একটি শহর

দুর্দান্ত এর ছবি
লিখেছেন দুর্দান্ত (তারিখ: বুধ, ০৯/০৩/২০১১ - ১:০০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কয়েকটি ঘর, কয়েকটি মহল্লা। রাস্তা দালান বাজার বিজলী-খাম্বা পানের-পিক কাক আর বস্তি। ইট কাঠ ইস্পাত কাঁচ আর ঘাম মিশিয়ে যে সরলরেখার সমাবেশ। একে আমরা শহর বলতে শিখি। এর সাথে আমাদের পরিচিতি ঘটে যায় অনেক আগেই। কিন্তু ঠিক সেই শহরটিই যে একটি জীবন্ত প্রাণী, সে রহস্য ক্রমাগত আমাদের আওতার আবডালে চলে যেতে থাকে।

আপনি জানেন কিনা জানিনা। পৃথিবীর সব শহরেরই কিন্তু একটি আত্মা থাকে। আত্মারা যেমন হয় আরকি। তাদের বয়েস নেই, সময় নেই, শুরু নেই, শেষও নেই। অনেকটা ক্যামেরায় বন্দী ছায়াছবির মতই, অথবা এমনটাও হতে পারে, যে ক্যামেরায় বন্দী ছায়াছবিগুলোই শহরের আত্মা। আসলে আমি ঠিক জানিনা। কিন্তু পুরাতন আসবাবের দেরাজে কিছু একটা যে মাস বছর যুগ ধরে ঘাপটি মেরে বসে থাকে সেটা তো মানেন? চলে যাওয়া যেসব মানুষগুলো তাদের কৌতূহল, হাসি, চমক, প্রতীক্ষা ও কষ্টের ধারালো টুকরোগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে ঠায় বসে থাকে, সময়ের আর ক্যামেরার ওপারে, তাদেরকে আপনি আর কি বলবেন?

দেখেছেন নিশ্চয় যে মাঝে মাঝে পুঁজিপতির বংশধরেরা শহরে প্রবেশ করে। এরা বহিরাগত, বাইরেই তাদের ঠিকানা। তার পরেও শিকড় খুঁজতে তারা বাইরের শহর ছেড়ে এই শহরে আসে। কার শিকড়, কেন এই শিকড়ের প্রয়োজন, সেটা তাদের পুঁজিপতি পিতা-প্রপিতামহের কাছে যতটা পরিষ্কার ছিল অথবা এখনো যতটুকু আছে, এই বহিরাগতদের কাছে সেই শিকড়ের বিশেষত্ব ঠিক ততটা চাঁছাছোলা রহস্যহীন নয়। তদুপরি এদের শিকড় খোঁজার কাজে বেতন দেয়া হয়, এবং তারা সেই বেতন গ্রহণ করে। এতে অবশ্য শহরের কিছু আসে যায় না। শহর তার বুকে খুলে থাকা বটগাছ আর রেন্ডিকরইয়ের ছাতার মত নিজের খেয়ালে নিজেকে মেলে ধরে থাকে। শহর গোপনীয়তার নিয়মকানুন জানেনা। তাই স্থানীয়-উদ্বাস্তু, উঁচুতলা-নিচুতলা, পুরুষ-নারী, শিক্ষিত-নিরক্ষর ইত্যাদি শ্রেণীসংগ্রাম অথবা শ্রেনীমিশেল সহ সবকিছু বিস্তারিত জানিয়ে দেয় সবাইকে এবং পুঁজিপতির বহিরাগত বংশধরকেও।

