তোমাদের যা বলার ছিলো, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?

বিপ্লব রহমান এর ছবি
লিখেছেন বিপ্লব রহমান (তারিখ: বুধ, ২০/০২/২০০৮ - ১২:১২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

.

প্রজন্ম '৭১ এর সাইদুর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় সাংবাদিকতার শুরুতে সেই ১৯৯২ - ৯৩ সালের দিকে। তখনও রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে বর্তমান শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধটি গড়ে ওঠেনি। তবে সে সময় প্রজন্ম '৭১ নিজ উদ্যোগে একটি ছোট্ট স্মৃতিসৌধ গড়ে সেখানেই প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে আসছিলো। সরকারের কাছে এ নিয়ে তারা অনেক ধর্ণা দিয়েও সরকার পক্ষকে উদ্যোগি করতে পারেননি।

সাপ্তাহিক খবরের কাগজে অরক্ষিত রায়ের বাজার বধ্যভূমির ওপর একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করার জন্য আমি শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারগুলোর সঙ্গে একে একে দেখা করে সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করি।

*

সে সময় সাইদুর রহমানের সঙ্গে আমার কথা হয় তার কর্মস্থল মতিঝিলের একটি ব্যাংকের সদরদপ্তরে। তিনি বলছিলেন '৭১ সালের কথা।

তখন তিনি পাঁচ-ছয় বছরের শিশু। সৈয়দপুরে যৌথ পরিবারের আদরে আনন্দময় শৈশব জীবন কাটছে তার। '৭১ এর উত্থাল দিনগুলোতে বিহারী রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি হিসেবে চিহ্নিত তাদের বাড়ি আক্রমণ করে বসে।

বাড়ির বড়রা শিশু সাইদুর আর তার পিঠেপিঠি দুই বোনকে একটি বড়ো ঘরে খাটের নীচে হাঁড়িকুড়ির পেছনে লুকিয়ে রাখেন।

তারপরেই ঘটে যায় তার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি!

রাজাকাররা ওই ঘরে সাইদুরের মা-বাবা, অন্যান্য ভাই-বোন, আত্নীয় - স্বজন সবাইকে ধরে এনে কসাইয়ের মতো জান্তব উল্লাসে রাম দা দিয়ে একে একে কুপিয়ে হত্যা করে!

আর এ সবই ঘটে যায় শিশুটির চোখের সামনে। জীবনের ভয়ে ছোট্ট সাইদুর টুঁ শব্দটি করার সাহসও পায়নি।

*

এর পর বহুবছর ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফেরে। বেশ কিছুদিন শিশুটি মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগেছে। এখনো স্বজনের আর্তনাদ তাকে আর ১০টা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দেয় না।...

ব্যাংকার সাইদুর রহমান যখন তাঁর এই দুঃসহ স্মৃতিকথা আমাকে বলছিলেন, তখন বার বার গভীর বেদনায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলো তার মুখ, ভেঙেচুরে যাচ্ছিলো তার কন্ঠস্বর!

কথা বলতে বলতে তিনি বলপয়েন্ট দিয়ে নিউজপ্রিন্টের একটি প্যাডের পাতায় কাটাকুটি করে কি যেনো একটি কথা বারবার লিখছিলেন।

সাক্ষাৎকার শেষে তার অনুমতি নিয়ে আমি নিউজপ্রিন্টের ওই কাগজটি চেয়ে নেই। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, অনেক কাটাকুটির ভেতর ঝকঝকে হরফে তিনি একটি কথাই বারবার লিখেছেন:

তোমাদের যা বলার ছিলো, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?
তোমাদের যা বলার ছিলো, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?
তোমাদের যা বলার ছিলো, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?...

*

শেষ পর্যন্ত খবরের কাগজের ওই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের ভেতর স্ক্যান করে সাইদুর রহমানের হাতে লেখা নিউজপ্রিন্টের টুকরো অংশটি তুলে দেই। লেখাটির শিরোনামও দেই: তোমাদের যা বলার ছিলো, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?

প্রতিবেদনটিতে সরকারি উদ্যোগে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিসৌধ গড়ার জন্য শহীদ পরিবারগুলোর আকুতি তুলে ধরা হয়। পরে প্রজন্ম '৭১ এই লেখার শিরোনাম নিয়ে একটি পোস্টারও প্রকাশ করে।

*

এরপর বিএনপি সরকার বদ্ধভূমিতে স্মৃতিসৌধ স্থাপনের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করলেও এর নথি আর উর্ধ্ব দিকে ধাবিত হয় না। সাইদুর রহমানসহ প্রজন্ম '৭১ এর সদস্যরা সরকারি উচ্চ মহলে দৌড়-ঝাঁপ শুরু করেন। তবু কিছুতেই কিছু হয় না। একটি একটি করে বছর গড়ায়। প্রজন্ম '৭১ এর নিজেদের গড়া ছোট্ট স্মৃতি সৌধটি প্রতি বছর ভেঙে পড়ে। প্রতি বছর পিলার আকৃতির ওই সৌধটি ১৪ ডিসেম্বরের আগে আবার গড়া হয়। আবারও দিন যায়।

