অনন্ত সময়ের উপহার (১)

বন্যা এর ছবি
লিখেছেন বন্যা (তারিখ: সোম, ০৩/১২/২০০৭ - ২:৪৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিবর্তনের উপর লেখাটার প্রথম দু'টো অধ্যায় সচলে দেওয়ার পর অনেকদিন আর কিছু পোষ্ট করা হয়নি বিভিন্ন কারণেই। অনেকেই সে সেসময়ে অনুরোধ করেছিলেন সিরিজটা চালিয়ে যেতে, ব্যাক্তিগতভাবে ইমেইল করেও বলেছেন কয়েকজন। দেখা যাক এবার বাকিটা শেষ করা যায় কিনা।

আগের লেখায় দেখেছিলাম ডারঊইন কিভাবে একজন ধর্মযাজক থেকে বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন। আমরা অনেকেই ডারঊইনের কথা জানি, কিন্তু ডারউইনের দেওয়া এই যুগান্তকারী বিবর্তনের মতবাদের পিছনে যে আরও কত বিজ্ঞানীর কয়েক শ' বছরের অবদান লুকিয়ে আছে সে সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি। এই তত্ত্বটি আবিষ্কার করতে যেমন কয়েক শ' বছরের প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়েছিল তেমনি একে প্রতিষ্ঠা করতেও লেগে যাচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।

বিবর্তনবাদ একটি যুগান্তকারী তত্ত্ব, এটি তো আসলে শুধুই একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই নয়, এটা আমাদের চিরায়ত চিন্তাভাবনা, দর্শন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনকেও প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। ঘুণ ধরা পুরনো সব মুল্যবোধে তীব্রভাবে আঘাত হেনেছে সে, পুরনো ধ্যানধারণাকে ভেংগে চুরমার করে দিয়েছে! পৃথিবীতে যে গুটিকয়েক তত্ত্ব মানব সভ্যতার চিন্তাধারার ভিত ধরে নাড়া দিয়েছে তার মধ্যে এটি একটি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক থমাস কুন এ ধরনের যুগান্তকারী বিপ্লবাত্মক ধারণাকে 'প্যারাডাইম শিফট্‌' নামে অভিহিত করতেন। প্যারাডাইম শিফট্‌ কিন্তু হর-হামেশা ঘটে না। মানব সভ্যতার ইতিহাস তামা-তামা করে খুঁজলেও দু'একটির বেশি প্যারাডাইম শিফটেরর উদাহরণ পাওয়া যাবে না। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব ছিল একটি প্যারাডিম শিফট্‌, যা আমাদের চিরচেনা বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের ছবিটাই দিয়েছিল আমূল বদলে। ঠিক একই ভাবে জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্যারাডাইম শিফটের উদাহরণ হল বিবর্তনতত্ত্ব। কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রচার করার জন্য যদি ব্রুনোকে পুড়ে মরতে হয়, গ্যালিলিওর মত বিজ্ঞানীকে চার্চ নামক নিপীড়ক প্রতিষ্ঠানটির কাছে হাঁটু ভেঙে ক্ষমা ভিক্ষা করতে হয়, তাহলে বিবর্তনবাদের মত একটা প্রলয় সৃষ্টিকারী তত্ত্বকে আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে কি প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হবে তা তো বোঝা দুঃসাধ্য নয়। তাই আজ দেড়শ' বছর পরেও আমরা এই প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কোন অন্ত দেখি না। সে যাক, চলুন এখন দেখা যাক, কিভাবে বিবর্তন ঘটেছিল এই তত্ত্বটার...।

অনন্ত সময়ের উপহার
-----------------------------

ছয় হাজার বছর বনাম কোটি কোটি বছর! মানুষের সীমিত ৭০-৮০ বছরের জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকশো কোটি বছর হাতে পাওয়াকে অনন্ত কাল বলেই তো মনে হওয়ার কথা। আগের অধ্যায়ে আমরা জেমস হাটন আর চার্লস লায়েলের কথা শুনেছি, তারাই দিয়েছিলেন ডারউইনকে এই মূল্যবান 'সুদীর্ঘ সময়ের' উপহার। অনেকে মনে করেন ডারউইন এদের কাছ থেকে এই অমুল্য উপহারটা না পেলে তিনি তার বিবর্তন তত্ত্বটা এত সহজে প্রমাণ করতে পারতেন না! প্রাণের বিবর্তন ঘটতে, এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতি তৈরি হতে লাগে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি বছর! ডারউইন কিভাবে বিবর্তন এবং তার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসতেন যদি তার মাথাটা বাইবেলের এই ছয় হাজার বছরের গন্ডিতেই আটকে থাকতো? একটা বৈজ্ঞানিক মতের পূর্ব শর্তটাই যদি পূরণ করা না যায় তাহলে তত্ত্ব হিসেবে তাকে উপস্থাপন করা হবে কি করে? আদম হাওয়াকে না হয় ঈশ্বর চোখের পলকে তৈরি করে টুপ করে পৃথিবীর বুকে ফেলে দিতে পারে; কাল্পনিক গল্প ফাঁদতে তো আর সাক্ষ্য প্রমাণের দায়ভার থাকে না! কিন্তু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে মানুষের সামনে হাজির করতে হলে তো লাগে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, প্রমাণ এবং যুক্তির সমন্বয়!

ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের বুড়ো পৃথিবী কখন এই কাল্পনিক ছয় হাজার বছরের বেড়াজালে বাঁধা পড়ে গেলো; কখন তার অসীম ব্যাপ্তি বিলীন হয়ে গেলো মানুষ নামের এই দ্বিপদী প্রজাতিটার কল্পণা, কুসংস্কার আর ক্ষুদ্রতার মাঝে? খুব বেশীদিন আগে কিন্তু নয়, ১৬৫৪ সালে আইরিশ ধর্মজাযক জেমস আসার ( ১৫৮১-১৬৫৬) বাইবেলের সব জন্মতালিকা হিসেব কষে বের করেছিলেন যে আমাদের পৃথিবীর বয়স নাকি ছয় হাজার বছর! অবশ্য মনে করা হয় যে এই ধরনের একটা গল্প ইউরোপীয় সমাজে হয়তো আরও আগে থেকেই প্রচলিত ছিলো, কারণ এর বেশ কিছুদিন আগে লেখা শেক্সপীয়ারের As you Like It নাটকে ছয় হাজার বছর বয়সের পৃথিবীর উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। তবে জেমস আসারই এই ধারণাটাকে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলেন, এবং তার ফলাফল হলো ভয়াবহ - বিশেষ করে ভুতত্ত্ববিদ্যার ভবিষ্যৎ মুখ থুবড়ে পড়লো আরও কয়েকশো বছরের জন্য। আর তার হাত ধরে পিছিয়ে পড়লো বিবর্তনবাদসহ জীববিজ্ঞানের অন্যান্য অগ্রগতি।

