হেড অর টেল

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি
লিখেছেন অছ্যুৎ বলাই (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৯/০৭/২০০৭ - ৩:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এপ্রিল, ৭১। পিরোজপুর মহকুমার তারাবুনিয়া গ্রামের দবির শেখ আশেপাশের দশবিশ গ্রামে একনামে পরিচিত। বিখ্যাত হাডুডু খেলোয়াড়। লোকজন দবির শেখের নামেই টিকেট কেটে খেলা দেখতে আসতো। দারিদ্র্যের ঘরের তাক মেডেলে ভরে গেলেও অর্থের সমাগম সমানুপাতিক হয় নি। বাবা বেহেশত লাভ করেছেন অনেক বছর হলো। খাঁটুনি শরীরে দ্রুত ধেয়ে আসা বয়সের ভারে ক্লান্ত মা। ভাইবোন নেই। দবির শেখ দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে যুদ্ধে গেলেন।

১১ ই আগস্ট, ৭১। যুদ্ধ চলছে। তখন যশোর এলাকায় দবির শেখ। উনারা খবর পেলেন পাকবাহিনীর একটা গাড়ির বহর যাবে এ অঞ্চল দিয়ে। অতর্কিতে আক্রমণ করবেন এমনই প্লান ছিলো। সামনে পড়ে গেলেন। বামপায়ের গোড়ালিতে গুলিবিদ্ধ হলেন দবির শেখ। সহযোদ্ধা হেকমত মিয়ার সাহসিকতায় সে যাত্রা জানে রক্ষা পেলেন। চিকিৎসার জন্য পরদিনই দবির শেখকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ভারতে। বিখ্যাত হাডুডু খেলোয়াড় দবির শেখ চিরদিনের জন্য খোঁড়া হয়ে গেলেন।

৩ রা নভেম্বর, ৭১। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের আশীর্বাদপুষ্ট পাকিস্তানীরা তখন জলে-স্থলে সর্বত্রই অপ্রতিরোধ্য। ব্যাপক ক্ষতির শিকার ভারতীয় বাহিনী লেজগুটিয়ে পিছু হটছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এরকম একটা অলাভজনক খাতে সাহায্য দিতে খুব একটা আগ্রহী নয়। ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেন। ভেঙ্গে পড়লেন দবির শেখ। হতোবল হয়ে পড়লো স্বাধীনতা প্রত্যাশী মানুষেরা। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান পাক বাহিনীর অধিকারে আসতে থাকলো।

১৬ ই ডিসেম্বর, ৭১। পাকিস্তানী জাতি তথা ইসলামের জন্য একটি বিরাট গৌরবের দিন। মালাউনদের কুপ্ররোচনায় ইসলামী জাতীয়তাবোধকে ধবংসের নীলনকশা কারী, শান্তির পাকিস্তানে গন্ডগোল সৃষ্টিকারী শেখ মুজিবরকে রেসকোর্স ময়দানে দেশ ও ধর্মদ্রোহীতার জন্য ফাঁসি দেওয়া হয়। এই কুখ্যাত কালপ্রিট মার্চ মাসে এখানেই তথাকথিত স্বাধীনতার জন্য ভাষণ দিয়েছিলো। এই শাস্তি পাকিস্তান তথা ইসলাম বিদ্বেষীদের জন্য একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

৭২। ফেব্রুআরির মাঝামাঝি। সৈন্যরা ইসলাম ও পাকিস্তানের প্রতি তাদের পবিত্র দায়িত্ব সূচারূভাবে পালন শেষে ব্যারাকে ফিরে গেছে। কিন্তু পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম রক্ষার অতন্দ্রপ্রহরী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, পিস কমিটির মুজাহিদগণ এখনো দায়িত্বপালন করে চলেছেন। ইঁদুরের গর্ত থেকেও খুঁজে খুঁজে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নামে জবেহ করা হচ্ছে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধানামধারী গাদ্দারদের। তাদের কলুষিত রক্তে ধুয়েমুছে পবিত্র হচ্ছে এ পাকভূমি। প্রাণের শঙ্কা থাকলেও মা'কে দেখার প্রচন্ড কৌতুহলকে দমিয়ে রাখতে পারছিলেন না দবির শেখ। মায়ের আপন মামাতো ভাই নূর মহম্মদ বিখ্যাত রাজাকার কমান্ডার। দবির শেখের মা গিয়ে তার পায়ে ধরে কেঁদে পড়লেন। নূর মহম্মদের দয়ায় দবির শেখ দেশে ফিরে এলেন।

ডিসেম্বর, ৭২। দবির শেখ বিয়ে করে সংসারী হন। খোঁড়া পা নিয়ে হাডুডু খেলা আর হয় নি। মেট্রিকে ফেল করেছিলেন। অনেক প্রাইমারী ফেল ছেলেপেলেও রাজাকারী সার্টিফিকেট দিয়ে ভালো চাকরী পেয়ে গেলো। দবির শেখ তালিকাভূক্ত গন্ডগোলকারী। গন্ডগোলকারীরা সরকারী চাকুরীতে আবেদন করতে পারবে না। তিনি পরের জমিতে কামলা খাটেন। স্বপ্নগুলো যখন ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে চায় সমস্ত অস্তিত্ব, দবির শেখ মা আর বউয়ের মুখের দিকে তাকান। স্বপ্নের দমক উড়ে যায় দীর্ঘশ্বাস হয়ে। ডানপিটে প্রাণোচ্ছল বিখ্যাত হাডুডু খেলোয়াড় দবির শেখ একজন স্বপ্নহীন মানুষ হয়ে গেলেন।

মে, ৮৩। দবির শেখের ৩ ছেলে। বড়োটা ক্লাস ফোরে পড়ে। মিজান শেখ। বাবার ছোটবেলার মতোই চটপটে। দবির শেখ ছেলেদের কাছে করেছেন সেই গন্ডগোলের বছরের আসল গল্প। কিন্তু ছেলেরা এখন পরিবেশ পরিচিতি সমাজে পড়ে পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য ব্যক্তি, সবচেয়ে কুখ্যাত দেশদ্রোহী শেখ মুজিবর। আর দেশ, জাতীয়তা ও ইসলামের শত্রু তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা নামধারী গন্ডগোলকারীরা। মিজান ধাঁধায় পড়ে যায়। কোনটা সত্যি? বাবার কথা, নাকি এইসব বইয়ের কথা?

