বইমেলা শেষ, বইকেনাও কি শেষ?

গৌতম এর ছবি
লিখেছেন গৌতম (তারিখ: রবি, ০২/০৩/২০০৮ - ১২:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রশ্নটা খুব নির্দয় শোনায়, তারপরও জানার আগ্রহ যায় না- হাবুডুবু খাওয়ার সময় একজন ডুবন্ত মানুষের কি পানিপিপাসা পায়? যদি পায়, তাহলে ডুবে যাওয়ার আগে কি সে পেট ভরে পানি খেয়ে নেয়? নাকি তখন পানি খাওয়ার কোনো তাড়না থাকে না তার মাঝে!

বইমেলায় গেলেই আমার এমন অবস্থা হয়। গত প্রায় দশ বছর ধরে নিয়মিত বইমেলায় যাচ্ছি। প্রায় প্রতিদিন। অথচ শেষ পাঁচ বছরে বইমেলা থেকে কোনো বই কিনেছি বলে মনে পড়ে না। যদিও অন্য মাসগুলোতে ‘বইকিনে কেউ কখনও দেউলিয়া হয় না’ বাক্যটিকে আস্থা রাখতে গিয়ে বান্ধবীকে গিফট দেওয়ার টাকায় টান পড়ে। কিন্তু বইমেলা থেকে বই কিনতে ইচ্ছে হয় না কেন?

এবারের বইমেলায় সবশুদ্ধ ২২ দিন গিয়েছি, ভিড়বাট্টার দিনগুলো এড়িয়ে। কোনো কাজে না। স্রেফ বসে থাকতে। কখনো বসে ছিলাম তথ্যকেন্দ্রের সামনে। কখনো পুলিশদের সাথে। কখনো উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাটি করেছি, দু-একটি বই নেড়েচেড়ে দেখিছি, নতুন বইগুলোর রিভিউ পড়েছি। সচলায়তনের বইটি নিয়ে ১৫ মিনিটেরও বেশি খুঁটিয়েছি। কিন্তু কিনিনি। বইমেলা থেকে কেন যেনো কোনো বই কিনতে ইচ্ছে করে না! হয়তো এই বইগুলোই কিনবো পরবর্তী মাসগুলোতে, সারাবছর ধরে, একটি একটি করে...

মাঝে মাঝে মনে হয়, আশেপাশে এতো বই! কোনটা রেখে কোনটা কিনবো? লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাই সবগুলোর দিকে। সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হয়। আশেপাশের মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকাই। কী অদ্ভুত দৃষ্টি তাদের! বইকেনার নেশায় মশগুল একেকজন। শিশুরা আনন্দে ভরপুর।

মানুষগুলোর এই আনন্দমুখর মুখগুলো দেখেও নিন্দুকের মতো প্রশ্ন বাড়ি মারে মনে- এই বইকেনার উৎসব কি কেবল একটা মাসের? পুরো ফেব্রুয়ারি মাস যারা বইকিনে নিজের সত্ত্বাটিকে বিনির্মাণের চেষ্টা করেছেন, তারাই কি আগামী একটি বছর মুখ ফিরিয়ে থাকবেন বই থেকে? তারাই কি মেতে থাকবেন পিৎজা-এসএমএস-জিন্স-ব্ল্যাকবেরি-ল্যাপটপ-নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে? তারাই কি কোনো বিয়ে-জন্মদিন-বৌভাত-প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ইত্যাদি উপলক্ষগুলোতে উপহার হিসেবে বইকেনাকে রাখবেন তালিকার তলানিতে? নিন্দুক মন আরো প্রশ্ন জাগায়- মানুষকে একমাসের জন্য বইকেনার তাড়না জাগিয়ে দিয়ে পরবর্তী মাসগুলোতে সেটিকে ধরে না রাখার যে আপ্রাণ চেষ্টা বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ-বহুজাতিক কোম্পানি-ব্যাংক স্পন্সর-মিডিয়া-লেখক-প্রকাশক, সেটি কি আমাদের জাতীয় অপরাধ নয়? মানুষকে আমরা একমাসের জন্য নিয়ে যাচ্ছি বইয়ের কাছে, কখনো কি চেষ্টা করছি বইকে মানুষের কাছে নিয়ে যেতে সারাটি বছর ধরে?

