শান্তির দূত না ধর্মব্যবসায়ী?

দিগন্ত এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত (তারিখ: সোম, ২১/০১/২০০৮ - ২:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লোকে ধার্মিক হলে দেশে নাকি শান্তি বজায় থাকে। কথাটা কতটা ঠিক সেটা তর্কসাপেক্ষ, কিন্তু আজকের দুনিয়াতে দাঁড়িয়ে আমার ধার্মিক দেশের কথা ভাবলেই ধর্মব্যবসার কথাই আগে মনে হয়। ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধার্মিকদের ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বানানো বা ভুল তথ্য উপস্থাপনা করে তাদের একরকম বোকা বানিয়ে নিজেরা খ্যাতি অর্জন করে। আমাদের ধার্মিক দেশে কোনোকালেই ধর্মব্যবসায়ীর অভাব দেখা যায় না। সে পুরোনো আমলের তন্ত্র-মন্ত্র হোক বা আধুনিক যুগের বাস্তুশাস্ত্র - বিশ্বাসের নামে সবাই একদলে। ভাবখানা এমন যে - “এত লোকে যখন বিশ্বাস করে তখন ...”।

তা প্রথমে নজর দেওয়া যাক ভারতের আপাতত সফলতম ধর্মব্যবসায়ীর দিকে। তিনি হলেন বিশ্বশান্তির উদ্যোক্তা শ্রী শ্রী রবিশঙ্করআর্ট অব লিভিং বলে একধরণের যোগক্রিয়ার কোর্সের উদ্ভাবক এই স্বনামধন্য গুরু হলেন কর্নাটকের লোক। আর্ট অব লিভিং একটি অদ্ভুত কোর্স যার মূল লক্ষ্য হল হতাশা দূর করা ও মানসিকভাবে মানুষকে চাঙ্গা করে তোলা। রবিশঙ্করের মূল দাবী - নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস হল মন আর শরীরের যোগসূত্র। সুদর্শন ক্রিয়া নামক একটি যোগক্রিয়ার মাধ্যমে উনি এই দাবীকেই জনসমক্ষে এনেছেন। আমেরিকায় একটি আর্ট অব লিভিং কোর্সের খরচা $৩৭৫। তবে সংগৃহীত এই টাকার সবটাই জনকল্যাণে ব্যবহৃত হয়।

কতটা বড় রবিশঙ্করের বৃত্ত? ২০০৭ সালে ইরাকের জনগণের হতাশা দূর করতে উনি ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ইরাকে গিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাথে দেখা করেন। ২০০৬ সালে আর্ট অব লিভিং-এর রজতজয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষে উপস্থিত হয়েছিলেন ভারতের প্রেসিডেন্ট, হল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আর ঘানার রাজা।

এহেন রবিশঙ্করের উদ্ভাবিত সুদর্শন ক্রিয়া যতক্ষণ মানসিক সমস্যার বৃত্তে আবর্তিত হয় ততক্ষণ নাহয় তা গ্রহণযোগ্য থাকে, কিন্তু যখন তা দুরারোগ্য ক্যান্সার বা এইডসের মত রোগ নিরাময়ের আশ্বাস দেয় তখনই ধর্মব্যবসার স্বরূপ উন্মোচিত হয়। ভারতের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সের দাবীমতে, সুদর্শন ক্রিয়া হতাশা কাটানোর জন্য বড়জোড় ধ্যানের মত আরেকটি যোগক্রিয়া হিসাবে স্বীকৃতি পেতে পারে। তা কি ভাবে সেই এইডসের মত রোগ নিরাময় ঘটে? খুবই সহজ পদ্ধতি - রবিশঙ্করের মতে, আমরা জীবনে আমাদের ফুসফুসের ক্ষমতার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশমাত্র ব্যবহার করি। আর আমরা ফুসফুস যত ভাল ভাবে ব্যবহার করতে শিখব, তত আমাদের শরীরে অক্সিজেনের যোগান বাড়বে আর সেই বাড়তি অক্সিজেন শরীরের জীবাণুনাশক হিসাবে কাজ করবে (!!)। এই দাবীর ওপর ভিত্তি করে উনি জানিয়েছেন, এইডসের জীবাণুও নাকি এরকম অক্সিজেন-প্রধান শরীরে বেঁচে থাকতে পারে না। সুতরাং, এটাই এইডস নিরাময়ের আদর্শ পথ। একই কথা ক্যান্সারের জন্য প্রযোজ্য। এই দাবী অবশ্য ফুতকারে উড়িয়ে দিয়েছে আমেরিকার স্বাস্থ্য-বিভাগ। তাদের মতে যোগক্রিয়া হিসাবেও এই সুদর্শন ক্রিয়া খুব একটা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আর প্রদত্ত প্রমাণাদি থেকে কোনো রোগ নিরাময়ের সাথেই এই যোগক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক সম্পর্কস্থাপন করা সম্ভব নয়। সম্প্রতি আরো ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এ নিয়ে, আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে আরো সত্য বেরিয়ে আসবে এ বিষয়ে।

