আমাদের পুরনো ছাদ ঃ একটি শিশুতোষ রূপকথা

গান্ধর্বী এর ছবি
লিখেছেন গান্ধর্বী [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ০৩/০৩/২০১৫ - ৪:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের বাড়িতে একটা মাত্র ঘর। সেই এক ঘরের বাড়িতে আমরা সবাই থাকি, খাই। এক ঘরের এই বাড়ির একটা দরজা, জানলা দুটো। একটাতে ভারী পর্দা ঝুলে আরেকটার কপাটে কালিমাখা। জানলাগুলো বন্ধই থাকে। তবু আমাদের একা রেখে বড়রা দূরে গেলে বারবার সেগুলোকে পরীক্ষা করে দেখা হয় বন্ধ আছে কিনা। তখন দরজা খোলাও বারণ। কারণ চোরের উপদ্রব খুব বেশি আর বাইরের ধু ধু মাঠে ঝড়ের হাওয়া ওঠে যখন তখন। সে ধুলোবালি ঘরে ঢুকে নোংরা করে দিতে পারে। আমরা ছোটরা চোর আর ধূলিঝড়ের ভয়ে জুবোথুবো হয়ে ঘরে বসে থাকি সে সময়।

আমাদের একটা দুটো বই আছে। বড়রা আমাদের সেগুলো পড়ে শোনায় দিনের বেলায়, যেদিন ওঁরা ঘরে থাকে। রাতে আলোর পর্যাপ্ততা থাকে না। দিনে ভারী পর্দার ফাঁক দিয়ে কিছুটা আলো ঘরে আসে, সে আলোতে আমাদের বই পড়তে দেয়া হয়। বইগুলোর নাম কিংবা এদের লেখকের নাম আমরা জানতে পারি নি কখনো। মলাটের ওপরে ধুলোর স্তর জমে গেছে, তাই নামগুলোও একেবারে ঝাপসা হয়ে গেছে। একবার জানতে চাইলে বড়রা একজনকে খুব শাস্তি দেয়। তাই আমরা আর কখনো ওসবের নাম জানতে চাই নি।

আমরা বড় হবার অপেক্ষায় থাকি। এখন আমাদের উচ্চতা কম, ধীরে ধীরে আমরা লম্বা হব, বড়দের মত। আমরা মাঝে মাঝে এসব গল্প করি। আমাদের বাড়ির ছাদটা খুব উঁচু নয়। সময়ের সাথে আমরা হিসেব করে দেখি আর কতদিন পর আমরা ছাদটাকে ছুঁতে পারব। কিন্তু কেউ কেউ বলে আমরা বড় হতে হতে আমাদের উচ্চতা বাড়বে কিন্তু আমরা ছাদ ছুঁতে পারব না। একজন জানতে চায়-কেন? আরেকজন বলে- তোমরা খেয়াল করে দেখোনি বড়রা ছাদ ছুঁতে পারে না। এর কারণটা জানতে চাইলে আমাদের মধ্যে একজন যে অন্যদের চেয়ে লম্বা আর বুদ্ধিমান সে বলে ওঠে- ওঁরা ছাদ ছুঁতে পারে না কারণ ওদের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গেছে, ওঁরা কোমর ভাঁজ করে চলাফেরা করে। ওঁরা যদি সোজা হয়ে চলত তবে বাড়ির ছাদটা সারিয়ে নিতে হত, আরো উঁচু করে তৈরি করতে হত। আমরা বললাম- ছাদ কী করে উঁচু করা যায়, এ তো বদলানো যায় না! তখন সে বলল-নতুন করে তৈরি করা যায়। বইতে লেখা আছে। আমরা অবাক হয়ে বললাম কোন বইতে এসব লেখা আছে? এসব কথা তো বড়রা আমাদের পড়ে শোনায় নি! সে চুপিচুপি বইটা বার করে সামনে মেলে ধরল। তারপর ভারী পর্দার জানালাটা খুলে দিল। হুড়মুড় করে আমাদের ঘরে আলো এসে পড়ল, অন্ধকারে অভ্যস্ত আমরা কিছুক্ষন অন্ধ হয়ে রইলাম, ভয় পেয়ে কেউ চিৎকার করে উঠল, কেউ জানালা বন্ধ করে দিতে চাইল। কিন্তু এর মধ্যে আমরা অবাক হয়ে দেখলাম একটা অচেনা নতুন বই। সবাই মিলে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পরলাম। সেদিন অনেক নতুন কিছু জানলাম আমরা। কিন্তু বেশীক্ষণ এসব নিয়ে আলোচনার সুযোগ পেলাম না কারণ বড়রা ফিরে এল।