সব ভাঁজ খুলে যায়।

আমি জানি, আপনি মাঝে মাঝে টের পান। শহরে ভোগের উৎসব বসেছে। এই উৎসবে বহিরাগত শহরকে দেয়। আর শহর দেয় বহিরাগতকে। ভোগসুখ। কিন্তু যেহেতু বহিরাগত জানেনা তার কিসের ক্ষুধা, অথবা যেহেতু সে শুধু ভোগ করতেই জানে, কিংবা অন্য কোন কারণ থাকবে হয়তো। আসলে আমার ঠিক জানা হয়ে ওঠেনি। বহিরাগত একদিন দেখতে পায় সে ঠিক শহরের মতই ধীরলয়ে নিজেকে মেলে ধরেছে। শহর সুদর্শন ও উচ্চাভিলাষী। সে প্রচার চায়। শহরের চেহারা এক, কিন্তু সে নিজে একাধিক। দিনের আলোয় সে দিব্বি খেটে খাওয়া মানুষ। রাতের আঁধারেও। সিনেমার লবিতে বন্ধুদের সাতে গুলতানি মারে। নিষিদ্ধ পাড়ার মোড়ে পুরিয়াবানিজ্যের সাক্ষী হয়। অবলীলায় মরে যাওয়া বন্ধুর মা-ভাইয়ের হাত ধরে ঘরে তোলে, বন্ধুর মা-ভাই তার নিজের হয়ে যায়। এসি-সিরিয়াল সাজানো শোবার ঘরে অতৃপ্ত মালকিনের খিস্তি-খেউরও নিষচুপ শুনে যায়। বহিরাগত তার স্বপ্নে নতুন মাত্রা যোগ করে। ভোগসুখের রহস্যময় উৎসব জমে ওঠে।

শহরকে অবলম্বন করে যে দর্শক, আমি বাজী রেখে বলতে পারি, আপনি তাকে চেনেন। সে যদিও একজন প্রতিথযশ শিল্পী, তবুও সে নির্বিকার ও পলায়নপর। জীবন তার চারপাশেই ঘটে যাওয়া ঘটনা, তবে সেই ঘটনার সে নায়ক নয়। সে দেখে, ভাল বাংলায় যাকে বলে পর্যবেক্ষণ করে। সে অনুভব করে। এটা আমরা জানতে পারি যে এই শিল্পী একজন উদ্ভ্রান্ত প্রেমিকও। সে ভরা মৌসুমের ঝুম বৃষ্টিকে সে ভালবাসে। আর্ট ডেকোর হলুদ চুনকাম করা ইমারত ভালবাসে। লোহার কাঠামোর ওপরে মোবাইল ফোনের বিলবোর্ড ভালবাসে। এ-বাড়ী ও বাড়ীর গায়ে গায়ে লেগে থাকা আর প্রতিবেশীর দৈনন্দিনে উঁকি মারতেও সে ভালবাসে। ভোরের স্নিগ্ধ সমীরণ আর হালকা আলোয় জ্বলে থাকা নিয়ন আলোকেও সে ছেড়ে দেয়না। একদিন তার কাছে চলমান ভোগসুখের উৎসবের নিমন্ত্রণ আসে। এই শিল্পী, যে কিনা পলায়নপর, নীরব ও একজন নির্বিকার দর্শকও, সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারেনা। কেন পারেনা, সেটা আমদের ঠিকঠাক জাননো হয়না।

যেমনটি হয়ে থাকে, ঠিক সেভাবেই এই শিল্পীর সাথে একদিন শহরের সেই অনেকদিনের মরে যাওয়া আত্মার দেখা হয়ে যায়। সেই যে ফেলে যাওয়া এক পুরাতন দেরাজে ঘাপটি মেরে বসে ছিল যে শহরের যে আত্মাটি। পরিকল্পনা ঠিক কি ছিল, সেটা জানবার প্রয়োজন বুঝে উঠবার আগেই ঠিকঠাক নিজের কৌতূহল, হাসি, চমক, প্রতীক্ষা ও ধারল কষ্টের টুকরোগুলোকে এক-দুই-তিন কিস্তিতে সে শিল্পীর সামনে পরিবেশন করে। টেলিভিশন, ক্যানভাস ও অসাধারণ সব ছবি-ফ্রেমে এক কিম্ভুত প্লানচেট শুরু হয়। পলায়নপর হলেও সেই অসীম শক্তিধর অশরীরীর হাত থেকে মুক্তি পায়না নির্বিকার দর্শক-শিল্পী। শিল্পীর হাত ছুঁইয়ে লাল ধুসর বাদামী রং এর প্রলেপ থেকে প্রলেপে স্বচ্ছতা থেকে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে সেই অশরীরীর অবনত মুখ।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় বহিরাগত আরও বিভ্রান্ত হয়। আর আমাদের শহর? সে থেকে যায় তারই মত। মুখ এক তবুও একাধিক।

(ধোবি ঘাট - আমার দেখা একটি অতি অসাধারণ ছবি)


মন্তব্য

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

মন খারাপ ইয়ে, মানে...