রোগ-নিরাময়ে সিউডো-সায়েন্সের প্রয়োগ এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর। মামুলী রোগ বা সাময়িক হতাশা নয়, উনি “ব্যক্তিগত বিজ্ঞানের” হাত লাগিয়েছেন সোজা দুরারোগ্য ব্যাধিতে। আর ধার্মিক দেশে অন্ধবিশ্বাসীদের প্রকোপে তার জনপ্রিয়তাও গগনচুম্বী।

জনপ্রিয়তার কথা যদি বলতেই হয় তবে আরেক ভারতীয়র নাম না বলে থাকা যায় না। উনি হলেন পিস টিভির প্রতিষ্ঠাতা জাকির নায়েক। ডাক্তারী পাশ করা এই শান্তি-প্রচারক ধর্মব্যবসায়ী বিভিন্ন মঞ্চে ইসলাম ও শারিয়া সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করেন। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তিনি যা তথ্য ব্যবহার করেন তার অধিকাংশই তার নিজস্ব।

কেমন তার তথ্যভান্ডার? একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। এক জায়গায় দেখলাম পুরুষের বহুবিবাহের স্বপক্ষে উনি দাবী জানিয়েছেন পৃথিবীতে মহিলার সংখ্যা পুরুষের থেকে বেশী (দক্ষিণ এশিয়াতে ভ্রূণহত্যার কারণে ব্যাপারটা উলটো)। আমেরিকায় ওনার দাবী মতে পুরুষের সংখ্যা মহিলার তুলনায় সাড়ে সাত মিলিয়ন কম, রাশিয়ায় সংখ্যাটা নয় মিলিয়ন। কিন্তু আমেরিকার সরকারি (সি-আই-এ) তথ্যসূত্র থেকে দেখা যায় আমেরিকায় মহিলার সংখ্যা ৫ মিলিয়ন বেশী বটে কিন্তু তার জন্য দায়ী হল ৬৪ বছরের বেশী বৃদ্ধারা। ০-৬৪ বছর পর্যন্ত পুরুষের সংখ্যা বেশী (জন্মাবস্থায়ও তাই)। আর মহিলার সংখ্যা বেশী বয়সে বাড়ার কারণ তাদের গড় আয়ু পুরুষদের তুলনায় ৫ বছর বেশী। তাহলে কি ভাবে এই তথ্য বিবাহের কাজে ব্যবহার করা যায়, যেখানে বিশ্বে ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ব্যতিরেকে বাকি বিবাহ ৬৪ বছরের নিচেই সম্পন্ন হয়?

এরপরে আসা যাক শূকরের মাংসের (পর্ক) ব্যাপারে ওনার মতামত সম্পর্কে। ওনার দাবি হল শূকর প্রাণী হিসাবে অত্যন্ত নোংরা বলে তার মাংস খাওয়া নিষেধ - কিন্তু নোংরা জীবের মাংসও যে নোংরা হবে সে নিয়ে (এমনকি সেদ্ধ করার পরেও) কোনো বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ তার কাছে নেই। সবথেকে মারাত্মক তুলনা উনি শুরু করেছেন শেষ অনুচ্ছেদে গিয়ে। তার দাবী শূকরের মাংস খেলে নাকি মানুষ শূকরের মত ব্যবহার করে (পত্নী-পরিবর্তন করতে শুরু করে)। শুধু তাই নয় উনি এ বিষয়ে আমেরিকানদের শূকরের সাথে তুলনা করেছেন, যেটি শুধু জাতিবিদ্বেষ সৃষ্টিকারীই নয়, নিজের মত প্রচারের জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও বটে (লক্ষ্যণীয় সবথেকে বেশী পর্ক খাওয়া হয় চিনে, উনি চিন নিয়ে কিন্তু কিছু বলেননি)।

এছাড়াও উনি মুসলিমদের সুদ-লেনদেন করে এমন ব্যাঙ্কে কাজ করতে নিষেধ করেন, দত্তক সন্তানকে আপন সন্তানের মত সমানাধিকার দিতে বারণ করেন আর বিশেষ কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র ব্যতিরেকে গান বা সঙ্গীতচর্চা থেকে বিরত থাকতে বলেন।
এগুলোর যে কোনোটিই সাধারণ মানবাধিকারের সরাসরি পরিপন্থী এবং এর পক্ষে সমাজ বা বিজ্ঞানের দিক থেকে কোনো সায় নেই।

