অসম্ভবের বিজ্ঞান (২য় পর্ব)

অভিজিৎ এর ছবি
লিখেছেন অভিজিৎ (তারিখ: রবি, ১৯/১০/২০০৮ - ১০:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্বের পর...

আমরা আগের পর্বে দেখেছি জুলভার্ণের ভেল্কিভাজি - সেই ১৮৬৩ সালে বসেই তিনি কল্পণা করতে পেরেছিলেন বিংশ শতাব্দীর আধুনিক প্যারিসের ছবি কেমন হতে পারে ! শুধু জুলভার্ণ নয়, 'বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎদ্রষ্টা' হিসেবে আমার বাছাই করা তালিকার শীর্ষে থাকবেন কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার সি ক্লার্কও। তার সফল ভবিষ্যদ্বানীর মধ্যে আছে কৃত্রিম ভূউপগ্রহ, ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট, ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক, বিভিন্নপদের নবায়নযোগ্য শক্তি, ইন্টারনেট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সাইবর্গের (মানবসদৃশ রবোট)।

auto

ছবিঃ আর্থার সি ক্লার্ক - এক সফল ভবিষ্যৎদ্রষ্টার প্রতিকৃতি

ধর্মবাদীরা প্রায়শই নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থে জোর করে 'আধুনিক বিজ্ঞান' গুঁজে দিয়ে 'বিজ্ঞানময় কিতাব' বানান, কিংবা তাদের নিজ নিজ 'ধর্মপ্রচারক'দের হাজির করেন সফল 'ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা' হিসেবে। যারা এই ধরণের 'উপরচালাকি' করেন এবং নিজে বিভ্রান্ত থাকেন অপরকেও বিভ্রান্ত করে একধরণের স্বর্গসুখ অনুভব করেন - তাদের আমি জুলভার্ণ এবং ক্লার্কের গল্প-উপন্যাসগুলো পড়ে দেখতে বলি। দেখবেন, কোন আসমানী 'ওহী' না পেয়েও ভার্ণ এবং ক্লার্ক ভবিষ্যতকে দেখতে পেয়ছিলেন তথাকথিত পয়গম্বরদের চেয়ে অনেক স্পষ্টভাবে। প্রশ্ন হতে পারে, কিভাবে তারা এত নিখুঁতভাবে ভবিষ্যতকে বর্ণনা করতে পারতেন? একটি কারণ হতে পারে, জুলভার্ণ এবং ক্লার্ক - দুজনেই বিজ্ঞানের সংস্কৃতিতেই থাকতেন - বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করতেন, নতুন নতুন প্রযুক্তির খোঁজ খবর রাখতেন, আর শুধু খোঁজ করেই থেমে যেতেন না - এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে পৌঁছুতে পারে, তার একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করতেন তারা মনে মনে। এটাই মনে হয় সফল বিজ্ঞানের 'ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা' হবার মূল চাবিকাঠি।

এই সঠিকভাবে 'মনে মনে ছবি আঁকার' ব্যাপারটা খুব 'সোজা' মনে হতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, বহু বিখ্যাত বিজ্ঞানী সারাজীবন বিজ্ঞান চর্চা করেও 'সোজা' বিষয়টা আত্মস্থ করতে পারেননি। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির একেবারে কেন্দ্রে থাকেও তারা ভুলভাবে ধারণা করেছিলেন কোন কোন প্রযুক্তির ভবিষ্যত এক্কেবারেই অন্ধকার। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে আসে উইলিয়াম থমসনের (লর্ড কেলভিন) নাম। উইলিয়াম থমসন (১৮২৪-১৯০৭) ছিলেন ভিক্টরীয় যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ। পদার্থবিজ্ঞানে তার অসামান্য অবদানের কারণে তাঁকে 'লর্ড কেলভিন' উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিলো, আর মৃত্যুর পর তাকে সমাধিস্ত করা হয়েছিলো ওয়েস্ট মিনিস্টার এবিতে- নিউটনের ঠিক পাশে। সেই লর্ড কেলভিন জীবদ্দশায় বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সম্ভাব্যতা নিয়ে নানা ধরনের 'বিখ্যাত' মন্তব্য করেছিলেন। ভবিষ্যতে উড়োজাহাজ আবিস্কারের সম্ভাবণা বাতিল করে দিয়ে ১৮৯৫ সালে বলেছিলেন, “বাতাসের চেয়ে ভারী বস্তু ঊড়বে না” -

"Heavier-than-air flying machines are impossible."

