''ধারণা থেকে বিশ্বাসের প্রকাশই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ'' ।। জ্যঁ মারি গুস্তাভ ল্য কেজিও

বর্ণদূত এর ছবি
লিখেছেন বর্ণদূত [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/১০/২০০৮ - ২:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'বর্ণদূত' নামে অতিথি হিসেবে সচল হওয়ার পর এটাই আমার প্রথম পোস্ট।- রুবাইয়াত্ আহমেদ
=============================
''সেই অনেককাল আগের কথা। এত আগে যখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে, সেই তখন, যখন সমুদ্রের ওপর কেউ ছিল না, শুধু পাখি আর সূর্যালোক ছাড়া। সেই ছোট্টবেলা থেকে আমি সেখানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, ঠিক সেখানে, যেখানে সবকিছুর শুরু এবং সবকিছুর শেষ।''

এমন করেই একটি গল্পের সূচনা করেছেন এবারের নোবেলজয়ী ফরাসি ঔপন্যাসিক জ্যঁ মারি গুস্তাভ ল্য কেজিও। গল্পের শুরু কিন্তু কী ভীষণ কল্পনাপ্রিয় আর কাব্যময়তা সেই চিত্ররূপ ভাষ্যে! তাঁর রচনাশৈলীর মূল প্রবণতা কিংবা স্বাতন্ত্র্য যাই বলি না কেন, ঠিক তাই। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে মনোনীত করার অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে কাব্যিক অভিযানকেই চিহ্নিত করেছে। যেখানে তারা কেজিওকে আমাদের বর্তমান মানব সভ্যতার বাইরে ভিন্ন এক মানবতার আবিষ্কার বলে স্বীকার করেছেন। ১৯৪০ সালের ১৩ এপ্রিল, ফ্রান্সের নিস অঞ্চলের রিভিয়েরা শহরে জন্ম নেওয়া কেজিও দুটি ভাষার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেন। ফরাসি ও ইংরেজি। তাঁর বাবা ইংরেজ আর মা ফরাসি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে চিকিত্সক হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন কেজিওর বাবা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাবার চাকরিসূত্রে দীর্ঘদিন তাকে পরিবারের সঙ্গে নাইজেরিয়ায় কাটাতে হয়েছে। মাত্র সাত-আট বছর বয়সেই তাঁর লেখার হাতেখড়ি। তিনি পরিচিতি পান মাত্র ২৩ বছর বয়সে লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাস 'ল্য পড়সস-ভারবাল' বা 'ইন্টারোগেশন' এর মাধ্যমে। কেজিওর পড়াশোনার সূচনা নিসেই। মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ চুকিয়ে তিনি ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যের ওপর অধ্যয়ন করেন। কয়েকবছর লন্ডন এবং ব্রিস্টলে পড়াশোনা করার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং শিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর চাকরির সুবাদে তাকে থাইল্যান্ডে পাঠানো হয় ১৯৬৭ সালে। কিন্তু শিশু পতিতাবৃত্তির ব্যাপারে প্রতিবাদ করায় তাকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করে মেক্সিকোতে পাঠানো হয়। কেজিও ১৯৬৪ সালে এক্স-এন-প্রোভিন্স থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৩ সালে ম্যাক্সিকোর ইতিহাসের ওপর গবেষণার জন্য পারপিগন্যান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পান। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও, দণি কোরিয়া, ব্যাংকক, ম্যাক্সিকো, বোস্টন, অস্টিনসহ বিশ্বের বিখ্যাত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কেজিও অধ্যাপনা করেন।

