প্রেমিক কবি ও দার্শনিক

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/০৩/২০০৮ - ১২:৩৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রেমিক

২২শে শ্রাবণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ দিবসে একসাথে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেল। কবিগুরুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই যখন বাড়ী ফিরছিল তখন হঠাত্ বিনানোটিশে ঝুম্ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আশ্রয়ের জন্য যে যেদিকে পারল ছুটে গেল। ইমরান জীবনে কবিগুরুর একটা কবিতাই পড়েছে, তাও এস.এস.সি তে পাঠ্য ছিল বলে, “ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা/ ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ/ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা“। তাই বৃষ্টির দিনে কোন রবীন্দ্র উৎসবে যোগদানে বিন্দুমাত্র উৎসাহী না হয়ে আধমরার মতোই নিজের বিছানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকাটাই তার কাছে বেশী যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হচ্ছিল। সেইসময় সত্যি সত্যি তাকে কয়েক ঘা খেতে হলো। দরজায় ঘা শুনে দরজা খুলে বন্ধু জাফরকে কাকভেজা অবস্থায় দেখে এক ঘা, দরজা খুলতে দেরী হওয়ার অপরাধে জাফরের তরফ থেকে দ্বিতীয় ঘা, জাফরের পেছনে বৃষ্টিস্নাত কিশোরীটিকে দেখে তৃতীয় ঘা আর মেয়েটির নাম শুনে চতুর্থ ঘা। চঞ্চরী- এমন নামও হয় নাকি মানুষের? কি সুন্দর!

এইফাঁকে ঠিক সুযোগমতো কিউপিড একখানা তীর ছুড়ে মারলেন, আফ্র্র্রো দিত কুটুস করে চোখ টিপে দিলেন আর সেন্ট ভ্যালেন্টাইন মুচকি হাসলেন।

কবি

জাফর একজন কবি। তবে কবিতা লিখে কবি নয় কবিতা পড়ে কবি। কবিতা লিখলে তাকে কবি বলা হলে যে সত্যিকারভাবে কবিতা পড়ে তাকেও কবি বলতে হবে এ কথাটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও জাফর অনেকটা গোয়ারের মতই নিজেকে কবি বলে দাবী করে। তবে জাফর কবিতা পড়ে, সত্যিকারভাবেই পড়ে এবং পছন্দ হলে সেটা মুখস্থও করে ফেলে। জাফরের একটা অদ্ভূত গুনের কারনে তাকে সবাই কবি বলে মেনে নিয়েছে। জাফর যেকোন পরিস্থিতি যে কোন দৃশ্যের বর্ণনা দিতে পারে কবিতা দিয়ে। নিজের কবিতা নয়, সত্যিকার কবিদের কবিতা দিয়ে।
গতমাসে সে তার ইংলিশ মিডিয়াম এ পড়া আহলাদী ছাত্রীটিকে চড় মারার কারনে মূল্যবান প্রাইভেট টিউশনিটা হারায় সেইসাথে বোনাস হিসেবে ছাত্রীমাতা কিছু কটু কথা শোনাতে গেলে জাফর ভরাট গলায় ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা‘ কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিল। বাদশা আলমগীরের পুত্রের শিক্ষকের মতো করে বলেছিল,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে কোন্ ছার
একবার বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়ে মুরগীর রোষ্ট হাতে নিয়ে সুকান্তের ‘একটি মোরগের কাহিনী‘ কবিতা ছলছল চোখে আবৃত্তি করেছিল। আরেকরার ছাত্রলীগের সমাবেশে, “আমরা শক্তি আমরা বল, আমরা ছাত্রদল“ বলায় ধাওয়া খেয়েছিল।
প্রেমে পড়ার পর ইমরান যে সর্বপ্রথম জাফরের কাছেই আসবে এ ব্যপারে আর সন্দেহ কি!

