গভীর সংঘর্ষের সন্ধানে - ৪

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: মঙ্গল, ২৬/০২/২০০৮ - ৯:১৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গ্রিনহাউজ ক্রিয়া
লি আর কাম্প ও মাইকেল এ আর্থার পরিমাপ করে দেখেছেন, বর্তমানে পৃথিবীর সবগুলো আগ্নেয়গিরি থেকে মোট যে পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস উৎক্ষিপ্ত হয় তার তুলনায় বিলুপ্তি সীমানার যুগে সমুদ্রতল থেকে উৎক্ষিপ্ত হাইড্রোজেন সালফাইডের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০০০ গুণ বেশি। এই বিশাল পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস তখনকার সব উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে হাইড্রোজেন সালফাইডের বিষাক্ততা বৃদ্ধি পায়। তাই ভৌগলিক উষ্ণায়নের স্বল্প সময়ের মধ্যে এই বিষাক্ততা অনেক বারই বেড়ে গিয়েছিল, যার কারণে এ সময়ে অনেকবার জীবকূল বিলুপ্তির শিকার হয়। আর এই ছোটখাট বিলুপ্তির সময়েই সম্ভবত সুপ্রাচীন অগ্ন্যুৎপাতগুলো শুরু হয়েছিল।

এরকম কয়েকটি গণ বিলুপ্তির সময়কার অগ্ন্যুৎপাতের কারণে ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্রতলের কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা লাভায় ঢেকে গিয়েছিল। এসব লাভার একটি উল্লেখযোগ্য অপজাত ছিল বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস যা লাভা স্তর থেকে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করেছিল। এ কারণেই ভৌগলিক উষ্ণায়ন ত্বরান্বিত হয়। পার্মিয়ান ও ট্রায়াসিক যুগের শেষ ভাগ, জুরাসিক যুগের প্রথম ভাগ, ক্রিটাশিয়াস যুগের মধ্য ভাগ ও প্যালিওসিন যুগের শেষ ভাগে বায়ুমণ্ডলে বিরাজমান কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ নির্ণয় করা গেছে। অন্য কিছু যুগের মত এই যুগগুলোতেও বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। এবং এই বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে গণ বিলুপ্তি শুরু হওয়ার ঠিক আগে। পুরো বিলুপ্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর আরও প্রায় হাজার, লক্ষ বছর কার্বন ডাই অক্সাইডের এই পরিমাণ অক্ষুন্ন ছিল।

এ সময় সবচেয়ে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল সমুদ্রগুলো। উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রতল বায়ুমণ্ডল থেকে অক্সিজেন শোষণ করতে পারছিল না। দেখা যাচ্ছে, একদিকে অগ্ন্যুৎপাতের কারণে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল আর কমে গিয়েছিল অক্সিজেনের পরিমাণ। যাও অক্সিজেন অবশিষ্ট ছিল তাও ভৌগলিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রজলে দ্রবীভুত হতে পারছিল না। অক্সিজেন স্বল্পতার বিপরীতে, গভীর সমুদ্রে সালফার ব্যাক্টেরিয়ার মত অণুজীবের মাধ্যমে সৃষ্ট হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছিল। ফলশ্রুতিতে এক সময় সেই অণুজীবগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠে এসেও বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে। অপরদিকে অক্সিজেনের উপর নির্ভরশীল জীবকূল ক্রমশ ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছিল। পুরো সমুদ্রই অক্সিজেনশূন্য হয়ে উঠে। এভাবে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস একসময় ভূভাগের সব জীব ধ্বংস করে ফেলে। এই প্রতিকূল পরিবেশে কোন জীবের পক্ষেই বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না।

কাম্পের প্রকল্প জল ও স্থলভাগের জীবকূলের বিলুপ্তির মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপনে সমর্থ হয়। পর্মিয়ান যুগের শেষ ভাগে কার্বন ডাই অক্সাউড বেড়ে যাওয়ার কারণে কিভাবে উভয় অঞ্চলের জীবই ধ্বংসের মুখোমুখী হয় তাও ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় এই প্রকল্পের মাধ্যমে। তাছাড়া পার্মিয়ান সীমানার সময়ে সালফার ব্যাক্টেরিয়ার মত অণুজীবের আধিক্যের কারণও এ থেকে বোঝা যায়। গণ বিলুপ্তির পর এই বিষাক্ত বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশ ঠিক হতে অনেক সময় লাগার কথা, এবং আসলেই যথেষ্ট সময় লেগেছিল।

