ট্যাক্সি টু ব্রাগা

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি
লিখেছেন অছ্যুৎ বলাই (তারিখ: শনি, ০৮/০৩/২০০৮ - ৩:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

"বেলটে ৯ মিনিটের মাথায় লাগেজ আসবে।" - কোনো এয়ারপোর্টে এত নিশ্চয়তাপূর্ণ ইনফর্মেশনের মুখোমুখি হতে হয় নি। এক এক করে মিনিট কমতে থাকে। ১ থেকে শূন্য পার হয়ে যখন ঋণাত্মক সময়ের গ্যারান্টির ফান দর্শন করবো বলে অপেক্ষা করছি, তখনই কে যেন ইনফর্মেশনের লাইনটিকে খপ করে ধরে পকেটে পুরে ফেলে। নিশ্চয়তার মান-সম্মান বাঁচলেও আরো মিনিট পনের পরেই শীতের ভোরে আড়মোড়াভাঙ্গাবেগে লাগেজ বেলট সচল হয়। আড়মোড়া ভাঙ্গার পরে অবশ্য ফ্রেশ হতে বেশি সময় নেয় না। লাগেজ চলে আসে। 'নাথিং টু ডিক্লেয়ার' এক্সিট দিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

পোর্তো এয়ারপোর্ট থেকে ব্রাগা যাওয়ার অর্থবাঁচানো ট্রেনসার্ভিস থাকলেও ট্যাক্সিটাই বেশি উপাদেয়, বিশেষ করে টাকা যখন নিজের পকেট থেকে যাবে না, সেখানে ছুঁতো পেলেই ঘোড়ারোগের বংশবিস্তার ঘটানো পাপ নয়। ট্যাক্সির বন্দোবস্ত থাকবে এমনটাই কথা ছিলো। সে কথার খেলাপ যে হয় নি, একহাতে নামের সাইনবোর্ড ধরে আরেক হাতে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বেরোবার মুখে রেলিংয়ে হেলান দেয়া যুবককে দেখেই বুঝা গেলো।

বাতচিত করতে গিয়েই পরিষ্কার হলো বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখাকে তিনি থোড়াই কেয়ার করেছেন। পর্তুগালের সাথে কলোনী ভাগাভাগি নিয়ে ব্রিটিশ রাজের সাথে মনোমালিন্যই তার কারণ কিনা, সে গবেষণায় আমি উৎসাহ দেখানোর আগেই তিনি কারো সাথে মোবাইলে কথা বলে নাম ধরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে 'ঠিক আছে' জানিয়ে তাকে অনুসরণ করলাম।

রোড চমৎকার। পাহাড়ি উঁচানিচা বাঁকাত্যাড়া উলটোমুখী গাড়ির আলো চোখে লাগে, তবুও মসৃণ। গতিসীমা ১০০, ১২০, কোথাও কোথাও তা ও উঠিয়ে দেয়া। চমৎকৃত হলাম। জার্মান অটোবানের আভিজাত্যে অন্যদেশের হাইওয়েগুলোর প্রতি একটু দরদ মাখা করুণা সবসময়ই কাজ করে। এই চমকের সাথে সেই দরদের ভায়াগ্রার যোগসূত্র লেস-মাইনাস করেও বলা যায় রাস্তা যথেষ্ট ভালো। তখন সন্ধ্যার বাতিগুলো নাইট শিফটে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ট্যাক্সি চলছে।

ট্যাক্সিওয়ালার নাম জানা হয় নি। জানার ফুরসৎও নেই। স্টিয়ারিং ধরেই সেই যে তিনি সেলফোনে বাতচিত শুরু করেছেন তার আর ক্ষান্তি নেই। রাস্তায় ট্রাফিক ভিড় জার্মানির হাইওয়ের তুলনায় কম। চমৎকার হাইওয়ের ট্রাফিক সিগনাল, সাইনবোর্ডগুলোও চমৎকারভাবে অর্গানাইজড। ইতালিতে গেলে এসব সাইনবোর্ডের অব্যবস্থাপনায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া টুরিস্টদেরকে যে কারণে নাকানিচুবানি খেতে হয়, পর্তুগালে সেটার সম্ভাবনা অনেক কম বলেই মনে হল। তবে সাইনবোর্ড থাকলেই কি, আর না থাকলেই কি! বাংলাদেশের চিটাগাং রোডে বাস ড্রাইভাররা যেমন লেন ভাগ করা লাইনগুলোকে দুই চাকার মাঝ বরাবর রেখে সোজা গাড়ি চালানো মশকো করেন, এখানেও সে জিনিস বেশ ফেবারিটই মনে হলো।

গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল আমার হাতে না থাকলে অনেকটা ক্যান্সারে মৃত্যু পথযাত্রী রোগীর ফিলোসফিতে আমি নির্বিকার থাকি। কিন্তু ১২০কিলো লিমিটের রাস্তায় ১৬০ বেগে ড্রাইভ করা দুটো গাড়ির মাঝে যখন মাত্র মিটার পাঁচেকের ব্যবধান থাকে এবং এর মাঝেই তারা লেন পালটায়, তখন সন্যাসভাব ধরে রাখা বেজায় কঠিন হয়ে পড়ে। শত হলেও জানের মায়া!

