সমুদ্রবক্ষের মাটির উৎস : পর্ব ২

পাগল মন এর ছবি
লিখেছেন পাগল মন [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১২/০৭/২০১১ - ৩:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এত দেরিতে পরের পর্ব দেয়ার জন্য এবং কাঠখোট্টা অনুবাদের জন্য।

প্রথম পর্ব: সমুদ্রবক্ষের মাটির উৎস : পর্ব ১

আগের পর্ব হতে: যদি গবেষকদের ধারনা অনুযায়ী মেল্ট ধীরে ধীরে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আনুবীক্ষণীক ছিদ্র দিয়ে উপরে উঠে আসে তাহলে সব মেল্টের রাসায়নিক গঠন হওয়া উচিত স্বল্পগভীরতায় (১০ কি.মি. অথবা তার কম গভীরতা) মেল্টের মত। কিন্তু বেশিরভাগ সংগ্রহকৃত নমুনার উৎস আসলে প্রায় ৪৫ কি.মি. কিংবা তারও গভীরে এবং তারা এতটা পথ তাদের চলার পথে কোন অর্থোপাইরক্সিন দ্রবীভূত না করেই সমুদ্রবক্ষে উঠে এসেছে। কিন্তু কিভাবে??

চাপে ভেঙে পরে?

সত্তুরের দশকের শুরুতে বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের একটি উত্তর প্রস্তাব করেন যা চিরাচরিত ধ্যানধারনা থেকে ভিন্নতর কিছু ছিল না, মেল্ট অবশ্যই কঠিন পাথরস্থ অসংখ্য ফাঁটল দিয়ে তার শেষের উর্দ্ধমুখী যাত্রা শেষ করে। এসব উন্মুক্ত ফাঁটল দিয়ে মেল্ট এত দ্রুতগতিতে উঠে যে তারা তাদের আশেপাশের পাথরের সাথে বিক্রিয়া করার সময়ই পায় না। এমনকি তারা তাদের স্পর্শ পর্যন্ত করে না। যদিও এসব উন্মুক্ত ফাঁটল উপরস্থ ম্যাণ্টলের সাধারণ বৈশিষ্ট্য নয়, মেল্টের উর্দ্ধমুখী চাপ এতটাই যে তা কঠিন পাথরেও ফাঁটল সৃষ্টি করতে পারে যেমনটা বরফভাঙা জাহাজ মেরুর কঠিন বরফ কেটে চলতে পারে।

অ্যাডলফ নিকোলাস (ইউনিভার্সিটি অফ মন্টপিলিয়ার, ফ্রান্স) ও তাঁর টীম এরকম ফাঁটল আবিষ্কার করেন যখন তারা অফিউলাইটস নামক এক অদ্ভুত ধরনের পাথরের গঠন পরীক্ষা করছিলেন। সাধারণত যখন ওশেয়ানিক ক্রাস্ট ঠান্ডা এবং পুরোনো হতে থাকে তখন তারা এতটাই ঘন হয় যে তারা তাদের পারিপার্শ্বিক ম্যান্টলে ডুবে যায়। কিন্তু অফিউলাইটস হচ্ছে পুরোনো সমুদ্রতল এবং এর আশেপাশের ঘনস্তর যা দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে উপরে উঠে এসেছে। এরকম একটি বিখ্যাত নমুনা পাওয়া যায় ওমানে যেখানে অ্যারাবিয়ান ও ইউরেশিয়ান প্লেটের ক্রমাগত সংঘর্ষের ফলে এটি পৃথিবী পৃষ্ঠে উন্মুক্ত হয়েছে। নিকোলাসের টীম এসব অফিউলাইটস এ অন্যরকম এক ধরনের হালকা রঙের শিরার মত নালী দেখতে পান। তারা মনে করেন এসব নালী তথা ফাঁটল দিয়েই মেল্ট সমুদ্রতলে উঠে আসার আগে প্রবাহিত হয়।

