তারক শিশু

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: শনি, ১৬/০২/২০০৮ - ১২:১৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মুহাম্মদ (মুহাম্মদ২০১৭)
---------------------------------

মনে হচ্ছে, এক রাতের ঘুম শেষে সবে উঠেছে। কিন্তু বাউম্যান জানে, সে ক্রায়োসংরক্ষিত হয়ে ছিল দীর্ঘ পাঁচশ বছর। এও জানে, আজকের দিনটি হল ২৫৮৭ সালের ১৫ই মে। পাশে তাকিয়ে লকউডকে দেখতে পেল, ক্রায়োসংরক্ষণের মেয়াদ শেষ হয়েছে সেই টিউবেও। দু'জনারই চোখ পড়ল রক্ষণাগারের অন্য তিনটি ক্রায়োটিউবের উপর। এই তিনজনকে জাগিয়ে তোলার ভার তাদের ওপরেই, যখন প্রয়োজন পড়বে তখন। প্রধান নভোচারী লকউডই প্রথমে কথা বলল,
- নবজীবনে স্বাগতম, বাউম্যান।
- এটাকে ঠিক নবজীবন বলে মানতে পারছি না। নতুনত্ব আর কই, সবই সেই আগের মত।
- যাই বল, কাজ কিন্তু নব উদ্যোমেই শুরু করতে হবে। প্রথম কাজটার কথা মনে আছে তো?
- শুধু প্রথম কেন, সব কাজের কথাই মনে আছে। আগে তো একটু মানিয়ে নিতে হবে।

মানিয়ে নিতেই কেটে গেল একটি পার্থিব দিন। নভোচারীদেরকে পৃথিবীর মত জীবনাচারেই প্রশিক্ষিত করা হয়। এমনকি নভোযানে সময় নির্ধারণ করা হয় পার্থিব ঘড়ি দিয়েই। বাউম্যানের মনে হয় এটা ঠিক না। পৃথিবীর জীবনাচারে তার বিতৃষ্ণা এসে গেছে, নতুন কিছু দরকার। নতুনের সন্ধানে নিবেদিত এই অভিযান তাই তার এতোটা পছন্দ হয়েছিল। লকউড, বাউম্যান একসাথেই পর্যবেক্ষণ কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল। রক্ষণাগারের দরজার উল্টোদিকে একটা বৃত্তাকার চাকি যার মধ্যে রয়েছে চারটি দরজা। ঠিক উপরের দরজাটা দিয়ে পর্যবেক্ষণ কক্ষে যেতে হয়, অন্য তিনটি দিয়ে খেয়াঘর, রোবট নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ও তথ্যকেন্দ্রে যাওয়া যায়। পর্যবেক্ষণ শেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লকউড বলল,
- সব ঠিক মতই চলছে। পৃথিবী থেকে আমরা ৫০ আলোকবর্ষ দূরে আছি, নভোযানের বেগ সেকেন্ডে ৩০,০০০ কিলোমিটার, নবধরায় পৌঁছুতে আর ছয় মাস সময় লাগবে।
- দ্বিতীয় কাজ "নবধরা কমিটি"-র শেষ কথাগুলো শোনা; যান্ত্রিক গলায় বলল বাউম্যান।

পর্যবেক্ষণ কক্ষ থেকে তথ্যকেন্দ্রে চলে আসলো দু'জনে। উপাত্ত মডিউলের মনিটর অন করে মনোযোগ দিয়ে শুনতে বসে পড়লো। নবধরা কমিটির প্রধানের শেষ কথাগুলো শুরু হলো,
"নবজীবনে স্বাগতম তোমাদেরকে। "ব্রুনো ৫৮১" তারার জগতে পাঁচটি গ্রহের মধ্যে একটির নাম "নবধরা" যাকে মানব বসবাসের উপযোগী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই গ্রহের সন্ধানে যেতে তোমাদের সাহসী পদক্ষেপের জন্য প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জানাই। তোমরা সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করবে। ক্রায়োসংরক্ষিত তিন জনকে জাগিয়ে তুলবে। পাঁচজনের সরল পরিবারের মাধ্যমে নবধরায় মানব সভ্যতার পত্তন ঘটবে। এসবই তোমাদের জানা। তোমরা সফল হলেই নবধরা অভিমুখে পরবর্তী নভোযান প্রেরণ করা হবে। এর মধ্যে তোমরা জাগিয়ে তুলবে বিশেষ রক্ষণাগারে সংরক্ষিত এক'শ জনকে। একসাথে নয়, ধীরে ধীরে, সময়ের প্রয়োজনে। তোমাদের নবসভ্যতার খবর আমি জানতে পারব না। কিন্তু যারা জানতে পাবে তারাও মানুষ। জানতে পাবে মানবতা। একাত্ম মানবতা তোমাদের সেই সভ্যতার পানে চেয়ে আছে।"
আল্যসে ভর করে লকউড বলে উঠল,
- নতুন কিছুই তো বললেন না।
- "নতুন কিছু বলার কথাও নয়, যাত্রার পরে আসা তথ্যগুলো যাচাই করে উল্লেখযোগ্যতা অনুযায়ী পড়তে হবে। নতুন যা তা সেখানেই।" বলে এই মাত্র আসা বার্তাটি পড়তে শুরু করল বাউম্যান,
"এক অদৃশ্য শক্তি ব্রুনো ৫৮১ জগতের পথে তোমাদের বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারে। এক অদৃশ্য শক্তি নয়, বিজ্ঞানীরা বলছেন এটি আসলে ডার্ক এনার্জির প্রভাবের কারণেই হচ্ছে। এ থেকে মুক্তির কোন উপায় তোমাদের বলতে পারছি না। নিজ সিদ্ধান্তে চলো।"
সবচেয়ে নবীন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এটি। পৃথিবীর সাপেক্ষে এটি ৫০ বছর আগের খবর। এর মধ্যে নিশ্চয়ই মুক্তির উপায় বেরিয়ে গেছে। তা জানার সময় তাদের নেই। কি সিদ্ধান্ত নিতে হবে তা দু'জনেই জানে। দু'জনেই একটিমাত্র সিদ্ধান্তের কথা ভাবল।

