অন্যরকম একদিন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৬/০৪/২০০৮ - ৬:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ক্যামেলিয়া আলম

সাম্য এপাশ ওপাশ করে উঠলো। তাঁকালো চারপাশে। এখনও অন্ধকার চারপাশে। অন্ধকারের আলোতে সাম্য দেখলো নিজের হাতগুলো। শ্যামলা হাতও ধবধবে মনে হচ্ছে নিজের কাছে। অনেকক্ষণ তাঁকিয়ে থেকে চোখ দু'টো সরিয়ে নিল। এই অদ্ভুত ধবধবে হাতটা যেন অন্য কারও_ লোমহীন_ফ্যাকাসে।

মৈত্রী হাঁটতে লাগলো। এক নিস্তব্ধ অস্থিরতা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ওকে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিল বাতাসে। নাহ আজ আর কোন মেডিটেশন _ কোন অসহায় মুখ _ কোন প্রকৃতি ওকে শান্ত থাকতে দিচ্ছেনা। এক হিংস্র সর্পিল ফোঁসফোসে আওয়াজ টের পেল নিজের ভেতর। এই মানুষটি মৈত্রীর বড় অচেনা। এই অজানা স্বত্ত্বাকে দিনের পর দিন লালন করতে হচ্ছে মৈত্রীর। অসহায় লাগলো ভেতরের দানবটির কাছে। যেভাবেই হোক এ খুনকে আটকাতে হবে। মৈত্রী বাজি ধরলো অন্য এক মৈত্রীর কাছে। দেখি না কে জেতে?

একটি শান্ত সুন্দর বাস স্টেশন। স্টেশন কখনই শান্ত থাকেনা। তবু এখন শান্ত । কারণএখন কাক ডাকা ভোর। ঠিক এই ভোরে এসে থামলো একটি মেয়ে। স্থির _ অপলক চোখ বাসের অপেক্ষায়। সাম্য তখন বেশ দূরে হাঁটছে। জনমানবহীন স্টেশনে প্রেতের মত মনে হল মেয়েটিকে। ক্লান্ত আর ব্যর্থ জীবনের প্রশ্বাস বয়ে হাঁটতে শুরু করল সাম্য। একটু দূরে এসে দাঁড়াল। আর তার পরপরই একেক প্রান্ত থেকে একেক জনমানব নিস্তব্ধতাকে ভেঙে আসতে শুরু করল। মৈত্রী তেমনই নিশ্চল দাঁড়ানো। সাম্য নিজের মাঝে অনেকগুলো প্রশ্নের অস্তিত্ত্ব টের পেল। নিঃশব্দে আবারও হাঁটা শুরু করল। উচ্ছসিত ভঙ্গীতে এক বাস এসে দাঁড়াল। মৈত্রী হাঁটতে শুরু করল। সাম্যও পিছু নিল। বাসের কাছে গিয়ে থমকাল মৈত্রী। টিকিট তো নেয়া হয়নি। উৎসুক চোখ খুঁজলো কাউন্টার। সাম্য এগিয়ে গেল টিকিট কাউন্টারে। দু'টো টিকিট কাটলো। কেন কাঁটলো সাম্য জানে না। সবসময়ের মতই ওর ভাগ্য এ কাজটি করাল। সারাজীবন একে এড়িয়ে যেতে পারেনি সাম্য। মৈত্রী তখনও পেছনে। এক শান্ত _স্নিগ্ধ চিন্তা নিয়ে হেলে দুলে হাঁটছে। এমন বিষন্ন পৃথিবীতেও এত নিঃসঙ্কোচে কেউ বাঁচে? আশ্চর্য!
আর এক পা হাঁটলে কাউন্টার। মৈত্রী এগুচ্ছে। সাম্য অজানা এক গাঁদা প্রশ্নের উত্তর ভেতরে ভেতরে তৈরি করে ঘামছে আপাদমস্তক। এক তীব্র শ্বাস নিয়ে ভাগ্য সাম্যর হাতটা বাড়াল। মৈত্রী তাঁকাল। দেখল টিকিটটা। নিল। প্রশ্নহীন। সাম্য মৈত্রী হাঁটতে শুরু করল বাসের দিকে।