auto

ছবিঃ লর্ড কেলভিন - উড়োজাহাজ তৈরি অসম্বব! 'এক্স-রশ্মি' একটা হোক্স (১৮৯৯)।

১৮৯৭ সালে তিনি বলেছিলেন “রেডিওর কোন ভবিষ্যৎ নেই”। আর ১৯০০ সালে বলেছিলেন, “পদার্থবিজ্ঞানে যা আবিস্কার করার সব কিছুই আবিস্কৃত হয়ে গেছে, নতুন কিছু আর আবিস্কার করার কিছু নেই”। 'এক্স-রশ্মি' ছিলো কেলভিনের মতে 'হোক্স'। শুধু কেলভিন নন, এমন হাস্যাস্পদ উক্তি আরো অনেক প্রথিতযশাঃ বিজ্ঞানীই করেছেন তাদের জীবনে। লর্ড রাদার্ফোর্ড (১৮৭১-১৯৩৭) যিনি নিউক্লিয়াসের চারিদিকে ইলেক্ট্রনের পরিভ্রমণের সেই পরমানুর 'রাদারফোর্ড মডেলের' জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন, তিনি আনবিক বোমা বানানোকে অসম্ভব বলে মনে করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন পরমাণু ভেঙে যে শক্তি পাওয়া যাবে তা এতই দুর্বল হবে যে সেটা চাঁদের আলোর সাথে তুলনীয়। শুধু রাদার্ফোর্ডকে দোষ দেই কেন, যে আইনস্টাইন তার বিখ্যাত ভর-শক্তির সমতুল্যতার সমীকরণ - E= mc2 -এর জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন, তিনি পর্যন্ত ১৯৩০ সালে পর্যন্ত ঢালাওভাবে ভাবতেন, আনবিক বোমা বানানো যাবে না। তার এ সংক্রান্ত বিখ্যাত উক্তিটি ছিলো -

There is not the slightest indication that nuclear energy will ever be obtainable. It would mean that the atom would have to be shattered at will.

একই কথা বলেছিলেন উইলিয়াম লিহেও-

'আনবিক বোমা কখনোই বানানো যাবে না। বিস্ফোরক সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি তা বলে দিতে পারি।

অথচ কল্পবিজ্ঞান লেখক এইচ. জি. ওয়েলস সেই ১৯১৪ সালেই 'The world Set Free' নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন যেখানে আনবিক বোমার সৃষ্টি এবং এর বিস্তৃতি দেখিয়েছিলেন। সেখানে ওয়েলস ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে, ১৯৩৩ সালে এক পদার্থবিদ আনবিক বোমা তৈরি করার রহস্যভেদ করতে সক্ষম হবেন। মজার ব্যাপার হল- হাঙ্গেরিয়-আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী লিও সিলার্ড ১৯৩২ সালে ওয়েলসের উপন্যাসটি পড়েন এবং ঠিক ১৯৩৩ সালেই তিনি চেইন রিয়েকশনের মাধ্যমে কিভাবে একটি অনু থেকে কিভাবে বিপুল শক্তি অর্জন করা সম্ভব তার তাত্ত্বিক মডেল তৈরি করে ফেলেন। লিও সিলার্ড নিজেই বলেছিলেন এইচ. জি. ওয়েলসের উপন্যাসটি তাকে মডেল তৈরিতে দারুনভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। এই মডেলই শেষপর্যন্ত ব্যবহৃত হয় ম্যানহাটন প্রজেক্টের 'প্রুফ অব কনসেপ্ট' হিসেবে।

আজকে যে ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগবর নিয়ে এত হৈ চৈ, কিছুদিন আগেও তা স্রেফ কল্পকাহিনী কিংবা কেবলমাত্র বিজ্ঞানীদের মাঝে গাণিতিক তত্ত্বকথা হিসেবে 'আঁতেলেকচুয়াল আলোচনায়' সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু ষাটের দশকে Cygnus X-1 নামের কৃষ্ণগহবর আবিস্কারের পর থেকে এটি আর তত্ত্ব কথায় সীমাবদ্ধ নেই, হয়ে গেছে নিখাঁদ বাস্তবতা। কিন্তু একটা সময় চেনা জানা বহু নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী কিন্তু এই ব্ল্যাকহোলের বাস্তব অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন। ১৯৩৯ সালে আইনস্টাইন একটি বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে 'প্রমাণ' করেন যে কৃষ্ণগহবর বাস্তবে কখনো তৈরি হতে পারবে না। অথচ আজ হাবল টেলিস্কোপ এবং চন্দ্র এক্স-রে টেলিস্কোপ মহাকাশে শত শত ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্বের জানান দিয়েছে।

আসলে আইনস্টাইন যখন তার কৃষ্ণগহবর সংক্রান্ত পেপারটা লিখেছিলেন তখন স্টিফেন হকিং বা পেনরোজের গবেষণা বাজারে ছিলো না - ফলে ব্ল্যাকহোলের বিজ্ঞানটি পরিস্কারভাবে বোঝার কোন উপায় ছিলো না তখন। এমনকি আপেক্ষিকতত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মেলবন্ধন করা 'কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি'র পূর্ণাংগ তত্ত্ব আজো পাওয়া যায়নি। এটা সবসময়ই একটা সমস্যা - অন্ততঃ বিজ্ঞানীদের জন্য। প্রতিটি যুগেই এই প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় নিয়েই তাদের কাজ করতে হয়। তারা কল্পবিজ্ঞান লেখকদের মত কল্পণার ফানুসকে যত্র-তত্র উড়িয়ে দিতে পারেন না। তাদের মাথায় থাকে 'অসম্ভব্যতার নীতি'র (principle of impossibility) কথা। তারা জানেন,