আসলে তো বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের এই সংঘাত কোন নতুন ঘটনা নয়। ধর্ম কোন যুক্তি মানে না, ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে মানুষের মনের বিশ্বাস; আর এদিকে বিজ্ঞান হচ্ছে ঠিক তার উলটো, তাকে নির্ভর করতে হয় যুক্তির পরীক্ষালব্ধ প্রমাণের উপর। কোন অনুকল্পকে (Hypothesis) বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের (Theory) জায়গায় উঠে আসতে হলে তাকে কতগুলো সুনির্দিষ্ট স্তর পার হয়ে আসতে হয় - প্রথমে গভীর পর্যবেক্ষণ, যুক্তি, সমস্যার বিবরণ, সম্ভাব্য কারণ, ফলাফল ইত্যাদির উপর নির্ভর করে প্রকল্পটা প্রস্তাব করা হয়, তারপর তাকে প্রমাণ করার জন্য চলতে থাকে ক্রমাগত পরীক্ষা নিরীক্ষা। বিভিন্ন পরীক্ষার থেকে পাওয়া ফলাফল এবং তথ্যের মাধ্যমে যদি প্রকল্পটাকে প্রমাণ করা না যায় তাহলে তাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। আর যদি দীর্ঘ দিন ধরে বারবার করে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষার মাধ্যমে তাকে প্রমাণ করা যায় এবং অন্য কোন বিজ্ঞানী এই প্রমাণের বিরুদ্ধে কোন তথ্য হাজির না করেন তবেই তাকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মর্যাদা দেওয়া হয়। এখানেই কিন্তু শেষ নয়, তার সাক্ষ্য প্রমানের দায় কখনই শেষ হয় না, বিজ্ঞানে বিমূর্ত বা অনাদি সত্য বলে কোন কথা নেই। এই প্রক্রিয়ায় একটা প্রচলিত এবং প্রমাণিত তত্ত্বকেও যে কোন সময় আংশিক বা সম্পূর্ণ ভুল বলে প্রমাণ করা যেতে পারে, আজকে একটা তত্ত্বকে সঠিক বলে ধরে নিলে কালকেই তাকে ভুল প্রমাণ করা যাবে না এমন কোন কথা নেই। তাই আমরা দেখি, নিউটনের তত্ত্ব পদার্থবিদ্যার জগতে কয়েকশো বছর ধরে রাজত্ব করার পরও আইনস্টাইন এসে বিশেষ কোন কোন ক্ষেত্রে তার অসারতা প্রমাণ করে দিতে পারেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এরকম উদাহরণের কোন শেষ নেই, কারণ বিজ্ঞান কোন তত্ত্বকে পবিত্র বা অপরিবর্তনীয় বলে মনে করে না, বিজ্ঞান ধর্মের মত স্থবির নয়, সে গতিশীল। এখানেই তার সাথে ধর্মের পার্থক্য। ধর্ম মানুষকে প্রশ্ন করতে বারণ করে, হাজার বছরের পুরনো ধ্যান ধারণাগুলোকে বিনা দ্বিধায় মেনে নেওয়াই ধার্মিকের দায়িত্ব।

প্রশ্ন করা যাবে না সৃষ্টিকর্তা কিভাবে সৃষ্টি হল, পৃথিবী আসলেই সমতল কিনা, ধর্মগ্রন্থগুলোর কথা মত আসলেই সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে কিনা! চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে হবে যে একজন সৃষ্টিকর্তার হাতে মাত্র ছয় হাজার বছর আগে সমস্ত জীবের সৃষ্টি হয়েছিলো, আর তারা অপরিবর্তিত অবস্থায়ই রয়ে যাবে অনাদিকাল ধরে। হাজারো সাক্ষ্য প্রমান চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এর সবই ভুল, সবই মানুষের আদিম অজ্ঞানতার ফসল, কিন্তু তবুও এই মিথ্যাকেই যেনো মেনে নিতে হবে! আশার কথা হচ্ছে, কিছু সচেতন এবং সাহসী মানুষ বহু অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েও মিথ্যা এবং অন্যায়ের বিরদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, আর তারই ফলশ্রুতিতেই এগিয়ে গেছে মানব সভ্যতা।

সে যাই হোক, এখন তাহলে দেখা যাক, এই যাত্রায় মানব সভ্যতা কি করে বেড়িয়ে এসেছিল ছয় হাজার বছরের ভয়াবহ চক্রাবর্ত থেকে। চট করে একবার ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলিয়ে নিলেই আমরা দেখতে পাবো এখানেও সেই একই কাহিনী, ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মধ্যে সেই সংঘাতময় দ্বন্দ্বের ইতিহাস। সতেরশো শতাব্দীতে ধর্মভীরু জেমস আসার যখন জেনেসিস (বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত সৃষ্টতত্ত্ব বিষয়ক অংশ) থেকে হিসেব কষে পৃথিবীর বয়স বের করলেন তখন কিন্তু তার মনে সংশয়ের সৃষ্টি হল না। তিনি প্রশ্ন করলেন না যে তথ্যের ভিত্তিতে তিনি গণনা করছেন তা কি করে বা কোথা থেকে আসলো - দেড় হাজার বছর ধরে বাইবেলে স্রষ্টার বচন বলে যা বলা আছে তাকেই তিনি পরম সত্য বলে মেনে নিলেন। এর বেশ আগেই অন্ধকার মধ্যযুগের ইতি ঘটে গেছে ইউরোপে, রেনেসাঁর যুগ মোটে শেষ হয়েছে, আর বিজ্ঞান হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে। কোপার্নিকাস, গ্যলিলিওর মত কিছু সাহসী বিজ্ঞানীর হাত ধরে পদার্থবিদ্যা এগিয়ে যেতে শুরু করলেও, জীববিজ্ঞান এবং ভুতত্ত্ববিদ্যা তখনও ধর্মের অবৈজ্ঞানিক ও কুসংস্কারপুর্ণ ব্যাখ্যার কারাগারেই জিম্মি থেকে গিয়েছিল। পৃথিবীর বয়স, প্রাণের সৃষ্টি, বিকাশ, প্রজাতির সৃষ্টি বা বিলুপ্তির ব্যাখ্যার জন্য মানুষ তখন বাইবেল, কোরান বা অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থে বলা কাল্পনিক গল্পগুলোরই স্মরণাপন্ন হত। ষোলশ শতাব্দীর ইউরোপে যে কোন মানুষকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে আপনি জেনেসিসের গল্প ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেতেন না। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত ইউরোপীয়ানদের জিজ্ঞেস করলেই হয়তো পেতেন বেশ অন্য ধরণের একটা উত্তর - পৃথিবীর বয়স আসলে অনেক অনেক বেশি, বাইবেলের কথাগুলোকে রূপক হিসেবেই নেওয়া উচিত, বিজ্ঞানের সাথে একে গুলিয়ে ফেলার কোন দরকার নেই, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