ট্যাক্সি চলে। এঁকে বেকে। ড্রাইভার সুনিপুণ। তার কারিশমা দেখলে যে কোনো গোঁখরো সাপের বাপও লজ্জায় সুইসাইড করবে। ফোনে কথা চলছে এখনও। চ্যানেল পালটিয়ে, ওপাশের কনট্যাক্টের পরিবর্তন ঘটে চলেছে একের পর এক। শুধু বিরাম নেই আমাদের ট্যাক্সিওয়ালারই। অকস্মাৎ কি যে হলো, এক বাঁক নেয়ার মুখেই প্রিয় সেল ফোনটি তার হাত থেকে পতিত হলো। অন্ধকার। লাইট জ্বলে। অ্যাক্সিলারেটর, ব্রেকের ভিড়ে তিনি এক চোখ চক্রাবক্রা রাস্তায় রেখে ১৪০+ বেগে চলন্ত গাড়িতে উর্ধাঙ্গ বাঁকা করে অ্যাথলেটিক নৈপূন্যের সাক্ষর রেখে প্রিয় সেলফোনটিকে আঁতিপাতি করে খুঁজেন। তবু তার দেখা নাই রে! একটু মায়াই হয়। বেচারা!

তার যে আরেকটি মোবাইল সেট আছে এতক্ষণ খিয়াল করি নাই। আমাদের চিরপরিচিত সেই অব্যর্থ বিদ্যার প্রয়োগ ঘটে। তিনি হারিয়ে যাওয়া নাম্বারে মিসকল দেন। ট্যাক্সির স্পিড তখনো ১৪০। কোনো গুপ্তচিপা থেকে মধুর স্বর বেরোয়। তিনি আবারও উবু হন। চিপা থেকে হারিয়ে যাওয়া ধন বের করেন। পিছনে বসে বুঝার উপায় নেই। তবে তার চোখে যে বিজয়ীর আনন্দ খেলা করে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেই হয়তো তিনি অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দেন। গতি বেড়ে ১৬০। আমি বাইরে চোখ দেই। লাল লাল বৃত্তের মধ্যে পরিষ্কার লেখা আছে, গতিসীমা ১০০।

পাহাড়ি রাস্তা। উপরে উঠছি ক্রমাগত। ৫০ মিটার যেতে না যেতেই মোড়। ট্যাক্সি চলে। এঁকে বেঁকে। সুনিপুণ দক্ষতায়। আর কয়েকটি বাঁক যেতেই হোটেলের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। টেনশনে ঘামে নেয়ে ওঠার মত পরিস্থিতি নয়; তবে একটু স্বস্তির শ্বাস হয়তো অচেতনেই বেরিয়ে আসে।


মন্তব্য

কনফুসিয়াস এর ছবি

জটিল লাগলো বর্ণনাটা। খুব সহজেই কোন একটা গল্প বা উপন্যাসের ছোটখাটো একটা চ্যাপ্টার হিসেবে ঢুকে যেতে পারে।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

কনফু, থ্যাংক্স। নিজের উপন্যাস লেখার মত ধৈর্য হবে না, তবে উপন্যাস লেখকদেরকে চুক্তিভিত্তিতে চ্যাপ্টার সাপলাই দেয়া যায়। চোখ টিপি

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

ধুসর গোধূলি এর ছবি

লাল লাল বৃত্তের মধ্যে পরিষ্কার লেখা আছে, গতিসীমা ১০০।

আপনে কি ট্যাক্সিও'লার চাইতে পর্তুগীজ ভাষা বেশি বুঝেন? ক্যাঙ ধইরা, দাঁতে খিল মাইরা পইড়া সেনা থাকবেন। ট্যাক্সি যাবে যেদিক আপনেও যাবেন সেদিক। বেহেশতে গেলে বেহেশতে আর খাদে গেলে খাদে। আপনেরে লাল লাল গোল্লার ভিতরে কী লেখা সেইটা পড়ার জন্য পোর্তা পাঠানো হইছে? খালি অপচয় করেন!-
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

এইডা একটা চিন্তার কথা কইছো। পর্তুগীজ ভাষায় ১০০ আসলে ১৬০ ও হতে পারে। বেচারা ট্যাক্সিওয়ালার নামে হুদাই গীবত করেছি।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

বিপ্লব রহমান এর ছবি

দারুণ!

ছবি থাকলে লেখাটি পুরোপুরি উৎরে যেতো।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

ওই সময়ে ছবি তোলা হয় নাই। দিন দিন নিস্পৃহ পর্যটক হয়ে যাচ্ছি।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

শেখ জলিল এর ছবি

শত হলেও জানের মায়া!

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

জ্বি কাকু, কী আছে জীবনে!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

পোর্তো এয়ারপোর্ট থেকে ব্রাগা যাওয়ার অর্থবাঁচানো ট্রেনসার্ভিস থাকলেও ট্যাক্সিটাই বেশি উপাদেয়, বিশেষ করে টাকা যখন নিজের পকেট থেকে যাবে না, সেখানে ছুঁতো পেলেই ঘোড়ারোগের বংশবিস্তার ঘটানো পাপ নয়।

ঠিক। দেঁতো হাসি

আরো পর্ব কি আসবে? আপনার চোখ দিয়ে পর্তুগালও না হয় একটু দেখা হয়ে যেতো!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

জুবায়ের ভাই, পুরা সময়টাই কাজ নিয়া ব্যস্ত ছিলাম। কাজকর্মের বর্ণনা দিয়া আরেক পর্ব নামাইলে গণপিটুনি খাইতে হইবো। হাসি

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

ঝরাপাতা এর ছবি

দারুন লেগেছে। আরো পর্ব আসুক।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

বলাই'দার লেখা গুলা পড়ে বারবার মনে হয় - কী যেনো কী একটা পড়া বাকী রয়ে গেলো, কিংবা সব কথা আসলে লেখা হয় নি। মানে - এটা আগামী পর্বেও যেতে পারতো ।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আমার তো মনেহয় লেখায় সেন্সরের কাঁচি চলে, কিংবা শাসকের চোখ রাঙানি!

আপনারও তাই মনেহয়?
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

কে হৈতে পারে?

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

হ, চিন্তার কথা।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।