মেঘপরী জলপরী। এক

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৩/০২/২০০৮ - ১২:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(ক্যামেলিয়া আলম)

০১
ঝমঝমে বৃষ্টির দুপুরে - চারপাশে মোমের আলোর মতো রোদ - ধীরে ধীরে মালার সামনে দিয়ে কতগুলো অচেনা অজানা শব্দে চলে গেলো- মা।

মালা তখন বিনুপিসীর কোলে। সকাল থেকে মায়ের কাছে যাবার জন্য অনেক কেঁদে চোখ ফুলিয়ে যখন বুঝল যে মা আর উঠবেই না ও পিঁড়িটা থেকে তখন কেমন একটা ক্লান্ত লাগা শুরু হলো মালার। আজ সকালে ঘুম ভেঙেই দেখে খাটে কত লোক। কিন্তু কাউকেই চেনা নেই - ঘুম ভাঙতেই সবার চোখগুলো যেন গিলে খাচ্ছে মালাকে। সবে গলা ফাটাতে যাবে - ঠিক এমনি সময়ে বিনুপিসী লাল চোখ নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এসে ঝপাৎ করে কোলে নিয়ে নিল। বিনুপিসীর কোলে উঠে জানলার চৌকাঠ ডিঙিয়ে উঠোনটায় চোখ গেলো। কাঠের একটা দোলনা - দোলনা? কেন? কার জন্য? আমার?

সাতপাঁচ ভেবে বিনুপিসীর কানের কাছে মুখ নিয়ে জানতে চাইল - ও দোলনাটা কার?
বিনুপিসী কাঁদছে?

মালা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। আর সাথে সাথেই একটা শব্দে - যদিও মালা এ শব্দটা আগে কোনোদিন শোনেনি। তবুও কেন যেন মনে হলো, এ শব্দের সাথে ভয় মেশানো আছে। সেই অদ্ভুত একটা সুরে কতগুলো কতগুলো লোক একটা সাদা মোড়ানো কী যেন ঐ কাঠের দোলনায় রাখল। মালা বিনুপিসীকে আঁকড়ে কাঁধে মাথা গুঁজে আড়চোখে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ ই মনে হলো, আরে মা কই?

আবারও বিনুপিসীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল - মা কই? মায়ের কাছে যাব। বিনুপিসীর চোখ উপচানো পানি - জড়ানো গলায় বলল - চলো আগে খেয়ে নাও। তারপরে বলব।
মাথা নাড়িয়ে হাত পা ছোঁড়ে মালা - শক্ত হাতে গলা চেপে ধরে বলে - খাবো না - আগে মা -
বলব তো - আগে খেতে হবে - চলো।

এরপরেই শুরু হলো মালার গলা ফাটানো কান্না। মার কাছে যাব ... মার কাছে যাব.....। ওর কান্নাটা দমকা বাতাস হয়ে ছড়িয়ে গেলো চারিপার্শ্বে। পুরো বাড়িতে তখন কান্না ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

কান্না আর জেদের বিড়ম্বনায় একটা সময়ে মায়ের কাছে নিয়ে গেলো বিনুপিসী। বাবা ঐ তো দূরে বসা। এক মনে ধ্যানস্থ। চারপাশে শব্দজঞ্জাল ছেড়ে দূরে কোথাও আছে। ঐ ওটুকু বয়সেও টের পেল মালা। আর মা - আশ্চর্য ঐ দোলনাতে শোয়ানো। অজানা অচেনা মা। কী সুন্দর নীল। কেমন ঘুমিয়ে আছে। মায়ের বুকে ঝাঁপ দিয়ে শোবার - ঐ বুকের মাদক গন্ধ নেবার জন্য উতলা হয়ে গেলো মালা। কিন্তু বিনুপিসীর শক্ত দুটো নিষ্ঠুর হাত মালাকে জাপটে ধরে রাখল। তীব্র আকাক্সক্ষা রোধের যে একটা শরীরী কষ্টও আছে জীবনে ঐ প্রথম টের পেল মালা। মায়ের মুখটা ঢেকে দিলো। মালাকে সরিয়ে নিয়ে আসা হলো।

এরপর ঐ তো চলে যাওয়া মায়ের। মা আমার নীলপরী হয়ে ঐ আকাশেই ভেসে চলে গেলো। আমার নীলপরী মা।

২.

মা মারা যাবার পর বিনুপিসীর ভার পড়ল মালাকে দেখাশোনা করবার। মালার একরত্তি কষ্টও রইল না। বিনুপিসী মুখ ধোওয়ায় - বিনুপিসী ভাত খাওয়ায় - বিনুপিসী গল্প শোনায় - বিনুপিসী ঘুম পাড়ায়। সবটাতেই বিনুপিসী নিখুঁত। এমনকি বাবাও আগের চেয়ে ঢের ঢের জিনিস কিনে দেয়। কখনও লাল মাটির পুতুল - কখনও মাথা ঝোলানো বুড়ো দাদু - বাতাস হলেও যার মাথা একটু একটু করে নড়ে। আর মাটির কলস চুলা পাতিল হাড়িতো ভুরিভুরি। কখনও কখনও বিনুপিসী মাটি দিয়ে কী সুন্দর আদল গড়ে দিয়ে চুলায় পুড়ে শক্ত করে মালার হাতে তুলে দেয়। বিনুপিসী যখন বসে রাঁধে - মালাও বসে যায় তার পাশে। বিনুপিসীর পাশ থেকে খড়ি ভেঙে ছোট ছোট টুকরো করে ঐ ছোট্ট মাটির চুলোটায় গুঁজে দেয়। একবার একটা জ্বলন্ত কয়লা বিনুপিসী তুলে চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। আর চুলাটার পাশ থেকে কী সুন্দর ধোঁয়া উঠল। চারপাশে কত আনন্দের উপকরণ - স্বাধীনতা - আদর - ভালোবাসা। কিন্তু এরপরেও মালা সারাদিন কাটায় খচখচে একটা কষ্ট নিয়ে। যে কষ্ট সারা সময়ে লেপটে থাকে গায়ে আর যদি কষ্টটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে যায় মালা তবে আস্তে আস্তে অবশ হয়ে আসতে থাকে শরীর। ক্লান্ত লাগে - হতাশ লাগে। কাঁদতেও পারে না মালা। এ কেমন কষ্ট আমার! ওই ওটুকু বয়সেও ভাবতে থাকে মেয়েটা।
সারাটাক্ষণ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ায়। বাবা - বিনুপিসী - বাড়িতে আরও যারা আছে সবার চোখে পড়ে ওর আন্মনা ভাবটা। কোনো কিছুতেই কিছু করতে পারে না। শেষমেষ ঠিক করল স্কুলে দেবে মালাকে। এদিকে বিনুপিসীর আবার বিয়ে ঠিক হয়েছে....


মন্তব্য

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

চলতে থাকবে?

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।