চিন্তার এই উত্তরোণ কিন্তু একদিনে ঘটেনি। আসলে, বিজ্ঞানমনষ্ক কিছু মানুষ আরও অনেক আগে থেকেই এ সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে সেই ১৫১০ সালেই লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি ( ১৪৫২ - ১৫১৯) সামুদ্রিক প্রাণী এবং ভূত্বকের বিভিন্ন স্তরের শীলাস্তুপ পরীক্ষা করে তার ডাইরি তে লিখেছিলেন, পৃথিবী মোটেও ছয় হাজার বছরে বা নুহের প্লাবন থেকে তৈরি হয়নি, এর তৈরি হতে লেগেছে তার চেয়ে ঢের বেশি সময় । তারপর সতেরশো এবং আঠারশ শতাব্দীতে রেঁনে দেকার্তে (১৫৯৬ - ১৬৫০) থেকে শুরু করে বুঁফো (১৭০৭ - ১৭৮৮ ), কান্ট (১৭২৪ - ১৮০৪) পর্যন্ত অনেকেই তখনকার দিনের সীমিত জ্ঞানের আলোকে পৃথিবীর বয়স নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন ৩। তাদের মধ্যে অনেকেই ভুপৃষ্ঠ কিংবা পাহাড়ের গঠণ, ক্ষয়, শীলাস্তর, ভূত্বকের বিভিন্ন স্তরে পাওয়া ফসিল ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্েত আসেন যে, পৃথিবীর বয়স ছয় হাজার বছরের চেয়ে অনেক অনেক বেশী। এত বড় বড় পরিবর্তন এত কম সময়ে ঘটা সম্ভব নয় - পৃথিবীর মাটি এবং জলের মধ্যে বহুবার স্থান বদল হয়েছে, আজকে যে পাহাড়গুলো মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছে তারা অনেকেই হয়তো একসময় সমুদ্রের নীচে ছিলো! বুঁফো ১৭৭৪ সালে উত্তপ্ত অবস্থা থেকে পৃথিবীর ঠান্ডা হয়ে এই অবস্থায় আসতে কত সময় লাগতে পারে তার হিসেব করে প্রস্তাব করেন যে, পৃথিবীর বয়স ৭৫ হাজার বছর বা তারও বেশী হবে ১০।

তার পরপরই ১৮০০ শতব্দীর বিজ্ঞানের রঙ্গমঞ্চে পা রাখেলন ভূতত্ত্ববিদ জেমস হাটন (১৭২৬-১৭৯৭), তিনি তার সারা জীবনের ভূতাত্ত্বিক গবেষণার জ্ঞান থেকে ১৭৮৫ সালে বললেন - পৃথিবীর বয়স আসলে অনেক অনেক বেশী, পৃথিবী পৃষ্ঠের বিভিন্ন স্তরে যে রকমের ব্যাপক পরিবর্তন এবং বিবর্তন দেখা যাচ্ছে তা কোন মতেই কয়েক হাজার বছরের সৃষ্টি হতে পারে না, বহু কোটি বছর ধরে ধীর গতিতে এই পরিবর্তন ঘটে আসছে।

অনেকে মনে করেন জেমস হাটনই হচ্ছেন ভূতত্ত্ববিদ্যার জনক এবং তিনিই প্রথম বৈজ্ঞানিক উপায়ে বাইবেলের বিপর্যয়বাদ বা প্রলয়বাদের বিরোধিতা করে দেেপ তমিে বা সুদীর্ঘ সময়ের ধারণার প্রচলন ঘটান। তিনি বললেন, আরম্ভেরও যেমন কোন চিহ¡ পাওয়া যাচ্ছে না তেমনি শেষ হওয়ারও কোন ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। সে সময় পৃথিবীর বয়স হিসেব করে বের করার মত প্রযুক্তি হাতে না থাকায় তিনি ধরে নেন যে এর বয়স অসীম।

নারায়ণ সেন তার লেখা 'ডারউইন থেকে ডিএনএ' বইটিতে (২০০৪) চমৎকার কিছু পরিসংখ্যান এবং উদাহরণ দিয়েছেন - 'বিশদ ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের সূত্রে হাটন বুঝেছিলেন প্রকৃতি আদতে ধীর গতিতে পৃথিবীর চেহারা পালটায়, যতই আমরা ঝড়, ঝঞ্চা, তুফানে কাতর হই না কেন। এই ধীর গতির রূপটি কয়েকটি আধুনিক পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাবে। জমির ক্ষয়ের কারণে, গড়পড়তায় প্রতি হাজার বছরে, নিচু জমিতে আনুমানিক মাত্র এক থেকে তিন সেন্টিমিটার এবং পাহাড়ি এলাকায় কুড়ি থেকে নব্বই সেন্টিমিটার মতো উত্তোলিত হচ্ছে। পৌরাণিক কাল থেকে হিমালয়ের সম্ভবত তিনশো থেকে চারশো মিটারের মত উচ্চতা বেড়েছে। বস্তুত ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ বলছে ছয় কোটি বছর আগে হিমালয়ের তখনকার মাটি ও স্তর সমষ্টি সমুদ্রের তলদেশে ছিল' । কিন্তু এসব পরিসংখ্যাণ তো তখন হাটনের হাতের সামনে ছিলো না, সে সময়ের রক্ষণশীল ইউরোপীয় সমাজ তাই হাটনের মতবাদের তীব্র বিরোধিতা করে এবং এক সময় দেখা যায় তার নাম ইতিহাসের পাতা থেকে প্রায় মুছেই দেওয়া হয়েছে।

প্রায় এক প্রজন্ম পর যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন লায়েল। ১৮৩০ সালে লায়েল বললেন, পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরের পরিবর্তনগুলো ক্রমাগতভাবে ধীর প্রক্রিয়ায় অসীম সময় ধরে ঘটেছে, বাইবেলের পথ ধরে শুধুমাত্র নুহের মহাপ্লাবনের প্রলয়বাদ দিয়ে এদেরকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তিনি অবশ্য শুধু এই ধীর এবং ক্রমাগত প্রক্রিয়াকেই ভূস্তরের পরিবর্তণের একমাত্র কারণ হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন যা পরে ভুল বলে প্রমানিত হয়; আসলে ধীর এবং আকস্মিক - দুই পদ্ধতিতেই কোটি কোটি বছর ধরে এই পরিবর্তন ঘটে আসছে। লায়েল সে সময় অত্যন্ত সুচারুভাবে তখনকার রক্ষণশীল ধার্মিক সমাজে তার এই মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। সে সময় চার্চের মধ্যযুগীয় প্রবল প্রতাপ যেহেতু দুর্বল হয়ে আসতে শুরু করেছিলো তাই তাকে ব্রুনো বা গ্যালিলিওর মত অবস্থার শিকার হতে হয়নি। কিন্তু বিজ্ঞান তো আর সেখানে থেমে থাকেনি। ১৮৬২ সালে লর্ড কেলভিন তাপগতি বিদ্যার সূত্র ব্যবহার করে পৃথিবীর বয়স ৯৮ মিলিয়ন বা ৯ কোটি ৮০ লক্ষ বছর বলে ঘোষণা করলেও পরে ১৮৯৭ সালে তাকে সংশোধন করে ২০ -৪০ মিলিয়ন বছরে নামিয়ে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে রাদারফোর্ড প্রথমবারের মত রেডিও আ্যকটিভ পদ্ধতিতে পৃথিবীর বয়স মাপার কথা প্রস্তাব করেন। তার কয়েক দশকের মধ্যেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা সঠিকভাবে প্রমাণ করেন যে, পৃথিবীর বয়স আসলে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বা সাড়ে চারশো কোটি বছর ।