চারটি মাস পেরিয়ে গেছে। অদৃশ্য শক্তির বিষয়টা তলিয়ে দেখার জন্য তিন বিজ্ঞানীকে জাগিয়ে তোলার বিকল্প ছিল না। রেবেকা, ওয়াইজউড বা সারা, কেউই নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারে নি। বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। খেয়াঘরে খেয়াযানগুলোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে করতে সেগুলো নিয়েই চিন্তা করছিল বাউম্যান। এমন সময়, অস্বাভাবিক মহাকর্ষীয় টান অনুভূত হল নভোযানের ভেতরে। তৎক্ষণাৎ নবজীবন থেকে বিদায় নিল চারজন। স্পেসস্যুট পড়ে থাকায় বেঁচে যেতে হলো বাউম্যানকে। কিন্তু সে জানে, অদৃশ্য শক্তির এ টান প্রতিহত করার মত যথেষ্ট নিরাপত্তা এই স্যুটে নেই। অচিরেই তাকেও বিদায় নিতে হবে, কার কাছ থেকে বিদায় নেবে তা অবশ্য জানা নেই। হয়তোবা আরেকটি জীবন শুরু হবে। বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক চিন্তায় আচ্ছন্ন সে। সেই সন্ধিক্ষণে আপাতদৃষ্টিতে আরও অপ্রাসঙ্গিক কিছু ঘটলো,

সে অতীত জীবনে ফিরে যাচ্ছে। স্থান-কাল সম্বন্ধে প্রাথমিক পাঠ তার আছে। স্থান-কালে এই অতিমানবিক ভ্রমণের শুরুতে সে ছোট্টবেলায় মহাকাশ দর্শনের মতই বিস্মিত হয়েছিল। কিন্তু, তার বিস্ময় এখন কেটে গেছে। কারণ বিস্ময় তো মানবিক, সে এখন যা করছে তা মোটেই মানবিক নয়।

এভাবেই বাউম্যান নিজের জীবন সংশ্লিষ্ট ঘটনার স্থান-কাল শঙ্কুতে প্রবেশ করল। স্থান-কালের বক্রতায় বেঁকে বেঁকে যাওয়া সেই ভ্রমণ তাকে অতীতের পথে নিয়ে চলল। এই ভ্রমণ তাকে সেখানে নিয়ে চলেছে যেখানে স্থান-কালের বিপরীতমুখী দুই শঙ্কু একে অপরের সাথে মিলিত হয়, যেখানে কেবল শূন্যতা, অসীম যেখানে অনুপস্থিত সেখানেই এই শূন্যতা। মানব সভ্যতার সর্বোৎকৃষ্ট অভিযানের শেষে পরবর্তী শঙ্কুতে নবজীবন শুরু করা তো দূরের কথা, দুই শঙ্কুর মিলনস্থলেও পৌঁছুতে পারে নি বাউম্যান। তার আগেই মহাকাল তাকে থামিয়ে দিয়েছে, কাল কিন্তু থামে নি। মহাকালের কেন জানি মা হতে ইচ্ছে হল, তাই বাউম্যানকে সে মাতৃগর্ভে থামিয়ে দিল। বাউম্যানের মনে নেই সে জীবনের কথা। কিছুই সে জানে না, অনেক কিছুই বিস্মৃত হয়ে গেছে, এই অভিযানের ভার তার পক্ষে আর বহন করা সম্ভব না, একটি ক্ষণের জন্যও নয়। মহাকাল কি তার কথা শুনলো? হয়তোবা। ছেলের কথা মা শুনবে না তো কে শুনবে।

