ঘোলা কাঁচের প্রতিবিম্ব (দ্বিতীয় খন্ড)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২৫/০৩/২০০৮ - ১১:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তিন. বরফগলা প্রহর

অপেক্ষার প্রহর নাকি সহজে কাটতে চায় না, অনেকবার শুনেছি, অনেকবার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা বাকি সবদিনের থেকে আলাদা। বোর্ড মিটিং ছিল একটা, সব সেকশন চীফদের নিয়ে। মনে হচ্ছিল যেন মাথাটা ছিড়ে পড়ে যাবে! একজন তো এতই বকবক শুরু করেছিল যে মনে হচ্ছিল যেন হয় ওঁর মাথা দেয়ালে ঠুকে দেই না হয় নিজের মাথা! ঝাড়া পঞ্চাশ মিনিটের মত বকবক করে তবে থামলেন তিনি এবং ইতিমধ্যেই একই বিষয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েক লক্ষ বার বলা হয়ে গেছে তার! অবশ্য তার কথা যে খুব একটা মন দিয়ে শুনেছি তাও দাবী করব না। মনটা পড়ে ছিল অন্য জায়গায়। এষার কাছে! আজ লাঞ্চের পর এষাকে নিয়ে বসতে হবে ভাবতেই কেমন যেন এক মিশ্র অনুভূতি হল। ভালও যেমন লাগছিল, একই সাথে কিছুটা নার্ভাসও যে লাগছিল না তা অস্বীকার করব না। মিটিংয়ে তখন মার্কেটিংয়ের এক সেকশন চীফ অহেতুক বকবক করে চলেছে ইফেক্টিভ টিম বিল্ডিং এর উপরে, আর আমি তখন চলে গেছি কয়েক সপ্তা পেছনে। ভাবতে শুরু করে দিয়েছি এষার সাথে প্রথম পরিচয়ের দিনটা।

একটা প্রজেক্টের টেন্ডার জমা দেবার শেষদিন। আমার দম ফেলারও সময় ছিল না। মাসে এরকম কিছু কিছু দিন আসে যখন খাওয়া, আড্ডা বা খোশগল্প পর্যন্ত করার ইচ্ছা থাকে না। তেমনি একটা দিন চলছিল। শেষ মুহুর্তের কিছু অসমাপ্ত কাজ নিয়ে ছুটোছুটি করছিলাম। তখন দেখা আমার ওর সাথে। হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজার (ফারহানা আপু) ওকে নিয়ে সব ফ্লোরে ঘুরে ঘুরে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন সবার সাথে। আমাদের অফিসে এই প্রথাটা আছে। পরে যদিও অফিস মিটিংয়ে সবার সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন সহকর্মীদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, তারপরও প্রথম দিনেও এভাবে পরিচয় করানো হয় যাতে করে জড়তাটা সহজে কেটে যায়। ফারহানা আপু তখন এষাকে নিয়ে আমাদের ফ্লোরেই আসছিলেন। আমি তখন সিড়িতে। ফারহানা আপুর ডাকে না হলেও নিশ্চিতভাবেই হয়ত আমি থমকে দাঁড়াতাম।

-- শাফায়েত, ব্যস্ত নাকি? এসো পরিচয় করিয়ে দেই। এ হল এষা। প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টে আজ নতুন জয়েন করেছে। আর এষা, এ হল শাফায়েত, আমাদের খুব অ্যাক্টিভ একজন এমপ্লয়ী। সেলসে আছে। প্রজেক্টের সুবাদে দু'জনকে একসাথে তো কাজ করতে হবেই। জানাশোনা হয়ে যাবে ধীরে ধীরে।

এষা তখন মিষ্টি করে গালে টোল ফেলা একটা হাসি দিল। কেন যেন ওই হাসিটাই ভেতরে সতর্কবানী জারি করে দিল, সাবধান!

