিও গেম খেলাটা এখনও তুমুল ভাবেই হয়। দুই ভাইয়ের মধ্যে সবসময় একটা অদৃশ্য টান আর পক্ষপাতিত্ব কাজ করে। ওর যে কোন ঝামেলায় ও নিঃসন্দেহে জানে ভাইয়া পাশে আছে, ভাইয়ার যে কোন সমস্যায় ও।
তবুও এখন খেয়াল করে দেখেছে ভাইয়ার রুমে আসলেই ওর মাথায় নানান দুঃশিন্তা ভর করে। নর্থ সাউথে পড়ার সময় যখন ওর টাকা চাইতে ভাইয়ার কাছে আসা পড়তো তখন মনে বিন্দুমাত্র ভয় কাজ করতো না। এটা শুরুই হয়েছে বাবার ব্যবসায় বসতে শুরু করার পর থেকে। বাবার রুমে ঢুকতে ওর সব সময়ই ভয় লাগে, সেই ভয়টা আসে বাবার প্রতি সন্তানের আজন্ম শ্রদ্ধা থেকে। ভাইয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্য রকম, এখানে ভয়ের চেয়ে বেশী কাজ করে আশঙ্কা... এই বুঝি ভাইয়া ভেবে বসল ছোট ভাইটা কোন কাজের না! ভাইয়া ওকে নিয়ে কি ভাবল এটা যে কোন কিছুর থেকেই থেকে ওর কাছে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ!
নিজেকে নিজে প্রোবোধ দিল রাজীব, আড্ডা মারতে ডেকেছে ভাইয়া। নির্ঘাত ঈশিকা আপুর সাথে ঝগড়া হয়েছে তাই নিয়ে কথা বলবে।
চার মাস হলো নর্থ সাউথ ছেড়েছে ও, কিন্তু নর্থ সাউথের সামনের আড্ডাটা এখনও ছাড়তে পারেনি। সাড়ে সাতটার সময় নিপুন, রানা, তমাল, ফয়সালের সাথে দেখা করার কথা। আড় চোখে একবার ঘড়িটা দেখতে গিয়েই ধরা পড়ে গেল রাজীব। মাউথপিসে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন ভাইয়া,
"কিরে? কাজ আছে তোর? দেরি হয়ে যাচ্ছে?"
মেরুদ্বন্ড দিয়ে শিরশিরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল ওর, মাথা নেড়ে 'না' বলল ও। ভাইয়ার গলা বেশ সিরিয়াস, গপ-সপের মুডে আছে বলে মনে হয় না। আজকের আড্ডাটা মনে হয় গেল!
সময় কাটাতে ফোনে কার সাথে কথা হচ্ছে সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলো ও। ভাইয়ার সাথে কাজ করে এই আন্দাজ করার কাজটা বেশ ভালই শিখেছে ও।
ভাইয়া বেশ চোস্ত ইংরেজীতে কথা বলছে। তার মানে বিদেশী কেউ, 'বায়ার' হবার সম্ভাবলা বেশী, কারন বেশ কয়েকবার 'রেট পার পিস' বলতে শুনল রাজীব। উপমহাদেশের কেউ হবার সম্ভাবনা কম, কারন ওদের সাথে কথা বলার সময় সবসময়ই ইংরেজীর সাথে কিছুটা বাংলা-হিন্দী মিশিয়ে দেন ভাইয়া। এশীয়ার অন্য কোন দেশেরও হবার কথা না। কারন চীনা হোক, জাপানী হোক আর কোরীয়ান হোক, এশীয়ান মানেই বিচ্ছিরি ইংরেজী, ওদের সাথে অনেক ধীরে সহজ ইংরেজীতে কথা চালাতে হয়। ব্রিটিশ কিংবা আমেরিকানও মনে হচ্ছে না, কারন ভাইয়াকে মাঝে মাঝেই দু'একটা কথার পূণরাবৃত্তি করতে হচ্ছে। মাতৃভাষা ইংরেজী এমন কারও কথাগুলো এক বারেই বুঝে নেবার কথা। শেষ সম্ভাবনা থাকে ইউরোপীয়ান, ওদের ইংরেজী ভাল না হলেও কথা বলতে হয় আমেরিকান অথবা ব্রিটিশ টানে।
ফোন রেখে সটান ওর দিকে তাকালেন সজীব, "আজ তোর আড্ডা দিতে যাওয়া হচ্ছে না। তোর দোস্তদের কল করে দে।"
"পরে করলেও হবে" মিনমিনে গলায় বলল রাজীব, "কি হয়েছে ভাইয়া? স্যাম্পলের ঝামেলাটা কিন্তু মিটে গেছে!"
"কোন স্যাম্পল?" অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন সজীব, পরক্ষণেই ধরতে পেরে মাছি তাড়াবার মত ভঙ্গী করলেন তিনি, "আরে ধুর, ওটা আমি আগেই শুনেছি। তোকে ডেকেছি অন্য কারনে। কথা বলছিলাম মার্সেলের সাথে, ওর কথা মনে আছে তোর?"