তাপগতিবিদ্যা মানতে গেলে - এমন কোন যন্ত্র আমরা নির্মান করতে পারব না যার দক্ষতা হবে ১০০ ভাগ, কিংবা আমরা পারব না অবিরাম গতিযন্ত্র (perpetual motion machine) বানাতে। বিজ্ঞানীরা জানেন কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে পরমশূন্য তাপমাত্রা (0 degree K) অর্জন করা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা জানেন, হাইসেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্র অনুযায়ী, ক্যানোনিকভাবে সম্পর্কযুক্ত দুটো ভৌতরাশি শতকরা ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে মাপা যায় না। কোন কণার অবস্থান খুব সূক্ষভাবে মাপতে গেলে বেগের তথ্য যায় হারিয়ে, আবার বেগ খুব নিখুঁতভাবে মাপতে গেলে বস্তুর অবস্থানের সার্বিক তথ্য অজানাই থেকে যায়। একইভাবে, তারা জানেন প্রকৃতিতে নিখুঁত স্ফটিক পাওয়া যাবে না, কিংবা কোন জড় কণার পক্ষে সম্ভব হবে না আলোর গতিবেগকে অতিক্রম করে যেতে।

এধরণের উদাহরণ হাজির করা যায় আরো অনেক।

এই সীমাবদ্ধতাগুলো বিজ্ঞানীমাত্রই জানেন, এসব সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো মাথায় রেখেই বিজ্ঞানীরা কাজ করেন প্রতিনিয়ত। এই সীমাবদ্ধতাগুলোই আবার কল্পণার ঘোড়ায় শুধুমাত্র লাগাম টেনে ধরেই ক্ষান্ত হয় না - সিন্দাবাদের ভুতের মত ঘারে সওয়ার হয়ে কখনো কখনো করে তুলে বিষম নৈরাশ্যবাদী! আইনস্টাইনের তত্ত্বেই ছিলো কৃষ্ণগহবর থাকার ইঙ্গিত - কিন্তু আইনস্টাইন নিজেই তাকে অস্বীকার করতে চেয়েছেন। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিলো, যখন আইস্টাইন মহাবিশ্বের প্রসারণ ঠেকানোর জন্য তার সমীকরণে জোর করে এক 'কাল্পণিক ধ্রুবক' (সেই বিখ্যাত ‘মহাজাগতিক ধ্রুবক’) আমদানী করে মহাবিশ্বকে এক ধরণের স্থিতাবস্থা দিতে চেয়েছিলেন। পরে ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল যখন মাউন্ট উইলসন মানমন্দির থেকে হুকার টেলিস্কোপের সাহায্যে নিশ্চিত করলেন যে মহাবিশ্ব আসলে স্থিতিশীল নয়, বরং প্রসারিত হচ্ছে - আইনস্টাইন তখন নিজেই ঘোষণা করলেন যে, গানিতিক সমীকরণে মহাজাগতিক ধ্রুবক যোগ করে মহাবিশ্বকে স্থিতিশীল করার চেষ্টাটি ছিল তার জীবনের ‘সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি’ (greatest blunder)। এ ধরনের ভ্রান্তি বা ব্লান্ডারের উদাহরণ দেয়া যায় আরো। লর্ড কেলভিনের কথা আরো একবার আসবে এখানে। কেলভিনের সময় পৃথিবীর বয়স পরিমাপের আধুনিক সূক্ষ পদ্ধতিগুলো বিজ্ঞানীদের জানা ছিলো না। বাইবেলীয় গণনায় অনেকেই ছয় হাজার বছরের পৃথিবীর ধারণায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন অনেকটাই। এ সময় ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমে পাওয়া বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণগুলো ইঙ্গিত করছিলো পৃথিবীর বয়স মোটেই ছয় হাজার বয়স নয় - নিদেন পক্ষে কয়েকশ' কোটি বছর তো হবেই। কেলভিন সাহেব ভাবলেন, বিবর্তনের এই সিদ্ধান্তটা বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা করবেন। পরীক্ষা করতে গিয়ে লর্ড কেলভিন সেসময়কার জানা তাপগতিবিদ্যার সূত্র প্রয়োগ করলেন। এ থেকে যে দিদ্ধান্ত বেরিয়ে এলো তা গেল বিবর্তন তত্ত্বের বিপরীতে। কারণ তিনি গণনা করে দেখলেন - জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে গলিত পৃথিবী ঠান্ডা হয়ে আজকের তাপমাত্রায় আসতে কয়েক লক্ষ বছরের বেশী লাগার কথা নয়। কেলভিন বললেন- 'বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমে পাওয়া কয়েকশ কোটি বছরের পৃথিবীর অনুমান সত্যি হতে পারে না'। কিন্তু পরবর্তীতে নতুন আরেকটি শক্তির উৎস হিসেবে পারমানবিক শক্তির কথা জানা গেলে হিসেব নিকেশের চেহারা আমূল পালটে যায়। মাদাম কুরি এবং অন্যান্যদের বৈজ্ঞানিক আবিস্কার থেকে তেজস্ক্রিয়তার গতি-প্রকৃতি যেমনি বোঝা গেল, তেমনি পরিস্কার হল পৃথিবীর অভ্যন্তর কিভাবে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে কয়েকশ কোটি বছর ধরে গলিত অবস্থায় থাকতে পারে। পারমানবিক তেজস্ক্রিয়তার এই আধুনিক 'রেডিও মেট্রিক ডেটিং' প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর বয়স নিঁখুত ভাবে নির্ণয় করে দেখা গেছে - কেলভিন নয়, ডারউইনের অনুমানই ঠিক, পৃথিবীর বয়স কম করে হলেও সাড়ে চারশ কোটি বছর। কেলভিন সাহেবের আমলে এই আধুনিক প্রযুক্তির কথা কারো জানা না থাকায় তিনি ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে বাধ্য হয়েছিলেন। এধরনের ভুলের খেলা আরো অনেক আছে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন একসময় বলেছিলেন, ‘ছবির কোন বানিজ্যিক মূল্য নেই, তাই কোন শালা কোনদিন ছবি চুরি করবে না’, আবার, 'এসি পাওয়ার'কে স্রেফ তামাসা হিসবে উল্লেখ করে বলেছিলেন - 'এর কোন ভবিষ্যত নেই'। এ সমস্ত উক্তি আজকের যুগে কিরকম হাস্যকর শোনাচ্ছে বুঝতেই পারছেন। ভাবছেন এমন দূরদর্শী লোকেরা কিভাবে ভুল করে? আমাদের সময়ের সফল ব্যবসায়ী, মাইক্রোসফটের কর্ণধর বিল গেটস এর কথাই বলি। বিল গেটস পারসোনাল কম্পিউটারকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছেন এটা আজকের ছোট বাচ্চারাও জানে। সেই বিল গেটস এক সময় বলেছিলেন (উক্তিটির সত্যতা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে যদিও), '৬৪০ কিলোবাইট মেমোরি ইজ এনাফ ফর এভ্রিবডি' । আজকের যে কোন সধারণ পিসির মেমোরিই এক গিগাবাইটের উপরে। আর দেড়শ গিগাবাইটের হার্ডডিস্ক তো বাজারে এখন স্রেফ ডাল ভাত। অথচ দূরদর্শী বিলগেটস একসময় ভেবেছিলেন ৬৪০ কিলোবাইটেই আমাদের কাজ চলে যাবে! আরেক ‘বিশেষজ্ঞ’- ডিজিটাল ইকুইপমেন্ট করপোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা কেনেথ ওলসেন ১৯৭৭ সালে মন্তব্য করেছিলেন, 'ভবিষ্যতে বাসায় বাসায় কম্পিউটার থাকার আমি কোন কারণ দেখি না - এটা সত্যই অবাস্তব এবং অসম্ভব'।

