জয় বাবা পশুনাথ!

বন্যা এর ছবি
লিখেছেন বন্যা (তারিখ: বুধ, ০৩/০৯/২০০৮ - ৮:৪৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

- আই তৃষা – প্যাঁচার মত মুখ করে বসে আছিস কেন?
- প্যাঁচা? প্যাঁচা মানে কি?
-owl, গাধা একটা...
- গাধা আসলো কোথা থেকে?

এরকম কথাবার্তা প্রায়ই হয় তৃষার সাথে আমার আর অভিজিতের। সেদিন তো ও আমার বাবাকে বলেই বসলো, 'নানা, মা আমাকে কালকে ছাগলের বাচ্চা বললো, তার মানে তো মা হচ্ছে ছাগল, আর তুমি হচ্ছো ছাগলের বাপ।' আমার বাবা বেচারা কি আর বলবে, হেসে বললো, 'হ্যা নানু, মার কথা অনুযায়ী তো ব্যাপারটা তাইই দাঁড়ায়।' ১১ বছর বয়স তৃষার, বেশ কিছুদিন ধরেই ও একটা কথা বলে – 'তোমরা বাংলায় বকা দেওয়ার সময় খালি পশু পাখি নিয়ে আসো কেন? যেমন, ছাগলের বাচ্চা তো একটা খুবই কিউট 'এনিম্যাল'– এরা আবার কি দোষ করলো? এদের নাম নিয়ে বকো কেনো? এটা একটা 'ডিস্ক্রমিনেশান'। ও যতবারই এটা বলে ততবারই আমি আর অভিজিত মহা আনন্দে ওর উপরে ঝাপিয়ে পরে পলিটিকাল ব্ল্যাক্-মেইলিং করি 'তোদের কাছে তো আরেক দেশে গিয়ে মানুষের উপর ৫০০ পাউন্ডের বোমা ফেলে আসলে কোন অসুবিধা হয় না, আর আমরা পশুপাখির নাম করে একটু গালি দিলেই ওটা হয়ে যায় 'ডিস্ক্রমিনেশান', হিপোক্রেট কোথাকার...।'

কিন্তু সেদিন হঠাৎ করেই মনে হল, আসলেই তো, আমাদের ভাষার এত 'পশুপাখি-প্রীতি' কেন? আমরা কারণে অকারণে পশু পাখি নিয়ে গালিগালাজ করি, ব্যাপারটা তো বেশ ভ্যাজাইল্যা। ভেবে দেখলাম – তাইতো - বদ পাবলিকরে আমরা বলি 'জানোয়ার'। অত্যাচার আর নির্যাতনকে বলি 'পাশবিক'। কিছুক্ষণ মুখে মুখে গাধা, গরু, ছাগল, শুয়োর, বান্দর, হনুমান, ভেড়ার পাল বলতে বলতে, লেখার জন্য খাতা কলম আনতে দৌড়ালাম, কি কান্ড, পাতাটা তো ভরে গেল, বিভিন্ন রকম পশু পাখিময় গালাগালিতে...। আর ওদিকে অভিজিতের তো আনন্দ আর ধরে না, গালি দেওয়ার সুযোগ পেয়ে খুশীতে নাচতে নাচতে বলতে থাকলো, 'কুত্তার বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা, হারামীর বাচ্চা... লাগায় দাও'। আমি বলে উঠলাম, 'আরে হারামী তো কোন পশু হল না... '।

- আরে হইলো না তো কি হইছে? হইলেই হওয়ায় দেওন যায়। হারামী মানে হইল কাউঠা পাবলিক। আর কাউঠা হইল গিয়া কচ্ছপের প্রতিশব্দ।

- কাউঠা আর হারামী কবে এক হইল?