-- হাই, নাইস টু মিট ইউ।

হাতটা বাড়িয়ে দিল সে। কিছুটা অবাকও হয়েছিলাম। বাহ বেশ তো! আধুনিক মেয়ে বটে! তখন ভালভাবে চেহারাটা একটু দেখলাম। বেশ লম্বা, একহারা গড়ন। কুচকুচে কালো চুল, পিঠ গড়িয়ে অনেকখানি নেমে এসেছে। বেশ ফর্সা, তবে ফ্যাকাসে নয়, কেমন গোলাপী একটা আভা আছে। আর ঠোটের নিচে ছোট্ট একটা তিল। কিছু সময়ের জন্য যেন সবকিছু ভুলে গেলাম। মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে আছি ওর সাথে। চারপাশে যেন অদৃশ্য এক দেয়াল উঠে গেছে, বাধা দিচ্ছে সব শব্দ আর মানুষের আনাগোনা। আচমকা যেন বাস্তবে ফিরে এলাম। হুঁশ হল যে প্রয়োজনের তুলনায় কয়েক সেকেন্ড যেন বেশিই হাতটা ধরে ছিলাম ওর। আমিও হাসিটা ফিরিয়ে দিলাম।

-- লাইকওয়াইজ। ওয়েলকাম টু আওয়ার অফিস। যে কোন প্রয়োজন বোধ করলে নিঃসন্কোচে যোগাযোগ করবেন।

পরে কথা হবে, এমন আশ্বাস দিয়ে তখনকার মত বিদায় নিলাম বটে, কিন্তু মাথার ভেতর থেকে ওকে বিদায় করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না।

যাই হোক, বোর্ড মিটিং শেষে দুপুরটাও বেশ অলসভাবেই কেটে গেল। অন্যান্য দিনের মত আড্ডাতে খুব একটা মন বসাতে পারলাম না। শাহীন ভাই, জাহেদ ভাইরা বারবার জিজ্ঞেস করছিল এত উদাসীন কেন! আমি যথারীতি নিরুত্তর। তারপর একটা হাসি দিলাম যার অর্থ অনেকরকমই হতে পারে, এখন যে যেভাবে বোঝে আর কি। তারপর সবাই যখন কবিরকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল, তখন চুপচাপ জায়গা ছেড়ে উঠে এলাম।

এষা এল আরো প্রায় ঘন্টাখানেক পর। পরনে হালকা নীল রঙের একটা কামিজ, মাঝে সাদা ছোপ ছোপ, বেশ মানিয়েছে ওকে। কনফারেন্স রুমে প্রজেক্টের পুরো টিম নিয়ে বসলাম। ব্রীফিং আর পরবর্তীতে করনীয় কিছু কাজ নিয়ে আলোচনা করতে করতেই ঘন্টাখানেক সময় চলে গেল।

শেষ বিকালে ভাগ্যটা নিতান্তই ভাল মনে হল। না হলে কি আর এমন মেঘ না চাইতেই জল! মাথাটা কেমন যেন ধরে ছিল, আগের রাতের দুঃস্বপ্ন আর অনিদ্রার ফল। বিকালের চা-বিরতিতে উপরের ক্যান্টিনে গিয়ে বসেছিলাম চায়ের কাপ নিয়ে, হাতে আজকের পত্রিকাটা। আজকাল পত্রিকার পাতায় দুনিয়ার যত মন খারাপ করা আর কিছু মেজাজ খারাপ করা খবর থাকে। আমার এসব ভাল লাগে না। তাই খেলার পাতায় কিছুক্ষণ চোখ বুলাই, আর বাকিটা শুধু পাতা উল্টানো। হঠাৎ করেই একটা কৌতুকে চোখ পড়ল। বেশ মজার, পড়ে একটু হেসেই ফেললাম জোরে। এমন সময় এষার আওয়াজ পেয়ে বেশ চমকেই উঠলাম।

-- কি, বসতে পারি?

-- ওহ, প্লীজ!

সাথে সাথে চিন্তা করে নিলাম আমার উত্তরে আবার একটু বেশি হ্যাংলামি প্রকাশ পেল না তো! কিন্তু সেদিকে ওর তেমন কোন নজর আছে বলে মনে হল না।

-- কি পড়ছেন? খুব মজার কিছু? হাসছেন যে!

-- এই আর কি একটা কৌতুক পড়ে হাসলাম।

-- দেখি দেখি!