স্কুলের হেড স্যার হাজী মনোয়ারউদ্দিন খান ভীষণ ধর্মপরায়ণ মানুষ। নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ পড়ে গেছে। মেহেদী রাঙা সুবিশাল দাঁড়ি। কেমন একটা রূহানী রূহানী ভাব। দেখলেই শ্রদ্ধায় মস্তক নত হয়ে যায়। গন্ডগোলের বছরে উনি এলাকার বিখ্যাত রাজাকার ছিলেন। দেশত্যাগী শত্রু সম্পত্তি কবজা করে উনি মসজিদ বানিয়েছেন, ইসলামী জাতীয়তার শত্রু মালাউনের মেয়েদেরকে পাকবাহিনীর জিহাদী যোদ্ধাদের কাছে গণিমতের মাল হিসেবে উপহার দিয়েছেন। এলাকায় উনার বড়ই দাপট। ক্লাস ফোর ও ফাইভে তিনি পরিবেশ পরিচিতি সমাজ পড়ান। মিজান তার ধাঁধার কথা তাকে ক্লাসে জিজ্ঞেস করে। মনোয়ার সাহেব তীক্ষণদৃষ্টিতে তাকান। " এমন নাফরমানী কথা কে বলেছে?"
-"বাবা"
-"তোর বাবা তো একটা গন্ডগোলকারী। ইসলাম আর পাকিস্তানের শত্রু।" তিনি গর্জে ওঠেন।
- "স্যার, বাবার নামে খারাপ কথা বলবেন না।" প্রতিবাদ করে মিজান।
অগ্নিদৃষ্টি হানেন হাজী মনোয়ারউদ্দীন, "আআআআরে আমার সোনার বাংলা! (এই ডায়লগটা উনার মুদ্রাগুণ। গন্ডগোলকারিদেরকে ব্যঙ্গ করে বলেন)। এখনই বের হ স্কুল থেকে। এই স্কুলের ত্রিসীমানায় যেন আর না দেখি। কাফেরের বাচ্চা কাফের!"

দবির শেখ ধড়মড়িয়ে ওঠেন। শীতের এই বিকেলগুলো বড়ই নেশাতুর। হালকা রোদে শরীরটা এলিয়ে দিতে কত্ত যে মজা! অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছেন তিনি। গাছের ছায়াগুলো কত বড় হয়ে গেছে! খোঁড়া পা টার দিকে একবার তাকান তিনি। ৩৬ বছর হয়ে গেলো দেশ স্বাধীন হয়েছে। যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, তার সাথে বর্তমানের বাস্তবতার পার্থক্য অনেক। হতাশ হন প্রায়ই। ক্লান্ত লাগে, বিরক্তি লাগে, অবসাদে পেয়ে বসে। কিন্তু এই মুহূর্তে আর কোনো ক্লান্তি থাকে না তাঁর মনে। তাঁর এই ত্যাগ বৃথা যায় নি। ওঠেন। গভীর করে একবার শ্বাস নেন তিনি। সে শ্বাসের পরতে পরতে গর্ব, অহঙ্কার। এই দেশটা এখন তাঁর!

(পূনঃ প্রকাশিত, রচনা: বিজয় দিবস, ২০০৬)


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আবার পড়লাম। দূর্দান্ত একটি লেখা।

_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

ধন্যবাদ, শিমুল। সচলে লেখাটার একটা ব্যাকআপ থাকলো।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

পুন:প্রকাশিত মানে।
আগে পড়ি নাই তো।
ভিড়বাট্টায় সব লেখা চোখে পড়ে না।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

নজমুল আলবাব এর ছবি

আবার পড়লেও খারাপ লাগে নাই। এসব লেখা বার বার পড়তে হয়।

হিমু এর ছবি
সুমন চৌধুরী এর ছবি

হুম
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

তারেক এর ছবি

দুর্দান্ত হইছে। গতকাল পড়ছি। কিন্তু লগইন করার আলসেমিতে কমেন্ট করা হয় নাই।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

নিঘাত তিথি এর ছবি

অসাধারণ!

যে আবেগ নিয়ে এই গল্পটা লিখেছেন, সেই আবেগে এখন আমার চোখ ভিজে গেছে। খুব না পাওয়া আর হতাশার অন্ধকারের মধ্যে এই রকম লেখা যেন টেনে তুলে আনে অনেক ওপরে।

হ্যাটস অফ।

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

খুব ভাল লাগলো। কিছুদিন ধরেই আফসোস করছিলাম এই ধাঁচের লেখা তেমন একটা নেই দেখে। আফসোস মিটে গেলো পুরাপুরি। ধন্যবাদ।

অচেনা এর ছবি

বেপাড়ায় এইটা পড়েই বলাই এর পাংখা হইছিলাম।

বলাইয়ের সেরা লেখা। চলুক

-------------------------------------------------
আমি ভালবাসি বিজ্ঞান
আমি ঘৃণা করি জামাত॥

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।