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

তাসনীম এর ছবি

কয়েকটি ঘর, কয়েকটি মহল্লা, কয়েকটি এলাকা। রাস্তা দালান বাজার বিজ্লী-খাম্বা পানের-পিক কাক আর বস্তি। ইট কাঠ ইস্পাত কাঁচ আর ঘাম মিশিয়ে যে সরলরেখার সমাবেশ। এক আমরা শহর বলতে শিখি। এর সাথে আমাদের আমাদের পরিচিতি ঘটে যায় অনেক আগেই। কিন্তু ঠিক সেই শহরটিই যে একটি জীবন্ত প্রাণী, সে রহস্য় ক্রমাগত আমাদের আওতার আবডালে চলে যেতে থাকে।

চলুক

শহর সম্বন্ধে আমার উপলব্ধিও এই একই।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

শহরকে অবলম্বন করে যে দর্শক, আমি বাজী রেখে বলতে পারি, আপনি তাকে চেনেন। সে যদিও একজন প্রথিতযশা শিল্পী, তবুও সে নির্বীকার ও পলায়নপর।

ভালো লেগেছে।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

অমিত এর ছবি

চমৎকার রিভিউ

অতিথি লেখক এর ছবি

এমন চমৎকার একটা রিভিউ পড়ে 'ধোবিঘাট' দেখবার আগ্রহটা বেড়ে গেলো হাসি

- আয়নামতি

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল হয়েছে। আপনি আরো ভাল লেখতে পারতেন যদি সময়টা একটু বেশি দিতেন।

সাফি এর ছবি

ট্যাক্সোনোমিতে রিভিউ দিতে পারতেন। মন্তব্যে না পড়লে বুঝতামনা যে রিভিউ। রিভিউ হোক আর যাই হোক লেখা পড়ে সিনেমাটা দেখার আগ্রহ জেগেছে

অতিথি লেখক এর ছবি

অসহনীয় একটা দুর্দান্ত বর্ণনা। চলুক চলুক চলুক

অতীত

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

"ধোবি ঘাট" মুভিটা চার জন মানুষের চোখে দেখা একটি শহর অথবা শহরে মানুষের জীবন অথবা শহরের মানুষের জীবনের গল্প। উপর তলা-নিচ তলা, আবাসী-অনাবাসী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বা নারী-পুরুষ নানা ডাইমেনশন আর নানা কনটেক্সট থেকে দেখা। মুভিটাতে কিছুটা গল্পহীনতা হয়তো আছে, কিছুটা জোর করে চাপানো বিষয় আছে, ফ্যান্টাসী তো আছেই। তবু এই পরীক্ষা-নীরিক্ষা মন্দ লাগেনা। সেখানে লাতিন আর দূরপ্রাচ্যের সঙ্গীতকারদের কাজ আছে, ভারতের বাইরের কুশলীদের কাজও আছে। ভারতের ছবিতে বাইরের কলা-কুশলীদের কাজের সুযোগ অবারিত হবার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

এই লেখাটা "ধোবি ঘাট"কে ভর করে লেখা হয়েছে ঠিক, তবে এটাকে লেখকের নিজের উপলদ্ধির রঙে রঙিন একটা লেখা বলেই মনে হয়েছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

ভাল্লাগছে ।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

দূর্দান্ত!!!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বর্ননাটা এমন যেন শহরটা এক পাক ঘুরে এরাম। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ধোবীঘাট দেখার কথা আরো কয়েকজনে বলছে... দেখতে হইবো জলদি।
লেখাটা দুর্দান্ত হইছে

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সবজান্তা এর ছবি

আপনার লেখাটা পড়েই মুগ্ধ হয়েছিলাম, ধোবি ঘাট ডাউনলোড করেছিলাম। ব্যস্ততায় আর দেখা হয়নি। আজ হঠাৎ দেখা শুরু করলাম...

একটু আগেই দেখে শেষ করলাম, আর আপনাকে একটা ধন্যবাদ দিতে আসলাম হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।