অকালবোধন

গান্ধর্বী এর ছবি
লিখেছেন গান্ধর্বী [অতিথি] (তারিখ: রবি, ১৪/০৯/২০১৪ - ১১:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘প্রিয় বাতিঘর,

এই সম্বোধনে আপনার মুখে যে একচিলতে হাসি ফুটে উঠেছে সে আমি কল্পনা করে নিতে পারছি। আপনি উপহাসের হাসি হাসতে পারেন কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো শব্দ খুঁজে আমি পেলাম না।

স্নান সেরে চুল আঁচড়াতে গিয়ে কিছুদিন আগে হল এক কান্ড, গোটা কয়েক ধূসর চুল আবিষ্কার করলাম। আমি বুড়িয়ে গেছি- এই ভেবে তখন মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু কদিন ধরে মনে হচ্ছে আমি ভুল ভেবেছিলাম। বুড়িয়ে যাইনি, নইলে এভাবে আবার বিবশ করা ভাল লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছি কেন!

কাজপাগল স্বামী আর একটা ভীষণ দুষ্টু শিশু নিয়ে আমার ফুটফুটে সংসার। এদের নিয়েই আমার সারাবেলা কেটে যায়। অবশ্য এরা অফিস আর স্কুলে চলে যাবার পর আমার নিজস্ব নিভৃত জগতে চলে যাই আমি। আমার গুচ্ছের যত বই, একটা চৌকো দেরাজে বন্দি একমাত্র খেরোখাতা আর তার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা অনেক পুরোনো আমি- এই নিয়ে সেই জগত।

'মল্লারের রাত', 'ময়ূখরথ ভ্রমণ'- আপনার লেখা এসব বই সদ্য পড়লাম। পড়ছি আর ভাবছি –আহা, কেন যে আপনার লেখাগুলো আরো আগে পড়তে পেলাম না! আমার গত জন্মদিনে এক বন্ধু ‘সাঁঝবাতি’ উপহার দিয়েছিল। সেই প্রথম আপনার লেখা পড়লাম। তারপর খোঁজ করে বাকি বইগুলো যোগাড় করে নিয়েছি। গত কদিনে অন্য কিছু পড়া হয় নি। ইদানিংকালের লেখকদের মধ্যে আর কারো লেখা এত মন দিয়ে পড়িনি, সত্যিই।

আমার সেই বন্ধু আপনার খোঁজ এনে দিল। বইমেলাতে গেলাম, শান্ত সৌম্য মূর্তিখানা দেখতে পেলাম। কিন্তু ত্রিসীমানায় ঘেঁষার সুযোগ পাই নি, আপনি তখন ভক্তবৃন্দের ব্যারিকেডে আবদ্ধ, বই নিয়ে আলাপে মগ্ন, নাগাল পাওয়া দুষ্কর। টিভিতে আপনার সে আলাপ শুনতে পেলাম। কিন্তু আমার তাতে আশ মেটে না। আরেকটু বেশি সান্নিধ্য প্রয়োজন। শুধু ছোট্ট একটা বিকেল চেয়ে নিতে চাইছি আপনার কাছ থেকে। হয়ত আপনার সময়টুকু মাটি হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে সময়টা অন্যরকম মাধুর্য নিয়ে সোনার ফ্রেমে বাঁধাই হয়ে থাকবে চিরকাল।

এখন আমার হাতে ‘মেঘফুলের গান’। গল্পের মেয়েটার মত আমার নামও ছন্দা। আমি বইটা পড়তে শুরু করে গল্পটা নিয়ে ভেবেছি অনেক। কিন্তু তারচেয়ে বেশি ভেবেছি আপনাকে নিয়ে। ছন্দাকে আপনি যখন কল্পনায় তিলতিল করে গড়ে তুলছিলেন তখন আপনার মুখাবয়ব কেমন দেখাচ্ছিল, ছন্দার জীবনটাকে লিখতে গিয়ে কলমটাকে শুইয়ে রেখে গালে হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলেন আপনি- ভাবছি এইসব। হয়ত শেষরাতের তারাটাও তখন মিলিয়ে গেছে, ক্লান্ত আপনি ঘুম জড়ানো চোখে বিছানায় এলিয়ে দিয়েছেন শরীর। ভোরের নরম হাওয়া আপনাকে ছুঁয়ে গিয়েছে। সে বিহ্বল ভোরে আমি কী করছিলাম!