কোন কিছুকে 'অসম্ভব' বলে উড়িয়ে দিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত আসলে আমাদের পতন ডেকে আনি। ড. রবার্ট গোদার্ড একসময় রকেট বানানোর সম্ভাব্যতার কথা প্রচার করে বৈজ্ঞানিক মহলে দারুনভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। তার জ্ঞানী-গুণি বিজ্ঞানী সহকর্মীরাই তাকে নানা 'যুক্তি' দিয়ে বুঝিয়েছিলেন - রকেটের কখনো সাধ্য হবে না বহির্বিশ্ব পরিভ্রমণের। রবার্ট গোদার্ডের অভিমতকে হাস্যকর হিসেবে চিহ্নিত করে লোকজন এর নামকরণ করেছিলো 'গোদার্ডের ছাগলামি' । নিউইয়র্ক টাইমসে গোদার্ডের সমালোচনা করে লেখা হয়েছিলো -

'অধ্যাপক গোদার্ড ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যাপার স্যাপারগুলো একদমই বুঝেন না। রকেট ফকেট নিয়ে চিন্তা বাদ দিয়ে তার আসলে হাইস্কুলের পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ নেয়া উচিৎ'।

এস্ট্রোনোমার রয়াল ড. রিচার্ড ভ্যান্ডার উলি বড়াই করে বলেছিলেন - 'Space travel is utter bilge'। বড় বড় ঝানুমাথা বিজ্ঞানীরা না বুঝলেও একজন ঠিকি রকেটের ভুত-ভবিষ্যতের কথা ভালমতই চিন্তা করতে পেরেছিলেন। তিনি আর কেউ নন, এডলফ হিটলার সয়ং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার 'গোদার্ডের ছাগলামি'কে বাস্তব রূপ দিয়ে দিয়েছিলেন ভি-টু রকেটের মাধ্যমে। এই রকেটের তান্ডবে লন্ডনের হাটু ভেঙ্গে পড়ার দশা হয়েছিলো একেবারে।

