সমুদ্রবক্ষের মাটির উৎস : পর্ব ৩

পাগল মন এর ছবি
লিখেছেন পাগল মন [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ২৯/০৭/২০১১ - ৮:৫৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তিন পর্বের শেষ পর্বটি আজ দিলাম। মাথা থেকে একটি বোঝা নেমে গেল মনে হচ্ছে। অনুবাদ করা অনেক কষ্টকর আর সেটা যদি হয় এরকম টেকনিকাল সায়েন্টিফিক আর্টিকেল তাহলে তো কথাই নেই। তার উপরে আমার অনুবাদের আড়ষ্টতা ব্যাপারটাকে আরো কঠিন করে তুলেছিল আমার জন্য। আর কথা না বাড়াই। হাসি

প্রথম পর্ব: সমুদ্রবক্ষের মাটির উৎস : পর্ব ১
দ্বিতীয় পর্ব: সমুদ্রবক্ষের মাটির উৎস : পর্ব ২

আগের পর্ব হতে: মিড ওশান রিজের বিপুল পরিমাণ লাভা মাত্র পাঁচ কিলোমিটার প্রশস্ত একটি অংশ হতে সমুদ্রতলে উঠে আসে। ভূকম্পন সার্ভে, যা কঠিন ও গলিত পাথর আলাদাভাবে সনাক্ত করতে পারে, দ্বারা দেখা যায় যে মেল্ট প্রায় ১০০ কিলোমিটার গভীরতা ও কয়েকশত কিলোমিটার প্রশস্ত একটি এলাকা জুড়ে বিদ্যমান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে এই বিপুল পরিমাণ লাভা আগ্নেয়গিরির সরু নালা দিয়ে সমুদ্রতলে উঠে আসে?

১৯৯০ সালে ডেভিড স্পার্কস এবং মার্ক পারমেন্টিয়ার (তখন ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ছিলেন) এই প্রশ্নের একটি সম্ভাব্য উত্তর প্রস্তাব করেন যা আসলে ওশিয়ানিক ক্রাস্ট এবং উপরের দিকের ম্যান্টলের তাপমাত্রার পার্থক্যের সাথে জড়িত।সদ্য উপরে উঠে আসা লাভা ক্রমাগত ওশিয়ানিক ক্রাস্টের স্তরে যুক্ত হতে থাকে ফলে অশিয়ানিক ক্রাস্ট মিড ওশান রিজের উভয় পাশেই বাড়তে থাকে। নতুন লাভার আগমনে ওশিয়ানিক ক্রাস্টের পুরাতন অংশ সরে গিয়ে নতুন, তপ্ত লাভার জন্য জায়গা করে দেয়। এসব তপ্ত লাভা অবশ্য তাপ হারিয়ে ধীরে ধীরে শীতল হয়ে যায়। যতই শীতল হতে থাকে ক্রাস্ট, সেটা ততই পুরু হয় এবং গরম, গলিত ম্যান্টলে ততই ডুবে যেতে থাকে। এই প্রক্রিয়া সমুদ্রতল এবং মিড ওশান রিজের মেঝে থেকে গড়ে প্রায় দুই কিলোমিটার গভীরে চলতে থাকে। এছাড়া শীতল ক্রাস্ট ম্যান্টলের উপরিভাগকেও ধীরে ধীরে শীতল করে দেয় ফলে একদম উপরিভাগের ম্যান্টলের শীতল অংশ আরো ঘনীভূত হয় এবং এর মেঝে রিজ থেকে আরো গভীরে ডুবে যেতে থাকে।

এই সম্পর্কের উপরে ভিত্তি করে স্পার্কস এবং পারমেন্টিয়ার ম্যান্টলে পোরাস ফ্লো’র একটি গাণিতিক মডেল দাঁড় করান। তারা এই মডেলের সাহায্যে দেখতে পান যে, উর্দ্ধমুখী মেল্টের কিছু অংশ যথেষ্ট পরিমাণে তাপ হারিয়ে উপরের দিকের ম্যান্টলের স্তরের পুরুত্ব বৃদ্ধি করে এবং অনেকটা ছাদ বা বাঁধের মত তৈরি করে। এই বাঁধ যত তপ্ত মিড ওশান রিজ হতে দূরে হয় ততই পুরু হতে থাকে, কিন্তু মেল্টের উর্দ্ধমুখী প্রবাহ চলতেই থাকে। তবে মেল্ট তখন সোজাসুজি না উঠে কিছুটা কোনাকুনিভাবে উঠতে থাকে ফলে এক ধরনের হেলানো ছাদের মত তৈরি হয় যার কেন্দ্র রিজের দিকে।

Sweating the sea floor
(বড় করে দেখার জন্য ছবিতে ক্লিক করুন)

