আছিয়া...

বিপ্লব রহমান এর ছবি
লিখেছেন বিপ্লব রহমান (তারিখ: রবি, ০৫/০৪/২০০৯ - ৮:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

..মেয়েটি কোনো বলিউড বা ঢাকাই ছবির হিট নায়িকা শাবনুর, শাবনাজ, শাহনূর--এ রকম কোনো চটকদার নাম বলেনি। নারায়নগঞ্জের গোদনাইলের সরকারি ভবঘুরে আশ্রয় কেন্দ্রের অন্য ভাসমান পতিতাদের ভীড়ে অল্প বয়সী ফর্সা মতোন মেয়েটি একটু দূরে একা দাঁড়িয়ে ছিলো। তার কোলে এক রত্তি একটি দুধের শিশু। সে বোধহয় সেদিন তার সত্যিকারের নামটিই আমাকে বলেছিলো, আমার নাম আছিয়া, আছিয়া বেগম।

আমি ও আরেক সহকর্মি মুন্নী সাহার সঙ্গে ভবঘুরে আশ্রয় কেন্দ্রটি ঘুরে ঘুরে সেখানের আশ্রিতাদের সমস্যার কথা শুনছিলাম, নোট নিচ্ছিলাম দ্রুত, মুন্নী আপা অটো ক্যামেরায় সাদা-কালো ছবি তুলছিলেন। সেটা ১৯৯৯ সালের কথা; আমরা দুজনেই তখন ভোরের কাগজের রিপোর্টার।

তো আমি হঠাৎ সস্তার সালোয়ার-কামিজ পরা, শিশু কোলের ওই মেয়েটিকে লক্ষ্য করি। তার মুখ ও হাতের অনাবৃত অংশে অসংখ্য কাটাকুটির চিহ্ন। চোখ দুটি অসম্ভব মায়াময়, বিষন্ন। যতো বারই তার সঙ্গে কথা বলতে চাই, ততবারই সে সভয়ে একটু করে পিছিয়ে যায়; আশ্রয় নেয় ইসকুল ঘরের মতো টানা টিনের চালার কেন্দ্রটির বারান্দায়।

আমি জানতাম, এইসব ভাগ্যহত, সমাজ নিগৃহিত মেয়েদের সম্ভবত শেষ আশ্রয়স্থল পিতৃপরিচয়হীন গর্ভজাত সন্তান!

তাই বুদ্ধি করে মেয়েটি কাছে গিয়ে কুশল বিনিময় করার ফাঁকে চট করে ওর আদুর গায়ের মাথা ন্যাড়া শিশুটিকে কোলে নেই। আন্তরিকভাবেই দেব শিশুটির কপালে বোধহয় একটি চুমুও খাই।

এবার সত্যিই আছিয়ার আগল খুলে যায়। সে তার মনোযন্ত্রণার কাহিনী বলতে থাকে নীচু স্বরে। ...

কয়েক বছর আগের কাস্টমারের আশায় এক সন্ধ্যায় আছিয়া দাঁড়িয়েছিলো সংসদ ভবন এলাকায়। একটি গাড়ি নিয়ে দুজন ছেলে আসে। 'কন্টাক্ট' হয় সারারাতের। দুজন মিলে সারারাত 'কাজ' করবে, ওকে দেবে এক হাজার টাকা। আছিয়া রাজি হয়। তখন তার বয়স পনেরো কি ষোল।

ওরা গাড়ি নিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে যায় উত্তরার একটি নির্জন এলাকার নির্মাণাধীন এক ভবনে। 'কন্টাক্ট' ভেঙে সেখানে আরো তিন-চারজন যুবক আসে। সারারাত ধরে চলে মদ্যপান এবং আছিয়াকে গণধর্ষণ। এক সময় আছিয়া জ্ঞান হারায়।...