মুচকি হাসলো রাজীব, মার্সেল বিয়েখনো জার্মানীর বায়ার। একটা বড় বহজাগতিক পোষাক কোম্পানীর মিডলম্যান হিসেবে কাজ করে। ওর কাজই হলো সস্তায় মাল কিনে ওর কোম্পানীকে সাপ্লাই দেয়া। ও যত সস্তায় মাল কিনবে ততই ওর লাভ, কারন ওর কোম্পানী ওকে একটা নির্দিষ্ট দামই পরিষোধ করবে দিন শেষে। কয়েক দিন আগেই ওদের ফ্যাক্টরীতে এসেছিল, উইন্টার এন্ডিং ধরতে হালকা স্যুয়েটারের অর্ডার দিতে চায়।
"মার্সেল ওদের কাজটা আমাদেরকেই দিতে চাচ্ছে, কিন্তু পিস প্রতি বলছে ১৫, আমি বলেছি ২০ এর কমে সম্ভব না। ফাইনাল কথা বলতে আজ গলফে ডেকেছে।"
অবাক হলো রাজীব, "গলফে না আজ ভুঁইয়া সাহেবের পার্টি?"
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন সজীব, "আরে এইটাই তো মজা! ভুইয়া সাহেবের সাথে গত বছরের ঝামেলাটার কথা বলেছিলাম না তোকে মনে আছে?"
মাথা নাড়লো রাজীব, ভালমতই মনে আছে ওর, আমেরিকান একটা কোম্পানি শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কাজ ওদের আর বাকি পঞ্চাশ ভুইয়া গ্রুপকে দিয়েছিলেন। পরে দুই ফ্যাক্টরীর কাজ মিলিয়ে দেখে কোম্পানী আর পরের ডিলটা ভুইয়াকে দেয়নি। এতে ওদের কোনই দোষই নেই কিন্তু ভুঁইয়া সাহেব সব সময় এর জন্য তিস্তা গ্রুপকেই দোষ দিয়ে এসেছেন। সেই থেকে ঝামেলার শুরু।
ব্যবসা জিনিসটা খুবই মজার। এইযে এত ঝামেলা দুই গ্রুপে, তবুও যে কোন অনুষ্ঠানে একে অন্যকে নিয়ম বেঁধে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। আজ ভুঁইয়া সাহেবের ২৫তম বিবাহ বার্ষিকির নিমন্ত্রণ কার্ডটা সেই এক হপ্তা আগেই অফিসে জমা পড়েছে। নিয়ম মতে অফিস থেকে দামী একটা গিফট ওখানে পৌঁছে যাবার কথা।
"ভুঁইয়া সাহেব আজ মার্সেলকেও নিমন্ত্রণ করেছেন। সেখানে তাঁরাও ডিলটা বাগানোর চেষ্টা করবেন। ভুঁইয়া সাহেব নাকি মার্সেলকে বলেছেন আজ ওখানে এক সাথে বসে তিন পার্টি মিলে আলোচলা হোক। ভুঁইয়া সাহেব ভালো মতই জানেন উনার পার্টিতে আমি অথবা বাবা কেউ যাব না। কিন্তু মার্সেলের তো আর সেটা জানা নেই। আর আমিও কিছু বলিনি, এ ধরনের ছেলেমানুষি কোন্দল আমি বাইরে বলা পছন্দ করি না, এতে রেপুটেশন কমে বই বাড়ে না।"
ভাইয়ার দূরাভিসন্ধী বুঝে গেল ও, গলায় ঝাঁঝ এনে বলল, "দেখ ভাইয়া, এটা মোটেই ঠিক না, তোমরা যাবে না ঠিক আছে, আমি কেন যাব!"
"আরে বোকা, যেয়ে দেখই না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন কত কাজ আমাদেরকে ব্যবসার খাতিরে করতে হয়। আর তোকে একটা গোপন কথা বলি, আমার ইচ্ছা ভুঁইয়া সাহেবের সাথে ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলার। আমার ব্যক্তিগত ভাবে উনাকে চমৎকার লাগে। প্রথম যখন বাবার ব্যবসায় ঢুকেছি, একবার ব্যাঙ্কে গিয়ে কি সমস্যা! আমি যে চেক এনেছি সে অ্যাকাউন্টে নেই টাকা! ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আবার তখন আমাকে চেনেন না, বলেন, 'আপনার বাবাকে কল দেন... উনার সাথে কথা বলি!' তখন বাবাকে কল দেয়া সম্ভব বল? বাবা একটা কথাই বলবেন, 'এমবিএ করে এই শিখেছ!' এদিকে আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা দরকার তক্ষুনি। সে সময় ভুঁইয়া সাহেবও ম্যানেজারের রুমে, তিনি কি বুঝলেন কে জানে কোন কথা না বলে একটানে পঞ্চাশ হাজারের একটা চেক লিখে দিলেন। বললেন, 'ম্যানেজার আমার অ্যাকাউন্ট নাম্বার জানেন, কাল টাকা জমা না পড়লে আমি কিন্তু রহমান সাহেবকে কল দেব!"