বেশ আগ্রহ নিয়েই হাত থেকে পত্রিকাটা নিল ও। তবে পড়ে খুব একটা যে মজা পেল তা মনে হল না ওর চেহারা দেখে।

-- আচ্ছা, আপনারা এই ছেলেরা, কেন যে এইসব সস্তা স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কিত জোকস পড়ে মজা পান বুঝি না! এই যে কৌতুকটা পড়ে আপনি হাসছেন, এটাতে যে স্ত্রীকে কতটা ছোট করা হয়েছে, আপনি কি বুঝতে পারছেন না? পারছেন, আর বুঝতে পেরেও হাসছেন! আমি কিন্তু এটার সাথে খুব একটা একমত হতে পারলাম না।

-- দেখুন এটা তো একটা সিম্পল জোক! আর বুঝতে পেরেছি জন্যেই তো হাসছি, না হলে তো আর জোকটা মজা লাগত না!

বহু অর্থপূর্ণ সেই হাসিটা দিলাম আবার।

-- না না, আপনি যাই বলুন না কেন, এরকম সব হাসি ঠাট্টা দিয়ে সব কিছু কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যায় না।

এরপর প্রায় মিনিট পাঁচেক টানা বলে গেল ও বিষয়টা নিয়ে। আমি প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলাম। যদিও কোন কথাই কানে ঢুকেছে কিনা সন্দেহ আছে। তারপর ও নিজেই যেন একটু লজ্জায় পড়ে গেল পাছে বেশি বক্তৃতা দিয়ে ফেলল কিনা।

-- আসলে এভাবে বলতে চাইনি। কিন্তু আজকাল চারপাশে এই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে লোকজনের উদাসীনতা আর অবহেলা খুবই কষ্টদায়ক! এমনটা কিন্তু মোটেও হওয়া উচিত নয়, এটা তো মানবেন!

-- দেখুন, আপনার কথা পুরোপুরি ঠিক আছে। কিন্তু যা হওয়ার নয়, তা হচ্ছে। যা ঘটার নয়, তা হরহামেশাই ঘটছে। কেন, এটার জবাব যদি জানতে চান, হয়ত দিতে পারব না। তবে এটুকু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সুযোগ পেলেই চোখ বুজে চুপচাপ পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যাওয়াটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে!

-- যাক, অন্তত আপনি যে বিষয়টাকে এভাবে সহজভাবে স্বীকার করে নিবেন, তা ভাবিনি। ভাল লাগল। আপনি জানেন, খুব শখ করে বেশ কিছু বন্ধু মিলে একটা বুক ক্লাব খুলেছিলাম। কথা ছিল, প্রতি দুই সপ্তায় একটা বই পড়ে শেষ করতে হবে। অথচ শেষ পর্যন্ত এর এতই করুন পরিণতি যে এখন আমি আর দুইজন বন্ধু ছাড়া সবাই বাদ দিয়ে দিয়েছে!

-- কি আর করবেন বলুন। আজকাল লোকজন ম্যাগাজিন পড়ার সময় বের করতে পারে, টিভিতে নিতান্তই অখাদ্য অনুষ্ঠান দেখে সময় পার করতে পারে, কিন্তু একটা বই পড়তে দেন, দেখবেন বেশির ভাগই একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে গেছে।

-- ঠিকই বলেছেন। আচ্ছা, আপনি আসেন না আমাদের বুক ক্লাবে! এই সপ্তায় আমরা শরৎচন্দ্রের দত্তা শুরু করছি। আপনি পড়েছেন বইটা? আমার বাকি দুই বন্ধুও বেশ খুশিই হবে দেখবেন। নবনী আর তারেক। দুজনেই বইয়ের পোকা। দেশি বিদেশি অনেক বই পড়ে। তাই শেষ পর্যন্ত ওরাই আছে এখনো, বাকিরা সেই কবেই সটকে পড়েছে!

এদিক ওদিক চিন্তা না করেই কথা দিলাম ওর বুক ক্লাবে যোগ দিব। কিন্তু ঘুনাক্ষরেও যদি জানতাম নবনীকে নিয়ে কি অপেক্ষা করছে ওখানে আমার জন্য তাহলে হয়ত চরম দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতাম না যোগ দেয়ার!

(চলবে)

অতন্দ্র প্রহরী


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।