দার্শনিক

নামের কারনে উদাসের স্বভাবটা এমন নাকি স্বভাবের কারনে নামটা এমন সেটা বলা মুশকিল। তবে উদাস যে স্বভাবে খানিকটা উদাস সে ব্যপারে কোন সন্দেহ নেই। উদাস একটু ভাবুক প্রকৃতির। ছোট্ট একটা ব্যপার নিয়ে ভাবতে শুরু করে জগৎ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একেবারে গভীরে চলে যায়। হয়তো নিজে দর্শনের ছাত্র হওয়াতেই তার এ সমস্যা হয়েছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে উদাস নিজের এই সমস্যাটা নিয়েই ভাবছিলো। ভাবনার যথেষ্ট কারন অবশ্য আছে। গতরাতেই বেশ গুরুতর ঘটনা ঘটে গেছে। কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে সামনে অপরিচিত একজন মানুষকে দেখে খুব বিনয়ী গলায় বলেছিলো, কাকে চান? লোকটির বিস্ময়াভিভূত চেহারার সামনে দাড়িয়ে একটু একটু করে লোকটির চেহারা চেনা মনে থাকে এবং প্রায় মিনিটখানেক পর সে বুঝতে পারে লোকটি তার জন্মদাতা পিতা। ক্ষেপে গিয়ে তার বাবা মাকে বলছিলো, “তোমার ছেলেকে ভাল একটা সাইক্রিয়াটিষ্ট দেখাও“। সেটা শোনার পর থেকে উদাস একটু চিন্তায় পড়েছিলো এবং মনে মনে ভাবছিলো, আমি কি পাগল? ভোরবেলাতেই পাশের বাড়ীতে কে যেন ব্যন্ডের গান শুনছে। গায়ক অনেক কষ্ট করে কষ্ট কষ্ট বলে গান গাইছিলো। ব্যন্ডের গায়কদের মনে কেন যে এত কষ্ট থাকে কে জানে! তবে সকাল সকাল উদাসের মনটা বোধহয় বেশ আর্দ্র ছিলো না হলে কষ্ট কষ্ট চিৎকার শুনে তার চোখে হঠাৎ পানি এসে যাবে কেন? তার হঠাৎ মনে হতে লাগল তারও অনেক কষ্ট যদিও অনেক ভেবে কষ্টের কারনটা কি সেটা মনে পড়ছিলো না। এমন সময় বাবা বারান্দায় এসে তাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। হবারই কথা! একটু পর শোনা গেল তিনি মাকে বলছেন,
“ আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো! ছেলে যখন নিজের বাপকে চিনতে পারেনা তখনই বুঝতে হবে তার বিয়ের বয়স হয়েছে। আল্লা মালুম কোন মেয়ের কাছে হাফসোল খেয়েছে আর এখন ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদছে“। কথাটা ডাহা মিথ্যে! উদাস হাফসোল ফুলসোল কোনটাই খায়নি। একজন মানুষ কেন কাঁদে? অধিকাংশ সময়েই বোধহয় “আমি কাঁদছি“ এটা দেখানোর জন্য কাঁদে। চারিদিকে এক অজস্র কান্না অথচ সত্যিকারের কান্না নেই কেন একটাও? সুখী মানুষের যেমন জামা থাকেনা সত্যিকারের কান্নাতেও কি কোন জল থাকে না?
জাফরের ডাকে উদাসের ভাবনা বন্ধ হলো। জাফর মনে হয় ইমরান আর চঞ্চরীকে বাঁধনে জড়াতে চাইছে। কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? ভালোবাসা বলে কি আসলেই কিছু আছে?

কবি ও দার্শনিক

: ঘটনাটা কি হলো?
: তেমন কিছূনা। ইমরান চঞ্চরীকে যে বইটা গিফট দিতে যাচ্ছে সেটার প্রথম পাতায় একটা কবিতা লিখে দিলাম। আমার লিখা প্রথম কবিতা! এখন নিশ্চই আমি নিজেকে সত্যিকারের কবি বলে দাবী করতে পারব। পড়ে দেখ কবিতাটা আমার ডায়েরীতে লিখা আছে।

আকাশ তুমি কি জানো,
মিতালী করেছে আমার সনে,
তোমারই মতো এক সুন্দর।
মায়াবী চাঁদনী রাতে
কেতকীর মতো আমারই প্রতিক্ষায় থাকে সে।
ভালোলাগে বলেই তাকে ভালোবাসি, হয়তো একদিন
লোহিত অধর দুটি কাঁপিয়ে
বাস্তব আর কল্পনাকে একাকার করে
সিক্ত করে আঁখি দুটো বলবে সেও, ভালোবাসি।