এবার তাহলে আবার ফিরে আসা যাক ডারউইনের গল্পে। হাটন এবং লায়েলের এই অবদানের হাত ধরেই চার্লস ডারউইন প্রকৃতিবিজ্ঞান বা জীববিজ্ঞানকে নিয়ে গেলেন এক নতুন স্তরে। তারাই উন্মুক্ত করে দিলেন অসীম সময় নিয়ে কাজ করার বহু শতাব্দীর বন্ধ দুয়ারটি। আমরা আগের অধ্যায়ে দেখেছি যে বীগেল যাত্রা থেকে ফিরে আসার সময়েই ডারউইন ক্রমশঃ জীবজগতের বিবর্তন বা ক্রমবিকাশ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে উঠছেন। তিনি নিশ্চিতভাবেই বুঝতে শুরু করেছেন যে, জীবজগৎস্থির নয়, কোন দিন ছিলোও না, সৃষ্টির আদি থেকেই এর বিবর্তন ঘটে আসছে। ইংল্যান্ডে ফিরে এসেই তিনি সারা পৃথিবী ঘুড়ে সংগ্রহ করা নমুনাগুলো নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজে লেগে যান। ১৮৩৮ সালে, আমরা দেখি, প্রথমবারের মত ডারউইন এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে লিখছেন,
'এভাবেই মূল প্রজাতি থেকে প্রকারণরা(Variation) বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত নতুন প্রজাতির জন্ম হয়, আর মূল প্রজাতিটি ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যায়, এবং তার ফলে টিকে যাওয়া প্রজাতির মধ্য বিচ্ছিন্নতার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ...' তিনি নিঃসংশয় হয়ে বললেন প্রজাতি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়, একযুগ থেকে আরেক যুগে অভিযোজনের (Adaptation) মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়।

কিন্তু এখন সমস্যা হল কিভাবে সবাইকে তিনি বোঝাবেন যে এতো দিন ধরে তোমরা যা বিশ্বাস করে এসেছো তা সবই ভুল! তোমাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত কাহিনীগুলো শুধু কল্পনাপ্রসুতই নয়, চরম মিথ্যা আর ধোঁকায় ভরা! তিনি কি জানেন না বাইবেলের কোন কথাকে চ্যালেঞ্জ করার পরিণতি, তিনি কি ভুলে গেছেন তার পূর্বসূরী কোপার্নিকাস, বৃদ্ধ গ্যলিলিও বা সাহসী ব্রুনোর কথা! তাহলে ডারউইন এখন কি করবেন?
চলবে...


মন্তব্য

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

অতীব চমৎকার।
ডিটেকটিভ গল্প লেখার দক্ষতায় এমনভাবে এমন জায়গায় থামলেন! এখন প্রতীক্ষার পালা আমার...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

হিমু এর ছবি
হাসান মোরশেদ এর ছবি

বন্যা-একটা তথ্য জানতে আগ্রহ হচ্ছে । শিশুতোষ মনে হওয়ার সম্ভাবনা বেশী । ক্লাশ ১২ 'র পর বিজ্ঞান বই ছুঁইনি আর হাসি
যাক, পৃথিবী বয়সের বিষয়ে বিজ্ঞান কি বলে? কবে এই গ্রহটার জন্ম হলো?

-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

বন্যা এর ছবি

হাসান, আর সবার মত বললাম না 'না না, কি যে বলেন, শিশুতোষ প্রশ্ন বলে কিছু নেই...' :)। তবে প্রশ্নটা বেশ সোজাসাপ্টা হলেও এর উত্তরটা বের করতে বিজ্ঞানীদের কিন্তু বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিল। মহাবিশ্বের উৎপত্তি প্রায় ১৪ শ' কোটি বছর আগে ঘটলেও আমাদের এই পৃথিবীর উৎপত্তি হয়েছে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বা সাড়ে ৪ শ' কোটি বছর আগে। আর তারপর প্রাণের জন্ম হতে লেগে গিয়েছিলো আরও প্রায় একশো কোটি বছর।
আসলে উপরের লেখাটার মধ্যেই পৃথিবীর বয়েসের কথা উল্লেখ করেছিলাম, দেখেন নি বোধ হয়ঃ

১৮৬২ সালে লর্ড কেলভিন তাপগতি বিদ্যার সূত্র ব্যবহার করে পৃথিবীর বয়স ৯৮ মিলিয়ন বা ৯ কোটি ৮০ লক্ষ বছর বলে ঘোষণা করলেও পরে ১৮৯৭ সালে তাকে সংশোধন করে ২০ -৪০ মিলিয়ন বছরে নামিয়ে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে রাদারফোর্ড প্রথমবারের মত রেডিও আ্যকটিভ পদ্ধতিতে পৃথিবীর বয়স মাপার কথা প্রস্তাব করেন। তার কয়েক দশকের মধ্যেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা সঠিকভাবে প্রমাণ করেন যে, পৃথিবীর বয়স আসলে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বা সাড়ে চারশো কোটি বছর ।

??? এর ছবি

একটা মজার এবং সর্বসাধারণের বোধগম্য বর্ণনা পড়েছিলাম একদা, কোনো এক বইয়ে। সেখানে একটা ক্যালেন্ডার দেয়া ছিল, এক বছরের। অর্থাত্ পৃথিবীর বয়স এক বছর হলে, মানে জানুয়ারিতে পৃথিবীর বা বিগব্যাং, সে ক্ষেত্রে মে-জুন মাসের দিকে প্রাণের (এক কোষী ছত্রাক) উদ্ভব ঘটে। মানুষের আবির্ভাব হয় ডিসেম্বর-এর ৩১ তারিখ রাত ১১-৫০ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে। সে হিসাব অনুযায়ী, ধরিত্রীর বয়স যদি এক বছর হয়, তাইলে মানব সভ্যতার বয়স শেষ দশ সেকেন্ড!
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