কয়েকদিন পর তার জ্ঞান ফেরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সারা শরীরে অসহ্য ব্যাথা, পুরো শরীর জুড়ে ব্যাণ্ডেজ, রক্ত আর স্যালাইন চলছে সমান তালে। প্রায় দেড় মাস পরে আছিয়া হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়।

পরে সে জানতে পারে, পুরো শরীরে তার ১২০টির ওপরে সেলাই লেগেছে। সে সময় সার্জারি বিভাগের একদল ভ্রাম্যমান বিদেশী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার শরীরের কাটাকুটিগুলো সেচ্ছাশ্রমে সেলাই করে দেয়। তারাই তার জন্য যোগাড় করে বেশ কয়েক বোতল রক্ত ও অন্যান্য অষুধপত্র।

আছিয়াকে উত্তরার বাউনিয়া এলাকার একটি ডাস্টবিন থেকে স্থানীয়রা কুড়িয়ে এনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে ছিলেন। তার সারা শরীর তখন ধারালো ক্ষুরের আঘাতে রক্তাক্ত, জখম। ওর তো বেঁচে থাকারই কথা ছিলো না!...

এইসব কথা বলতে বলতে আছিয়ার চোখ ছলছল করে।... সে আমার সামনে একটানে উন্মোচন করে আরেক রূঢ় বাস্তবতা।

ও ভাই, দেহেন তো, অহন এই কাঁটা-ছেঁড়া করা বেশ্যা-মাগীরে আর কে লইবো? আমার তো অহন আর আগের মতো বাজার নাই। তার ওপর হাউশ কইরা বাচ্চা নিলাম; কাস্টমাররা বাচ্চাওয়ালা মাগীর লগে কাম করবার চায় না!...

আছিয়ার অতীত, বর্তমান ও সম্মুখের অনিশ্চিত ভবিষ্যত আমাকে নির্বাক করে দেয়। অনেকক্ষণ সিগারেট না খাওয়ার ফলে নিকোটিনের অভাবে কি না জানি না, হঠাৎ আমার মনে হয়, খর দুপুরের বাতাসের অক্সিজেনটুকুতেও বুঝি আগুন ধরে গেছে; আমার এমনই দমবন্ধ করা অস্বস্তি হতে থাকে।

আমি সহকর্মিকে তাড়া দেই, মুন্নী আপা, বাইরে চলুন প্লিজ। এখানে খুব গুমোট গরম...আমার আর ভালো লাগছে না।...

---

ছবি: ফলেন ডাউন, ভ্যান গখ, অন্তর্জাল।।


মন্তব্য

এনকিদু এর ছবি

হুমম...

ক্ষুর গুলো খারাপ হাতে পড়েছিল । জানে না ক্ষুর দিয়ে কোথায় কিভাবে টান মারতে হয় ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

শ্যাজা এর ছবি
রায়হান আবীর এর ছবি

স্যাড... মন খারাপ

কবি এর ছবি

কষ্টের ব্যপার কি জানেন? ঊত্তরার ঐ ছেলেরা কিন্তু বাস-ট্রাক ড্রাইভার গোছের কেঊ না। এরা আমি আপনি। এরা আমার আপনার বন্ধু বান্ধব। এরা আমাদের সাথেই ওঠে বসে, ঘোরে ,মানবাধিকারের বুলি কপচায়। এরাই আমি আপনি।

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

একদম ঠিক কথা!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়...

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

এত কষ্ট লাগে এসব পড়লে! এইসব আছিয়াদের আর কত একই ভাগ্য বরণ করতে হবে!
মাঝে মাঝে মানুষকে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট মনে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

কষ্ট আমার হাজার খানেক,মাঝে মাঝে দেখি
কষ্ট দেখে কষ্ট লাগে ,তাই লুকিয়ে রাখি

(জয়িতা)

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

বাকহারা............

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

বলার মতোন কিছু পাচ্ছি না। এখানে লিখলাম না, কিন্তু আমার স্টকের সবচেয়ে খারাপ গালি আর বদদোয়া দিলাম ঐ দুপেয়েগুলোর প্রতি।

আমিন।

___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ

স্নিগ্ধা এর ছবি

কী বলবো, জানি না ...... এইসব জানোয়ারগুলো বেঁচে থাকে, অথচ কত দরকারী মানুষগুলো চলে যায় .........