মৈত্রীর পিছু পিছু বাসে উঠে বসলো সাম্য। সিট খুঁজে মৈত্রী এগুচ্ছে। সিটের কাছে গিয়ে বসলো জানালার ধারটায়। সাম্য ইতস্তত ভঙ্গীতে বসল। কেন কোন প্রশ্ন নেই _তারও হাজার রকম প্রশ্ন ভীড় করল সাম্যের মাথায়। হালকা রোদ উঠেছে। একে একে এক জাগরণী দিনে পরিণত হচ্ছে চারপাশ। হকারদের ভাঙা স্বরে ডাকা_ ঘুমভাঙা অচেনা পরিবেশে কোন এক শিশুর ডুকরে ওঠা_ অনেকগুলো যানবাহনের মিলিত কর্কশ শব্দ _সবই যেন কেমন মায়াজাল সৃষ্টি করে চলেছে চারপাশে। পাশে বসা প্রেতিণীকে নিয়ে ঠিক একথাটিই মনে হল সাম্যের।
ভোঁতা শব্দের গুঞ্জন কমছে মৈত্রীর। এক অবশ শরীর _ অবসন্ন মাথা কি যেন চাচ্ছে_ তা জানেনা মৈত্রী। না জেনেই দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশত বলল

চা পাওয়া যাবে?
এই চা - এই - এদিকে - দুধ না রঙ?
দুধ চা -
দুই কাপ

প্লাস্টিকের দু'টো কাপ ধরা হাত এগিয়ে এল। মৈত্রীর হাত ব্যাগের ভেতরে - টাকা গুণে বের করে দিল। এক অদ্ভুত ধ্বনি নিয়ে চলতে শুরু করল বাস।

সাম্য মৈত্রী -দু'জন অচেনা স্বজন পাশাপাশি চলছে। বাসের হালকা দুলুনীতে চা ছলকে ছলকে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে যাচ্ছে। ধ্যানস্থ দু'জন যেন পৃথিবীর অপর প্রান্ত দিয়ে ছুটে যাচ্ছে।

একের পর এক বন্ধ মার্কেটের কপাট পেরিয়ে বাস খালি এক জায়গায় পৌছে নিশ্চল হয়ে রইল। সাম্যর মাথা বামদিকে বেঁকে গেল। এক বড় জ্যাম আটকে দিয়েছে ছুটন্ত এ বাসটিকে।
জ্যাম সামনে ।

মৈত্রী শুনল। ফিরলো জানলার দিকে। সাম্য ডুবে রইল আপন চিন্তাভূমিতে।
হৃদয় ঘুমাচ্ছে?
মাহিব ভাই কম্পিউটার ওপেন করছে নিশ্চয়ই?
পিনাক যে কবে দিবে জিনিষদু'টা Ñ
আর কতক্ষণ?
মাথার ভেতরের শব্দের মধ্য থেকে বাইরের এ শব্দের কাছে পৌছাতে কিছু সময় লাগলো সাম্যর।
আর কতক্ষণ জ্যাম থাকবে?
সাম্যর মাথা পুনরায় বামদিকে ঝুঁকলো । অল্প অল্প করে দূরে সরে যাচ্ছে দূরের গাড়িটি ।
উত্তর দেবার আগেই চলা শুরু করল বাস। আবার নিস্তব্ধতা দু'জনের মাঝে। এবার শহর ছেড়ে বাসটি এগিয়ে যাচ্ছে নদীর ধার ধরে। সারি সারি নৌকা - আর স্টিমার দাঁড়ানো - যেন কোন ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে । নদীর ঠান্ডা বাতাসের সাথে নদীর এক উত্তাল গন্ধ ভেসে এল সাম্য আর মৈত্রীর নাকে। এ গন্ধ মনে করিয়ে দিল মৈত্রীকে অনেক পুরনো দিনের স্মৃতি _ যে স্মৃতিতে আছে নিঃশঙ্ক হাসি _ কোলাহল _স্বপ্ন। আর সাম্যের নাকে গন্ধটি তাকে চেনা পথে বহুবার চলার পথকে শুধু মনে করাল। সাম্য প্রাণভরে নিল বাতাস । এ বাতাসটুকু নিয়ে আবারও কিছুদিন পথ চলতে হবে ওর। মৈত্রী নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে বের করার সময় বের করে দিল সমস্ত অতীতের স্মৃতিগুলো। বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল সেই সময় । মৈত্রী বিভোর হয়ে ইথারে ভাসা জীবনগুলোকে দেখতে লাগল।