বন্যা এর ছবি

ধন্যবাদ সুমন, হ্যা এরকম বেশ কিছু মজার তুলনা আছে, বছর এমনকি দিনের সাথেও। আপনার বর্ণনাটাকে একটু বিস্তারিত করে বললে এরকম দাড়ায়ঃ
পৃথিবীর জন্ম প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিলো বছরের প্রথম দিন বা পয়লা জানুয়ারীতে, আর ফেব্রুয়ারী বা মার্চে প্রথম উৎপত্তি ঘটলো ব্যকটেরিয়া বা নীলাভ শৈবাল জাতীয় প্রথম আদি প্রাণের। এই আদি জীবদের প্রতিপত্তি চলেছে বহুকাল ধরে। বছরের অর্ধেকেরও বেশী পেরিয়ে অক্টোবর মাস এসে গেছে বহুকোষী জীবের বিকাশ হতে হতে। জটিল ধরণের কোন প্রাণীর সন্ধান পেতে হলে আপনাকে কিন্তু সেই নভেম্বর মাসে এসে পৌঁছাতে হবে, যদিও তাদের রাজত্ব তখনও শুধুমাত্র পানিতেই সীমিত। নভেম্বরের শেষের দিকে প্রথমবারের মত পানিতে চোয়ালওয়ালা মাছ আর মাটিতে উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, আর ওদিকে পানি থেকে ডাঙ্গায় বিবর্তিত হওয়া প্রাণীগুলো পৃথিবীর মাটিতে রীতিমত জাঁকিয়ে বসেছে ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে। জুরাসিক পার্ক সিনেমায় দেখা সেই বড় বড় ডায়নোসরগুলোর আধিপত্য শুরু হলো এ মাসের মাঝামাঝি, কিন্তু ২৬ তারিখ আসতে না আসতেই তারা আবার চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেলো পৃথিবীর বুক থেকে। খেয়াল করে দেখুন যে বছর শেষ হতে আর মাত্র ৫ দিন বাকি, কিন্তু এখনও মানুষ নামক আমাদের এই বিশেষ প্রজাতিটির কোন নাম গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে না পৃথিবীর বুকে। ডিসেম্বরের ২৬ তারিখের দিকে আমাদের পুর্বপুরুষের বিবর্তন শুরু হয়ে গেলেও বানর জাতীয় প্রাণীর দেখা মিলছে ২৯ তারিখে আর নর বানরের উৎপত্তি ঘটতে দেখা যাচ্ছে ৩০ তারিখে। বছরের শেষ দিনে এসে উৎপত্তি ঘটলো শিম্পাঞ্জির আর আমাদের এই মানুষ প্রজাতির কথা যদি বলেন তাহলে তাদের দেখা মিললো বছর শেষের ঘন্টা বাজার মাত্র ২০ মিনিট আগে। আমরা এই আধুনিক মানুষেরা ইউরোপ অষ্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছি এই তো মাত্র ৬ মিনিট আগে আর কৃষি কাজ করতে শিখেছি ঘড়িতে রাত বারোটা বাজার ১ মিনিট আগে

মাহবুব লীলেন এর ছবি

'আদম' শব্দটার মধ্যেই ছয় হাজার বছরের একটা ধাঁধা আছে
আদম বলতে দুটো জিনিস বোঝায়; এক আদম মানে মানুষ বা মানবজাতি
আর দুই আদম একজন মানুষের নাম। যিনি সেমেটিক ধর্মগুলোতে 'নবী/আদিপিতা' হিসেবে পরিচিত

নবী আদম ছয় হাজার বছর আগের মানুষ। কিন্তু সেমেটিক ধর্মগুলো ব্যক্তি (নবী) আদম আর মানবজাতি অর্থে ব্যবহৃত আদম শব্দে গোলমাল পাকিয়ে মানবজাতির সৃষ্টিকে ব্যক্তি আদমের জীবনীর সাথে মিশিয়ে ফেলেছে

অভিজিৎ এর ছবি

...গোলমাল পাকিয়ে মানবজাতির সৃষ্টিকে ব্যক্তি আদমের জীবনীর সাথে মিশিয়ে ফেলেছে...

আসলে গোলমাল পাকায় নাই। খুব সূক্ষ ভাবেই হিসাব করেছিলেন জেমস উশার (১৫৮১-১৬৫৬)। তার হিসাব মতে পৃথিবী তৈরি হয়েছিল খ্রীস্টপূর্ব ৪০০৪ সালের ২৩ এ অক্টোবর রবিবার (দ্যেখেন কি পুঙ্খানুপুংখ হিসাব!)। তারপর খ্রীস্টপূর্ব ২৩৪৯ সালে নূহের প্লাবন, তারপর খ্রীস্টপূর্ব ১৯২১ সালে খোদা আব্রাহামরে ডাক পাড়ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি সবই আছে তার ক্যালকুলেশনে।

গোলমাল আসলে বাঁধছে বাইবেলের বর্ননাকে অভ্রান্ত হিসবে মেনে নেওয়ায়। গণিতে ভুল নাই। গণিতের উৎসেই ভুল।

=============================
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

??? এর ছবি

ভালো লাগল ডারউইনের বিবর্তনবাদের আলোচনা। এটাকে দর্শনশাস্ত্রে মেকানিক্যাল ইভ্যুলিউশন কয়। বিবর্তনবাদের আরো অনেক তত্ত্ব আছে, যথা ল্যাপলাস, স্পেন্সার, বার্গসোঁ বা লয়েড মর্গান প্রমুখের নানারকম থিওরি। আশা করি পরের পোস্টে সেসবের আলোচনা পাবো।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