শেষ কাজটি করতে না পারলে বইমেলা আস্তে আস্তে পরিণত হবে বইবাণিজ্যমেলায়।


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আনাড়ির ঘোড়া লয়ে অপরেতে চড়ে
ধনীজন কেনে বই গুণীজন পড়ে
_ সধবার একাদশী/দীনবন্ধু মিত্র

০২
ভালোমানুষ বই কেনে না। বই লেখে

গৌতম এর ছবি

...আর অতিভালোমানুষরা বই কেনে না, লিখে। কিন্তু ছাপায় না।

আচ্ছা, ইজা ও নগদ কবিতাটি কি আপনার? অনেকদিন আগে পড়েছিলাম, কিন্তু লেখকের নামটা স্মরণ করতে পারছি না। জানাবেন?
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ইজা ও নগদ

যে দোকানদার আমাকে সিগারেট না দিয়ে ধমকে দিয়েছে সেদিন
বড়ো হয়ে তাকে আমার মাইর দেওয়ার কথা

অনেকের মারাত্মক উপকার করার কথা- খুন করার কথা বেশ কিছু
বেশ কিছু প্রতিশোধ বাকি আছে। সারা ঘরে তালমিছরি ছড়িয়ে রাখার কথা- সারাদিন বাদাম খাওয়া আর ইচ্ছামতো সিনেমা দেখার কথা আমার
বড়ো হয়ে

বড়ো হলে কারো সাথে আমার মারামারি করার কথা; প্রেম করার কথা কারো সাথে
এবং শহীদ হয়ে যাবার কথা বিশেষ কোনো কারণে কোথাও

রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি হবার কথা আমার
পাশের দেশ দখল করে নিজেদের সীমানা বাড়াবার কথা
সবগুলো পুরস্কার জেতা- সবগুলো খেলা- সবগুলো নির্বাচনে
জয়লাভ করা শ্রেষ্ঠ গায়ক কবি ও চিত্রশিল্পী হওয়া
এবং
এরকম
দশ লক্ষ ছিয়াশি হাজার কাজ বাকি রেখে দিয়েছি বড়ো হবার অপেক্ষায়
শুধু মিটিয়ে দিয়েছি আমি বড়ো হবার মতো যথেষ্ট সময়

পানের দোকানদার মার খায়নি আমার হাতে
তালমিছরি কিংবা বাদাম কেনা হয়নি আমার

এখন
আমাকে ধমকায়
আরো বেশি লোক
২০০৪.০১.২৯ বিষুদবার
মাংসপুতুল/২০০৫

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দিতে পারেন এ ব্যাপারে।

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

গৌতম এর ছবি

কার কাছে? কী লাভ?

বইমেলা যেনো প্রকাশকদের ব্যবসায়িক মিলনক্ষেত্র না হয়ে পুরোপুরি বইয়েরই একটি মেলা হয়, সে বিষয়ে অনেক বড় বড় লেখকরা বলেছেন। তাদের কথা কি কেউ কানে তুলেছে?
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

নিঘাত তিথি এর ছবি

কেউ চেষ্টা করছে না তা মনে হয় নয়। ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জোর করে বই গেলানোর চালিয়েই যাচ্ছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার। এটা একটা বলার মত বড় উদ্যোগ।
আরেকটা কথা আমি ব্যাক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, বই যারা পড়ার, যারা কিনে পড়ার তারা এমনিতেই সেটা করে, সব সময় করত, এখনও করে। যারা পড়ার নয়, কেনার নয়, তারা কখনও পড়ত না, কিনতো না, এখনও তা করে না। এর সাথে অন্যান্য সমসাময়িক উপসর্গগুলোর খুব যোগ আছে বলে মনে করি না। এই ডিজ্যুস জেনারেশনেও কিন্তু যারা বই ভালোবাসে তারা ঠিকই বই পড়ে, কিনেই পড়ে। যারা এখন পড়ছে তারা অন্য সময়গুলোতেও হয়ত বই না পড়ে অন্য কিছুই করতো। "বইমেলা"টা অনেক অনেক অনেক বই একসাথে দেখার, হাতে পাওয়ার, বইপ্রেমী মানুষগুলোকে কাছে দেখার একটা বিশাল সুযোগ, আনন্দ। বইমেলা শেষ হয়ে যাবার পরেও এদের অনেকেই হয়ত আপনার মত এখান সেখান থেকে সারা বছরই বই কিনতে থাকে, সেই খোঁজ তো আর রাখা যায় না...।
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