এ ঘটনা জানা ছিল না রাজীবের।
"শোন, তুই না গেলে ভুঁইয়া সাহেব পুরো ডিলটাই নিয়ে নেবেন, আর তুই গেলে তাঁর চেষ্টা থাকবে শতকরা ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ ভাগ কাজ হাতিয়ে নেবার। আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। আমরা আমেরিকার কাজ গুলো নিয়ে এমনিতেই ব্যস্ত, মেশিনগুলোও সব রানিং। জার্মানীর কাজটা পেলে সেটা হবে উপড়ি।"
অশোন্তোষ নিয়ে গুম হয়ে বসে থাকলো রাজীব, বোঝাই যাচ্ছে এজিএম হিসেবে ভাইয়ার ডিসিশন নেয়া হয়ে গেছে। এখন আর তর্ক করে লাভ নেই। ওর মনে ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে কাজটা ওকে দেয়া হচ্ছে ওকে পরীক্ষা করার জন্য। এমন একটা জায়গায় পাঠানো হচ্ছে যেখানে হারাবার কিছু নেই। ব্যাপারটা অনেকটা এমন - যদি কিছু করতে পার তাহলে বোঝা যাবে তোমাকে দিয়ে 'ডিল ক্লোজ' করা হবে, আর না পারলে তুমি এখনও তৈরী নও... আরও কিছু দিন ভাইয়া-বাবার সাথে সাথে খাতা-বই নিয়ে ঘোরাঘুরি কর।
"এখন সোজা তোর রুমে চলে যা। ম্যানেজার চাচাকে কিছু ফাইল তোর টেবিলে দিতে বলেছি, একটু চোখ বুলিয়ে নে। আটটার দিকে রওনা দিয়ে দিস!"
"ওকে!"
"আরেকটা জিনিস, যখন রেট নিয়ে কথা হবে তখন কিন্তু তোকে আর ভুঁইয়া সাহেবকে এক সাথে কাজ করতে হবে। চোখ-কান খোলা রাখিস। আমরা সতেরোর নিচে পারবো না। আমার মনে হয়না ভুঁইয়া সাহেবও এর নিচে যেতে পারবেন। যদি অহমিকা বশে যান তাহলে তাঁকে কনগ্রাচুলেট করে চলে আসিস, ওকে?"
"ওকে!"
"আর শায়খ রহমান ধরা পড়েছে জানিস?"
হঠাৎ বিষয়ের পরিবর্তনে কথাটা ঠিক ধরতে পারলো না রাজীব, "হুম্?"
"জেএমবি'র আমির, শায়খ রহমান... ধরা পড়েছে!"
"ওহ্ হ্যাঁ, টিভি রিপোর্ট দেখলাম।"
অবাক হলেন সজীব, "টিভি রিপোর্ট? তোর রুমে টিভি লাগিয়েছেন নাকি বাবা?"
কান লাল হয়ে রাজীবের, "ইয়ে... না... মানে... কমপিউটারে... টিভি কার্ড..."
ট্রেড মার্কড মাছি তাড়াবার ভঙ্গী করলেন ভাইয়া, "বুঝেছি! যাহ্ এখন... আর শোন, যাবার আগে ভুঁইয়া সাহেবের গিফটটা নিয়ে যাস্!"
নিজের রুমে ঢুকে নিজেকে নিজের চড় মারতে ইচ্ছে করলো ওর। কি পরিমান গর্ধভ হলে টিভি কার্ডের কথাটা মুখে চলে আসে।
দরজা খুলে একটা ফাইল নিয়ে ঢুকলেন ম্যানেজার চাচা। চিরকুমার মানুষ, পনের বছর হলো ওদের সাথেই আছেন। সজীব-রাজীবকে নিজের ছেলের মতই স্নেহ করেন তিনি, "রাজু, ৩ থেকে ৫ নম্বর পাতা গুলো কিন্তু ভালো মত পড়তে হবে। গিফট আর ইনভাইটেশন কার্ড তোমার গাড়িতে রাখা আছে!" বাবার পরে অফিসের একমাত্র তিনিই সজীব-রাজীবকে সাজু আর রাজু বলে ডাকার অধিকার রাখেন।
"আচ্ছা!"
চাচা বেরিয়ে যেতেই মোবাইল বেজে উঠলো ওর, ফয়সাল নিঃসন্দেহে! কে কল করেছে না দেখেই কল রিসিভ করলো ও, "দোস্ত, আজ আর আইতে পারুম নারে। বিশাল ক্যাচালে পড়ছি!"