অবশেষে দেখা যায়, কেবল পার্মিয়ান যুগের শেষ ভাগের জন্যই এই প্রকল্প সত্য নয়, আরও বেশ কিছু ছোটখাট বিলুপ্তি ঘটনায় এর অবদান রয়েছে। যেমন, ৫৪ মিলিয়ন বছর আগে প্যালিওসিন যুগের শেষ দিকে স্বল্প পরিসরে যে গণ বিলুপ্তি ঘটনা ঘটেছিল তা এই প্রকল্পের মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ সেই বিলুপ্তির আগে স্বল্প পরিসরে ভৌগলিক উষ্ণায়নের সৃষ্টি হয় এবং তার কারণে সমুদ্রগুলো অক্সিজেনহীন হয়ে পড়ে। জৈব নির্দেশক অন্বেষা এবং ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে দেখা যায়, ট্রায়াসিকের শেষ ভাগ, ক্রিটাশিয়াসের মধ্যভাগ এবং ডেভোনিয়ান যুগের শেষ ভাগেও এ ধরণের প্রতিকূল গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। এ থেকে এখন বোঝা যাচ্ছে, চূড়ান্ত বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার এ প্রক্রিয়া বারংবার ঘটতে পারে।

সবচেয়ে জটিল ও ভীতিকর প্রশ্নটি হচ্ছে: আমাদের প্রজাতি তথা মানুষের কি এ ধরণের বিরূপ পরিবেশকে এখন ভয় করা উচিত? একবার নয় বারবার যা ঘটেছে আবার কি তা ঘটতে পারে না? পরিবেশ থেকে কি পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড সে সময় বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করেছিল তার সঠিক পরিমাণ আমরা জানিনা, তথাপি কি হারে সে সময় জীবকূল বিলুপ্ত হয়েছিল তার আমাদের জানা আছে।প্যালিওসিন যুগের তথাকথিত তাপীয় বিলুপ্তি শুরু হয়েছিল, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রতি মিলিয়নে ১,০০০ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর। ট্রায়াসিক যুগের শেষে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ছিল প্রতি মিলিয়নে ১,০০০ ভাগের সামান্য বেশি। বর্তমানে বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রতি মিলিয়নে ৩৮৫ ভাগ যা বেশ নিরাপদ বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু ভয়ের কথা হল, প্রতি বছর এই পরিমাণ প্রতি মিলিয়নে ২ ভাগ করে বেড়ে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে ৩ ভাগ করেও বাড়া শুরু করতে পারে। সে হিসেবে আগামী শতাব্দীর শেষ দিকে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ গিয়ে দাড়াবে প্রতি মিলিয়নে ৯০০ ভাগ যার কারণে বেশ সহজেই সমুদ্রজলে অক্সিজেনস্বল্পতার সৃষ্টি হতে পারে। সেই অক্সিজেনহীনতার যুগ শুরু হওয়ার পর কতদিন লাগবে আরেকটি পরিপূর্ণ গ্রিনহাউজ বিলুপ্তি শুরু হতে? এটি এমন একটি প্রশ্ন যা কখনই আমাদের বের করার চেষ্টা করা উচিত হবে না। বরং এই মুহূর্ত থেকে আমাদের উচিত কার্বন ডাই অক্সাইড নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা।

চলবে..........
---------------------------------
মূল প্রবন্ধঃ ইমপ্যাক্ট ফ্রম দ্য ডিপ, পিটার ডি ওয়ার্ড
---------------------------------
পূর্ববর্তী কিস্তিসমূহ
* গভীর সংঘর্ষের সন্ধানে
* গভীর সংঘর্ষের সন্ধানে - ২
* গভীর সংঘর্ষের সন্ধানে - ৩
---------------------------------
সূত্রঃ সাইন্টিফিক অ্যামেরিকান, অক্টোবর ২০০৬
---------------------------------

মুহাম্মদ


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

চলুক। ভালো লাগছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।