একটা স্টপেজে গাড়ি থামলো। মৈত্রী উঠে দাঁড়াল। সম্মোহিতের মত সাম্যও পিছু পিছু নামলো। অচেনা পথে মৈত্রী পা রাখলো _ সাম্য নামলো তার চেনা পথে। চেনা মুখ ঘুরলো ডানদিকে _ মৈত্রীর সামনে গেল। দু'জনেই দু'দিকে তাকাল। সাম্য মৈত্রীর পাশে হাঁটতে লাগল খানিকটা এগিয়ে। সামনের ছাপড়ার হোটেলটায় গিয়ে খোলা বেঞ্চিতে বসল। চেনা দু'টো চোখ দেখল সাম্যকে। এক মিনিটেই খাবারের থালা সামনে চলে এল। সাম্য তাকাতেই দেখল মৈত্রীর খোলা দৃষ্টি। এই প্রথম দু'জন দু'জনকে দেখতে পেল। এতটা সময় মৈত্রী ছিল ছায়াশরীরের পাশে আর সাম্য ছিল এক অবয়বের সামনে।

শারীরিক আর মানসিক উপস্থিতি নিয়ে দু'জন এবারে মুখোমুখি বসা। দু'জনেই খাচ্ছে।
এই জায়গাটি আপনার চেনা?
হুম্
কতদিনের?
জানি না
কতবার এসেছেন এখানে?
কি জানি? আপনি এসেছেন কখনও?
নাহ-
আবারও নিঃশব্দে দু'জনের আঙুল নড়তে থাকে । সেই সাথে শেষ হতে থাকে থালার নির্জীব খাবারগুলো । টুকটাক দু'টো একটা শব্দ চলতে থাকে চারপাশে।
একসময় বেরিয়ে আসে দু'জন।

কোথায় যাবেন এখন?
হাঁটি -

দু'জনে হাঁটতে থাকে। কতগুলো স্কুলড্রেস পরা গ্রামের মেয়ে প্রান্তের পর প্রান্ত হেঁটে চলছে।

কি হবে ওদের পড়ে? প্রতিযোগিতায় আর কতদূর যেতে পারবে?
যতটুকু ওদের স্বপ্ন --

আবারও নিঃশব্দ চলা। বাতাস গরম হয়ে উঠছে।

চলুন ঐগাছটার ধারে বসি -

দু'জনে বসল। সামনে ধুলার প্রান্তর -- আর দূরে রাস্তা-- বাস কিছু সময় পর পরই চোখের সামনে দিয়ে উড়ে উড়ে চলছে। দু'জনের বিষাদ আর ক্লান্তি একটু থমকালো। জাপটে ধরা মনটা যেন ছাড়তে শুরু করল সমস্ত পার্থিব ভাবনাগুলো। কিচির মিচির করে দু'টো একটা শালিক আশপাশে বসতে লাগল। কোত্থেকে উড়ে এল একটা প্রজাপতি - চকচকে নতুন পাখা নিয়ে ভাসতে ভাসতে কোথায় হারিয়ে গেল। মৈত্রীর চোখ পুনরায় ইথারের দিকে-- আর সাম্য তার চিন্তাগুলোর ছন্দ মেলাতে লাগলো আন্মনে।
সাম্য উঠে দাঁড়াল।

একটু হাঁটলে একটা নদী আর গ্রাম --

দু'জনের হাঁটা শুরু। তপ্ত বালুতে -- শীতল মন নিয়ে দু'জনে চলতে লাগল। একেকটি খন্ড খন্ড গল্প ভাবনায় দু'জনেই সাজাতে লাগল তাদের ভাবনা।