এ সমস্ত উদাহরণ যখন চোখের সামনে উঠে আসে, তখন আমি সত্যই হতভম্ব হয়ে ভাবি - বহুল কথিত 'অসম্ভব্যতার নীতি' বলে সত্যই কি কিছু আছে, নাকি এটাও আসালে প্রকারন্তরে আমাদের জ্ঞান এবং প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা? একটা সময় যে ব্যাপারগুলো 'একেবারেই অসম্ভব' বলে মনে হয়েছিলো, তার অনেক কিছুই বিজ্ঞান সম্ভবপর বলে মনে করছে, ব্যবহারিকভাবে না হলেও তাত্ত্বিক ভাবে তো বটেই। সময় পরিভ্রমণ বা টাইম ট্রাভেলের কথাই বলি। এক সময় মনে করা হয়েছিলো সময় পরিভ্রমণ যৌক্তিকভাবে অসম্ভব। আর তা হবে নাই বা কেন? প্রযুক্তিগতভাবে যদিও বা সম্ভব হয় কোনদিন, দার্শনিক একটা সমস্যা তো রয়েই যায়। আমি যদি টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে গিয়ে আমার বাবাকে তার ছোটবেলায় গিয়ে খুন করে আসি, তা হলে আজকে আমার অস্তিত্বের ব্যাখ্যা কি হবে? সহজ কথায়, একজন লোক ছোটবেলায় মারা গিয়ে থাকলে, ভবিষ্যতে তার ছেলে থাকার প্রশ্ন আসবে কোথা থেকে? কিন্তু এই ক্ষেত্রে মরা বাপের শুধু ছেলেই থাকছে না, সে আবার টাইম মেশিনেও চড়ছে! কাজেই এই দার্শনিক বিভ্রান্তি থেকে উদ্ধার পাওয়ার সবচেয়ে সফল যৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছিল - সময় পরিভ্রমণ অসম্ভব। জোতির্বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের এক নতুন নীতি খুঁজে পেতে যেটি শেষ পর্যন্ত আমাদের সময় পরিভ্রমণে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তার অনুমিত 'অসম্ভবের নীতি'র এক গালভরা নামও দিয়েছিলেন তিনি - 'ক্রনোলজি প্রোটেকশন কনজেকচার'। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে হকিং, কিপ থোর্ণ এবং অন্যান্য গবেষকদের বছরের পর বছরের ক্লান্তিকর গবেষণায় যে ফলাফল বেরিয়ে এল তা হকিং-এর পুর্বের অনুমানের ঠিক উলটো। সময় পরিভ্রমণে বাধা হয়ে দাঁড়ানো কোন গুফো দারোয়ানের তো দেখা মিললোই না, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফলাফল পাওয়া গেল একেবারে বিপরীত। অর্থাৎ, কিছু কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে সময় পরিভ্রমণ খুবই সম্ভব। কিন্তু মুশকিল হল - সে সমস্ত পরিস্থিতি তৈরি করার মত যথার্থ প্রযুক্তি এখনো আমাদের হাতে নেই। হকিং নিজের কথা নিজেই গিললেন এই বলে - 'Time Travel may be possible, but its not practical'।

প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে ইনভিজিবিলিটি বা অদৃশ্যতার কথাও বলা যায়। বছর কয়েক আগেও বছর কয়েক আগেও এই অদৃশ্য হবার ব্যাপারটি কেবল ‘ইনভিজিবল ম্যান’ এর মত গল্প আর সায়েন্টিফিক ফ্যান্টাসির পাতায় কিংবা হলিউডের 'হলো ম্যান' জাতীয় সিনেমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু মেটা ম্যাটেরিয়াল নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার অগ্রগতি সায়েন্স ফিকশনকে নিয়ে এসেছে বাস্তবতার খুব কাছাকাছি। এ মুহূর্তে খুব ছোট স্কেলে সাফল্য এলেও বিজ্ঞানীদের দৃঢ় বিশ্বাস আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ঢাউস ঢাউস আকারের সব জিনিস-পত্রকে ডেভিড কপারফিল্ডের যাদুর মত অদৃশ্য করে দেয়া যাবে চোখের সামনে থেকে। হ্যা - হ্যারি পটারের 'ইনভিজিবল ক্লোক' আর বিজ্ঞানীদের জন্য আজ আর আকাশ কুসুম কল্পনার বিষয় নয় তা বলাই বাহুল্য। মুলতঃ অদৃশ্যতা নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার সাফল্য অপটিকসের উপর লেখা সমস্ত পাঠ্যপুস্তক গুলোকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে বাধ্য করছে।


ছবিঃ অদৃশ্যতা নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার অগ্রগতি হ্যারি পটারের 'ইনভিজিবল ক্লোক' কে নিয়ে এসেছে বাস্তবতার কাছাকাছি

চোখের নিমেষে কোন বস্তুকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর বা 'টেলিপোর্টেশন' কে একসময় অসম্ভব বলে ভাবা হয়েছিলো, ভাবা হয়েছিলো এটি হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তাসূত্রের লঙ্ঘন। স্টারট্রেকের টেলিভিশন সিরিজে যখন টেলিট্রান্সপোর্টার দেখানো হয়েছিলো প্রথম বারের মত, তখন তা কোয়ান্টাম পদার্থবিদদের কাছ থেকে তা এমনই সমালোচিত হয়েছিলো যে এর পরের পর্বে তারা এই 'ত্রুটি' দূর করার জন্য পরিচালক মশাই 'হাইজেনবার্গের কম্পেনসেটর' নামে একটি চেম্বার সিরিজে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে হাইজেনবার্গের সূত্র লঙ্ঘন না করেই একটি অনুকে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে তারা স্থানান্তর করতে পারছেন, কিংবা ফোটনকে 'টেলিপোর্ট' করে পাঠাতে পারছেন দানিয়ুব নদীর এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে। আর এই ধরণের টেলিপোর্টের পেছনে যে তাত্ত্বিক ভিত্তিটি দাঁড়িয়ে আছে সেটিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে 'কোয়ান্টাম আঁতাঁত' (Quantum Entanglement)। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, আজকে কোয়ান্টাম আঁতাতের মাধ্যমে শুধুমাত্র একটি অণু বা একটি ফোটনকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করা গেলেও আগামী এক দশকের মধ্যেই কোন সরল ডিএনএ কিংবা ভাইরাসের অণুকে টেলিপোর্ট করা সম্ভব হবে। আগের পর্বে টেলিপোর্টেশনের কিছু উদাহরণ হাজির করে পাঠকদের এ নিয়ে কিছুটা ধারণা দেবার প্রয়াস পেয়েছি। কাজেই টেলিপোর্টেশন আজ আর কল্পকাহিনীর রূপকথা কিংবা 'গাঁজাখুড়ি গপ্প' নয়, একেবারে নিখাঁদ বাস্তবতা। এ ধরনের উদাহরণ দেয়া যায় অনেক। সম্প্রতি নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত মিচেল মার্শালের লেখা '10 impossibilities conquered by science' প্রবন্ধটি প্রাসঙ্গিকভাবে পাঠকেদের জন্য চিন্তার খোরাক হতে পারে। প্রবন্ধকার দেখিয়েছেন, মাত্র বছর কয়েক আগেও যে বিষয়গুলোকে অসম্ভব বলে ভাবা হত, ধরে নেওয়া হত স্রেফ আধি-ভৌতিক ফ্যান্টাসি হিসবে, তার অনেকগুলোই আজ কিন্তু বিজ্ঞানের চোখে সহজ সরল বাস্তবতা। এই সমস্ত হরেক রকম অসম্ভবের কেচ্ছা-কাহিনীর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ-সম্ভাব্যতা নিয়েই আমার এবারকারের সিরিজ 'অসম্ভবের বিজ্ঞান'।