বন্যা এর ছবি

সুমন, আমি দর্শন শাস্ত্রে বেশ অজ্ঞ, তাই একটু কনফিউসড হয়ে যাচ্ছি। আমি এখানে জৈবিক বা প্রাণের বিবর্তনের কথা বলছি, আপনিও কি একই প্রসংগে বলছেন? আপনি যাদের কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে মরগ্যান তো সামাজিক বিবর্তনের কথা বলেছিলেন, এঙ্গেলস এর 'পরিবার, রাষ্ট্র ব্যাক্তিগত মালিকানা' বইয়ে তার বিশদ উল্লেখ আছে, মর্গ্যানের লেখা বইগুলোও আমি পড়েছি। কিন্তু বাইয়োলজিক্যাল বিবর্তনের সাথে তাকে মিলিয়ে ফেলা বোধ হয় ঠিক হবে না। একই কথা প্রযোজ্য স্পেন্সরের ক্ষেত্রেও, এই স্পেন্সর আসলে ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের বিকৃতির জন্য দায়ী।
স্পেন্সর ডারউইন কথিত জীবন সংগ্রাম (Social Darwinism)কে বিকৃত করে 'যোগ্যতমের বিজয়' (survival of the fittest) শব্দগুচ্ছ সামাজিক জীবনে ব্যবহার করে বিবর্তনে একটি অপলাপমূলক ধারণার আমদানী করেন। হার্ভার্ডের দর্শনের মূল নির্যাসটি ছিল - 'might is right' তিনি প্রচারণা চালান যে, গরীবদের উপর ধনীদের নিরন্তর শোষণ কিংবা শক্তিহীনদের উপর শক্তিমানদের দর্প এগুলো নিতান্তই প্রাকৃতিক ব্যাপার। প্রাকৃতিকভাবে বিবর্তনের ফলশ্রুতিতেই এগুলো ঘটছে, তাই এগুলোর সামাজিক প্রয়োগও যৌক্তিক। এ ধরনের বিভ্রান্তকারী দর্শনের ফলশ্রুতিতেই পরবর্তীতে বিভিন্ন শাষক গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ঔপনিবেশিকতাবাদ, জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্যকে বৈধতা দান করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন বিভিন্ন সময়। হিটলার তার নাৎসীবাদের সমর্থনে একে ব্যবহার করেন। ১৯৩০ সালে আমেরিকার ২৪ টি রাষ্ট্রে 'বন্ধ্যাকরণ আইন' পাশ করা হয়, উদ্দেশ্য ছিল জনপুঞ্জে 'অনাকাঙ্খিত' এবং 'অনুপযুক্ত' দুর্বল পিতামাতার জিনের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা। অর্থাৎ 'সামাজিকভাবে ডারউইনবাদের প্রয়োগ'-এর মাধ্যমে 'যোগ্যতমের বিজয়' নানা ধরণের নৈরাজ্যজনক প্রতিক্রিয়শীলতার জন্ম দিয়েছিল, আর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল, যা থেকে অনেকে এখনও মুক্তি পায় নি। কিন্তু সত্যি বলতে কি- ডারউইন কখনওই এধরনের 'যোগ্যতমের বিজয়'-এর কথা বলেন নি, কিংবা তার প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বকে কখনই সামাজিকজীবনে প্রয়োগ করার কথা ভাবেননি।
প্রকৃতিতে কিছু ঘটে বলেই তা সামাজিক জীবনেও প্রয়োগ করা উচিৎ - এ ধরণের চিন্তাধারা এক ধরনের কুযুক্তি বা হেত্বাভাস । প্রাকৃতিক নির্বাচন আসলে প্রকৃতিতে প্রজাতির প্রতিযোগিতার মাধ্যমে টিকে থাকার কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথাই শুধু ব্যাখা করছে - সামাজিক জীবনে এর প্রয়োগের 'ঔচিত্য' নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাচ্ছে না। প্রকৃতিতে কিছু ঘটার অর্থ এই নয় যে তা সামাজিকভাবেও প্রয়োগ করতে হবে।

??? এর ছবি

বন্যা, আমি ডারউইনের জৈবিক বিবর্তনবাদ এবং তাকে ঘিরে যে বিশ্ববীক্ষার যে "প্যারাডাইম শিফট" ঘটে গেছিল তার কথাই বলছি। প্রাণের বিবর্তন নেহাত প্রাণের বিবর্তন তো নয়, আপনিই না বললেন:

বিবর্তনবাদ একটি যুগান্তকারী তত্ত্ব, এটি তো আসলে শুধুই একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই নয়, এটা আমাদের চিরায়ত চিন্তাভাবনা, দর্শন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনকেও প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে।

আমি সেই জায়গা থেকেই আলাপটা বুঝতে চাইছি। প্রকৃতিতে যা ঘটে তাকে দিয়ে সামাজিক জীবনকে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা হেত্বাভাস কেন হবে সেটা বোধগম্য হয় নি। আপনি নিশ্চয় অবগত যে যুক্তিশাস্ত্রে "কুযুক্তি" বা "হেত্বাভাস" একটা স্পেসিফিক টার্ম এবং সব ধরনের হেত্বাভাসেরই নির্দিষ্ট নাম আছে। প্রকৃতিতে ঘটা ঘটনাকে সামাজিক জীবনে দেখতে পাওয়ার প্রবণতা যদি হেত্বাভাস হয় তবে সেটি কোন্ ধরনের হেত্বাভাস? সেক্ষেত্রে আপনার যে বক্তব্য উদ্ধৃত করলাম সেটিই বা জৈবিক তত্ত্বকে অপরাপর ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে দেখছে কোন্ যুক্তিতে।

আমার বক্তব্য বলি: দর্শনশাস্ত্রে বিবর্তনকে একটু ভিন্নভাবে পাঠ করা হয়। ডারউইনের বিবর্তনবাদ গোটা বিবর্তনবাদের আলোচনার একটা অংশ মাত্র। যেমন অংশ ল্যাপলাস বা স্পেনসার বা বার্গসোঁ বা লয়েড মর্গান (লয়েড মর্গানকে আপনি বোধ হয় লুইস হেনরি মর্গ্যান ভেবেছেন, দুজন আলাদা ব্যক্তি)। দর্শন বলে জগতের বিবর্তনবাদী তত্ত্বগুলো দুই ধরনের: নিয়ন্ত্রণবাদ আর অনিয়ন্ত্রণবাদ। সেই অর্থে ডারউইনের জৈবিক বিবর্তনবাদ নিয়ন্ত্রণবাদ, কারণ সেখানে অতীত ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ করে। অতীতকে ব্যাখ্যা করেই ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা পাওয়া সম্ভব। এইটার সামাজিক চেহারাটা হল মার্কস এঙ্গেলসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যাকে অনেকে ঐতিহাসিক নিয়ন্ত্রণবাদও বলে থাকেন। এখন দেখা যাক ধর্ম জগতকে কিভাবে ব্যাখ্যা করে। ধর্ম পরকালকে ধ্রুব ধরে নিয়ে জগতের গতিপ্রকৃতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। এটাও নিয়ন্ত্রণবাদ, এখানে ভবিষ্যত অতীত এবং বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিষয়টা অনেক সংক্ষেপে বললাম।

এখন তৃতীয় একটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে বিবর্তনবাদের পক্ষে, যেখানে জগতের বিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণবাদের খপ্পর থেকে বের করে আনার চেষ্টা আছে। বার্গসোঁ-র ক্রিয়েটিভ ইভ্যুলিউশন বা লয়েড মর্গানের ইমারজেন্ট ইভ্যুলিউশন সে ধারার মতবাদ। এগুলো নিরেট দার্শনিক মতবাদ, এদের পেছনে খুব কমই ইম্পিরিক্যাল সাপোর্ট আছে। কখনো কখনো একেবারেই স্পেকুলেটিভ। তাও এদের গুরুত্ব এখানে যে, জগতের বিবর্তনকে তারা নিয়ন্ত্রণবাদের বাইরে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। ধর্ম যেখানে এক নিরাকার ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণে জগতকে ঠেলে দিয়ে মহা সুখে আছে, ডারউইনের মতবাদ এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যথাক্রমে অতীত ও ইতিহাসকে ঈশ্বর ঠাউরে নিয়েছে বলে এরা মনে করেন। সন্দেহ নেই এরা ডারউইনের মাপের বিবর্তনবাদী নন, কিন্তু ডারউইনের ডিটারমিনিস্টিক অবস্থানটি তুলে ধরেছেন কিন্তু এরাই। আমি ব্যক্তিগতভাবে বার্গসোঁর সাগরেদ।