- আরে হইল আরকি। 'বক' যদি ধার্মিক হয়ে 'বক ধার্মিক' হতে পারে 'হারামী বকচ্ছপও' হতে পারে। খচ্চরের মত গালি দেওয়া নিয়া না কথা। আর তা ছাড়া হারামী আইছে 'হারাম' থিকা। আর হারাম কি? ওই যে নিষিদ্ধ প্রানী - শুয়োর। দেখো, শেষ মেষ পশুতে আইস্যাই ঠেকলো।

এই ধরণের জিনিস আর কি আছে?

আছে ধর ... এই যে আমার শরীরটা হাতির মত বিশাল হয়ে যাচ্ছে বলে প্রত্যেকদিনই খোঁটা দিচ্ছ – কোথায় হাতী আর কোথায় অভিজিৎ। তোমার চিল্লাচিল্লির উত্তর না দিলেই বল, আমার নাকি গন্ডারের চামড়া, চামড়ার পুরুত্বের সাথে বৌদ্ধিক সংবেদনশীলতার সম্পর্কটা কি ভাই?

কারও চলাফেরা, ব্যবহার, চেহারা নিয়ে কটুক্তি করার সময় তো আমাদের ভাষায় পশুপাখি থেকে শুরু করে কীট পতঙ্গ পর্যন্ত কিছুই বাদ পড়ে না। নর্দমার কীট থেকে শুরু করে ছুঁচোর মত মুখ, ঘোড়ার মত দেখতে, ভিজা বিড়াল, গাছে ঝোলা বাদর, বিচ্ছু, শিয়ালের মত ধূর্ত, 'ভ্যাদা মাছের' মত মুখ, কেঊটে সাপের মত বিষাক্ত, মৌমাছির মত হুল ফোঁটানো কথা, পাঠার মত গায়ের গন্ধ, বাজ পাখির মত দৃষ্টি, চিলের মত ছো মেরে কেড়ে নেওয়া... সবই আছে। আমাদের বাগধারায় আছে 'কই মাছের' প্রাণ, ‘সাপে-নেউলে’ সম্পর্ক, 'ভুষুণ্ডির কাক', কিংবা 'বুড়ো শালিকের' ঘাড়ে রো।

আমার লেখা নিয়ে ছোট বেলায় বাবা বলত – হাতের লেখা নাকি 'কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং'। হাতের লেখার সাথে বেচারা কাক আর বকের সম্পর্ক কোথায় তা আজো আমার বোধগম্য হল না। আমরা 'ব্যাঙের মত' গাল ফুলাই, ‘গজেন্দ্র গমনে’ চলি, 'অসুইখ্যা মুরগীর' মত ঝিমাই, নাইলে 'ষাঁড়ের মত' চ্যাঁচাই, হায়েনার মত হাসি, শুয়োরের মত ঘোৎ ঘোৎ করি, উটের মত চলি, কিংবা 'তীর্থের কাকের' মত বসে থাকি। এমনকি দেয়ালে রাজনৈতিক শ্লোগান লিখতে গেলেও –'চিকা মারি'।

আমাদের ঠাকুরমার ঝুলিতে কিংবা পৌরানিক কাহিনীতেও জন্তু জানোয়ারের ছড়াছড়ি। এখানে আছে 'শিয়াল পন্ডিত', ব্যাঙ্গমা-ব্যঙ্গমী, টোনা-টুনি, গরুর, জটায়ু, রাম গরুরের ছানা। 'হাই প্রোফাইল' জন্তু জানোয়ারেরও কিন্তু অভাব নাই। হিন্দু ধর্মে তো গরুকে মায়ের আসনে বসিয়ে রাখা হয়েছে, হিন্দু পুরানে দেবদেবীদের আছে নানা বাহন – সবই পশুপাখি –ময়ুর, লক্ষী প্যাঁচা, ইঁদুর, হনুমান কত কি, এই মুহুর্তে সবগুলা মনেও আসতেছে না। মা দুর্গাও 'মহিষাসুর' বধ না করে পারেন না। আমাদের মহানবী আবার 'বোরাকে' চড়ে টাইম ট্র্যভেল করেন বলে শুনি।