অস্তিত্ববাদী দর্শনের যে প্রাবল্য তার ঠিক পরবর্তী সময়ের তরুণ লেখক কেজিও। ফলে তাঁর প্রথম দিককার লেখায় অস্তিত্ববাদের আবছায়া বর্তমান। তবে তারপরও প্রাত্যহিক কথা কিংবা কথকতাকে তিনি জাদুকরের মতো রাষ্ট্রেও অনৈতিকতার ঊর্ধ্বে প্রয়োজনীয় বাস্তবতায় যথাযোগ্য মর্যাদায় গ্রন্থন করেছেন। মূলত তাঁর স্বাতন্ত্র্য ঠিক এ জায়গাতেই। জীবনের ভিন্ন দিকগুলোর প্রতি তাঁর অত্যধিক মনোযোগ কিংবা আকর্ষণের কারণে সমালোচকেরা কেজিওর সাহিত্যকর্মকে অতীন্দ্রিয়বাদী বলে চিহ্নিত করে থাকেন। অবশ্য শুরুর দিকের লেখায় প্রতিবেশ প্রবলভাবে ওঠে আসায় তাকে প্রতিবেশ সচেতন লেখক হিসাবেও শনাক্ত করা হয়। ষাটের দশক ও সত্তরের দশকের শুরুর দিকে প্রকাশিত বইগুলো পর্যবেক্ষণ করলে বিষয়টি সম্পর্কে একটি আভাস পাওয়া যাবে। যেমন, ফিভার (১৯৬৬), দ্য ফাড (১৯৬৭) এবং তেরা আমাতা (১৯৬৯)। তবে তাকে ফ্রান্সের শীর্ষ লেখক হিসাবে বিশ্বে পরিচিতি এনে দেয় উপন্যাস ডেজার্ট (১৯৮০)। এ উপন্যাসের জন্য তিনি ফ্রেন্স একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। উত্তর আফ্রিকার মরু অঞ্চলের হারিয়ে যাওয়া এক সংস্কৃতির কথা উঠে এসেছে তার ডেজার্ট উপন্যাসে, যেখানে তিনি ইউরোপ যেভাবে অনাকাক্সিত অভিবাসীকে দেখে তার সঙ্গে মরু অঞ্চলের সংস্কৃতির তুলনামূলক পার্থক্য শিল্পিত ভঙ্গিতে বয়ান করেছেন। তাঁর সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, স্মৃতিকথা, নির্বাসন, তারুণ্য আর সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব। নিজের সৃষ্টির ব্যাপারে এক সাক্ষাত্কারে তাকে প্রশ্ন করা হয়, আপনার লেখাকে অতীন্দ্রিয়, দার্শনিক এবং এমনকি ইকোলজিক্যাল বলে বর্ণনা করা হয়! আপনি কি এ ধরনের কোনও অভিধায় নিজেকে চিহ্নিত করেন?
প্রত্যুত্তরে কেজিও বলেন, ''নিজের মনে করার বিষয়টি বর্ণনা করা কঠিন। আমি যদি আমার বইগুলো সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে যাই, তাহলে শুধু বলতে পারব এগুলোর ভেতরের কোন বিষয়কে আমি বেশি পছন্দ করি। অন্যথায়, আমি যা এবং আমি যা বিশ্বাস করি তার পরিবর্তে আমি কী ধারণা করি তার প্রকাশ আমার কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ। যখন লিখি, প্রাথমিকভাবে আমি চেষ্টা করি প্রতিদিনের প্রতিটি বিষয় বা ঘটনার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক তার অনুবাদ করতে। আমরা সঙ্কটাপন্ন এক জমানায় বাস করছি, যা বিশৃঙ্খল ধারণা আর চিত্রের আঘাতে ধ্বংসোন্মুখ। বর্তমানে সাহিত্যের ভূমিকা সম্ভবত সেই বিশৃঙ্খল ধারণা-চিত্রের প্রতিধ্বনি তোলা।''
চল্লিশোর্ধ্ব গ্রন্থের রচয়িতা ল্য কেজিওর প্রায় ১২টি গ্রন্থ ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। উপন্যাস ছাড়াও গল্প, প্রবন্ধ এবং শিশুদের জন্যও তিনি লিখেছেন। ফ্রান্সের বাইরের পাঠক ও সমালোচকদের কাছেই তিনি তুলনামূলকভাবে বেশি পরিচিত, নন্দিত। ফ্রান্সের জীবিত লেখকদের মধ্যে তাঁকে মহত্তম লেখক বলে বিবেচনা করা হয়। ১৯০১ সাল থেকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করার পর থেকে ল্য কেজিও চতুর্দশ ফরাসি লেখক যিনি এই পুরস্কার অর্জন করেছেন।
=============================
উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম : দ্য ইন্টারোগেশন (১৯৬৩), ফেভার, দ্য ফাড (১৯৬৬), মেটেরিয়েল এক্সট্যাসি (১৯৬৭), বিলভড আর্থ (১৯৬৭), দ্য বুক অব এস্কেপস (১৯৬৯), ওয়ার (১৯৭০), দ্য জায়ান্ট (১৯৭৩), জার্নিস বিয়োন্ড (১৯৭৫), চিলাম বালাম (১৯৭৬), মন্ডো অ্যান্ড আদার স্টোরিজ (১৯৭৮), দ্য স্ট্রেঞ্জার অন দ্য আর্থ (১৯৭৮), থ্রি হোলি সিটিজ, ডিজার্ট (১৯৮০), দ্য রাউন্ড অ্যান্ড আদার কোল্ড হার্ড ফ্যাক্টস (১৯৮২), দ্য প্রসপেক্টর (১৯৮৫), ডিয়েগো অ্যান্ড ফ্রিদা, দ্য ম্যাক্সিকান ড্রিম (১৯৮৮), ¯িপ্রং অ্যান্ড আদার সিজনস, ওয়ান্ডারিং স্টার : এ নভেল (১৯৯২), দ্য গোল্ডেন ফিশ, দ্য কাউড পিপল, স্যাং সেলিব্রেশন, বার্নট হার্ট অ্যান্ড আদার রোমান্সেস, দ্য আফ্রিকান (২০০৪) ইত্যাদি।


মন্তব্য

নজমুল আলবাব এর ছবি

'বর্ণদূত' নামে অতিথি হিসেবে সচল হওয়ার পর এটাই আমার প্রথম পোস্ট।- রুবাইয়াত্ আহমেদ

নিজের নামটি যখন জানিয়েই দিলেন, তো নিক নিলেন কেন? যাইহোক, সেটা আপনার অভিরুচি। তবে লেখাটা ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ টাটকা বিষয়টা উপস্থাপনের জন্য।

আরও লিখুন।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ধন্যবাদ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুমন সুপান্থ এর ছবি

লেখাটার জন্য ধন্যবাদ রুবাইয়াত ।

---------------------------------------------------------

'...এইসব লিখি আর নাই লিখি অধিক
পাতার তবু তো প্রবাহেরই প্রতিক...'

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

পুতুল এর ছবি

আর একজন ফরাসী লেখককে উপহার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। খুব ভাল করেই আপনার কলমে সে লেখক আমাদের সামনে নমস্য হলেন।
স্বাগতম!
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অতিথি লেখক এর ছবি

ব্বাহ্!
লেখক! আমি আপনার বন্ধু হই। হাসি
অনেক ভালো লাগলো, এমন হঠাত্ দেখা পেয়ে গিয়ে। আর লেখা পেয়ে তো আরোই বেশ লাগলো। ভালো হয়েছে। জানলাম। আমার পড়া হয়নি এর মধ্যে এখনও উনার সম্বন্ধে। তুমি তো জানোই আমি কেমন ভীষণ পড়ুয়া ব্যক্তি একজন! চোখ টিপি
দেখা হবে। লেখা হবে। কথা হবে।
ভালো থেকো।

_ সাইফুল আকবর খান

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।