গৌতম এর ছবি

আপনার কথাগুলো সত্য হলে অসম্ভব খুশি হবো। কিন্তু আমার চারপাশের মানুষগুলোকে দেখে আসলে তেমনটি মনে হয় না। আপনি নিজেই কি দেখবেন যে আপনার চারপাশের মানুষগুলো বইমেলা থেকে বই কিনেছেন, তারপর সারাবছর তাদের বইকেনার কথা মনে করেন কি-না। কিংবা যে বইগুলো তারা কিনেছেন, সেগুলো সব পড়েছেন কি-না।

আমি হয়তো কিছুটা হতাশা ছড়িয়ে দিয়েছি, যার বিপরীতে আপনি লিখেছেন। আমিও চাই আপনার মতো এরকম আশাবাদী অর্থাৎ ইতিবাচক কথাগুলো লিখতে। ধন্যবাদ।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমরা কি আসলে খুব বেশি সংশয়বাদী হয়ে যাচ্ছি না? একমাস ধরে মানুষ বই কিনছে, সেখানে দোষের কী থাকতে পারে আমার বোধগম্য নয়। ধরে নিই, এর মধ্যে তিন চতুর্থাংশ মানুষ বইগুলি পড়বেই না। তারপরেও বইগুলি আগুনে পুড়বে না, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে পয়সা দিয়ে কেনা বই দিয়ে কেউ ঠোঙাও বানাবে না। বইগুলি থাকবে, একসময় কেউ না কেউ পড়বে। পড়বেই। তাতে ক্ষতি কোথায় হচ্ছে? বইয়ের মান-টান এইসব বাদ রেখেও বলা চলে, পড়ার অভ্যাসে কিছু যোগ হচ্ছে। বইয়ের ভালোমন্দ বিষয় নিয়ে এইটুকু বলা যায় যে মানুষ সবসময় পুষ্টিকর খাদ্য খায় না, ফুচকা-চটপটিও খায়।

একমাস ধরে ২০-২৫ কোটি টাকার বই বিক্রি হলো। তাতে অর্থনীতির সচলতায় কিছুই কি এসে গেলো না? এই টাকায় কতোজনের শ্রমের মূল্য পরিশোধিত হলো, তা হিসেবে নেবো না?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

গৌতম এর ছবি

বোধহয় আমি আমার বক্তব্য ঠিকমতো উপস্থাপন করতে পারি নি। একমাস ধরে মানুষ বই কিনছে, তাতে দোষের কিছু নেই। অবশ্যই অর্থনীতির সচলতায় অনেক কিছু আসে-যায়। কিন্তু ফ্রিজ, আলু, কিংবা জামা-কাপড়ের তুলনায় পণ্য হিসেবে বই অন্য গুরুত্ব বহন করে।

মানুষ বই কেনে, এটা অবশ্যই আশার কথা। আমার বক্তব্যের সেন্স ছিলো অন্য জায়গায়। এই বই কেনাটা যেনো সারাবছর ধরে রাখা যায়, বই কেনার মানুষটিকে যেনো বই পড়ার মানুষে পরিণত করা যায়। সেই দিকগুলো আমরা অনেকেই চিন্তা করছি না। এই মানুষগুলোকেই আমি বইকেনা, বইপড়ায় নিয়মিত দেখতে চাই।

না হলে, বইমেলা যে আরেক বাণিজ্যমেলা হয়ে যায়!
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।