মাতৃগর্ভে গিয়ে মা'কে খুঁজে পায়নি বাউম্যান। তাই স্থান-কালের এক বুদবুদ তার মা হল। কালের সাথে মিলে স্থান তাকে নিয়ে গেল ভিন্ন এক ছায়াপথে। লক্ষ কোটি তারার আলোকজ্জ্বল গালিচার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এই তারক শিশু। বোঝা গেল, নবমানবের মধ্যেও বিস্ময় রয়েছে আর ভ্রু না থাকলেও ভাস্বর হয়ে উঠেছে সে বিস্ময়। এবার আর বক্র নয়, স্থান-কালের সরল পথে মহাকালের টানে ভেসে চলল সে। নবমানবের প্রথম কুঁড়ি হয়ে জানান দিল মহাজাগতিক এক সভ্যতার বারতা।

--------------------------------
[স্ট্যানলি কুবরিক পরিচালিত "২০০১: আ স্পেস অডিসি" চলচ্চিত্রটি থেকে অনুপ্রাণিত।]

--------------------------------


মন্তব্য

রায়হান আবীর এর ছবি

বিশাল একটা উপন্যাস হতে পারত। আপাতত সারমর্ম মনে হচ্ছে। অনেক কিছুই বুঝিনাই। মুহাম্মদ নিশ্চই পরে বুঝায়া দিবে।

দ্রোহী এর ছবি

পড়ার আগেই জানতে চাইছি - তারক শিশু শব্দটির মানে কি? পড়ে মন্তব্য করবো। সচলায়তনের প্রথম অফিসিয়াল বিজ্ঞান কল্পকাহিনী হতে পারে এইটা। হাসি


কি মাঝি? ডরাইলা?

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

সচলায়তনের প্রথম অফিসিয়াল বিজ্ঞান কল্পকাহিনী হতে পারে এইটা।

অতিথি লেখক এর ছবি

"তারক শিশু"-কোন প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক শব্দ না। স্পেস অডিসিতে "স্টার চাইল্ড" ব্যবহার করা হয়েছিল। একটি শিশু অতীতে ফিরে যেতে শুরু করে, একসময় মাতৃগর্ভে ফিরে যায়। কিন্তু তার মা সেখানে ছিল না। তাই স্থান-কালের একটি বুদ্‌বুদ তার মা'র ভূমিকা নেয়। বুদ্‌বুদের ফিটাসের ভেতরে আবদ্ধ হয়ে সে ভাসতে থাকে। কাছ থেকে দেখে একটি তারার মত লাগতে পারে। তাই তারক শিশু।

----------
মুহাম্মদ

অতিথি লেখক এর ছবি

কয়েকটি শব্দ অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য লাগতে পারে:
খেয়াঘর - যে ঘর থেকে ছোট ছোট সন্ধানী যান নিয়ে নভোচারীরা মহাশূন্যে ঘুরতে বেরোন।
খেয়াযান - সন্ধানী যানের অপর নাম। আকারে ছোট। স্পেসওয়াক এবং মূল নভোযান মেরামতের কাজে ব্যবহৃত হয়।
স্থান-কাল শঙ্কু - প্রত্যেকটি ঘটনাকে স্থান-কালের চারমাত্রিক স্থানে প্লট করা যায়। সুবিধার জন্য স্থানের তিনটির বদলে দুইটি মাত্র ও কালের একটি মাত্রা নিয়ে প্লট করলে একটি শঙ্কুর (চোঙা) মত হয়। দুটি বিপরীত শঙ্কু একটিবিন্দুতে মিলিত হয়। এই বিন্দুটিকেই আমি শূন্য বলে আখ্যায়িত করেছি।
স্থান-কালে ভ্রমণ - স্থান-কালের শঙ্কুতে বক্রপথে ভ্রমণ করছিল বাউম্যান। কালে ভ্রমণের কারণে মাতৃগর্ভের সময়ে ফিরে গেল। আর স্থানে ভ্রমণের কারণে এক ছায়াপথ থেকে অন্য ছায়াপথে চলে গেল। তাই অন্য এক ছায়াপথে তারক শিশু হয়ে জীবন কাটাতে লাগল।

স্থান-কালে ভ্রমণের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সম্বন্ধে আমরা কেউ জানিনা। যে কোন কিছু হতে পারে। এখানে যেমন তারক শিশু হল। তারক শিশুর মাধ্যমে মানুষের একটি নতুন প্রজাতির জন্ম হয়েছে। স্থান-কালের বক্রে এই নবমানবের জন্ম।

------------------------
মুহাম্মদ

পরিবর্তনশীল এর ছবি

সুন্দর প্রচেষ্টা
---------------------------------
চোখের পাতায় হাত রেখে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখার যন্ত্রণা দেয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।