শেষ উদগীরন

মাঠপর্যায়ের অবসার্ভেশন আর তাত্ত্বিক মডেল এ পর্যন্ত দুটি রহস্যেরই সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পেরেছে। উর্দ্ধমুখী মেল্ট শেষের অনেকখানি উপরে আসার পথে তার পার্শ্বস্থ পাথরের সাথে কোনরূপ বিক্রিয়া করেনা কেননা তখন তারা রাসায়নিকভাবে আলাদা হয়ে যাওয়া ডিউনাইটের প্রশস্ত নালী দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। এসব নালী মিড অশান রিজের দিকে যেতে থাকে এবং পথে কিছু মেল্ট শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় উপরের দিকের ম্যান্টলে ঘনীভূত হয় ও ছাদের মত তৈরি করে। কিন্তু একটি নতুন প্রশ্নের উদ্ভব হয় এ থেকেঃ যদি মেল্টের এই উর্দ্ধমুখীতা ক্রমাগত চলতেই থাকে আমাদের ধারণা অনুযায়ী তাহলে কী কারণে গলিত পাথর সময় সময় সমুদ্রতলে বিস্ফোরিত হয় যা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের সৃষ্টি করে সমুদ্রবক্ষে?

এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আবারও মাঠপর্যায়ের ভূতত্ত্ববিদ্যা তাত্ত্বিক ভূতত্ত্ববিদ্যার সাহায্যে এগিয়ে আসে। নব্বইয়ের দশকে নিকোলাস এবং তার কলিগ, ফ্রাঙ্কো বোউডাইর ওমান অফিউলাইটে দেখতে পান যে, মেল্ট ওশিয়ানিক ক্রাস্টের মেঝে থেকে স্বল্প গভীরতায় এক ধরনের লেন্স আকৃতির প্রকোষ্ঠে জমা হয়। এই প্রকোষ্ঠ কয়েক মিটার হতে শুরু করে কয়েকশত মিটার উঁচু এবং শতশত মিটার প্রশস্ত হতে পারে। কিভাবে এই প্রকোষ্ঠ তৈরি হয় তা ব্যাখ্যা করার জন্য লেখক এবং তার কলিগরা ক্রাস্টের মেঝের ঠিক নিচের ম্যান্টল কিভাবে অনেক গভীরতায় থাকা ম্যান্টলের থেকে ভিন্নতর আচরণ করে সেটা বিবেচনা করেন।

ক্রম সম্প্রসারণশীল রিজ যেমন পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিজ অথবা ওমান অফিউলাইট রিজের নিচে উপরের দিকের ম্যান্টলের তপ্ত, গলিত পাথর ক্রমাগত তাপ হারিয়ে শীতল হতে থাকে। ফলে কিছু মেল্ট ঘনীভূত হয়। এই ক্রম-তাপহ্রাসীকরণে ঘনীভূত মেল্ট উপরের ম্যান্টলের নিচে লেন্স আকৃতির প্রকোষ্ঠে জমা হতে থাকে। যত বেশি মেল্ট এই প্রকোষ্ঠে জমা হয়, লেন্সের ভেতরে চাপ ততই বাড়তে থাকে। অনেক গভীরে হয়ত প্রচন্ড তাপমাত্রার কারণে পাথর গলিত হয়ে প্রবাহিত হতে পারে যা উদ্ভুত চাপ প্রশমন করতে পারে কিন্তু উপরের ম্যান্টলের ক্রমাগত তাপ হ্রাসের ফলে প্রকোষ্ঠে জমা হওয়া এসব মেল্ট তেমন নড়াচড়া করতে পারেনা। ফলে চাপ বাড়তেই থাকে এবং এই চাপ প্রকোষ্ঠের উপরিভাগের পাথরে ধীরে ধীরে ফাটল তৈরি করতে থাকে। এসব ফাটল দিয়েই মেল্ট উপরে উঠে আসে। কিছু মেল্ট ক্রাস্টের মেঝের কাছাকাছি এসে জমা হয় এবং কোন ধরনের বিস্ফোরণ ছাড়াই পাথরের স্তর তৈরি করতে থাকে কিন্তু এক সময় মেল্ট ঠিকই আগ্নেয়গিরির গলা দিয়ে তীব্রবেগে এবং প্রায় ১০ মিটার প্রশস্ত ও প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ নালার মত সমুদ্রতলে উঠে আসে এবং সমুদ্রতলে আগ্নেয় পাথরের স্তর সৃষ্টি করে।