..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

বন্যা এর ছবি

সুমন, আপনি এখানে অনেকগুলো বিষয় উত্থাপন করেছেন, যার উত্তর দিতে গেলে একটা পুরো লেখা লিখতে হয়। আমি সংক্ষেপে যতটুকু বলা যায় তা দিয়ে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো।

প্রকৃতিতে ঘটা ঘটনাকে সামাজিক জীবনে দেখতে পাওয়ার প্রবণতা যদি হেত্বাভাস হয় তবে সেটি কোন্ ধরনের হেত্বাভাস? সেক্ষেত্রে আপনার যে বক্তব্য উদ্ধৃত করলাম সেটিই বা জৈবিক তত্ত্বকে অপরাপর ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে দেখছে কোন্ যুক্তিতে।

হেত্বাভাস্টির নাম ' Naturalistic fallacy'। একে 'The Natural Law fallacy / Appeal to Nature' বলা যেতে পারে। আমি একটা উদাহরন দেই। আইন্সটাইন থিওরী অব রিলেটিভিটি পদার্থবিজ্ঞানে প্রদান করার পর অনেকে ভুল ভাবে সেটা সামাজিক জীবনে প্রয়োগ করতে গিয়ে বলতে শুরু করেন – সব কিছুই আপেক্ষিক। আসলে তো সব কিছু আপেক্ষিক নয়। অনেক কিছুই আপেক্ষিক নয়। একটি উদাহরণ হতে পারে ‘আলোর গতিবেগ’। যাহোক মুল কথা হচ্ছে, জীববিজ্ঞান বা পদার্থবিজ্ঞানের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এবং প্রয়োগিত একটি তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানে প্রযুক্ত হতে হবেই- এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। প্রকৃতিতে তো অনেক প্রানি তার সন্তানকে হত্যা করে। ক্যানিবলিজম, মারামারি, হানাহানি সেখানে দুর্লভ নয়। তা বলে কি মানব সমাজেও সেটার প্রয়োগ ‘যৌক্তিক’ বলে ধরে নিতে হবে? স্পেনসার যখন ডারউইনের তত্ত্বকে যান্ত্রিকভাবে সামাজিক জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন, তখন তার জীববিজ্ঞানের কন্টেক্সট মাথায় থাকে না। প্রকৃতিতে কেবল নিরন্তর প্রতিযোগিতাই চলছে না, বরং বিভিন্ন ধরণের পারষ্রিক সহযোগিতা, মিথোজীবীতা কিংবা সহ-বিবর্তনও বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। জীবের টিকে থাকার জন্য এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অথচ, সামাজিক বিবর্তনবাদে এই ব্যাপারগুলো অস্বীকার করে কেবল ‘যোগ্যতমের বিজয়’-এর কথাই কেবল সোচ্চারে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, বিবর্তন ঘটার জন্য প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরণের প্রকারণ অবশ্য প্রয়োজনীয়। জনপুঞ্জে জেনেটিক প্রকারণ না থাকলে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া কাজই করতে পারবে না। কিন্তু সামাজিক ডারউইনবাদের প্রবক্তারা জোর করে 'অনাকাঙ্খিত' জিনকে হটিয়ে দিয়ে প্রকারণকে দূর করার জন্য তৎপর হয়েছিলেন। এ জন্য বহু আগেই 'সামাজিক ডারউইনবাদ' সচেতন বৈজ্ঞানিক মহল থেকে পরিত্যক্ত হয়েছে। অনেকেই অজ্ঞতার কারণে এখনো ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাথে পরিত্যক্ত সামাজিক বিবর্তনবাদকে গুলিয়ে ফেলেন।
আমি আর আপনি বোধ হয় এখানে দুই কথা বলছি। ডারউইনের বিবর্তনবাদ একটি জৈবিক প্রক্রিয়া এখানে বিবর্তনের খুঁটিনাটি ডিটেইল বা টেকনিক সমাজ বা সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করছে না, বরং জীবের বিবর্তন নিয়ে মানুষ এবং তার গড়া ধর্মীয় মতবাদগুলো যে স্থবির মতবাদের জন্ম দিয়েছিল তা ভেঙ্গে পড়েছে। এখানে কন্সেপ্টএর কথা বলেছি, কিন্তু এটা টেকনিকালি কিভাবে কাজ করে সেটা জীবজগতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও অন্যত্র হবেই এমন কোন কথা নেই। আমি সে গুরুত্বের প্রেক্ষাপটে বলেছিলাম 'বিবর্তনবাদ একটি যুগান্তকারী তত্ত্ব, এটি তো আসলে শুধুই একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই নয়, এটা আমাদের চিরায়ত চিন্তাভাবনা, দর্শন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনকেও প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে।'

আমার বক্তব্য বলি: দর্শনশাস্ত্রে বিবর্তনকে একটু ভিন্নভাবে পাঠ করা হয়। ডারউইনের বিবর্তনবাদ গোটা বিবর্তনবাদের আলোচনার একটা অংশ মাত্র। যেমন অংশ ল্যাপলাস বা স্পেনসার বা বার্গসোঁ বা লয়েড মর্গান (লয়েড মর্গানকে আপনি বোধ হয় লুইস হেনরি মর্গ্যান ভেবেছেন, দুজন আলাদা ব্যক্তি)। দর্শন বলে জগতের বিবর্তনবাদী তত্ত্বগুলো দুই ধরনের: নিয়ন্ত্রণবাদ আর অনিয়ন্ত্রণবাদ। সেই অর্থে ডারউইনের জৈবিক বিবর্তনবাদ নিয়ন্ত্রণবাদ, কারণ সেখানে অতীত ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ করে। অতীতকে ব্যাখ্যা করেই ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা পাওয়া সম্ভব। এইটার সামাজিক চেহারাটা হল মার্কস এঙ্গেলসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যাকে অনেকে ঐতিহাসিক নিয়ন্ত্রণবাদও বলে থাকেন।