প্রশংসা করার সময়েও আমরা জন্ত-জানোয়ার আনি, তবে তার সংখ্যা বোধ হয় খুব বেশী না। বাঘের বাচ্চা হওয়ার ইচ্ছা অনেকের আছে তা জানি, কিংবা কারো কারো আছে সিংহের সাহস, তার উপর আছে মোঘল সম্রাট আকবরের সিংহের গদি – সিংহাসন। প্রজাপতির মত ফুরফুরা কিংবা 'চপলা হরিনী' বলতেও বাধা নেই। পজিটভ ভাবে আর কি কিছু বলি? মনে করতে পারছি না এখন। পজিটিভ জিনিস আমদানীর দায়িত্ব সচলায়তনের ব্লগারদের। শুধু পজিটিভ না, পশুতালিকার লিস্টি টা যে দিক দিয়ে ইচ্ছা বড় করণের গুরুভারও আপনাদের উপরে আরোপিত হইল। অন্য ভাষাতেও এইরম 'পশুপ্রীতি', 'পাখি-প্রীতি', 'কীটপতঙ্গ-প্রীতি' কি আছে? থাকলে সেই শ্রুতিমধুর শব্দভান্ডার জানাতে ভুলেন না কিন্তু।

বহুদিন কিছু লেখা হয় না। অনেক গুরুগম্ভীর সব টপিক নিয়ে ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত এই ফালতু লেখাটা লিখে শেষ করে আর ব্লগে দিয়েই –'নিজের খেয়ে বনের মোষ' তাড়ালাম আর কি! তৃষাটা বাংলা পড়তে পারে না দেখে এ যাত্রা বেঁচে গেছি। নইলে আমাদের ‘পশুপ্রেম’ নিয়ে তার ‘হাইপোথিসিস’টাই থিওরীতে পরিণত করে ছাড়ত।

জয় বাবা পশুনাথ!


মন্তব্য

স্নিগ্ধা এর ছবি

তোকে শুধু একটাই প্রশ্ন - তোর হইসেটা কি?????

বন্যা এর ছবি

তুই যখন থেকে 'শ্রমের মূল্য','নৈতিকতার মূল্য' টাইপের লেখা ধরলি তখন থেকেই ঠিক করসি আমার উলটা পথে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নাই ঃ)। তাই একটু চেষ্টা করলাম...কোথায় একটু উৎসাহ দিবি, না...যাথারীতি ঝারিবাজি শুরু করলি।

পান্থ রহমান রেজা [অতিথি] এর ছবি

উপভোগ্য লেখা।

অফটপিক: আপনার বির্বতনের পথ ধরে বইটি আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে। আজ আপনাকে পেয়ে আমার ভালোলাগাটুকু জানিয়ে গেলাম।

বন্যা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে,কষ্ট করে এই খটমটা বইটা পড়ার জন্য।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

তাহলে আপনার একটা ব্যাঙের ঘুম পূর্ণ হলো
অতদিনে মনে হচেছ নিজেই একটা বিবর্তনচক্র পার করে এলেন?

বন্যা এর ছবি

লীলেন ভাই, চেষ্টা করতেসি,কিন্তু এই লম্বা ঘুম থেকে ওঠা কি সহজ কথা? দেখি এবার আসলেই ঘুম ভাঙ্গে নাকি।

তারেক এর ছবি

গরুর চোখের মতন মায়াভরা বড় বড় চোখ- এইটা পজেটিভ/নেগেটিভ কোন সেন্সে নেয়া যায়? একটা মেয়েরে এইটা বললে বিপদের সম্ভাবনা কতদূর? _________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

অভিজিৎ এর ছবি

ব্যাপারটা রিস্কি হবে নিঃসন্দেহে। আমি একবার একটা গান শুনাইছিলাম বন্যারে -

আরে ... কুত্তা যেমন ভালবাসে মরা গরুর হাড্ডি রে
তেমন ভালাবাসি তোমারে।

বিলাই যেমন ভালবাসে ইলিশ মাছের কাঁটারে
তেমন ভালবাসি তোমারে

কাউয়া যেমন ভালবাসে ডাস্টবিনের ময়লারে
তেমন ভালবাসি তমারে...