কিন্তু তাদের এই মনে করার একটি সমস্যা হচ্ছে যে এসব নালা যেরকম পাথরে পূর্ণ থাকে তা সমুদ্রতলের কাছাকাছি স্তরের মেল্ট থেকে সৃষ্ট, সমুদ্রতলের প্রায় ৪৫ কিলোমিটার নীচের মেল্ট থেকে নয় যেখানে বেশিরভাগ মিড ওশান রিজের লাভার উৎপত্তি। এছাড়াও বরফ ভাঙার জাহাজের ধারনা মিড ওশান রিজের প্রায় ১০ কিলোমিটার নীচের স্তরের জন্য ঠিক প্রযোজ্য না কেননা সেখানে গরম ম্যান্টল অনেকটা অনেকক্ষন রোদে রেখে দিলে ক্যারামেল যেভাবে প্রবাহিত হয় সেরকমভাবে প্রবাহিত হয়, মোটেই সহজেই ফেটে যায় এমনভাবে না।

ছিদ্রযুক্ত নদী

কিভাবে লাভা মেল্টিং রিজিয়নে প্রবাহিত হয় এই রহস্যের সমাধান করার জন্য লেখক (আমি না, দেঁতো হাসি ) একটি বিকল্প হাইপোথিসিস দাঁড় করান। উনার পিএইচডি করাকালীন সময়ে, আশির দশকের শেষের দিকে উনি একটি রাসায়নিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেন: উর্দ্ধমুখী মেল্ট যতটা অর্থোপাইরক্সিন দ্রবীভূত করে তার চেয়ে কম পরিমাণে অলিভাইন সঞ্চয় করে, যার ফলে মেল্টের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। নব্বইয়ের দশকে উনি এবং উনার কয়েকজন সহকর্মী, জ্যাক হোয়াইটহেড (উডস হোল ওশিয়ানোগ্রাফিক ইন্সিটিউশন), এইনাট আরোনভ (বর্তমানে উইজম্যান ইন্সিটিউট অফ সাইন্স, রেহোভট, ইস্রায়েল এ কর্মরত) ও মার্ক স্পেগেলম্যান (ল্যামন্ট- ডোহার্টি আর্থ অবসারভেটরী, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি) মিলে এই প্রক্রিয়ার একটি গাণিতিক মডেল দাঁড় করান। তাদের পরীক্ষায় দেখা যায় যে, কিভাবে এই দ্রবীভবন প্রক্রিয়ায় সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ ছিদ্র বড় ছিদ্রে পরিণত হয় এবং কিভাবে মেল্ট তার প্রবাহের জন্য ধীরে ধীরে জায়গা করে নেয় কঠিন পাথরের মধ্য দিয়ে।

যখন ছিদ্রগুলো ক্রমাগত বড় হতে থাকে তারা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হয়ে ছোট নালার মত সৃষ্টি করে। এভাবেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নালা একত্রে মিলে বড় নালায় পরিণত হয়। তাঁদের মডেল এই ধারনা দেয় যে, ৯০% এর বেশি মেল্ট মাত্র ১০% এলাকার মধ্যে খুবই ঘন সন্নিবেশিত অবস্থায় থাকে যার মানে লক্ষাধিক আনুবীক্ষণিক সূতার মত প্রবাহিত মেল্ট মাত্র কয়েক ডজন কিংবা তার বেশি ১০০ মিটার বা তার কিছু বেশি প্রশস্ত উচ্চ প্রবাহসক্ষম নালা দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে।

তারা ধারনা করেন যে, অতি প্রশস্ত নালায়ও মেল্ট তার আদি গুনাগুন বজায় রেখে চলাচল করে কিন্তু অত্যন্ত ধীর গতিতে, বছরে মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার। সময়ের সাথে সাথে এত পরিমাণ মেল্ট একটি নালা দিয়ে প্রবাহিত হয় যে ইতোমধ্যে সমস্ত অর্থোপাইরক্সিন দ্রবীভূত হয়ে গিয়েছে এবং শুধুমাত্র অলভাইন ও অন্যান্য খনিজ যা মেল্ট দ্রবীভুত করতে পারেনা তারা রয়ে গিয়েছে। ফলে এসব নালায় থাকা মেল্টের গঠন তাদের এবং তাদের পারিপার্শ্বিক পরিমন্ডলের চাপ দ্বারা পরিবর্তিত না হয়ে যেখানে তারা সর্বশেষ অর্থোপাইরক্সিন পেয়েছিল সেখানকার মতই থেকে যায়।