প্রিয় পাঠক থাকুন এ সিরিজটির সাথে ।

বিঃ দ্রঃ এটির একটি দীর্ঘ সিরিজে পরিণত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আমি এখন মুলতঃ সিরিজের ভুমিকার মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছি। ভূমিকা শেষ হতে আরো একটি বা দুটো পর্ব লাগবে। ভুমিকার সমাপ্তির পর আমি প্রতিটি বিষয় ধরে ধরে এর পেছনের কারিগরী বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় যাব। পাঠকদের ধৈর্য কামনা করছি।


মন্তব্য

দিগন্ত এর ছবি

আবার, 'এসি পাওয়ার'কে স্রেফ তামাসা হিসবে উল্লেখ করে বলেছিলেন - 'এর কোন ভবিষ্যত নেই'।

এতো আলভা এডিসনের সাথে টেসলার দ্বন্দ্বের কাহিনী। সেও এক মজার ঘটনা।

যাহোক, সাম্প্রতিককালেও টেস্ট টিউব বেবী খ্যাত বিজ্ঞানী সুভাষ মুখপাধ্যায়-কেও সেই অসম্ভবের বিজ্ঞান সহ্য করতে হয়েছিল।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

অভিজিৎ এর ছবি

এতো আলভা এডিসনের সাথে টেসলার দ্বন্দ্বের কাহিনী। সেও এক মজার ঘটনা।

হ্যা ঠিক তাই। এটা ছাড়াও এডিসনের এরকম অনেক মজার মজার কমেন্ট আছে, যেগুলো শুনলে মনে হবে - এত বড় বিজ্ঞানী হয়েও কিভাবে তিনি এগুলো বলেছিলেন!



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

রণদীপম বসু এর ছবি

আপনার সর্বশেষ বাক্যটাই তো অসম্ভবের বিজ্ঞানের হাস্যস্পদ উক্তি হয়ে গেছে !

পাঠককে আপনি বলছেন সাথে থাকতে ! আরে, পোস্ট ছাড়তে দেরি করলে এই সাথে থাকা পাঠকেরাই হন্যে হয়ে খুঁজবে আপনাকে খুন করতে !

অতএব সাবধান ! নিজের ফাঁসে নিজেই এবার আটকে আছেন, মনে থাকে যেনো !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

রণদীপম বসু এর ছবি

আর হাঁ, আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি।
বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ যদি অশিক্ষিত হতেন তাহলে তিনি হতেন লালন। আর লালন যদি যথাযথ শিক্ষিত হতেন, তিনি হতেন রবীন্দ্রনাথ। কার কথা জানি না।

তবে আমার ধারণায়, আর্থার সি ক্লার্ক যদি সেই আমলে জন্মাতেন, তিন হতেন জুল ভার্ন। আর জুল ভার্ন একালে জন্মালে হতেন আর্থার সি ক্লার্ক।

কথাটা কি খুব বেশি অসঙ্গত ?

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

শিক্ষানবিস এর ছবি

হুমায়ুন আজাদের নেয়া আহমদ শরীফের সাক্ষাতকারে এটা পড়েছিলাম। আহমদ শরীফ বলতেন, লোকসাহিত্যের সৃষ্টিকর্তারা শিক্ষিত হলে তাদের সাহিত্যের মান অনেক বৃদ্ধি পেতো। লালন ফকির যদি শিক্ষিত হতেন তাহলে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ কবি হতেন।

অভিজিৎ এর ছবি

না অসঙ্গত নয়, মনে হয় ঠিকি বলেছেন।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

অভিজিৎ এর ছবি

পোস্ট ছাড়তে দেরি করলে এই সাথে থাকা পাঠকেরাই হন্যে হয়ে খুঁজবে আপনাকে খুন করতে !