শাখাপ্রশাখায় ছড়িয়ে পরা

সমুদ্রতলে মেল্ট প্রবাহের এই বিস্তৃর্ণ জাল পৃথিবীপৃষ্ঠে ছড়িয়ে থাকা নদীনালার বিস্তীর্ণ জালের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেভাবে ছোট ছোট নালার মত শাখা একত্রে নদীর সৃষ্টি করে গভীর ম্যান্টলে সেভাবেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নালী রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বড় নালীতে পরিণত হয়। উপরের দিকের ঘনীভূত মেল্ট বাঁধের মত তৈরি করে যা অনেকটা নদী যখন মোহনায় তারই বয়ে আনা পলি দিয়ে প্রাকৃতিক বাঁধের মত তৈরি করে তার মতন। এই দুই অবস্থাতেই তৈরি বাঁধে এক সময় ফাটল তৈরি হয় এবং শেষে একটি প্রশস্ত নালার মত অংশ দিয়ে মেল্ট এবং পানি বের হয়ে আসে। এই বিষয়ের উপরে আর গবেষণা হয়ত একটি মৌলিক তত্ত্বের অবতারনা করতে পারে যা দুটি প্রক্রিয়াকেই ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হবে।


মন্তব্য

ফাহিম হাসান এর ছবি

ভূ-তত্ত্ব বিষয়টা আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়, কিন্তু ভাল ভাবে পড়া হয়ে উঠেনি। আপনার লেখা থেকে অনেক কিছু শিখলাম। পরিশ্রমের এমন ফসল দেখতে ভাল লাগে। তিনটা পর্বেই অনুবাদ ভালোই হয়েছে। তবে কিছু টাইপো রয়ে গিয়েছে। মেল্ট, ম্যান্টল এর কি কোন পারিভষিক শব্দ আছে? অনুবাদ করতে গিয়ে কী ধরনের সমস্যাইয় পড়েছেন, শেয়ার করুন প্লিজ।

পাগল মন এর ছবি

ফাহিম ভাই, ভূতত্ত্ববিদ্যা আমিও তেমন ভালোভাবে পড়িনি। ভার্সিটিতে একবার ছিল এক সেমিস্টারে, কিন্তু এমন টীচার আর এত মুখস্থ ছিল যে সেটার প্রতি ভীতিই কাজ করত আসলে। আমি নিজেই যে পুরোটা বুঝেছি এমন না, আইডিয়াটা ধরতে পেরেছিলাম। যারা তিনটি পর্বই পড়েছেন, তারাও যদি অন্তত আইডিয়াটা ধরতে পারেন তাহলেই আমার অনুবাদ সার্থক হয়েছে আমি বলব।

আর টাইপো কিছু আছে স্বীকার করছি। লেখাটা শেষ করতে চাচ্ছিলাম। আরো যত্ন নিয়ে লিখলে হয়ত টাইপো কিছু কম থাকত।
আর মেল্ট, ম্যান্টলের বাংলা অনুবাদ আমি জানিই না। কেউ জানলে জানানোর জন্য অনুরোধ রইল।
সবশেষে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

কৌস্তুভ এর ছবি

তৃতীয় পর্বের অপেক্ষায় ছিলাম। তবে টেকনিকাল আলোচনাগুলো ভালো বুঝতে পারলাম না মন খারাপ আসলে আপনি যতটা বিষয়জ্ঞান নিয়ে আর্টিকলটা পড়ছিলেন, তার সিকিভাগও তো এই অনুবাদটা পড়ার সময় আমাদের নেই...

পাগল মন এর ছবি

অনেকদিন অপেক্ষায় রাখার জন্য দুঃখিত। একটু ব্যস্ত ছিলাম। ইয়ে, মানে...
আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি টেকনিকাল ব্যাপারগুলো সহজে বুঝিয়ে বলার কিন্তু নিজে ভালো না বুঝলে যা হয় আরকি, কঠিন হয়েই যায়। এটা আমারই ব্যর্থতা আসলে। মন খারাপ আমার ধারনা দ্রোহীদা একই জিনিস লিখলে বুঝতে আরো অনেক সহজ হত। হাসি

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

আপনি ইচ্ছে করলে আক্ষরিক অনুবাদ না করে ছায়াবলম্বনে লিখতে পারতেন। অর্থাৎ মূলভাব ঠিক রেখে উদাহরণ, নিজস্ব ভঙ্গিমায় লিখতে পারতেন। পাঠক-ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো।

অনুবাদ করা কতো যে কষ্টকর কাজ আমি বুঝি। সেই সুবাধে আপনার অনেক ধন্যবাদ প্রাপ্য।

পাগল মন এর ছবি

ভূতত্ত্ববিদ্যা আমার বিষয় না আসলে তাই ইচ্ছা থাকলেও ভাবানুবাদ করা সম্ভব হয়নি। তবে পরবর্তীতে আপনার পরামর্শ মাথায় রাখার চেষ্টা করব।
পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।