ঠিক এই রকমই কি জীবনটা?
নাহ
আপনি বেশি হতাশাবাদী
উহু -- বাস্তবতাবাদী--

আবারও দু'জনের নিঃশব্দে পথ চলা। দু'জন একজন করে গ্রামীণ কিশোরী, নারী হাসতে হাসতে গল্প করতে করতে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। মাথায় ঝাকা নিয়ে একদল লোক তরকারী বয়ে নিয়ে প্রায় দৌড়াচ্ছে। কোথাও বেদনার চিহ্ন মাত্র নেই। সকলেই প্রাণবন্ত -- উচ্ছল-- গতিময়।

এত সরল আর সহজ কি জীবন?
নাহ -- অনিশ্চিত-- নিরাপত্তাহীন -

কথাগুলো খেলা করতে লাগল মৈত্রীর মাথায়। কিন্তু কোন চেতনায় ধারণ করতে পারল না।
অন্তত আপনার জন্য -
থমকে তাকাল মৈত্রী। সাম্যের চোখে গভীরভাবে তাঁকাল।
নিরাপত্তার চোখ কি আপনি চেনেন?
হু -
ভাল -
শুনুন - আমি বসতে চাই - দীর্ঘ সময় বসতে চাই - আমার শরীর আর মাথা আমায় আর হাঁটতে দিচ্ছে না--
আরেকটু শাসন করুন - সামনেই আজকের দিনের গন্তব্য _

আবারও হাঁটতে লাগল দু'জনে। একটা সময় সুতার মতন এক চিকন নদী দৃষ্টিতে পড়লো। দু'জনেই নিজের অজান্তে চলার গতি বাড়াল। একটা সময় দু'জনেই দৌড়াতে শুরু করল। কেউ বলেনি কাউকে _ কেন প্রতিযোগিতা তাও জানে না _ শুধু জানে এখন ছুটতে হবে দু'জনের _ অনেক ছুটতে হবে । পাশ দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে সেই সময়ের দৃশ্যগুলো _ শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস কেটে কেটে যেতে থাকল কানের পাশ দিয়ে। একটা সময় দু'জনেই হাঁপাতে লাগল থেমে। ঘামের বিন্দু ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের সব খানে _ আর মুখে তীব্র হাসি। কোন কারণ নেই হাসার তবু হাসছে দু'জনে।
পাশে নদী আর চোখের সামনে নীলাকাশ রেখে শুয়ে পড়লো সাম্য। মৈত্রী ভ্রু কোচকাল।

চোখে লাগে না রোদ?
সাম্য জোড়ে হেসে উঠলো।
অপারগতার প্রশান্তিই এখানে _
বুঝলাম না _
শুতে পারছেন নাতো -- তাই রোদকে চোখের শত্রু বানাচ্ছেন _
কে বললে শুতে পারছি না _ এখানে কে আমায় চেনে? আমি যা খুশি করতে পারি _
পারলে ঐ বিশাল উন্মুক্ত পৃথিবীকে এই প্রান্তরে দেখার লোভ সামান্য রোদের দোহাই দিয়ে ঢাকতেন না _
মৈত্রী ধপ করে বসল।

সত্যিই শুবেন?
মৈত্রী এবার গলা ছেড়ে হাসলো।

ভয় পাচ্ছেন?
নাহ _ শুয়ে পড়ুন _
আমার বসেই বেশ লাগছে _
সাম্য হাসল পুনরায়। মৈত্রী কপট রাগ দেখাল