সময়: রাত ৮:২০-১২:৫৫
কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব, ঢাকা
পার্টি রুমে ঢুকেই রাজীবের মনে হলো একটা ভুল হয়ে গেছে, আসার পথে বাসা থেকে একটা ব্লেজার তুলে নেয়া উচিত ছিল। পার্টিতে সবাই বেশ ফর্মাল। পুরুষরা পুরোদমে স্যুটেড-ব্যুটেড, মহিলারা সবাই পাল্লা দিয়ে জমকালো শাড়ি। একটু কম বয়সী মেয়েরা অবশ্য স্কার্ট-টপ দিয়ে চালিয়ে দিয়েছে। সে তুলনায় ডকারস ট্রাউজার আর পোলো শার্টে রাজীবকে বেশ ম্রিয়মানই বলা যায়।
পোষাকের চিন্তা বাদ দিয়ে পার্টিতে ঢুকে গেল ও। যা হবার হয়েছে, এখন সবার আগে ভুঁইয়া সাহেবের সাথে দেখা করে জানান দিতে হবে যে সে পার্টিতে এসেছে। ঢুকতেই সাদা-কালো ঊর্দি পরা বেয়ারা পাশে এসে দাঁড়ালো ওর,
"স্যার, শ্যাম্পেন?"
একটা গ্লাস তুলে নিয়ে চারপাশে তাকালো রাজীব, পানীয়ের ব্যবস্থা থাকবে সেটা নিমন্ত্রণপত্র দেখেই বোঝা গেছে, সঙ্গত কারনেই পার্টিতে অপরিনত কাউকে দেখা যাচ্ছে না... লোকজনও তেমন বেশী নয়, সব মিলিয়ে প্রায় দু'-আড়াইশো। ভুঁইয়া সাহেব সম্ভবত খুব কাছের মানুষ ছাড়া কাউকে নিমন্ত্রণ করেননি।
একটু পরেই ভুল ভাঙলো রাজীবের, কাছের মানুষ নয় তিনি নিমন্ত্রণ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ মানুষদেরকে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতেই দুই মন্ত্রী, এক উপমন্ত্রীকে দেখে ফেলল ও। বাকি সবাই স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। রাজীবের প্রায় সবার সাথেই কম বেশী পরিচয় আছে। তাঁরা এখনও রাজীবকে রহমান সাহেবের ছোট ছেলে হিসেবেই দেখেন, তিস্তা গ্রুপের এক্সিকিউটিভ হিসেবে নয়। এরকম পার্টিতে যা হয়, সবাই ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। এমন একটা গ্রুপে ঢুকতেই ভুঁইয়া সাহেবের দেখা পেল ও। রাজীবকে দূর থেকে দেখেই চিনে ফেললেন তিনি, হেসে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন,
"তৃতীয় রহমান, ঠিক তো?"
"জ্বী, স্লামালেকুম আঙ্কেল!" হেসে হাত বাড়ালো রাজীবও, "আমার নাম রাজীব।" বয়স প্রায় সাতান্ন হলে কি হবে ভদ্রলোকের পাঞ্জার জোর আছে। চেহারা দেখে অবশ্য পঞ্চাশের উপরে বলার যো নেই। শ্যাম বর্ণ, টানটান ছয় ফিট লম্বা, টেইলর্ড ছাইবর্ণ স্যুটে চমৎকার মানিয়ে গেছেন।
"চমৎকার, তাও তো কোন এক রহমানের দেখা মিলল আমার পার্টিতে। তা হাজী সাহেব আছেন কেমন?"
ভাইয়া ব্যবসায় বসার পর থেকে অবসরের সুযোগে প্রায় নিয়মিতই হজ্জ্বে যাচ্ছেন বাবা-মা। তাই মজা করে অনেকেই হাজী সাহেব ডাকা শুরু করেছেন বাবাকে।
"জ্বী ভাল। আপনাকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বাবা-মা আর ভাইয়া।"
"আর বিবাহবার্ষিকী! এসব পার্টি আমার কাছে একদমই ছেলেমানুষী লাগে, কেবল তৃণার চাপাচাপিতে পার্টিটা দিতে হলো।"
হাসলো রাজীব। এসব টুকটাক পারিবারিক আলাপে তেমন স্বাচ্ছন্দবোধ করে না ও, তাই সরাসরি কাজের কথায় চলে গেল, "আঙ্কেল, মার্সেল কি এসেছে!"
"আসেনি মানে! ডিনার সার্ভ করার আগেই সে অর্ধ-মাতাল হয়ে বসে আছে। তবে জার্মান তো, জাতে মাতাল হলেও ওরা তালে একদম ঠিক। দেখবে মিটিংয়ে একটা আঙ্গুল পর্যন্ত কাঁপবে না।"
"মিটিংটা হবে কখন?"
ওর পিঠে গুরুজনের মত হাত রাখলেন ভুঁইয়া সাহেব, "আরে হবে হবে... এত তাড়াহুড়ার কি আছে! রাত তো সবে সাড়ে আটটা। ডিনার সার্ভ করা হোক, ভীড়টা একটু হালকা হোক, এরপরে। তুমি পার্টি এনজয় করো, মিটিং এর সময় হলে তোমার কাছে ঠিকই খবর চলে যাবে।"
"জ্বী, আঙ্কেল!"