বিপ্লব রহমান, এটা তো ১৯৯৯ সালের কথা - এই দশবছরে ওই মেয়েগুলোর অবস্থার কোন পরিবর্তন কি হয়েছে? ওরা কি এখনও 'ভাসমান' ? আপনাদের ওই ইন্টারভিউ নেয়ার পর কী হয়েছিলো? ছাপানো হয়েছিলো?

বিপ্লব রহমান এর ছবি

স্মৃতির ভাড় সত্যিই অনেক দীর্ঘ ও দুঃখময়। সঙ্গে থাকার জন্য সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।...

---
স্নিগ্ধা,

সে সময় ভবঘুরে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর ওপর আমি ও মুন্নী সাহা 'এই সব ভবঘুরে' নামে একটি পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন করেছিলাম ভোরের কাগজে। আছিয়ার মতো আরো অনেক ভাগ্যহত নারী ও শিশু-কিশোরের কথা তুলে ধরা হয় সেই সব প্রতিবেদনে। এতে দেখানো হয়, সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর সমস্যা-সীমাবদ্ধতা ও অনিয়ম।

একই সঙ্গে তুলে ধরা হয়, পুনর্বাসনের নামে সেখানে যে প্রহসন চলে, তারও বাস্তবচিত্র। কেননা সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে আছিয়াদের গার্মেন্টেসে সামান্য বেতনের কাজ জুটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়; আর এতে এক মাসে তাদের যা হয়, তা রাস্তার পতিতাবৃত্তির জীবনের একদিনের আয় মাত্র! তাই আছিয়ারা জীবিকার তাড়নায় আবারো ভাসমান পতিতা হয়। যেনো এই যাঁতাকল থেকে তাদের কোনো মুক্তি নেই!

তো ওই বছর সেই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি 'নারী ও শিশু' বিভাগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করে। ২০০৪ সালে রিপোর্টার্স ইউনিটি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিবেদনসমূহ গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করেছে। সেখানে ওই প্রতিবেদনটিও আছে।...

আপনার আগ্রহকে সাধুবাদ জানাই। ধন্যবাদ।


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

তুলিরেখা এর ছবি

কিছু বলার থাকে না! অসহায় লাগে, যেদিকে তাকাই দেখি হিংস্র নখর! মানুষ পশুর অধম হয়ে গেছে! নাকি চিরকালই এরকমই ছিলো! পশুর থেকে অনেকগুণ বেশী হিংস্র,বর্বর আর নির্বোধ।

-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

.............................
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অবাঞ্ছিত এর ছবি

... জানোয়ারগুলোকে যা করা উচিত তা লিখলে মন্তব্যটি আর ছাপা হবে না...

__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...

__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

(দীর্ঘশ্বাস)

সিরাত এর ছবি

গা কেমন জানি করলো পড়তে গিয়ে। খুব ভালো লিখেছেন।

মুস্তাফিজ এর ছবি

এদেরকে নিয়েই আমাদের সমাজ

...........................
Every Picture Tells a Story

রেজওয়ান [অতিথি] এর ছবি

এদের কষ্টগুলো অনুভব করাটাও দুঃসাধ্য

বিপ্লব রহমান এর ছবি

আছিয়ারা তো বেঁচেও মরে আছে। আপনাদের বিনীত অনুরোধ জানাই, মরে বেঁচে যাওয়া আরেক দুর্ভাগা নারীর এই পুরনো সংবাদটি পড়ার।
---
সবাই অনেক ধন্যবাদ।


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

সৌরভ এর ছবি

কষ্ট।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

তানবীরা এর ছবি

একটা সিনেমা দেখেছিলাম অনেক আগে "দামিনী"। অনেকেই আবার এদের রক্ষা করতে মারাত্বক ভাবে এগিয়ে আসেন। দূর্ভাগ্য আমাদের

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

বিপ্লব রহমান এর ছবি

একমত@ তানবীরা আপা।
---
সবাইকে আবারো ধন্যবাদ।


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।