সমুদ্রবক্ষের মাটির উৎস : পর্ব ১

পাগল মন এর ছবি
লিখেছেন পাগল মন [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ১৭/০৬/২০১১ - ১১:১৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ডিস্ক্লেইমার: প্রথমেই বলে নেই যে আমি কোন ভূতত্ত্ববিদ নই, ভূ-পদার্থবিদতো নয়ই। কিন্তু এই আর্টিকেলটা হঠাৎ করেই চোখে পড়ে গিয়েছিল সেদিন। আগ্রহী হয়ে পড়তেও শুরু করলাম। পড়া শেষে মনে হল, এটা বেশ ইন্টারেস্টিং, শেয়ার করা যায়। আর্টিকেলটা বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে আবারো বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার অভাব বোধ করলাম কেননা অনেক শব্দের বাংলা আমি জানিই না। তো এটা পড়ার সময় অনেক শব্দ দেখতে পারেন যা একটু জটিল, বৈজ্ঞানিক। আর আমি ভালো অনুবাদ করতে পারি না, তাই অনুবাদ কাঠখোট্টা লাগতে পারে, নিজগুনে ক্ষমা করে দিয়েন। হাসি

প্রারম্ভিক

শীতল অন্ধকার সমুদ্রবক্ষে পৃথিবীর প্রায় ৮৫% অগ্নুৎপাতই আমাদের অগোচরে থেকে যায়। এসব অগ্নুৎপাত যদিও দেখা যায় না কিন্তু তারমানে এই না যে এদের কোন গুরুত্ব নেই, বরং এসব অগ্নুৎপাতের ফলেই সৃষ্টি হয় পৃথিবীর সমুদ্রবক্ষের বিশাল, পুরু পাথরের জমিন। ভূপদার্থবিদগণ ষাটের দশকের শুরুতে ‘ওশিয়ানিক ক্রাস্ট’ হিসেবে পরিচিত সমুদ্রতলের মাটির উৎস সম্পর্কে জানতে শুরু করেন। বিজ্ঞানীরা ‘সোনার সার্ভে’র মাধ্যেম জানতে পারেন যে অসংখ্য আগ্নেয়গিরি প্রায় পরপর পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করেছে যা পৃথিবীকে বেসবল/ক্রিকেট বলের সীমের মত ঘিরে আছে। এরপরে তারা এসবের উৎস সম্পর্কে জানতে সচেষ্ট হন। সাধারণভাবে তারা ধারনা করেন যে যেহেতু ওশান ক্রাস্ট নিজেদের থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে এবং তাদের মাঝে শূন্যস্থান সৃষ্টি হচ্ছে, সেহেতু সেই শূন্যস্থান পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ লাভা দ্বারা পূরণ হয়। কিন্তু কিভাবে সে লাভা তার উৎপত্তিস্থল থেকে এতটা উপরে উঠে আসে সেটা রহস্যই থেকে যায়।

সম্প্রতি গাণিতিক মডেলিং দ্বারা গলিত ও কঠিন পাথরের মধ্যকার সম্পর্ক সম্বন্ধে জানা যায় যা এপ্রশ্নের কিছুটা উত্তর পেতে সাহায্য করে। এছাড়া পুরোনো সমুদ্রবক্ষের কিছু অংশ যা বিভিন্ন দেশে উন্মুক্ত হয়েছে সেটা পরীক্ষা করেও বিজ্ঞানীরা এপ্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা পেয়েছেন। প্রক্রিয়াটি সাধারণ ধারনা হতে সম্পূর্ণ ভিন্নতর, সাধারণ ধারনা অনুযায়ী আগ্নেয়গিরির নীচে ম্যাগমা প্রথমে বিশাল এক প্রকোষ্ঠে জমা হয় তারপর সেটা প্রচন্ডবেগে উপরে উঠে আসে এবং সমুদ্রবক্ষের সৃষ্টি করে। কিন্তু নতুন ধারনা অনুযায়ী, এ প্রক্রিয়া সমুদ্রবক্ষ হতে হাজার হাজার কিলোমিটার নীচে শুরু হয় যেখানে ক্ষুদ্র শিশিরকণাতুল্য গলিত পাথর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আনুবীক্ষণীক ছিদ্র দিয়ে ধীরে ধীরে, প্রায় ১০ সে.মি/বছর (আমাদের নখের বৃদ্ধির হারের সমান), উপরের দিকে উঠতে থাকে। যখন তারা সমুদ্রবক্ষের কাছাকাছি আসে তখন তাদের গতি উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে এবং অবশেষে সমুদ্রবক্ষে প্রচন্ডবেগে (প্রচন্ডবেগে চলন্ত ট্রাকের মত) নিক্ষিপ্ত হয়।