যাক গে, কথায় কথায় অনেক অকাজের কথা লিখে ফেললাম, ক্ষমা করবেন। এ বেলা কাজের কথায় আসছি। আসছে শুক্রবার আপনার চা এর নেমন্তন, আমি ক্যাফে রোজ্জোতে অপেক্ষা করব। চিনবেন কী করে? আপনার গল্পের ছন্দার মত ধুপছায়া রঙ শাড়ি, কবরীতে করবী ফুল - এসব বড় ছেলেমানুষি হয়ে যাবে। আমি সে ছন্দা নই, আমি আমিই! আপনার লেখা কিছু বই সাথে করে নিয়ে আসবো বরং। সময়? ঠিক বিকেল পাঁচটে। আমার একটা দোষ আছে, ঘড়ির কাঁটাকে বড্ড মেনে চলি। সময় জ্ঞানহীন লোকদের দুচক্ষে দেখতে পারি না। তবে দুএকজন মানুষের জন্য অপেক্ষা বড় মধুর, হয়ত মানুষটির চেয়েও!

ইতি
ছন্দা।

পুনশ্চঃ চিঠিটা এবার ফেলে দিতে পারেন আঁস্তাকুরেতে। আর এতেও যদি বিরক্তি না কমে তো নম্বর দিয়ে দিলাম, ফোন করে গালমন্দ করে নিতে পারেন সাধ মিটিয়ে!’

আমার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এল। সকাল থেকে কবার পড়েছি এই চিঠি হিসেব নেই। প্রথমবার পড়ে সত্যিই হেসে ফেলেছি। তারপর তারিখ মিলিয়ে দেখলাম, বছর পনের আগেকার চিঠি। বইয়ের ভাঁজে ছিল। খুলে দেখা হয় নি এতকাল, চোখ এড়িয়ে গিয়েছে কোনোভাবে। চিঠিটা দশ বারোবার পড়ে ফেলে এখন বেশ অস্থিরতায় ভুগছি। খানিকটা বিরক্তিও লাগছে নিজের উপর। পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে আমার বেশ আগে। এ বয়সে এমন অস্থিরতা বড় বেমানান। চোখের সামনে একটা দৃশ্য ফুটে উঠছে- রোজ্জোতে অপেক্ষারত ছন্দা। অচেনা ছন্দাকে ভাবতে গিয়ে গল্পের ছন্দার মুখটা ভেসে উঠছে। কিন্তু এ তো আরেক ছন্দা!

বিকেলবেলা অদ্ভুত এক পাগলামি ভর করল আমাকে। নম্বরটাতে একবার ফোন করে দেখব কিনা ভাবছি। ছন্দা এখন হয়ত চল্লিশোর্ধ রমনী, ধূসর চুলের সংখ্যা বেড়ে গেছে অনেক। কিন্তু ও এখন নিজেকে বুড়ো ভাবছে কিনা, ওর সন্তান এখন তেমন চঞ্চল রয়ে গেছে কিনা এসব তুচ্ছ ব্যাপার জানতে ইচ্ছে করছে! মায়াবি অক্ষরে লেখা এত অদ্ভুত সুন্দর চিঠি আমি কখনো পড়ি নি, কেউ লেখেও নি আমায়। যে এভাবে লিখেছে তাকে জানবার ইচ্ছেটাই বোধ হয় এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

একটা বিকেল ওকে অনায়াসে দিতে পারি এখন। আমার আজকাল বেজায় অবসর। আমাকে সময় দেবে, পাশে বসে দুটো কথা গল্প করবে এমন কেউ তো নেই। আবার মনে হচ্ছে এতকাল পর ছন্দার খোঁজ নিলে ওকে বিব্রত করা হবে না তো। কী ছেলেমানুষিতে পেয়েছে আজ! ওর নম্বর, ঠিকানা এসবও বদলে যেতে পারে, সে সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