হাসলেন? শুনুন - মেয়েদের অনুভূতি অনেক বেশি _ পুরুষদের যা উপলব্ধি আর চেতনা দিয়ে বুঝতে হয় _ নারীদের আপনাতেই তা হয়ে যায় _ কাজেই আপনার মতন না শুয়েও আমি আপনার চাইতে বেশি অবগাহন করতে পারছি_
এ আপনাদের রপ্ত করে নেয়া কথা _আপনাদের কম দিয়ে বোঝানো হয় এই কমেই তোমরা ওদের সমান _আপনারাও বোকার মতন বিশ্বাস করে ভেবে সুখী হয়ে যান
সুখী হওয়াটাই তো বড় বিষয় _ বেশি বুঝে দুঃখ পেয়ে লাভ কি বলুন?
না চাইলেও এক দীর্ঘশ্বাস শেষের কথাগুলোয় হানা দেয়।
মানছি _
আবারও নিঃশব্দ। দু'জনের দুই চিন্তা মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকে। দূরে নদীর হালকা স্রোত শান্ত হয়ে বসে আছে যেন।
সমুদ্র হলে বেশ মানাত এখানটায় _
তার পাশে পাহাড় _
সমুদ্রের পাশে কখনও পাহাড় মানায়? কি যে বোকার মতন কথা বলেন আপনি?
সাম্য হাসতে থাকে।
এমনি ই বললাম _ পাহাড় আমার অনেক ভাল লাগে _
আমার সমুদ্র _
পাহাড়গুলো দেখে মনে হয় কতগুলো শরীর মিশে ওর এই স্তম্ভ _
সমুদ্র দেখে মনে হয় _ কতজনের কানাকানি সে বয়ে নিয়ে চলছে
আমি নাক পেতে সেই সব প্রাণীর গন্ধ নেই আর কান পেতে শুনি তাদের কলরব
আমি কান পেতে শুনি সেই চুপিচুপি বলা আনন্দ _ উচ্ছাস _ আর বেদনার ধ্বনি _
আবার দু'জন থমকে যায়। সাম্য হাসতে থাকে একসময়।

হাসছেন কেন?
আমরা কেউই কবি নই _ কিন্তু কবির ভাষায় কথা বলছি মনে করে হাসি পাচ্ছে _
আপনি কেমন করে জানেন আমি কবি নই Ñ
সাম্য হাসে।

আমি জানি _
আর কি জানেন?
আর কিছু জানি না _
মৈত্রী উঠে হাঁটতে শুরু করে। সাম্য তেমনই শোয়া। নীল আকাশে চোখ রেখে কত কথা বলে যাচ্ছে এক মনে। আর মৈত্রী পা ডুবিয়ে দিয়েছে তখন জলে। ঠান্ডা পানিগুলো শুষে নিচ্ছে পায়ের তলার যন্ত্রণা। হাত স্পর্শ করল এবার জল। ঠান্ডা _ নিঃসঙ্গ _ জীবন্ত । পানির ঝাপটা এসে ছিটকে মুখে লাগল। গড়িয়ে মুখের যন্ত্রণাগুলো নিয়ে আবার পানিতে পড়লো সেই জলফোটা। পাগলের মত পানির ঝাপটা আসতে লাগল চোখে_মুখে_ ফোঁটা গুলো ঝরতে লাগল এক রাশ বেদনা গলিয়ে নিয়ে। এক আশ্চর্য প্রশান্তিতে মন ভরে গেল।
সাম্যর দিকে ফিরল। চিৎকার করে ডাকল।
আসুন না এখানে _
সাম্য তাঁকাল।
আসুন _শুনে যান _
সাম্য উঠে বসতে দু'সেকেন্ড ভাবল। তারপর ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মৈত্রীর কাছাকাছি পৌছে গেল।

এখন ছেলেমানুষের মত পানি দিয়ে মাতামাতি করবেন?

মৈত্রী একরাশ পানি নিয়ে সাম্যর মুখে ছুড়ে মারল।
আপনি বড় পুরুষবাদী _ একেবারে জীবনানন্দ_
জ্বী _
মানুষ ভদ্রতা করেও কোন কাজ করে _
আমার এখন ভদ্রতা করে আপনাকে পানি ছিটাতে হবে?
ফিরে যান তো আপনি _ ওখানেই গিয়ে শুয়ে পড়ুন _

সাম্য হেসে পানির উপর দিয়ে হেঁটে সামনে এগুতে থাকে।
পিছন ফিরে জানতে চায়।

সাঁতার জানেন?
নাহ _আপনি?