কয়েকজন ভুলে গেল নতুন বইটার কথা। রাতের বেলা নিচুস্বরে দিনেরবেলার কথাগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করল কেউ কেউ । দু’একজন বলল নতুন বইয়ের কথা বড়দের জানিয়ে দেবে, ওঁদের না জানিয়ে এসব করা মোটেও উচিত হচ্ছে না। এ কথা শুনে যারা আলাপ করছিল তারা ভয় পেয়ে চুপ হয়ে গেল। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। শুধু জেগে রইল একজন। তার মনে অনেক প্রশ্ন জমে গেছে। সে ঠিক করল সেগুলোর উত্তর খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করবে। আর বাকিদের জানাবে। বড় হয়ে মেরুদণ্ড বাঁকা না করে এই বাড়িতে হাঁটা যাবে। কিভাবে নতুন করে ছাদটাকে উঁচু করা যায় সেটা সবাইকে শিখিয়ে দেবে। বড়দের মত কোমর বাঁকা করে কেউ চলাফেরা করবে না।

একদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে আমরা ছোটরা ওকে খুঁজে পেলাম না, যে আমাদের মধ্যে লম্বা আর বুদ্ধিমান ছিল, যে আমাদের নতুন কিছু কথা বলেছিল। আমরা ছোট তাই একদিন ভুলে গেলাম ওর কথা।

তারপর আমরাও বড় হলাম। মাথার উপর পুরোনো ছাদটা এখনো রয়ে গেছে। আমরা কোমর বাঁকা করে হাঁটি। ছাদ ছোঁয়ার গল্প ভুলে গেছি আমরা। আমাদের ছোটরা ছাদ ছোঁয়ার গল্পই জানে না, কারণ ওরা সবাই বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়ে কিংবা বামন হয়ে জন্মাচ্ছে। তাই আমরা আমাদের পুরনো ছাদটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগি না।

-----------------------


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আমরা মানুষ, পৃথিবীর সবচেয়ে কিম্ভূত প্রাণী। আমরা ছোটবেলায় ছাদ পেরিয়ে আকাশ ছুঁতে চাই, বড় হলে ছাদটাকেই আকাশ ভেবে নিই। ছোটবেলার সবচেয়ে সাহসী আর নতুন কথা বলা বন্ধুটাকে বড়বেলায় ভুলে গিয়ে পুরনো কথা বলা পুরনো বইগুলোই পড়ে শোনাই ছোটদের, নতুন কথা বলা যে বইটি একদিন অনেক প্রশ্ন বয়ে এনেছিল তেপান্তরের মাঠ থেকে, তাকে লুকিয়ে ফেলি গাঢ়তরে অন্ধকারের দেশে, পাছে ছোটরা ছাদটা ভাঙতে চায়! বড়ই অদ্ভূত!

দেবদ্যুতি

গান্ধর্বী এর ছবি

আমরা ভুলে যাই, এটাই হয়ত আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পটার ভেতরেও একটা গল্প আছে! সুন্দর এক গল্প! কিছু জানার গল্প কিছু জানানোর গল্প।

-------------------
রাধাকান্ত

গান্ধর্বী এর ছবি

ভেতরের গল্পটা বড় করুণ, হতাশার, গ্লানিময়। মাঝেমাঝে গল্পটা সশরীরে সামনে এসে দাঁড়ায়, বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত করে দিয়ে যায়।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

অতিথি লেখক এর ছবি

হতাশা ও গ্লানিময় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই হবে। সূর্যের কিরণে মেঘ বেশি ক্ষন থাকতে পারে না।

----------------
রাধাকান্ত

আয়নামতি এর ছবি

উত্তম জাঝা! কোলাকুলি
মেরুদণ্ড সোজা রাখার বিদ্যাটা বলে যেতে হবে, বলার মত কেউ না থাকলে করে দেখানোর মানুষ তৈরী হবে কি করে?