বয়সের বলিরেখা ছন্দাকেও আক্রান্ত করেছে নিশ্চয়ই। এবার ছন্দার সুস্থতা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার। একটা খোঁজ নেয়া যেতেই পারে। নম্বরটাতে ফোন করলাম শেষমেশ।

ওপাশে একটা মিষ্টি গলা। ছন্দা আছে কিনা জানতে চাইলাম আমি। আমাকে একইসাথে চমকে দিয়ে আর হতাশ করে দিয়ে বলল – 'উনি বাড়ী নেই।' ছন্দার নম্বর তাহলে বদলায় নি! আমার পরিচয় জানতে চাইল এবার। কী বলব বুঝতে পারলাম না। মেয়েটা আমার নম্বর চেয়ে নিল। চটপটে মেয়ে, বলল-কী নাম বলব?

-অনিমেষ।

ফোন রেখে দিলাম আমি। ছন্দা কবে বা কখন ফিরবে জানি না। জেনে নেয়া যেত হয়ত। কিন্তু একটা সংকোচ চেপে ধরেছিল আমায়।

-----------------------
(চলবে?)


মন্তব্য

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

বাহ্! চলুক। হাসি

গান্ধর্বী এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

এক লহমা এর ছবি

হাততালি
চলে চলুক, ভাল গল্প যত বেশী সংখ্যায় আসে ততই ভাল। কিন্তু এই চমৎকার গল্পটা এখানেই শেষ। এই যা পড়েছি, একে আমি, এই এ'টুকুতেই, একটি নিটোল গল্প হিসেবেই মনে রাখব। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

গান্ধর্বী এর ছবি

চলবে কিনা ভয়ে ছিলাম! ইয়ে, মানে...

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

মেঘলা মানুষ এর ছবি

সুন্দর, সাবলীল কিন্তু খানিকটা বিষণ্ণতা ধরানো গল্প চলুক

গান্ধর্বী এর ছবি

ধন্যবাদ মেঘলা আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

শুধু এটুকুও কম ভালো লাগলো না। পরেরটুকুতে কী আছে কে জানে?
অপেক্ষা হাসি

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

গান্ধর্বী এর ছবি

ধন্যবাদ নজরুল ভাই। পরেরটুকু ভাবছি এখনো খাইছে

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

সেকী!! এত ছোত্ত কেন? চলবে সেটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু এত অল্প পড়ে তো মন ভরে না গল্প দিদি - আরো বড় করে পর্ব দিন।

____________________________

গান্ধর্বী এর ছবি

দিব গো দাদা, একটু ভেবে নেই দেঁতো হাসি

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পের শুরুটা চমৎকার, চিঠির পরতে পরতে একজন নারীর নিভৃত জগত। অপেক্ষায় থাকলাম শেষটার। শুভ সকাল। ভাল থাকুন।
সুলতানা সাদিয়া

গান্ধর্বী এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে গেলেই বা ক্ষতি কি? রেশ তো রইছেই মনে! 'অকালবোধন' নাম দেয়াতে বোধকরি আর তা সম্ভব হচ্ছে না, তাই তো! নামটা যেন গল্পটাকে আরো কিছুদূর টেনে নিয়ে যেতে চাইছে।

চিঠির ভাষা অত্যন্ত প্রাণবন্ত আর প্রজাপতির মত তুলতুলে।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

গান্ধর্বী এর ছবি

কবি ভাই, অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর মন্তব্যের জন্য।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

অতিথি লেখক এর ছবি

বড্ড ভালো গল্প। মন খারাপ সময়টাতে একটা ভালো অনুভূতি জাগিয়ে দিল।

দেবদ্যুতি

গান্ধর্বী এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ! পরের পর্ব আর মেলাতে পারছিনা।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।