শেষে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে স্মৃতি সৌধর সরকারি প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখে। তৈরি হয় বর্তমান সৌধটি।

*

খবরের কাগজের ওই প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লেখার পর বহুবছর সাইদুর রহমানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। ২০০০ সালে ইটিভির কারওয়ান বাজারের ভবনে কি একটা কাজে বিখ্যাত সাংবাদিক সায়মন ড্রিঙ্ক এর কাছে গিয়েছি। লিফটের ভেতর এক অচেনা ব্যক্তি আমার নাম ধরে ডাকেন। তিনি নিজের নাম বলতেই হঠাৎ এক নিমিষে আমার মনে পড়ে যায় সব।

সাইদ ভাই তখন ইটিভিতে সংবাদ পাঠক হিসেবে খণ্ডকালীন কাজে যোগ দিয়েছেন। ইটিভি বন্ধ হওয়ার পর তিনি চ্যানেল আই এ সংবাদ পাঠ করতে থাকেন।

এখনো প্রায় রাতে চ্যানেল আই সংবাদ দেখতে বসলে আমি তাকে খবর পড়তে দেখি। মাঝে চ্যানেল আই টক-শোতে কয়েকবার অংশ নিয়েছি। প্রতিবার কাজ শেষে সাইদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছি।

নতুন করে শুরু হওয়া ইটিভির একটি অনুষ্ঠানে সম্প্রতি আবারো দেখি তাকে। সেদিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে একটি টক-শোতে হাজির সাইদ ভাই।

তিনি খুব স্পষ্ট গলায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে বললেন, যতদিন এই বিচার না হবে, ততদিন অন্তত আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতেই থাকবো। ... এমন কি মৃত্যূর সময় শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে যদি একটি মাত্র মুহূর্ত পাই, তখনও এ দেশের মানুষের কাছে বলবো, আমি এর বিচার চাই!...


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

সাইদুর রহমান কিছুদিন আগে ইটিভিতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন এ কথাগুলো। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম তাঁকে দেখে।

সাইদুর রহমানের সাথে কণ্ঠ মেলাই বার বার। বিচার চাই। শাস্তি চাই যুদ্ধাপরাধীদের।


হাঁটুপানির জলদস্যু

রায়হান আবীর এর ছবি

কয়েকদিন আগে বাসে করে নীলক্ষেত যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই বাস লোকদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া নিয়ে আলোচনা জমে উঠল। সবাই পক্ষে রায় দিলেও এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, এত বছর এই পুরান কাসুন্দি নিয়ে ঘাটাঘাটি কেন? তারা অনেকদিন আগে একটা (!) ভুল করেছিল এখন তো আর করছেনা। আমি তখন কিছুই বলিনাই। মনে মনে শুধু ওই ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে একটা কথাই বলেছেলাম......
ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

তোমাদের যা বলার ছিলো, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অমিত আহমেদ এর ছবি

বিচার চাই!
সব গুলার শাস্তি চাই! একটাও যেন বাদ না যায়।

থার্ড আই এর ছবি

অনেক কিছুই বলেছি এখন করার পালা
তার আগে চল করি বধ রাজাকারের ছানা।।
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

কনফুসিয়াস এর ছবি

চলুক
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

যতদিন এই বিচার না হবে, ততদিন অন্তত আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতেই থাকবো। ...

আপনি একা নন, জনাব সাইদুর রহমান। আমরাও আপনার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে চলছি।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

... নাকি তাদেরকে ভোট দিয়ে মন্ত্রী বানাবো?

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

এম. এম. আর. জালাল এর ছবি

তোমাদের যা বলার ছিলো, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?
তোমাদের যা বলার ছিলো, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?
তোমাদের যা বলার ছিলো, বলেছে কি তা বাংলাদেশ?...

====
এম. এম. আর. জালাল
"ফিরে দেখুন একাত্তর ঘুরে দাঁড়াক বাংলাদেশ।"


এম. এম. আর. জালাল
"ফিরে দেখুন একাত্তর ঘুরে দাঁড়াক বাংলাদেশ।"

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সময় এসেছে বদলাবারঃ

এত বাড়াবাড়ি করার কী আছে, এবার অফ যাও তো বাংলাদেশ!

আর কিছুদিন যাক, দেখবেন এটা জাতীয় শ্লোগান হয়ে গেছে!!

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার অন্য সব লেখার মতই গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা। আমাদের সচেতন করে।
- শামীম হক

বিপ্লব রহমান এর ছবি

সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।