এ প্রক্রিয়ার একটি অন্যতম ধারনা এই যে, একটি নালায় কিনারার/ধারের মেল্টই কেবল তার আশেপাশের অর্থোপাইরক্সিন দ্রবীভুত করতে পারে, ভিতরের মেল্ট অপ্রিবর্তিত অবস্থাতেই উপরের দিকে উঠতে পারে, যা ফোকাসড পোরাস ফ্লো নামে পরিচিত। গাণিতিক মডেল দ্বারা এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ম্যান্টলের গভীরে সৃষ্ট মেল্ট কঠিন পাথরে ফাঁটল তৈরি করে নয় বরং তার কিছুটা দ্রবীভুত করে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে। এই মডেলিং এর ফলাফল সংগ্রহকৃত নমুনার সাথে মিলিয়ে দেখেন তারা এবং তারা তাদের ধারনার পক্ষে জোরালো বাস্তব ভিত্তি খুঁজে পান।

ওমানের বিশাল অফিউলাইট সেকশন যা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১০০ কিলোমিটার প্রশস্ত, অন্যান্য অফিউলাইটের মতই খসখসে খয়েরী রঙের এবং হাজার হাজার শিরার মত নালীযুক্ত। ভূতত্ত্ববিদ্গণ অনেকদিন আগেই এ ধরনের শিরার মত নালী ডিউনাইটে আবিষ্কার করেছেন কিন্তু তারা ডিউনাইট বা তার পার্শ্বস্থ পাথরের খনিজের গঠন পরীক্ষা করেননি। বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন উপরের দিকের ম্যান্টলের আশেপাশের পাথর অর্থোপাইরক্সিন ও অলিভাইনে ভরপুর থাকবে কিন্তু ডিউনাইটের ৯৫% এর বেশি অলিভাইন, যা মেল্ট ম্যান্টলের ভিতর দিয়ে উপরে উঠার সময় রেখে গিয়েছে। ডিউনাইটে অর্থোপাইরক্সিন একেবারেই নেই, যা লেখকের রাসায়নিক তত্ত্বের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে ধারনা করা হয়েছিল যে সমস্ত অর্থোপাইরক্সিন একসময় দ্রবীভুত হয়ে যাবে। এরকম আরো কিছু প্রমাণ থেকে ডিউনাইট যে মেল্টের মিড ওশান রিজ হতে প্রায় সমুদ্রতলের কাছাকাছি উঠে আসার মাধ্যম সেটা পরিষ্কার হয়।

যদিও এই আবিষ্কার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু এটা দ্বিতীয় একটি রহস্যকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। মিড ওশান রিজের বিপুল পরিমাণ লাভা মাত্র পাঁচ কিলোমিটার প্রশস্ত একটি অংশ হতে সমুদ্রতলে উঠে আসে। ভূকম্পন সার্ভে, যা কঠিন ও গলিত পাথর আলাদাভাবে সনাক্ত করতে পারে, দ্বারা দেখা যায় যে মেল্ট প্রায় ১০০ কিলোমিটার গভীরতা ও কয়েকশত কিলোমিটার প্রশস্ত একটি এলাকা জুড়ে বিদ্যমান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে এই বিপুল পরিমাণ লাভা আগ্নেয়গিরির সরু নালা দিয়ে সমুদ্রতলে উঠে আসে?
(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)


মন্তব্য

ফাহিম হাসান এর ছবি
পাগল মন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

পড়ছি

পাগল মন এর ছবি

সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

অনেক কিছু জানলাম ভাইয়া......... চলুক ......পরের পর্ব তাড়াতাড়ি দিয়েন.............

পাগল মন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

কৌস্তুভ এর ছবি

দুটো পর্ব একসাথে পড়লাম। বেশ ইন্টারেস্টিং করে লিখছেন।

পাগল মন এর ছবি

আমি যতটা ইন্টারেস্ট নিয়ে আর্টিকেলটা পড়েছিলাম তার দশভাগের একভাগও অনুবাদে আনতে পারিনি। মন খারাপ

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।