খাইছে! কি করুম ভাই - আমি তো আর পেশাদার লিখিয়ে না। আর যেগুলান বিষয় আশয় নিয়া লিখি - তা এত তাড়াতাড়ি 'ম্যানুফ্যাকচারিং' করবার পারি না।

তারপরো চেষ্টা করব বাকি পর্বগুলো তাড়াতাড়ি দিতে।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

শিক্ষানবিস এর ছবি

যতই পড়ছি ততই আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে। সিরিজটা জমে উঠছে। বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু করার আগেই অসম্ভবের বিজ্ঞানের সম্ভাব্যতার কথা বলেছেন। এর ফলে স্বপ্ন দেখার সুযোগ তৈরী হয়েছে। তাই বিষয়ভিত্তিক লেখাগুলো পড়ার পর স্বপ্নের সাথে মিলিয়ে নেয়া যাবে।

বিজ্ঞানীদের তুলনায় সাহিত্যিকদের কল্পনাশক্তি প্রখর। বিজ্ঞানী আর কল্পবিজ্ঞান লেখকদের ভবিষ্যৎ দর্শন দেখে তা আরও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। দুয়ে মিলেই সুন্দর ভবিষ্যতের সৃষ্টি করবে। বিজ্ঞানের অপব্যবহারের কারণে যখনই সমাজ ধ্বংসের সম্মুখীন হবে তখনই সাহিত্যিক সমাজ তাদের লেখনীর মাধ্যমে তা ধরিয়ে দেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের সব কল্পবিজ্ঞান লেখকেরা একসাথে নিউক্লীয় বোমায় ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর কথা লিখতে শুরু করেছিল। সে সময়ের অনেক বইয়েই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এভাবেই হয়তো ভারসাম্য বজায় থাকবে। কারণ আমরা কখনও ভারসাম্য হারাইনি। মানুষ এ পর্যন্ত নিজেদের টিকিয়ে রাখতে সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। ভবিষ্যতেও অসম্ভবের বিজ্ঞান থেকে টিকে থাকা ও বিকশিত হওয়ার উপকরণ আসবে বলে আশা করা যায়।

অভিজিৎ এর ছবি

আপনার মন্তব্যও আপনার লেখার মতই দারুন!



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

তুলিরেখা [অতিথি] এর ছবি

সেইটা আবার এসে গেছে। আইনস্টাইন "ভুল করেছি" বলে কসমোলাজিকাল কন্সট্যান্ট বাদ দিয়েছিলেন, এখন মহাবিশ্বের ত্বরিত প্রসারণ দেখে তাকে আবার ডেকে আনা হয়েছে। কখন যে কী হয়ে যাবে কিছুই বলা যায় না।

বজলুর রহমান এর ছবি

অভিজিতের এই সিরিজটি খুবই প্রয়োজনীয়। রাজনীতির মত বিজ্ঞানেও শেষ কথা নেই। অথচ মজার ব্যাপার এই যে, সব চেয়ে গুণী বিজ্ঞানীরাও আশ্চর্যরকম সংরক্ষণশীল, অথবা যুক্তিহীণ একগুঁয়ে। জুলে ভার্নের '৮০ দিনে ভুপ্রদক্ষিণ' চলচ্চিত্রের ২০০৪ সালের ভার্সনে লর্ড কেলভিনকে অন্যতম ভিলেন হিসেবে দেখানো হয়েছে। নিউটন জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করতেন, এবং কেউ এ নিয়ে হাসাহাসি করলে ক্ষেপে যেতেন। আইন্সটাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে নস্যাৎ করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। সালাম কোরানের মধ্যে বিজ্ঞানের সূত্র খুঁজে বেরিয়েছেন কিছু দিন। স্রোতের বিপরীতে এই সব বিশ্বাস পরাজিত হয়েছে।

তবে সাহিত্যিকরা ভবিষ্যতের শ্রেয় বক্তা, এ রকম সাধারনীকরণও বিপজ্জনক। ২০০১ সালে কোন স্পেস ওডিসী হয় নি হ্যালের সাহায্যে। ১৯৮৪ সালে জর্জ অরওয়েলের সমাজ বা সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। কালভ্রমণ ভবিষ্যতের দিকে অবশ্যই সম্ভব, অতীতের দিকে বড় স্কেলে (মানে পারমাণবিক কোয়ান্টাম স্কেলের বাইরে) না হওয়ার পক্ষে অনেক যুক্তি আছে। এটা বিশ্বাসের ব্যাপার না, সাই-ফাই লেখকরা যতই লাফালাফি করুক না।

কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন সম্বন্ধেও সাংবাদিকরা (এমন কি নিউ সায়েন্টিস্টও) কিছু ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে। এসব বিষয়ে পেশাদার পদার্থবিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হওয়া বেশি নিরাপদ।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

কালভ্রমণ ভবিষ্যতের দিকে অবশ্যই সম্ভব,

এটা কি শুধু ভবিষ্যৎ দেখা সম্ভব না কি ভবিষ্যতে অংশগ্রহনও সম্ভব?
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

বজলুর রহমান এর ছবি

মনে পড়ে অভিজিতের আইন্সটাইন সিরিজটিতে আলোচিত হয়েছিল। লোরেন্তস রূপান্তর। দ্রুত (আলোর কাছাকাছি গতিতে) চললে যাত্রীর ঘড়ি আস্তে যাবে, স্থির পশ্চাৎভূমির তুলনায়। সুতরাং সে অনেক চক্কর ঘুরে শকট থেকে নেমে যখন আবার স্থির জমজের সাথে দেখা করবে, তখন দেখবে ভাইটি থুরথুরে বুড়ো। কতখানি ভবিষ্যতে যাবে তা নির্ভর করবে কতবেগে কত সময় চলেছিল , তার ওপর।
সশরীরেই যাবে, ফিরতে পারবে না আর। সুতরাং বর্তমানে বসে থেকে লটারীর উইনিং নম্বর পাওয়া সম্ভব নয়।