গান্ধর্বী এর ছবি

কী করে হবে দিদি, জানি না, ভেবে পাই না। একটা প্রবল ঝড় আসুক কিংবা জাদুবলে, তবু একটা কিছু হোক যেন চিত্ত শুদ্ধি হয় সকলের।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রথাগত মানুষরা সর্বদা পিঠ বাকিয়েই চলতেন । পুরোনো সংস্কার কে ধরে নতুনের জাগরন ঠেকানোই ঐসব ব্যাকা মানুষগুলোর কাজ।

--------------
রাধাকান্ত

গান্ধর্বী এর ছবি

বাঁকা হতে হতে অস্থিগুলো ভেঙ্গে যাবার উপক্রম, তবু বিকার নেই। 'পঙ্গুত্ব দীর্ঘজীবী হোক' হুঙ্কারে আকাশ বাতাস কাঁপাবে।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

অতিথি লেখক এর ছবি

যৌবনের গানে তাদের বিরক্তি তাই 'পঙ্গুত্ব দীর্ঘজীবী হোক' হুঙ্কারে দিক বিদিক করে ।

-----------------
রাধাকান্ত

এক লহমা এর ছবি

"আমরা আমাদের পুরনো ছাদটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগি না।" নাঃ আর দুশ্চিন্তার কিছু নেই। মন খারাপ

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

গান্ধর্বী এর ছবি

চির অন্ধকারের জীব হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি সবাই।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

অতিথি লেখক এর ছবি

আলোকের পথে আলোকিত হতে আমি ঘুরছি। আরো আছে ও আরো হবে!

-----------
রাধাকান্ত

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার চলুক

মহাবিশ্বের পরিব্রাজক

গান্ধর্বী এর ছবি

লিখে আর পড়ে কী হবে বলুন! তবু, ধন্যবাদ।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

অতিথি লেখক এর ছবি

লিখতে হবে ,তার চাইতে বেশী পড়তে হবে। অন্ধকার আসবে কিন্তু হাজার বছরের অন্ধকারও এক ঝলক আলোর কাছে হার মানে !হতাশ হবেন না।
----------------
রাধাকান্ত

গান্ধর্বী এর ছবি

চেষ্টা করছি, হতাশ না হতে।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

রানা মেহের এর ছবি

ছাদের মধ্যে বাংলাদেশ নামের একটা দেশকে দেখতে পেলাম

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

গান্ধর্বী এর ছবি

যে দেশটাকে বড় অচেনা লাগে মাঝেমাঝেই।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ক’দিন ধরে কিছু লিখতে পারছিলাম না, পড়তেও না। কেমন যেনো হিপোক্রেট লাগছে নিজেকে। আমার মাথা তো সেই কবেই ছাদে আটকে গেছে। আমি কিছুই করতে পারি না। আমি শুধু কাঁদতে পারি। আপনার ফিরে আসাটা এভাবে এমন একটা বিষণ্নতায় ভরা হবে ভাবিনি।
(প্রথম লাইনটি আবার পড়ুন-আমদের বাড়িতে একটা মাত্র ঘর।)

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

গান্ধর্বী এর ছবি

ফিরে আসাটা এমন হোক আমিও চাই নি, প্রিয় দিদি। আমি কাঁদলাম, অশান্ত, অস্থির হয়ে ছটফট করলাম, তারপর যা যা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তাই লিখতে গিয়েও কলমটাকে থামিয়ে দিলাম। নিজের গল্পের ওই ছোট আর ভীতুদের দলেই পড়ি কিনা। এই ভণ্ডামি বড় অসহ্য লাগছে।
(মেজাজের ঠিক ছিল না, চোখেও পড়ে নি টাইপোটা, এবার ঠিক করে দিলাম)

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

তবুও তো আঙুলগুলোই আমাদের ছটফটানি কমায়। অথচ একবার কি ভাবতে পারি, আমার, আপনার আঙুল নেই?

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক মন খারাপ
সুন্দর গল্প। আরও এমন গল্প দরকার।

-সো।

গান্ধর্বী এর ছবি

ধন্যবাদ।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

সোহেল ইমাম এর ছবি

সুন্দর লেখা

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

গান্ধর্বী এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।