সাম্য শরীর ডুবিয়ে চলতে থাকে পানির মধ্য দিয়ে। একটু সময় পরে ফিরে এসে বলে
আপনার ওড়নাটা বাঁধুন শরীরে_
এবারে হাত ধরুন_ পা আর মাথা তুলে ধরুন আকাশের দিকে_
মৈত্রী ধুপ করে করতে গেলে খানিকটা ডুবে যেতে থাকলেই সাম্য শক্ত হাতে মেরুদন্ড ধরে রাখে।
এবার ভাসতে চেষ্টা করুন_ আমি আছি _ তবে এ জায়গায় ডুবলেও তা ঠেকবে আপনার কোমর পর্যন্ত_ শরীর টেনে তুলতে পারবেন আশা করি _ নিশ্চিন্তে আমাকে ভরসা করুন _

কিছু সময়ের মধ্যেই পানিতে ভাসার এক নতুন আবিষ্কারে মৈত্রীর মন বিস্মিত হয়ে যায়। পুরো পৃথিবীর সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণ যেন এখন একা ওরই হাতে। উচ্ছল হাসি আর সময়ের মাধুর্যে মৈত্রী খেলা করতে থাকে পানির সাথে।
সূর্য তখন নীলিমা গুটিয়ে সবে গনগনে হচ্ছে। একটা সময় মৈত্রী আবিষ্কার করে নিজের অতীত আর বর্তমানকে। পিছু হটাতে চাইলেও অতীতের তীব্র আক্রমন ঝলসে উঠে হৃদয়ে। এক ঝটকায় নিজেকে তুলে নেয় পানি থেকে। ঘটনার আকস্মিকতার মাঝে কিছু সময় বিরতি নেয় সাম্য। মৈত্রীকে ছেড়ে নিজেকে ভাসিয়ে দেয় জলে। আকাশের সাথে কথা বলে বলে ভাসিয়ে রাখে নিজেকে। ততক্ষনে মৈত্রী সামলে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনে মন। তবু মনতো _চাইলেও ছন্নছাড়ার যাত্রা থেকে বিরতি পায়না।

ভেজা শরীরে দু'জন বসে আছে। চুপ করে।
চলুন খেয়ে আসি _
ভাল লাগছে না _ বসি আরেকটু সময় _
আবারও চুপ।
এ জায়গার নাম কি?
সাম্য নদীর দিকে তাঁকানো।
শুনেছেন?
জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর জানতে নেই _
আবারও চুপ। একেক সময়ে একেক চিন্তা খেলা করতে থাকে দু'জনার মনে _ ছড়িয়ে পড়ে তা শরীরে_ সেই ছায়ালোকে মুখ হয় কখনও উদ্ভাসিত _ কখনও বেদনায় নীল।
চলুন উঠি _
সাম্য উঠে দাড়ায়। দু'জনে হাঁটতে থাকে। বাজারের এক খাবার দোকানে যায়।

এ মাছ কি ঐ নদীর?
কি জানি?
আপনি এত কম জানেন কেন সব কিছু?
সুখী হবার জন্য _
দু'জনেই হেসে ফেলে।
খাওয়া শেষ হলে বেরিয়ে আবারও হাঁটতে থাকে। নদীর ধারে এসে বসে। এবার মৈত্রী শুয়ে পড়ে ধুপ করে।
একটা গান ধরেনতো _
সাম্য হাসে। কিছু না বলে দূর প্রান্তে চোখ রাখে।
চোখ বন্ধ করে মৈত্রী গাইতে থাকে
মোর বীনা উঠে কোন সুরে বাজি _ কোন নব ছন্দে _
পুরো গানটা নিস্তব্ধতার মাঝে গেয়ে শেষ করে। মৈত্রীর দু'চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে অঝোরে। কিছু সময় পরে সাম্য পাশে গিয়ে বসে।
আর কাঁদে না _
মৈত্রীর হু হু কান্না আরও বাড়ে। সাম্য নিঃসঙ্কোচে হাত ধরে স্বান্ত্বনার _ আশ্বাসের উপস্থিতি নিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

পৃথিবীর সমস্ত দুঃখই ম্লান হয় _ বেদনা গ্লানি মানুষের শরীরের মনের অপার সৌন্দর্য্য _ এজন্যই আপনি এতটা সুন্দর_ এই পৃথিবীরই মতন