আর আপনি ডারউইনবাদের সাথে অন্যদের নামোল্লেখ করে যেগুলো বলেছেন তারা মনে হয় কেউই জৈববিবর্তন বা প্রানীজগতের বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কথা বলছেন না (আমি যদি ভুল বুঝে না থাকি)। আমরা জীববিজ্ঞানে 'ডিটারমিনিস্টিক' বলতে স্পেসিফিক ব্যাপার বুঝে থাকি। যেমন, বিবর্তনের অন্যতম কারণ 'প্রাকৃতিক নির্বাচন' কিছু নিয়ম মেনে চলে , সে অর্থে ডিটারমিনিস্টিক, কিন্তু আবার মিউটেশনগূলো রান্ডম। সে অর্থে অনিয়ন্ত্রিত। বিবর্তন তত্ত্বের মধ্যে সেই অর্থে নিয়ন্ত্রণবাদ আর অনিয়ন্ত্রণবাদ দুটো দিকই আছে। আপনি যেভাবে বলেছেন 'সেই অর্থে ডারউইনের জৈবিক বিবর্তনবাদ নিয়ন্ত্রণবাদ, কারণ সেখানে অতীত ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ করে' এটাও বোধ হয় ঠিক নয়, কারণ বিবর্তনবাদ কোনভাবেই ভবিষ্যতে কোন পথে বিবর্তন হবে তা নির্দিষ্ট করে বলে দিতে পারে না। এখানে মোদ্দা কথাটা হচ্ছে যে, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আর সামাজিক বা দার্শনিক তত্ত্বকে বোধ হয় আলাদা করে দেখতে পারতে হবে। কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যদি সঠিক হয় তাহলে তা সামাজিক 'সঠিকতা', 'নৈতিকতা', 'নিয়ন্ত্রনবাদ' ইত্যাদির উপর নির্ভর করে না, এখানে তত্ত্বটা যা তাইই। কিন্তু সামাজিক তত্ত্বের বেলায় মনে হয় ব্যাপারটা সেরকম নয়।

এ প্রসঙ্গে অন্য একটি কথা বলি, বিখ্যাত ডারউইনবাদী দার্শনিক Daniel C. Dennett এর Darwin's Dangerous Idea: Evolution and the Meanings of Life বইটি একটি চমতকার বই, না পড়ে থাকলে পড়ে দেখতে পারেন, হয়তো ভালো লাগবে।
অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে এখানে, আজকের মত এখানেই ক্ষ্যমা দিলাম, ব্যাপারগুলো ঠিক বোঝাতে পারলাম কিনা জানি না। অনেক ধন্যবাদ দর্শনের আ্যঙ্গেল থেকে আলোচনাটা করার জন্য। এক ডারউইনের তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক দিকগুলো বুঝতেই আমার প্রায় ৫ বছর সময় কেটে গেছে। এর উপর আপনাদের মত সামাজবিজ্ঞানী বা দার্শনিকদের কথা শুনলে তো আমি রীতিমত ভয় পেয়ে যাই, দর্শন বুঝতে গেলে হয়তো বাকি জীবনটাই কেটে যাবে...ঃ)।

বন্যা

??? এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ বন্যা, সময় দেয়ার জন্য। আমি জীববিজ্ঞানের ছাত্র নই, দর্শন ও সমাজবিদ্যার লোক। ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিস হাতে নিয়েছি, কিন্তু পড়বার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে বিবিধ জ্ঞানকান্ডগুলোর যোগাযোগে বিশ্বাস করি, এবং মনে করি একের সাপেক্ষে অন্যকে বিচার করবার দরকার আছে। শুধু বৈজ্ঞানিক মহলে নয়, সমাজবিদ্যার ডিসকোর্সেও "সোশাল ডারউইনিজম" পরিত্যক্ত হয়ে গেছে, কারণ ঐ ডিটারমিনিজম। সেটাকেই তাত্ত্বিকেরা বলছেন অতীতের আয়নায় ভবিষ্যতকে দেখা। বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতকে অতীতের যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে মানা। সেই অর্থে অতীত ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ করে ডারউইনের মতবাদে। আপনি দেখিয়েছেন কিভাবে সোশাল ডারউইনিজম জৈবিক বিবর্তনের নিয়মকে সমাজে প্রয়োগ করতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা করে ছেড়েছে। এখন কথা হচ্ছে, জীবের যেমন একটা বিবর্তন আছে তেমনি সমাজেরও একটা বিবর্তন আছে। জৈবিক বিবর্তনের মূলনীতি দিয়ে সামাজিক বিবর্তনের ধারাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসি হয়, আপনি সুন্দর বলেছেন। আমিও তাই বলি, হালের সমাজবিদ্যাও একই কথা বলে।

তাহলে কথা হচ্ছে, সামাজিক বিবর্তনের নিয়মগুলো কী হতে পারে? আপনি বলছেন যে বিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা ও দর্শনকে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করতে পারতে হবে। এখানে আমার স্পষ্ট দ্বিমত আছে। আমি মনে করি, এসব জ্ঞানকান্ডকে পরস্পর দিয়ে পরীক্ষিত হতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা একটা সার্বজনীন জ্ঞানের রূপরেখা পেতে সক্ষম হব। নইলে, সবকিছুই বিশেষায়িত থাকবে, পরীক্ষাগারের বাইরে জ্ঞানকে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না।

দর্শনশাস্ত্র মূলত বিভিন্ন বিজ্ঞানের মূলনীতিগুলো, যেগুলো ঐ সমস্ত বিজ্ঞান বিনাবিচারে মেনে নেয়, সেগুলোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে। সেই অর্থে ডারউইনের "প্রাকৃতিক নির্বাচন"এর নীতিকে দর্শনশাস্ত্রে নিয়ন্ত্রণবাদ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। আমি যাদের নাম বলেছি তারা সেই নিয়ন্ত্রণবাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। এরা কেউই জৈবিক নিয়ন্ত্রণবাদী নন, তবে এরা সবাই সোশাল ডারউইনবাদের প্রতিপক্ষ। সামাজিক বিবর্তনের ক্ষেত্রে জৈবিক বিবর্তনের নীতি পুরোপুরি খাটে না এটা তাদেরও অভিমত। এখানে আপনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য দিয়েছেন: প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ন্ত্রণবাদী হলেও মিউটেশনগুলোকে র‌্যানডম বলার মাধ্যমে এখানে অনিয়ন্ত্রণবাদেরও জায়গা করা হয়েছে। সেই অর্থে ডারউইনিজম একাধারে নিয়ন্ত্রণবাদ ও অনিয়ন্ত্রণবাদ। এইতো সুন্দর একটা সুযোগ তৈরি হল বিজ্ঞানের সাথে সমাজবিদ্যা ও দর্শনের দেনদরবার করার।

জীবের বিবর্তন নিয়ে আপনি আরো বলবেন আমরা শুনব। সেই সাথে এটাও ভাবব যে, আমাদের সমাজটিও বিবর্তিত হয়ে চলেছে। সেই বিবর্তনের মূলনীতি কি? সেই মূলনীতি ডারউইনের মূলনীতি থেকে কতটা ভিন্ন? কেন ভিন্ন? সমস্ত ভিন্নতার মাঝে কি অখন্ডতা বা ঐক্যের কোনো মূলসূত্র নেই?

সমাজবিদ্যা ও দর্শনের প্রসঙ্গ নিয়ে আরো কম ভয় পেতে হবে! আপনি এত ভয় পাওয়া ধরলে শেষে আমরাও তো বিজ্ঞানকে ভয় পাওয়া শিখে ফেলব! হাসি তাইলে কি যোগাযোগ সম্ভব?

চালিয়ে যান। ডারউইনের কথাই বরং শুনি আপনার কাছ থেকে।

..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।