বুঝতেই পারছেন অভিজ্ঞতাটা সুখকর হয় নাই। এই পশুপ্রেম কই যে যায় তখন! হাসি



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

স্নিগ্ধা এর ছবি

বুঝতেই পারছেন অভিজ্ঞতাটা সুখকর হয় নাই।

অভি, এতো মহাবিশ্বে ফিশ্বে বুদ্ধিমত্তার খোঁজ না করে, একটু নিজের ঘাড়ের উপরের দিকে করলে কেমন হয়??

যেমন আক্কেল, তেমন সঙ্গীতপ্রতিভা, আর গলাখান? আমার বন্ধু যে আজও বেঁচে আছে এইই না বেশী !!

অভিজিৎ এর ছবি

যেমন আক্কেল, তেমন সঙ্গীতপ্রতিভা, আর গলাখান?

ঠিক করে কথা বলো স্নিগ্ধা। নইলে পশুপ্রেমীরা মনোক্ষুন্ন হতে পারেন।

তোমার বলা উচিৎ ছিলো ... গাধার মত আক্কেল, ষাড়ের মত গলা আর গরিলার মত চেহারা। দস্যু কালা হিমুরেও ছাড়ায় গেছে!

ঠিক এইটাই তো বলতে চাইছিলা, নাকি? হাসি



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

তবে পশু পাখিদের একটা রোগ আমার বড় পছন্দ...
রাণীক্ষেত রোগ... সারাদিন ঝিমানো যায়... আহ্...

কয়দিন আগে আমার ফেসবুকের শিরোনাম ছিলো 'আমার রাণীক্ষেত রোগ হইছে... সারাদিন খালি ঝিমাই'
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রাশেদ এর ছবি

পশুশেণীর নামে গালি দিয়ে আমরা মানব পশুরা, জোর করে নিজেদের জাত ভুলে থাকতে, প্রমাণ করার চেষ্টা করি আমরা ওদের থেকে আলাদা—আশরাফুল মাখলুকাত। আসলে এর ফলে অজান্তেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের স্বরূপ। এভাবে জাতকে অস্বীকার করতে গিয়ে পরোক্ষভাবে জাতকে মেনে নেওয়া—এটা কি আমাদের বিবর্তন-ইতিহাসকেই সমর্থন করছে না?

হাসান মোরশেদ এর ছবি

যাক বন্যার দেখা পাওয়া গেলো আবার হাসি
-------------------------------------
"শিয়রের কাছে কেনো এতো নীল জল? "

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দুর্দান্ত লাগল। জয় বাবা পশুনাথ! হাসি
_________________________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?

কনফুসিয়াস এর ছবি

পড়ে একটা পাশবিক আনন্দ পেলাম। হাসি
জটিল্স লিখছেন!
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

নন্দিনী এর ছবি

বন্যা, অনেক দিন পর তোমার লেখা পড়লাম । লেখাটা দারুন হয়েছে । এরকম করে কখনও ভাবা হয়নি তো ঃ)!

নন্দিনী

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍দারুণ উপভোগ্য লেখা।

আরও একটা মনে পড়লো: "কুত্তার মতোন মদ খাওয়া" হো হো হো

রুশ ভাষায় গালি হিসেবে "কুকুর", "শুয়োর" বা "জন্তু" ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আবার আদর করে "পাখি", "মাছ", "খরগোস" বলার প্রচলনও আছে। "নেকড়ের মতো ক্ষুধার্ত", "অজগরের মতো শান্ত", "হাতির মতো তৃপ্ত" - এসব তো হরদমই শুনি।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও। - হুমায়ুন আজাদ

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।