চলুন এবার একটু গভীরে যাই

সমুদ্রতলের অনেক অনেক গভীরে, অগণিত ধাপ নীচে, যেখানে রয়েছে ম্যান্টল, যা দ্বারা সমুদ্রবক্ষ সৃষ্টি, প্রায় ৩২০০ কিলোমিটার পুরু তপ্ত পাথরের লেয়ার যা পৃথিবীর মধ্যভাগ সৃষ্টি করেছে এবং পাথুরে কেন্দ্রকে ঘিরে রেখেছে। পৃথিবীর ঠান্ডা পৃষ্ঠে উপরিভাগের পাথরের রঙ হয় গাঢ় সবুজ কিন্তু এদের যদি তার উৎপত্তিস্থলে দেখা যেত তাহলে দেখা যেত এরা মোটেই ঠান্ডা, সবুজ নয় বরং উজ্জ্বল লাল অথবা সাদা কিন্তু প্রচন্ড গরম। ম্যান্টলের উপরিভাগের তাপমাত্রা প্রায় ১৩০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং এ তাপমাত্রা প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ১ ডিগ্রী করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এছাড়াও হয়েছে উপরস্থ পাথরের ওজন, যা প্রতি তিন কিলোমিটারে প্রায় ১০০০ বায়ুচাপের সমান বাড়তে থাকে।

Earth

ম্যান্টলের এই বিপুল পরিমাণ তাপ ও চাপ সম্পর্কিত জ্ঞান দিয়ে বিজ্ঞানীরা ষাটের দশকের শেষের দিকে একটি হাইপোথিসিস দাঁড় করান যে ওশান ক্রাস্ট/সমুদ্রবক্ষ আসলে গরম কঠিন পাথর থেকে উদ্ভুত, অনেকটা গরমে ঘামার মত, ক্ষুদ্রক্ষুদ্র শিশিরকণাতুল্য গলিত পাথর থেকে সৃষ্ট। এমনকি অতি অল্প পরিমাণ চাপ নিঃসরনেও এসব গলিত পাথর কঠিন পাথরে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আনুবীক্ষণীক ছিদ্র সৃষ্টি করতে পারে।

কিভাবে গরম কঠিন পাথরের ঘাম হতে উদ্ভুত গলিত পাথর সমুদ্রবক্ষে উঠে আসে এর ব্যাখ্যা করা ছিল খুবই কঠিন। মেল্ট (গলিত পাথর) স্বাভাবিকভাবেই কঠিন পাথর থেকে কম ঘনত্ববিশিষ্ট। একারণে এরা ক্রমাগত উপরের দিকে উঠতে চায় যেখানে চাপ অপেক্ষাকৃত কম, এটাই ছিল প্রাথমিক ধারনা। কিন্তু গবেষণাগারে পরীক্ষাকৃত নমুনা (যা মিড-ওশান রিজ থেকে সংগ্রহকৃত) থেকে প্রাপ্ত ফলাফল এ ধারনাকে সমর্থন করে না। এসব নমুনার রাসায়নিক গঠন মেল্টের রাসায়নিক গঠনের সাথে মিলে না। ম্যান্টল পাথর থেকে তাপ ও চাপে ক্রিস্টাল তৈরীর স্পেশালাইজড যন্ত্রপাতির সাহায্যে গবেষকরা জানতে পারেন যে, মেল্টের রাসায়নিক গঠন এর গভীরতার উপরে নির্ভরশীল এবং এই গঠন মেল্ট ও কঠিন পাথরস্থ খনিজ যার মধ্য দিয়ে মেল্ট প্রবাহত হচ্ছে তার মধ্যকার অনুবিনিময় দ্বারা প্রভাবিত। পরীক্ষা করে দেখা যায়, যখন মেল্ট উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন সে এক ধরনের খনিজ, অর্থোপাইরক্সিন, দ্রবীভূত করে এবং আরেক ধরনের খনিজ, অলিভাইন, রেখে যায়। এ থেকে গবেষকরা ধারনা করেন যে যত বেশি মেল্ট তৈরি হবে তত বেশি অর্থোপাইরক্সিন দ্রবীভূত হবে এবং অলিভাইন রয়ে যাবে। তারা এই পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান মিড-ওশান রিজ হতে সংগ্রহকৃত নমুনার সাথে তুলনা করে দেখতে পান যে, প্রায় সব নমুনার রাসায়নিক গঠনই ৪৫ কিলোমিটার কিংবা তারো গভীরে সৃষ্ট মেল্টের রাসায়নিক গঠনের মত।