"তোমার জন্য একটু সমস্যাই হয়ে গেছে তাই না? সব বুড়ো ব্যবসায়ীদের ভীড়ে?" হেসে বললেন ভুঁইয়া সাহেব, "কি করবে বল, ব্যবসায় ঢুকে পড়েছ, এখন এগুলো তো একটু সহ্য করতেই হবে!"
"জ্বী, আঙ্কেল!"
"তবে তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তুমি অন্য রহমানদের চেয়ে একটু আলাদা তাই না?" রাজীবের বাম হাতে ধরা গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন ভুঁইয়া সাহেব। ইঙ্গিতটা বুঝে মুচকি হাসলো রাজীব।
"তোমার আন্টির সাথে পরিচয় হয়েছে?"
"জ্বীনা"
"বল কি! যার সাথে আমার হাজতবাসের রজতজয়ন্তী তার সাথেই পরিচয় হয়নি? এ তো শাস্তিযোগ্য অপরাধ! চল চল আগে পরিচয় পর্বটা সারা যাক।" রাজীবের বাহু ধরে অন্য একটা গ্রুপের দিকে নিয়ে চললেন ভুঁইয়া সাহেব।
পার্টি এখন বেশ জমে গেছে। এক দিকে হাউজি খেলা চলছে, অন্য দিকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে চলছে জেএমবি আর শায়খ রহমানের গ্রেফতার নিয়ে চরম আড্ডা। জাদুকর জুয়েল আইচ সাহেবও আজকে আমন্ত্রিত, উনি এক পাশে মহিলাদেরকে হাতসাফাইয়ের খেলা দেখাচ্ছেন। একটু কম বয়সীরা সবাই মাঠে এসে বসেছে, গীটার বাজিয়ে গান হচ্ছে সেখানে।
মার্সেলের সাথে একটু আগেই দেখা হয়েছে ওর। ভুঁইয়া সাহেব ঠিকই বলেছিলেন, অয়েল ট্যাঙ্কারের মত লোকটা লিকার গিলেই চলেছে। ঘড়ি দেখলো রাজীব, সাড়ে দশটা বেজে গেছে। মিটিংটা হবে কখন কে জানে! একটা সিগারেট ধরাতেই গলা ভেজাবার তাগিদ বোধ হলো রাজীবের... বেরুবার সময় হাতে কিছু একটা নিয়ে বেরুনোর দরকার ছিল।
প্যাটিও থেকে ছেলেমেয়েদের গিটারের সাথে নাচ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পার্টিটা অন্য কারও হলে রাজীবও ওখানেই থাকত। ওর মেয়েঘেঁষা দূর্নামটা এমনি এমনি ছড়ায়নি। ওর চেষ্টাই থাকে খুঁতহীণ চেহারাটা (মাঝে মাঝে ক্রেডিটকার্ডও) ব্যবহার করে মোবাইলে মেয়েদের নাম্বারের সংখ্যা বাড়নো। তবে একটা নীতি ও সব সময় মেনে চলে সেটা হলো কারও সাথে কখন কমিটমেন্ট যাওয়া নয়, কেউ চাইলেও সে আস্তে করে সরে পড়ে।
"বিয়ার?"
হঠাৎ প্রশ্নে চমকে গেল রাজীব। স্কার্ট-টপ পরা হ্যাংলা-পাতলা একটা মেয়ে হাতে দু'টো বিয়ারের ক্যান ধরে আছে। মেয়েটার চেহারাটা খুব পরিচিত মনে হলো ওর কিন্তু কোথায় দেখেছে তা মনে করতে পারলো না।
"অবশ্যই!" ক্যানটা নিতে নিতে বলল রাজীব, "সত্যি কথা বলতে কি, এখন একটা বিয়ারের অভাবই অনুভব করছিলাম।"
খিলখিল করে হেসে উঠলো মেয়েটা, "তুমি তো খুব মজার বাংলা বল, 'অনুভব করছিলাম'... হোয়াট ড্যজ দ্যট ইভেন মিন?"