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা একটি মহান উদ্যোগ। তার জন্য নিজ নিজ পথও তারা বেছে নিতে স্বাধীন। কিন্তু বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা বা মানবমুক্তির জন্য এত মিথ্যার আশ্রয় কেন নিতে হবে সেটাই আমার প্রশ্ন।


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধর্ম আর গণতন্ত্র শান্তি আনেনি ইতিহাসে কোথাও
শান্তিপূর্ণভাবে লিখে গেছে দাসত্ব আর হত্যার কলাকৌশল

এমন কোনো ধর্ম নেই মানুষকে নরকে পাঠায়নি যারা;
মানুষকে বাতিল বলেনি যারা
এমন কোনো গণতন্ত্র নেই মানুষকে বন্দি করেনি যারা;
মানুষকে হত্যা করেনি যারা

সব ধর্মই মানুষকে পাপী বলে শেষ করেছে অলৌকিক বাণী
সব গণতন্ত্রই মানুষকে অপরাধী বলে শেষ করেছে ইশতেহার ওদের

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

লেখাটির শিরোনামে জিজ্ঞাসাসূচক চিহ্নটি অতিরিক্ত বলেই মনে হচ্ছে আমার কাছে। রিচার্ড ডকিন্সের বিখ্যাত ডকুমেন্টারি ছবির নামের শেষের জিজ্ঞাসাবোধক চিহ্নটিও (The Root Of All Evils?) বাহুল্য বলেই বোধ হয়।

ধর্ম যে এখন খুব লাভজনক ব্যবসা, এ নিয়ে সংশয় প্রকাশের অবকাশই নেই। নব্বই দশকের মাঝামাঝি এক রুশ পত্রিকায় পড়েছিলাম, ভাটিকানের পোপের প্রতিটি বিদেশ ভ্রমণের পেছনে গড়ে খরচ হয়, কয়েক মিলিয়ন ডলার (যদ্দূর মনে পড়ছে, সাতাশ)! কোত্থেকে আসে এতো টাকা?

মিলিয়ন ডলার থেকে নেমে আসা যাক ধর্মব্যবসার অতি ছোট স্কেলে। রুশ ইন্টারনেটের সাইটগুলোয় একটা ছবি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এক চার্চে ঝোলানো নোটিস, আর তাতে লেখা: "চার্চের বাইরে কেনা মোমবাতি আশানুরূপ ফল দেবে না।"

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

দিগন্ত এর ছবি

""চার্চের বাইরে কেনা মোমবাতি আশানুরূপ ফল দেবে না।""

-- দারুন দারুন!!!


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

সবজান্তা এর ছবি

যদি ভুলে না যেয়ে থাকি, এই ভদ্র লোক সম্পর্কে বছর দুয়েক আগে শারদীয়া দেশ পত্রিকা ( কিংবা আনন্দবাজার বা অন্যকিছুতে ) একটা লেখা পড়েছিলাম। খুব সম্ভবত শংকরের লেখা। সেখানে অবশ্য এই অন্ধকার দিকগুলি আসেনি, বরং গুনগানই ছিল সর্বত্র। আজ অন্য দিকগুলোও জানতে পারলাম।

বেশ ! বেশ!!
------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

দিগন্ত এর ছবি

"বরং গুনগানই ছিল সর্বত্র। "

- বুঝতেই পারছেন, কি লেখা পড়েছেন। লোকে সবটা হয়ত জানে না, কিন্তু আমি এক আর্ট অব লিভিং-ওয়ালার সাথে তর্কে গিয়ে এত কিছু জানতে পারলাম।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

শিক্ষানবিস এর ছবি

জাকির নায়েকের আরও কিছু বিষয় এখানে উঠে এসেছে। খুব ভাল লাগল। কোন এক ফাঁকে মিস হয়ে গিয়েছিল। অনেক দেরি করে ফেললাম।
রবিশঙ্কর নিয়েও অনেক কিছু জানতে পারলাম। জাকির নায়েক আর রবিশঙ্কর মিলেও তো একটা প্রোগ্রাম করেছিল: Concept of God নামে।
তুজনে একসাথে অসদুপায়ে অর্থ কামানোর ধান্ধায় নেমেছে। এদের মুখোশ উন্মোচন হওয়া খুবই দরকার।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।