এই ফলাফল বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্কের সূত্রপাত করে যে কিভাবে মেল্ট এতটা পথ তাদের রাসায়নিক গঠন যা আসলে অনেক গভীরতায় মেল্টের জন্য উপযুক্ত তা অক্ষুন্ন রেখে আসতে পারে। যদি গবেষকদের ধারনা অনুযায়ী মেল্ট ধীরে ধীরে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আনুবীক্ষণীক ছিদ্র দিয়ে উপরে উঠে আসে তাহলে সব মেল্টের রাসায়নিক গঠন হওয়া উচিত স্বল্পগভীরতায় (১০ কি.মি. অথবা তার কম গভীরতা) মেল্টের মত। কিন্তু বেশিরভাগ সংগ্রহকৃত নমুনার উৎস আসলে প্রায় ৪৫ কি.মি. কিংবা তারও গভীরে এবং তারা এতটা পথ তাদের চলার পথে কোন অর্থোপাইরক্সিন দ্রবীভূত না করেই সমুদ্রবক্ষে উঠে এসেছে। কিন্তু কিভাবে??

লেখক পরিচিতি: আর্টিকেলটির লেখক ড: পিটার বি. কেলেমেন। উনি আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লামন্ট-ডোহার্টি আর্থ অবসারভেটরীর (আর্থার ডি. স্ট্রোক মেমোরিয়াল) প্রফেসর।
মূল আর্টিকেল: "The Origin of the Land under the Sea" by Peter B. Kelemen, Scientific American, February 2009.
উপরের ছবিটিও মূল আর্টিকেল থেকে নেয়া।


মন্তব্য

দ্রোহী এর ছবি

ভালো লেখা। চলুক

কয়েকটা জিনিস শুধরে দিই:
১. ওশান ক্রাস্ট না বলে 'ওশিয়ানিক ক্রাস্ট' বলা ভাল।
২. প্রফেসর ভদ্রলোকের নামের উচ্চারণ হবে: পিটার কেলেমেন
৩. ল্যামন্ট-ডোহার্টি আর্থ অবজারভেটরি (Lamont-Doherty Earth Observatory)

ল্যামন্ট-ডোহার্টিতে কিছুদিন হাঁটাহাটি করার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। সেই সুবাদে ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল। দেঁতো হাসি

পাগল মন এর ছবি

ঘ্যাচাং

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

পাগল মন এর ছবি

ভালো লেখা

লইজ্জা লাগে
দ্রোহীদা, ঠিক করে দিলাম।
আপনাকে কিঞ্চিত হিংসা হচ্ছে এরকম বস একজনের সাথে পরিচয় আছে শুনে।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

শামীম এর ছবি

পাগল মন ভাই,
পরের পর্ব দ্রুত চাই।

হাততালি

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

পাগল মন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
চেষ্টা করবো।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

মাহবুবুল হক এর ছবি

আমাদের মত ব্যাক্কলদের বোঝার অনেক বাইরে তবুও মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে কিছুটা খাইয়া ফালাইছি। আর্টিকেলের ভূমিকায় অনুবাদক যতটা নাদানের ভাব দেখাইছেন সেইটা যে বিনয়ের বাড়াবাড়ি তা বুঝতে বেশিক্ষণ লাগে নাই। সাধুবাদ।

--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।

পাগল মন এর ছবি

খেয়েছেন তো, এখন হজম করতে পারলে হয়। চোখ টিপি

আর আমি মোটেই বিনয় করছি না, আমি আসলেই অনুবাদ করতে পারিনা, এই আর্টিকেলটা ভালো লাগায় একটা চেষ্টা করলাম আর কী।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমি ভাবছিলাম সমুদের বুকে মাটি জেগে কীভাবে দেশের জামি বাড়ে সেই বিষয়ে কিছু বলবেন
বঙ্গোপসাগরের মাটি জেগে বাংলাদেশের সীমা বাড়ার সংবাদ দেখতে ভেতরে ঢুকে দেখি পুরাটাই বিজ্ঞান

পাগল মন এর ছবি

আপনি হতাশ হয়েছেন দেখে দুঃখ পেলাম। হাসি আর বিজ্ঞান কী খারাপ? চিন্তিত
ওই বিষয় নিয়ে জাহিদ স্যার (সচল জাহিদ) মনে হয় একটা লেখা দিয়েছিলেন। আমারো লেখার ইচ্ছা আছে, কিন্তু সেটা নিয়ে একটু পড়াশুনা করতে হবে, অলস হওয়ার কারণে করছি না।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

পাগল মন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- রোমেল ভাই।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

ফাহিম হাসান এর ছবি

চলুক খাসা

পাগল মন এর ছবি

লইজ্জা লাগে

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।