কণা পর্যায়ে পরীক্ষিত। ক্ষণস্থায়ী কণার আয়ু দ্রুত ধাবমান হলে বেড়ে যায় , যেমন মিউ-মেসনের ক্ষেত্রে।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

ধন্যবাদ।
ক্লিয়ার হয়েছে, তবে এখনও মনে হচ্ছে, "আসলেই?"
সবই ফিজিক্স না পড়ে চোথা ফলো করার ফল চোখ টিপি
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

একটা প্রশ্ন:

ধরুন একটা পাত্রে পানি নিয়ে সেটাকে একটা নির্দিষ্ট চুলোয় নির্দিষ্ট তাপে পুরো বাস্পীভূত করতে ১ ঘন্টা লাগে

এখন মনে করুন, আমি আলোর বেগের কাছাকাছি চলা কোন যানে সেই চুলো আর পাত্রভরা পানি নিয়ে উঠলাম (মনে করুন আমি আর পাত্রটি দুটো আলাদা প্রকোষ্ঠে আছি, এবং আমি সেটাকে দেখতে পাচ্ছিনা), এবং শূন্যে যান চলা শুরু করার সাথেসাথে পাত্রের পানি চুলোর সেই নির্দিষ্ট তাপে গরম করা শুরু হলো।

এখন, যানের ভেতর আমি যদি আধঘন্টা (পৃথিবীটে যেটা হবে অনেকগুলো বছরের সমান) সময় কাটাই, তখন কি পাত্রের অর্ধেকটা পানি বাষ্পীভূত হবে, নাকি যান চলা শুরু সাথে সাথেই কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পানি উধাও হয়ে যাবে?
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

বজলুর রহমান এর ছবি

একটা নির্দিষ্ট জড়কাঠামোর সাপেক্ষে স্থির বা আলোর তুলনায় স্বল্পগতিতে চলমান সব ঘড়ি একই লয়ে চলবে।আপনি সত্যিকার জ্বীন না হলে আপনার হাত পা মাথা যেমন একসাথে চলবে (স্থানে এবং কালে), তেমনি আপনার যানের চুলা-পানিও। সুতরাং আপনার ঘড়িতে যখন আধঘন্টা হবে তখন অন্য ঘরে রাখা পাত্রে আধা পানিই থাকবে, আপনি দেখুন, আর না-ই দেখুন। এটা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ব্যাপার না, তাই পর্যবেক্ষণের ওপর কিছু নির্ভর করে না।

ক্রস-টকের জন্য দুঃখিত। এটা অভিজিতের ব্লগ, তিনি আরো মজার উত্তর দিতেন, কিন্তু মনে হলো প্রশ্নটা আমাকে করা।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আপনার আগের লেখাটি থেকে যে ধরনের টার্ন আশা করছিলাম সেটা এই পর্বে এসে একেবার ঘুরে গেলো। বলা বাহুল্য দারুন লাগছে! পর্বগুলো ছাড়তে থাকুন নিয়মিত।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অভিজিৎ এর ছবি

হুমম ... কোন ধরনের টার্ণ আশা করেছিলেন? হাসি



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

পথে হারানো মেয়ে এর ছবি

খুবইইই মজা লাগছে পড়তে। তাড়াতাড়ি বাকি পর্বগুলোও লিখে ফেলুন।

অভিজিৎ এর ছবি

ধন্যবাদ। লেখার চেষ্টা করছি তাড়াতাড়ি। দেখি কি হয়!



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

অমিত আহমেদ এর ছবি

লেখা দুর্দান্ত হচ্ছে।

অভিজিৎ'দা, একটি অনুরোধ, বাংলা প্রতিশব্দের সাথে ইংরেজিও দিয়ে দেয়া যায় না? মাঝে মাঝে হঠাৎ বুঝতে সমস্যা হয় কিসের কথা বলা হচ্ছে।


ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

অভিজিৎ এর ছবি

ধন্যবাদ অমিত।
আমি তো অধিকাংশ টার্ম অনুবাদ করিনি, মূল ইংরেজীতেই রেখেছি ... চেইন রিয়েকশন, ইনভিজিবিলিটি, ব্ল্যাক হোল, টেলিপোর্টেশন ... একটা দুটো শব্দ বাংলা করে বললেও হয়ত বলে থাকতে পারি। দেখি পরের পর্বগুলোতে আরো সচেতন থাকার চেষ্টা করব।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

কীর্তিনাশা এর ছবি

জমে উঠেছে। আবারো বলছি সিরিজটা দারুন!!

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

অভিজিৎ এর ছবি

ধন্যবাদ আবারো।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

রানা মেহের এর ছবি

বাহ! সুন্দর
আমি কোনদিন বি্গ্গান বুঝতে পারবো।
এই 'অসম্ভব'ও সম্ভব হবে হয়তো কোনদিন!!!!!!!!
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অভিজিৎ এর ছবি

নিশ্চয় পারবেন। আমার মত গবেট যখন পারছে, আপ্নেও পারবেন। কোন ডর নাই!



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।