কান্নার সকরুণ শব্দ তবু প্রকৃতি ভেদ করে চলতে থাকে। এক সময় ফিকে হয়ে আসে মৈত্রীর কান্না। সেই সাথে ফিকে হয়ে আসে সূর্য। দু'জনে অপলক নদীর দিকে তাঁকানো।

মৈত্রী আরও একটা গান ধরে। ভেজা গলায়। সেই গানের ছন্দ ধরেই সূর্যের শেষ নীলিমা ঢাকা পড়তে থাকে।
এমন খোলা প্রান্তরে অন্ধকার নামে ঝপ করে _ চলুন ফিরি _
প্রস্তাবটা দু'জনকেই ব্যথিত করে । সিদ্ধান্তটা তবু নিতে হয়।

ফেরার পথটা সত্যিই কষ্টের _

দু'জনে চলতে থাকে নির্বিকার। একের হাত অন্যের হাত ছুঁয়ে। নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় স্টেশনে। জোড়ালো শব্দের এক বাস এসে দাঁড়ায় সামনে। নিশ্চুপ দু'জন তাতে চেপে বসে।
পূর্ণিমার অন্ধকার দেখতে থাকে দু'জনার চোখ নিঃশব্দে। শুধু দু'জনের হাতের স্পর্শ পরম মমতায় জড়িয়ে থাকে যেন।
অন্ধকারকে আমি বড় ভয় পাই _ আপনি?
ভালবাসি _
কেন?
নিজের মুখ লুকাতে পারি _আর অন্যের কঠিন অবয়ব দেখতে হয়না বলে _
মানুষকে এত ভয় আপনার?
ভয় তো মানুষকেই পেতে হয় _ নির্জীব অন্ধকার তো আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না _
বাস এসে থামে। যেন হঠাত করেই দু'জনার হৃৎপিন্ড এসে ধাক্কা খায়। ধীর পায়ে নেমে দু'জনে মুখোমুখি দাঁড়ায়।
ইতস্তত ভঙ্গীতে মৈত্রী বলে।

আমরা আসলে কেউ কারও নাম _
থাক _ জানতে হবে না _
বাঁচালেন _ তবে আমি জানি _
সাম্য প্রশ্নাতুর চোখে তাঁকায়। মৈত্রী বুকের মাঝখানটায় হাত রাখে সাম্যর।
এখানে আমার একটা নাম আছে _ তাই না?
হ্যা _
কি?
প্রেতিণী _
মৈত্রী ফিক করে হেসে ফেলে। ফেরার জন্য পা বাড়ায়। সাম্যর অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে_

আমার নাম?
নক্ষত্র _ ক্ষণিক সময়ের _ কিন্তু উজ্জ্বল
মৈত্রী কপালের টিপ খুলে বলে
আপনার বন্ধ মোবাইলটা দিন _
সাম্য বের করে। মৈত্রী টিপটা মোবাইলে সেঁটে দেয়।
আমার উপহার_
বলে হাত বাড়ায়। সাম্য হাতটা ধরে গুটিয়ে দেয়।
আপনাদের অনুভূতি আমাদের উপলব্ধির সমান _ কথাটা আমি মানি _ আপনি আমায় ভুলবেন না
আসি_
আসি_।।


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দুর্দান্ত একটা লেখা লিখলি অনেক দিন পরে
একেবারে পাক্কা একটা গল্প। হাড্ডিগুড্ডি ভেঙে গিয়ে ভেতরে কোথায় ঘাই মারে

মনে হয় হয়তো এরকম কোথাও কোনো এককালে আমিও গিয়েছিলাম কিন্তু মনে নেই কোথায়....

অতিথি লেখক এর ছবি

কি অসাধারন কল্পনা!!
-নিরিবিলি

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

কাল রাতে হাবিজাবি ঝামেলার মধ্যেই একবার চোখ বুলিয়েছিলাম।
তখন ভাল করে বুঝিনি।
এখন আবার পড়লাম।
দারুণ লাগলো !

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

দুই হাতে লিখে যান।

---------------------------------------------------------
আমাকে ডাকে আকাশ, বোঝে মাটি হাওয়া জল
বোঝে না মানুষ আর বিনাশী মুদ্রার ছল

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।