উত্তর না দিয়ে হাসলো রাজীব।
"আমার নাম তৃণা। তোমার নাম কি?" প্রশ্নটা আসলো ইংরেজীতে। এই একটা নতুন ফ্যাশন হয়েছে, বাবা-মা ছেলে-মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবেন আর ছেলে-মেয়েরা দিব্যি বাংলা ভুলে ইংরেজীর আরাধণা শুরু করবে। বাবা-মার কাছে অনেক ঋণী রাজীব যে এই গড্ডালিকা স্রোতে তাঁরা গা ভাসাননি। রাজীব নিঃশ্চিত যে বাংলা ভাল না জানলে কি হবে, হিন্দি গানের কথা লাইন ধরে ঠিকই মুখস্ত এই মেয়ের।
"আমার নাম রাজীব। তুমি তো ভুঁইয়া সাহেবের মেয়ে, তাই না?" মেয়েটার চেহারা এত পরিচিত লাগছিল কেন সেটা এখন ধরতে পেরেছে ও। তৃণার চেহারা একদম ওর মা, মিসেস ভুঁইয়ার মত! মিসেস ভুঁইয়াকে কম-বেশী ওর মার মতই লেগেছে রাজীবের, ঘরমুখী। স্বামী-সন্তানের গতিশীলতার সাথে তাল মেলাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে ক্লান্ত।
"ইয়াপ, আমার বাবা। তুমি ব্যস্ত? আমাদের সাথে বসবে ওখানে?" হাত তুলে প্যাটিওর পেছনের দিকটা দেখাল তৃণা। সেখানে আরও দু'টো মেয়ে আর একটা ছেলে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। হাসল রাজীব, ঘটনা এখন পরিষ্কার হলো। তৃণা এখন ওকে ওর বন্ধুদের কাছে নিয়ে যাবে। বন্ধুরা ওকে সেইসব প্রশ্ন জিজ্ঞাস করবে যেগুলো তৃণার জিজ্ঞাস করতে বাঁধবে। এর পর যা হবার আপন গতিতে হবে, শেষটা হবে চিরন্তন ফোন নাম্বার বিনিময়ের মাধ্যমে। কিন্তু এখন রাজীবের মোটেই ইচ্ছে নেই ভুঁইয়া সাহেবের মেয়ের সাথে কিছু করার - ঝামেলা হয়ে যাবে। কিভাবে সুন্দর করে 'না' বলা যায় ভাবছে রাজীব, সে সময় চিন্তা থেকে মুক্তি দিল উর্দি পরা পরিচিত বেয়ারা, এগিয়ে এসে মুখ কানের কাছে এনে বলল,
"স্যার, ভুঁইয়া সাহেব মিটিংয়ে বসেছেন... আপনার খোঁজ করছেন!"
"আচ্ছা, তুমি একটু আমার ড্রাইভারকে বল আমার ব্রীফকেসটা নিয়ে আসতে, ঠিক আছে?"
মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে সরে গেল বেয়ারা।
তৃণার দিকে ফিরলো রাজীব, বলল,
"পরিচিত হয়ে খুব ভাল লাগলো তৃণা, বাট আই হ্যাভ টু গো নাউ!"
৩ মার্চ, ২০০৬
সময়: দুপুর ১২:০০-১:০০
অফিস - তিস্তা গ্রুপ, মহাখালী, ঢাকা
টিভি ছাড়বেনা ছাড়বেনা করতে করতেও ছেড়ে ফেলল রাজীব। কার্টুন নেটওয়ার্কে 'ফ্লিন্টস্টোনস' দেখাচ্ছে। কার্টুনের উপর ওর শিশুকালের দূর্বলতাটা এখনও টিকে আছে। টিভি দেখার একটা বড় অংশ ও কার্টুন দেখেই পার করে। অফিসের কাজ বাদ দিয়ে টিভি দেখছে সেটা ভাইয়া জানতে পারলে কপালে খারাবি আছে, কিন্তু গতকালের ডিলটা ফাইনাল করে ওর মন আজ পুরা বিন্দাস! দেখলে দেখুক, যা হবার হবে।
কাল রাত একটার দিকে বাসায় গিয়ে দেখে বাবা-মা-ভাইয়া কেউ ঘুমায়নি। সবাই জেগে অপেক্ষা করছে ওর জন্য। ডিলটা ফাইনাল হয়েছে শুনে বাসায় সেই একটার সময়ই একটা উৎসব মত হয়ে গেল। তিস্তা আর ভুঁইয়া গ্রুপ দু'জনেই কাজটার শতকরা পঞ্চাশ ভাগ করে পেয়েছে। রেট ঠিক হয়েছে ১৮ পার পিস। সত্যি কথা বলতেকি বাবা-ভাইয়া মনে করেছিলেন ও কাজটা হাতছাড়া করে ফেলবে। তাই উৎসবটা যতটা না ছিল এগ্রিমেন্ট সাইন করার জন্য তার চেয়ে বেশী ওর সাফল্যে। একমাত্র মার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল ওর উপর, উনি সন্তান সাফল্যে উদ্ভাসিত হয়ে বলেই চললেন, "আগেই বলেছিলাম না, রাজু ঠিকই পারবে!"
চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলে পা তুলে দিল ও। গতকাল মিটিংটা একদমই একমাত্রিক ছিল। ভুঁইয়া সাহেব প্রথম থেকেই বলেছেন দুই গ্রুপে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ করে কাজ ভাগ করে দেয়া হোক। এ প্রস্তাবে প্রতিবাদের কোন কারন দেখেনি রাজীব। পরে আসল তর্কা-তর্কীটা হয়েছে রেট পার পিস নিয়ে। মার্সেলের মত পিচ্ছিল বায়ার আগে দেখেনি রাজীব... এক্ষুনি হয়তো বলল, "আমার লাভ থাকছে শতকরা পনের ভাগ", একটু পরেই সেকথা সে বেমালুম অস্বীকার করে যাবে। সে সময় ভুঁইয়া সাহেবের সাথে চমৎকার বোঝাপোড়া হয়েছে। ভদ্রলোক রাজীবের প্রতিটি প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করেছেন, ছোট বলে কোন অবহেলা দেখাননি। লোকটাকে ভাইয়ার কেন পছন্দ তা তখন বুঝতে পেরেছে রাজীব। এগ্রিমেন্ট সাইন করার পর রাজীবের হাতটা শক্ত করে ধরে ভদ্রলোক বললেন, "তুমি আর তোমার ভাই, দু'জনের মধ্যেই একটা জিনিস আছে যেটা যে কোন ব্যবসায়ীর থাকাটা খুব জরুরী। তোমরা দু'জনেই জান কখন, কোন সময়টা কথা বলতে হয়, আর কখন চুপ থাকতে হয়। তোমার বাবা অসম্ভব ভাগ্যবান!"
'ফিন্টস্টোনস' শেষে 'দ্য পাওয়ার পাফ্ গার্লস' শুরু হলো। কোন এক বিচিত্র কারনে এই শিশুতোষ মেয়েলি কার্টুনটাও ওর বেশ ভালোই লাগে।
এমন সময় মোবাইলটা কর্কষ স্বরে বেজে উঠল রাজীবের, অচেনা নাম্বার।
"হ্যালো!"
"হ্যালো, ক্যান আই টক টু রাজীব প্লীজ?"
"স্পিকিং!"
"রাজীব, হাই! আমি তৃণা।"
"তৃণা?"
"এরই মাঝে ভুলে গেছ? কাল পরিচয় হলো মনে আছে? হাইনিকেন খেলাম একসাথে?" মেয়েটার গলায় স্পষ্ট অভিমান!
আশ্চর্য তো! ওর ফোন নাম্বার কোথা থেকে পেল!
"হ্যাঁ মনে আছে। কেমন আছ তৃণা?"
"ভালো। শোন, তোমার আজ বিকালে কোন কাজ আছে?"
সতর্ক হয়ে গেল রাজীব, "কেন বল তো?"
"সেটা তো এখন বলা যাবে না! আগে বল কাজ আছে কি-না?"
তৃণা সরাসরি উত্তর দেবেনা আগেই বুঝেছে রাজীব। এটা একটা ফাঁদ, এখন ও যদি বলে কাজ নেই তাহলে হয়ত দেখা করতে চাইবে।
রাজীবের নীতি গ্রামের চোরদের মত, নিজের মহল্লায় সিঁধ কাটেনা ও। তাও মেয়ের বাবা যেখানে ভুঁইয়া সাহেব... সতর্ক ভাবেই জবাব দিল ও,
"আজ বিকালে একটু কাজ আছে অবশ্য। কি ব্যাপার শুনি?"
"কাজটা পরে করা যায় না?"
"নাহ, সমস্যা হয়ে যাবে, খুবই জরুরী কাজ। কি হয়েছে বল না আগে শুনি?"
"তোমার কিচ্ছু শোনার দরকার নেই!" রাগ দেখিয়ে দুম করে ফোন রেখে দিল মেয়েটা।
বোকার মত মোবাইল হাতে বসে থাকল রাজীব! ঘটনা কি ঘটল তা ঠিক হজম করতে পারছে না। বড় করে শ্বাস নিয়ে মোবাইলের বোতাম টিপে রানার নাম্বারটা বের করলো ও। রানা ওর ছোটবেলার বন্ধু। পরিচয় সেই ক্লাস সিক্সে বনানী বিদ্যানিকেতনে। এর পরে শাহীন কলেজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় সব একসাথে পেরিয়ে দু'জনের কয়লা বন্ধুত্ব আজ হীরকে পরিণত।
রানাকে বলা যায় মেয়েদের চলমান ডেটাবেস। ঢাকার হেন মেয়ে নেই যার সম্পর্কে রানা জানে না। ছেলে হিসেবে কিন্তু সে রাজীবের সম্পূর্ন উল্টো। কমপিউটার বিজ্ঞান থেকে ভাল রেজাল্ট করে এখন সিমেন্সে মোটা বেতনে কাজ করছে। মেয়েঘেঁষা স্বভাবের ছিটেফোঁটাও নেই ওর মাঝে। ওর শখ কেবল মেয়েদের নিয়ে ঢাকার বাতাসে ওড়া গুজব গুলো সংগ্রহ করে ওর ঝোলা সমৃদ্ধ করা। রাজীব নিশ্চিত যে তৃণা সম্পর্কে রানার কাছে সলিড খবর পাওয়া যাবে।
"কিরে দোস্ত, লাঞ্চ করবি নাকি একসাথে?" ফোন ধরেই উদ্দাম গলায় সুধালো রানা। উত্তর দেবার ধারে কাছ দিয়েও গেল না রাজীব,
"তুই তৃণাকে চিনিস?"