: খুব একটা উঁচু মানের কিছু বলে মনে হচ্ছে না!
: আমার লিখা প্রথম কবিতা! একটু কাঁচা হতেই পারে। তবে ওটা একটা এক্রস্টিক কবিতা।
: এক্রস্টিক কবিতা আবার কি জিনিস?
: কবিতার প্রতি লাইনের প্রথম বর্ণটা নিয়ে পড়ে দেখ্। একটা ম্যাসেজ্ পাবি।
: এটা কেন করলি? ইমরান জানে?
: নাহ্! ওকে এক্রসটিক্ কবিতার ব্যপারটা বলিনি। তবে চঞ্চরী ব্যপারটা ধরে ফেলতে পারবে মনে হয়। ও তো আর ইমরানের মতো গাধা না। কবিগুরুর চ্যালা!
: কাজটা কি ঠিক হলো? ভালোবাসা বলে কিছু আছে নাকি?
: আজকের আবওহাওয়াটা দেখেছিস্? একটু পরেই ঝুম্ বৃষ্টি নামবে। ইমরান যাবে চঞ্চরীর সাথে দেখা করতে।
এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরিষায়!
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপহীন ঘন তমসায়।

: সক্রেটিস সবসময় কি বলতো জানিস না? know thyself! ইমরান তো নিজেই জানেনা সে চঞ্চরীকে ভালোবাসে কিনা।

: আমার সামনে সক্রেটিস কপ্চাবিনা। তাহলে আমি শেক্সপিয়ারকে টান দিব।
Ah, dear Juliet
Why art thou yet so fair? Shall I believe
That unsubstantial death is amorous
and let the lean abhorred monster keeps
There here in dark to be his paramount?

: ভালবাসার অনুপ্রেরণা আসে সৌন্দর্য থেকে। মানুষ সবসময় তার চেয়ে উচ্চতর ও উৎকৃষ্ট জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই আকর্ষন থেকে তৈরী হয় একরকম বেদনা আর এই বেদনা থেকে আবার সৃষ্টি হয় সেই জিনিসটিকে পাবার ইচ্ছা। একথা আমি বলিনি, প্লেটো বলেছে। চঞ্চরী নয় তার সৌন্দর্যই হয়তো ইমরানকে কাছে টানছে।
: জীবনানন্দ দাশ কি বলেছে জানিস ....
: ফ্রয়েডের মতে ....

কবি ও দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার, প্লেটো, জীবাননন্দ দাস, ফ্রয়েড সবাইকে অস্ত্র বানিয়ে তর্ক করতে থাকুক। আমরা বরং প্রেমিকের কাছে যাই।

উপসংহার

ইমরানের কাছ থেকে বইটা নিয়ে চঞ্চরী খুব মন দিয়ে কবিতাটা পড়ল। তার অনেকণ পর মাথা তুলে একচোখ জল নিয়ে প্রায় অনুচ্চারিত শব্দে বলল,
: আমিও
: আমিও মানে? আমিও কি?
: নাহ্! কিছু না!

ওদিকে কবি আর দার্শনিক তখনও তর্ক করে চলেছে। কবি বলছে, ভালোবাসা আছে আর দার্শনিক বলছে নেই। আর যে দুজন এইমাত্র ভালোবাসা কি সেটা না জেনেই পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলল তারা একে অন্যের দিকে অপলক তাকিয়ে ছুটে চলল অজানা এক গন্তব্যে ।

[এই গল্পে ব্যবহৃত কবিতাটির রচয়িতা আমার বন্ধু দীপ্তেন্দু। সে কোন এক ঘনঘোর বরষার দিনে এই কবিতার মাধ্যমে তার পছন্দের মানুষটিকে তার মনের কথা জানিয়ে সফল হয়েছিলো। সে আমাকে অনুমতি দিয়েছিলো আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসার জন্য এ কবিতা ব্যবহারের। আমি ব্যবহার করে কিন্তু সফল হতে পারিনি। হয়তো তখন সময়টা বর্ষা না হয়ে শীতকাল ছিলো বলে! পাঠক, দেখবেন নাকি আপনিও একবার চেষ্টা করে?]

........................................... উদাস
পূর্বের লেখা:
ঘটকালি
আপ-ডাউন ফ্রেশ ডেয়ারী ফার্ম


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগলো। বেশ রোমান্টিক্!

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুন লাগলো! খোফ ফাইন।
----------------পাখি বালক

------------------------------     সুবচন নির্বাসনে এর ছবি

ভালো লেগেছে।
এক্রসটিক্ আইডিয়াটা ভালো।রোমান্টিকতার আবহে স্মার্টলি কাউকে বাঁশ মারা যাবে।

উদাস,আপনি শীতকাল বাদ দিয়ে অন্য সময়ে একটা ট্রাই নিয়ে দেখতে পারতেন।এই কবিতা দিয়ে সফলতার সম্ভবনা অনেক বেশী হওয়ার কথা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।