"কেন দোস্ত? কাহিনী কি?" বাঁধ ভাঙা আনন্দ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো রানা।
"কাহিনী বলতেছি। আগে বল চিনিস নাকি?"
"পাঁচটা তৃণাকে চিনি। কোনটার কথা কস?"
হাসলো রাজীব, এই না হলে রানা!
"ভুঁইয়া সাহেবের মেয়ে।"
"বলিস কি! ভুঁইয়া গ্রুপের ভুঁইয়া!" রানার গলায় বিস্ময়টা স্পষ্ট।
"না তো কি! কয়টা ভুঁইয়াকে চিনিস তুই?"
"কস কি দোস! কাহিনী কি বল তো?"
"ধুর ব্যাটা! খামাখা কথা প্যাচাস। কইলাম তো পরে কমু। তুই কি জানিস?"
"মেয়ে তো চরম হট দোস্ত। কোকড়া চুল না?"
"হুম!"
"লম্বা, শ্যামলা? বিপাশা বাসুর মত দেখতে?"
"লম্বা, শ্যামলা ঠিক আছে। বিপাশা বাসুর মত দেখতে নাকি বলতে পারবো না!"
"দোস্তওওওওওও... কি করছ তুমি শুনি?"
"কিচ্ছু না। তুই এত খুশি কেন শুনি?"
"মেয়ে তো চরম প্লেয়ার দোস্ত!"
"প্লেয়ার মানে?"
"প্লেয়ার মানে তোমার নারী ভার্সন! বুঝছো? মেয়ে তো দুই দিন পর পর বয়ফ্রেন্ড বদলায়!"
"তাই?"
"হ ব্যাটা! কেউ মাস খানেকের বেশী টিকে না। বাপে চিন্তায় আছে ওকে নিয়ে। ইংল্যান্ডে ফুপুর কাছে পাঠানোর ধান্দায় আছে। মেয়ে যাইতে চায় না।"
"কেন?"
"সেইটা আমি কেমনে জানুম। মনে হয় বয়ফ্রেন্ড গুলো ছাইড়া যাইতে মন চায় না।"
"মেয়ের বয়স কত?"
"সিওর জানি না। তবে আইইউবি'তে বিবিএ পড়ে। থার্ড ইয়ারে। গর্ধভ টাইপ স্টুডেন্ট... ফেইল আর রিটেকের উপরে আছে।"
"তুই এত জানিস কিভাবে?" অবাক হলো রাজীব।
"আরে আমার খালাত বোনটা আছে না, সীমা? ওর সাথে পড়ে। সীমার বাসায় দেখেছি কয়েকবার। দুইটাই গর্ধভ তো, ভালো মিল। আমার কিঞ্চিত ইচ্ছা আছিল মেয়ের সাথে প্রেম করার। গর্ধভ বইলা আসল প্রেম চিনে নাই!"
হেসে ফেলল রাজীব, খুলে বলল কি হয়েছে গত রাত্রে। তৃণা ফোন করেছিল শুনে লাফিয়ে উঠলো রানা,
"দোস্তওওওওওওও! কাহিনী তো বেশ প্যাচ খাইছে!"
"শুনো দোস্ত। এইটা ভুঁইয়া সাহেবের মেয়ে উই আর টকিং অ্যাবাউট। বুঝছোস? ওর সাথে আমি কিচ্ছু করবো না।"
"আরে ব্যাটা, মেয়ে তো তোকে বিয়া করতে চাবে না। কইলাম না, মেয়ে প্লেয়ার?"
"ডাসন্ট ম্যাটার দোস্ত। আমার পক্ষে সম্ভব না।"
"বুঝছি! শোন আজ এনএসইউ'র সামনে আসবি না বিকালে? তখন কথা হবে এটা নিয়ে। ঠিক আছে?"
"আচ্ছা!"
"ভালো কথা, এই মেয়ের কিছু ছবি কিন্তু ইন্টারনেটে অনেক চালাচালি হইছে!"
"কি!"
"ইয়েস। ইন্টারন্যাশনাল কার শো'র কিছু ছবি। মেয়ে সেখানে মডেল ছিল। আমার কোন ইমেইলের এটাচমেন্টে এখনও থাকতে পারে। পাঠাবো তোকে?"
"পাঠা!"
"আইচ্ছা! পনের মিনিট পরে মেইল চেক করিস। আমি এখন গেলাম।"
লাইন কাটতেই আবার বেজে উঠল রাজীবের মোবাইল। ওপাশ তৃণা বলল,
"রাগ করে ফোন কেটে দিয়েছিলাম, স্যরিইইইই! তুমি রাগ করনি তো?"
[চলবে...] © অমিত আহমেদ
মন্তব্য
কতটা পথ পেরুলে তাকে পথিক বলা যায়...?!
কতটা অপেক্ষার পর এখানে সদস্য হওয়া যায়..?!!!
প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর নেই জানা.!
অমিত দা, সরি, আপনার ব্লগে এই প্রশ্ন করার জন্য - আমি বকলম।
নতুন মন্তব্য করুন